নিউ কার্থেজের পতন (২০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
দুই সিপিওর মৃত্যু ও রোমান বাহিনীর পরাজয়ের পরেও স্পেন জয় করতে সিনেট বদ্ধপরিকর ছিল। কারণ স্পেন থেকেই মূলত কার্থেজ তার সম্পদ ও লোকবল যোগান দিচ্ছিল। স্পেনের রোমান অধিনায়ক নিরোর মধ্যে আগ্রাসী মানসিকতার অভাবে সিনেট তিক্ত হয়ে ওঠে। তারা চাইছিল এমন কাউকে যে দুই সিপিও ভাইয়ের মতো আক্রমণাত্মক হবে।
২১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। বিশেষ আইনে নির্বাচিত নতুন রোমান কমান্ডার এম্পোরিয়ামে এসে পৌঁছলেন ১০,০০০ পদাতিক ও ১,০০০ অশ্বারোহী সেনা নিয়ে। এই যুবকের নাম পাব্লিয়াস আফ্রিকানাস সিপিও। ২১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিহত পাব্লিয়াস সিপিওর সন্তান ও গেনিয়াস সিপিওর ভ্রাতুষ্পুত্র। তার মধ্য দিয়েই রোম পেয়েছিল দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে তাদের শ্রেষ্ঠ জেনারেল, যিনি হ্যানিবালের সাথে সমানে সমানে পাল্লা দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।
অন্যান্য রোমান জেনারেলদের সাথে সিপিওর পার্থক্য ছিল এই যে, তিনি তার প্রতিপক্ষের রণকৌশল ও শক্তির জায়গা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতেন। সম্ভবত হ্যানিবালের সমর কৌশল তিনি হ্যানিবালের থেকেও ভাল করে বুঝতে পেরেছিলেন। সিপিও যখন স্পেনে এসে নামলেন তখন সেখানকার তিন কার্থেজিনিয়ান সেনানায়ক ম্যাগো, হাসড্রুবাল গিসগো ও হাসড্রুবাল বার্কার মধ্যে চলছিল রেষারেষি। ফলশ্রুতিতে সবাই আলাদা আলাদা ভাবে বিদ্রোহী স্প্যানিশ গোত্রের সাথে লড়াইতে লিপ্ত ছিলেন।
সিপিও তাদের কাউকে আক্রমণ করলেন না। তিনি রোমান ইব্রোর উত্তরে রোমান ঘাঁটি রক্ষার জন্য কিছু সেনা রেখে বাকিদের নিয়ে নদী পাড়ি দিলেন। এরপর ঝটিকা মার্চ করে সাত দিনে নিউ কার্থেজের উপকণ্ঠে এসে পড়লেন। শহর প্রতিরক্ষার জন্য ছিল মাত্র ১,০০০ সেনা। আর সিপিওর সাথে ২৫,০০০ পদাতিক আর ২,৫০০ ঘোড়সওয়ার। তবে প্রাকৃতিকভাবে নিউ কার্থেজ সুরক্ষিত। এর অবস্থান উপদ্বীপের পাঁচটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী এলাকাতে। উত্তরদিকে এক প্রাকৃতিক ল্যাগুন একে আলাদা করে রেখেছে, যা আবার উপসাগরের সাথে একটি কৃত্রিম খাল দ্বারা সংযুক্ত। উপদ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে যাবার রাস্তাও সংকীর্ণ তাই বড় কোনো সেনাবাহিনী সেদিক দিয়ে একবারে আসতে পারবে না।
সাগরপথে শহরের পেছনে রোমান জাহাজ পাহারা দিচ্ছিল। এর মধ্যে সিপিওর সেনারা মই দিয়ে নগর প্রাচীর বেয়ে উঠতে চেষ্টা করে। উচ্চতার কারণে তাদের অসুবিধা হচ্ছিল। আর শহর প্রতিরক্ষা বাহিনী অত্যন্ত উদ্যমের সাথে তাদের প্রতিহত করতে থাকে। কয়েক ঘণ্টা প্রচেষ্টার পর ক্লান্ত সেনাদের বিশ্রাম দিতে সিপিও সরে এলেন। কিন্তু একই সাথে তার দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে শুরু করলেন।
স্থানীয় জেলেরা সিপিওকে খবর দিয়েছিল যে, নিউ কার্থেজের উত্তরের ল্যাগুন বেশ কিছু জায়গা অগভীর, যেখান দিয়ে ল্যাগুন পার হওয়া সম্ভব। সিপিও সাহসী ও শক্তিশালী ৫০০ রোমান সেনাকে মই সহ সেদিকে পাঠিয়ে দিলেন, আর তাদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে রাখতে সামনে থেকে আবার প্রাচীর আক্রমণের নির্দেশ জারি করলেন।
শহরের প্রতিরক্ষা বাহিনী তখন রোমানদের হটিয়ে দেয়ার এই আনন্দে উল্লসিত। নতুন করে আবার আক্রমণের তাড়ায় কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়ে। এই সুযোগে উত্তর দিকে থেকে বিনা বাধায় রোমান সৈন্যরা দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে। তারা দরজা খুলে দিলে সিপিওর মূল বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। নির্বিচারে হত্যা ও লুণ্ঠন চলল অনেকক্ষণ। শেষ পর্যন্ত সিপিও সব বন্ধের নির্দেশ দিলেন। কার্থেজের বেঁচে যাওয়া সেনাদের বন্দি করা হল।
নিউ কার্থেজ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আর রসদপত্র সিপিওর হস্তগত হয়। মূল্যবান জিনিস তিনি সৈন্যদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেন। তিনি স্প্যানিশ বন্দিদের প্রতি নমনীয় আচরণ করেন এবং অনেককে মুক্তি দিতে তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন। নিউ কার্থেজের পতন দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে কার্থেজের অপূরণীয় ক্ষতি করে দেয়।
ব্যাটল অফ বাকুলা (২০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
হাসড্রুবাল বার্কা বেটিস নদীর উজানে বাকুলাতে শীতকাল কাটাচ্ছিলেন। নিউ কার্থেজে কিছু সেনা রেখে সিপিও এবার তার দিকে এগিয়ে গেলেন। হাসড্রুবাল সরে গিয়ে শহরের ঠিক বাইরে একটি ছোট পাহাড়ের ওপর ঘাঁটি বানালেন। পাহাড়ের পেছনে নদী আর দুই পাশে খাড়া ঢাল। সামনের রাস্তা ঢালু হয়ে নিচে নেমেছে। সবদিক থেকে ছিল আদর্শ অবস্থান।
সিপিও দুই দিন অপেক্ষা করলেন। কিন্তু অন্য দুই কার্থেজিনিয়ান সেনানায়ক এসে পড়লে তিনি বিপদে পড়বেন, এই আশঙ্কা থেকে তৃতীয় দিন তিনি হামলার নির্দেশ দিলেন। তার হালকা অস্ত্রে সজ্জিত যোদ্ধারা হাসড্রুবালের অগ্রগামী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এছাড়াও সিপিও দুই দল সেনা পাঠালেন যাদের কাজ ছিল হাসড্রুবালের দিকে যাওয়ার দুটি পথ আটকে বসে থাকা, যাতে কোনো সাহায্য তার কাছে আসতে না পারে।
হাসড্রুবাল দেখলেন তার অগ্রগামী সেনারা মার খাচ্ছে, তাই তিনি মূল বাহিনী নিয়ে নামতে শুরু করলেন। তিন একদল সেনা নিয়ে পাহাড় ঘুরে হাসড্রুবালের বামে আর তার সহকারী লেইলাস একইভাবে ডানে আঘাত করল। কার্থেজ বাহিনী রণসজ্জার সময়ই পেলনা। দুই দিক থেকে প্রচণ্ড হামলায় তাড়া বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। হাসড্রুবাল পালিয়ে গেলেন। তার বহু সৈন্য হতাহত হলো।
মার্সেলাসের মৃত্যু (২০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
রোমান কন্সাল মার্সেলাস ও ক্রিস্পিনাস ভেনুসিয়া ও ব্যান্টিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে ঘাঁটি করলেন। তাদের মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে হ্যানিবালের ক্যাম্প। দুই পক্ষের মধ্যে ছোটখাটো কিছু সংঘর্ষ ছাড়া আর কিছু হচ্ছিল না। এর মধ্যে ট্যারেন্টাম থেকে রোমান সেনারা থুরি আক্রমণের চেষ্টা করলে হ্যানিবালের পাঠানো সৈন্যরা তাদের অ্যামবুশ করল। প্রায় ২,০০০ সাথী ফেলে রেখে রোমানরা ট্যারেন্টামে পালিয়ে গেল।
এদিকে দুই ক্যাম্পের মাঝখানে ঘন গাছগাছালিতে ছাওয়া এক পাহাড় ছিল। সেখানে ক্যাম্প সরিয়ে নেয়া যায় কি না তা পর্যালোচনা করতে ২২০ জন অশ্বারোহী সহ মার্সেলাস ও ক্রিস্পিনাস এগিয়ে গেলেন। ওদিকে পাহাড়ের পাদদেশে নুমিডয়ানরা ঘাপটি মেরে বসে ছিল। তারা ও হ্যানিবালের কিছু সৈনিক রোমানদের ও পর আচমকা হামলা করে। বর্শার আঘাতে মার্সেলাস নিহত হন। ক্রিস্পিনাস আহত হলেও পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেন। সেদিন রাতেই ক্যাম্প গুটিয়ে রোমানরা চলে গেল। ক্রিস্পিনাস বছর গড়াতে না গড়াতেই আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় মারা যান।
গ্রুমেন্টামের লড়াই (২০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
হ্যানিবাল প্রথমে লুসেনিয়ার দিকে অগ্রসর হলেন। এখানে গ্রুমেন্টামকে কেন্দ্র করে আশেপাশের শহরগুলোকে দলে টানার ইচ্ছা ছিল তার। তাই গ্রুমেন্টামের এক কিলোমিটার বাইরে ক্যাম্প করলেন তিনি। কন্সাল গাইয়াস ক্লডিয়াস নিরো তার আড়াই কিলোমিটারের মধ্যে এসে অবস্থান নিলেন।
দুই ক্যাম্পের মাঝখানে খোলা প্রান্তর। আশেপাশে গাছপালা আর পাহাড়ি টিলা-টক্কর খুব কম। তা সত্ত্বেও নিরো রাতের বেলা কিছু সৈন্য পাঠালেন যারা সেখানে লুকিয়ে থাকল।
ভোরে কার্থেজিনিয়ানরা প্রস্তুত হবার আগেই নিরো তার বাহিনী নিয়ে সামনে আগালেন। রোমানদের আসতে দেখে হ্যানিবালের সেনারা বিশৃঙ্খলভাবে হয়ে এলো। কোন রকম ফর্মেশনে না গিয়েই তাড়া আত্মরক্ষা করতে লাগল। হ্যানিবাল এই পরিস্থিতি দেখে তাড়াতাড়ি নিজের সেনাদল নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু তিনি সেনাদের সংগঠিত করার আগেই আগের রাতে নিরোর পাঠানো সেনাদল পেছন থেকে কার্থেজিনিয়ানদের উপর হামলা করে বসল। কার্থেজিনিয়ানরা দ্রুত পিছু হটে ক্যাম্পে চলে গেল। লিভি দাবী করেন প্রায় ৮,০০০ সেনা কার্থেজিনিয়ানরা হারায়।
কয়েকদিন পর্যন্ত নিরো চেষ্টা করেও হ্যানিবালকে আর যুদ্ধে জড়াতে পারেননি। বরং তাকে ধোঁকা দিয়ে হ্যানিবাল সরে গেলেন। নিরো হ্যানিবালকে তাড়া করে গেলেন। ফলে আপুলিয়াতে দ্রুত পৌঁছানোর পরিকল্পনা হ্যানিবাল ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।
ব্যাটল অফ মেটারাস (২০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
সিপিওর হাতে পরাজয়ের পর হাসড্রুবাল পিরেনিজ পার হয়ে গল অঞ্চলে এসে বিশ্রাম নেন। এখান থেকে আল্পস পাড়ি দিয়ে হ্যানিবালের সাথে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। মেসালিয়া থেকে রোমে এই সংবাদ পৌঁছলে তারা দুই ভাইয়ের সম্মিলন রুখতে বদ্ধপরিকর হয়। কন্সাল লিভিয়াস স্যালিনেটর উত্তর ইটালিতে সামগ্রিক কমান্ড নিলেন। লিসিনাস ও ভারো আল্পস থেকে ইটালিতে ঢোকার দুই রাস্তা বন্ধ করে বসে রইলেন।
এসবের মধ্যেই হাসড্রুবাল মাত্র দুই মাসে আল্পস অতিক্রম করতে সক্ষম হলেন। তিনি হ্যানিবালের কাছে দূত পাঠালেন, যাতে তিনি আম্ব্রিয়াতে তার সাথে দেখা করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দূতরা রোমানদের কাছে ধরা পড়ে যায়। ক্লডিয়াস নিরো হাসড্রুবালে পরিকল্পনা রোমানদের জানিয়ে দেন এবং ৭,০০০ সেনা নিয়ে স্যালিনেটরের সাথে যোগ দিতে যাত্রা করেন। দ্রুত মার্চ করে তিনি হাসড্রুবালের অগোচরে কন্সালের সাথে যোগ দেন। হাসড্রুবাল স্যালিনেটরের থেকে কিছু দূরে ক্যাম্প করেছিলেন। তার গুপ্তচরেরা প্রথমে বুঝতে না পারলেও তিনি নিরোর আগমন টের পেয়ে যান। যুদ্ধ না করে হাসড্রুবাল সেখান থেকে সরে পড়েন।
রোমানরা ধাওয়া করে তাকে মেটারাস নদীর তীরে ধরে ফেলে। নিরো প্রথমে আক্রমণ করেন, তার সাথে লিসিনাস এসে যোগ দেন। এর সাথে স্যালিনেটরের ভারি অস্ত্রে সজ্জিত পদাতিকরা আক্রমণ করে। যুদ্ধ চলতে থাকে সমানে সমান।
একপর্যায়ে নিরো তার অশ্বারোহী দলে কিছু যোদ্ধা নিয়ে রোমান বাহিনীর পেছন দিক ঘুরে হাসড্রুবালের ডান বাহুতে আক্রমণ করলেন। এই কৌশলে কার্থেজিনিয়ানরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হাসড্রুবাল নিহত হলেন। পলিবিয়াসের বর্ণনায় তার ১০,০০০ সেনাকে রোমানরা হত্যা করে ও প্রায় সমসংখ্যক বন্দি হয়।