দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কার্যত ৪ ভাগ হয়ে যায় জার্মানি। স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে পশ্চিমা অধিকৃত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম জার্মানি। পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েতপন্থী সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানি। ‘৫০ এর দশকে স্নায়ুযুদ্ধের পারদ তুঙ্গে ওঠে, পারমাণবিক শক্তিধর দুই রাষ্ট্র চলে যায় যুদ্ধের কাছাকাছি। সামান্য বিষয় নিয়েই নিজেদের ক্ষমতা দেখানো শুরু করে দুই পক্ষ। এরকম এক ঘটনা থেকেই ১৯৬১ সালে যুদ্ধের মুখোমুখি পৌঁছে গিয়েছিল দুই সুপারপাওয়ার। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থলবাহিনী নেয় মুখোমুখি অবস্থান।
১৯৬১ সালের অক্টোবর। পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিম জার্মানিতে জনগণের যাওয়া ঠেকাতে সবেমাত্র ২ মাস আগেই বার্লিন দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। জীবনধারণের মানের দিক থেকে পূর্ব জার্মানি ছিল পশ্চিমের থেকে পিছিয়ে। তাই লোকজন অনেকেই পালিয়ে যেত পূর্ব থেকে। এছাড়াও নিজেদের সমাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমাদের সংস্পর্শে আসা যাবে না এমন নীতিতেও বিশ্বাসী ছিল তারা। বিশাল দেয়াল নির্মাণ করলেও এই দেয়ালে ৬টি গেট ছিল। এগুলোকে বলা হতো বর্ডার ক্রসিং চেকপয়েন্ট। ভিসা নিয়ে পূর্বে কেউ আসলে তাদের এসব চেকপয়েন্ট পার হয়ে ঢুকতে হতো। এরকমই একটি চেকপয়েন্ট ছিল চার্লি ।
১৯৬০ সাল থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন দাবি করতে থাকে যে, পশ্চিমাদের বার্লিন ছেড়ে দিতে হবে। এ নিয়ে চুক্তি করতে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুসেভ পশ্চিমাদের চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু পশ্চিমারা প্রত্যাখ্যান করে সোভিয়েতদের দাবি। এদিকে সোভিয়েতরা বার্লিন দখল করতে সেনা অভিযান চালানোর হুমকি দেয়। বার্লিন সংকট নিয়ে যখন তীব্র উত্তেজনা দেখা দিয়েছে তখনই সোভিয়েতরা আরেকটি পদক্ষেপ নিয়ে বসে। ১৯৬১ সালের আগস্ট মাসে সোভিয়েতরা চেকপয়েন্ট চার্লি ঘেঁষে একটি ভবন নির্মাণ করে।
আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী ভিসা নিয়ে কড়াকড়ি কূটনৈতিকদের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। কিন্তু ভবন নির্মাণের পর থেকেই আমেরিকানদের পূর্বে যাওয়া নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করে সোভিয়েতরা। উল্লেখ্য, আলোচনার জন্য প্রায়ই তখন পশ্চিম থেকে আমেরিকান কূটনৈতিকরা এই চেকপয়েন্ট পার হয়ে পূর্বে যেত। কূটনৈতিকদের চলাচলে বাঁধা দেয়ার ফলে ক্ষিপ্ত হয় আমেরিকা।
পশ্চিমে অবস্থান করা যুক্তরাষ্ট্রের চিফ অফ মিশন অ্যালান লাইটনার থিয়েটার দেখার কারণ দেখিয়ে পূর্বে যাবেন বলে ঠিক করেন। সোভিয়েতদের কড়াকড়ির মধ্যে পূর্ব থেকে ঘুরে আসাটা ক্ষমতার প্রদর্শন ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক রীতি না মেনে সোভিয়েতপন্থী পূর্ব জার্মান সেনারা আটক করে লাইটনারকে। এদিকে বিরক্তির পরিমাণ বাড়তে থাকে আমেরিকানদের। মার্কিন জেনারেল লুকাস ক্লে নির্দেশ দেন, এরপরে যে কূটনৈতিক পূর্বে যাবেন তার সাথে সামরিক পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে থাকবেন। জেনারেল ক্লে প্রেসিডেন্ট কেনেডির দেয়া ক্ষমতাবলে বার্লিনে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।
এবার অ্যালবার্ট হেমসিং নামের আরেক কূটনৈতিককে পাঠায় আমেরিকা। হেমসিং চেকপয়েন্ট চার্লিতে আসা মাত্রই সামরিক পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তাকে পূর্বের সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যান। কিন্তু তাকেও বাঁধা দেয়া হয়। নাছোড়বান্দা হেমসিং অনেকটা জোর করেই পূর্বে ঢোকার চেষ্টা করেন এবং সফলও হন। আমেরিকানরা এ ধরনের আচরণকে শান্তি প্রক্রিয়ার বাঁধা হিসেবেও উল্লেখ করে। কিন্তু সোভিয়েত বর্ডার কমান্ডার সোলোভিয়েভ কড়া হুঁশিয়ার করেন। ভবিষ্যতে এরকম আচরণ সহ্য করবে না তারা। বিদেশী দূতদের জন্য আর নিয়ম শিথিল করা হবে না।
এদিকে ২৭ অক্টোবর আবার হেমসিং একই কাজ করেন। তারপর যেটা হয়েছিল সেটা নিয়ে দু’রকম বক্তব্য পাওয়া যায়।
পশ্চিমা মিডিয়া প্রচার করে, হেমসিংকে পূর্বে ঢুকতে দেয়া হয়নি এবং সোভিয়েতরা আগ্রাসীভাবে ৩৩টি টি-৫৫ মডেলের ট্যাংক পাঠিয়ে দেয় সীমানার কাছে। এর মধ্যে ১০টি ট্যাংক সীমানা থেকে মাত্র ৭৫ ফুট দূরে অবস্থান নেয়। জবাবে সমান সংখ্যক ট্যাংক মোতায়েন করে আমেরিকাও।
অন্যদিকে সোভিয়েতদের ভাষ্যমতে, হেমসিংকে পূর্বে ঢুকতে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নিয়মনীতির প্রতি সম্মান করতে বলায় এবং সোভিয়েতদের কড়াকড়িতে চটে গিয়ে আগে আমেরিকা ট্যাংক পাঠায়। ১০টি এম-৪৮ ট্যাংক এবং ৩টি আর্মার্ড ভেহিক্যাল মোতায়েন করে। কমান্ডার সোলোভিয়েভ নিকিতা ক্রুশ্চেভের সাথে আলোচনা করে পাল্টা ট্যাংক মোতায়েন করেন।
নিরপেক্ষ সূত্র অনুযায়ী, হেমসিংক যখন দ্বিতীয়বার সঙ্গীসহ পূর্বে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন তাকে থামিয়ে দেয়া হয় এবং জবাবে আমেরিকাই প্রথম ট্যাংক পাঠায়। তবে কে ট্যাংক আগে মোতায়েন করেছে এর থেকে বড় আতঙ্ক ছিল এই যে। দুই পক্ষের ট্যাংকই গোলাবারুদে পরিপূর্ণ ছিল এবং অবস্থা বুঝে দু’পক্ষেরই ফায়ার করার নির্দেশ ছিল। আমেরিকান ট্যাংকগুলো বাড়তি হিসেবে ট্যাংকের সামনে বুলডোজারের অংশ সংযুক্ত করেছিল। কোনো স্থাপনা ভাঙতে ট্যাংককে বুলডোজার হিসেবেও ব্যাবহার করা যায়।
যুদ্ধের আশংকায় মার্কিন বাহিনী ইউরোপে তাদের সব ঘাঁটিকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোও প্রস্তুত ছিল। মার্কিনীদের পরিকল্পনা ছিল যুদ্ধ বাঁধলে যত দ্রুত সম্ভব বার্লিন দেয়াল উড়িয়ে দিতে হবে। পদাতিক সেনাদের চলাচলের পথ পরিষ্কার করে দিতে হবে এবং বার্লিন দখল করতে হবে। জেনারেল ক্লে কেনেডিকে তার এই পরিকল্পনার বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখেন। ব্যক্তিগতভাবে কেনেডি শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন এবং তিনি যুদ্ধ চাইতেন না। ক্রেমলিনের হুকুমে এদিকে প্রস্তুত ছিল সোভিয়েত বাহিনীও। মাত্র ১৫০ ফুট দূরত্বে মুখোমুখি হয় সোভিয়েত এবং আমেরিকান ট্যাংক।
পুরো বিশ্ব যেন শ্বাসরোদ্ধকর অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল চেকপয়েন্ট চার্লিতে। একটি মাত্র ফায়ার হলেই সেদিন যুদ্ধ বেঁধে যেত, যেটা হয়তো কয়েকদিনেই রূপ নিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
এদিকে কেনেডি এবং ক্রুশ্চেভ দুজনই বুঝতে পারলেন যে, যুদ্ধ কোনো ভালো সমাধান নয়। কেনেডি ক্রেমলিনে যোগাযোগ করতে বললেন মার্কিন কর্মকর্তাদের।
সোভিয়েত ইউনিয়নে উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখেন সামরিক গোয়েন্দা শাখার গোয়েন্দা জর্জি বলশেকভ। সেসময় তিনি সাংবাদিক ছদ্মবেশে ওয়াশিংটনে ছিলেন। অত্যন্ত গোপনে তিনি প্রেসিডেন্ট কেনেডির ভাই অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির সাথে দেখা করেন। সে সময় প্রকাশ্যে দু’দেশের প্রতিনিধিদের দেখা হওয়াটা দু’দেশেরই সম্মানের প্রশ্ন ছিল। জর্জি বলশেকভ ক্রুশ্চেভকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, এত ছোট বিষয় নিয়ে যুদ্ধ বাঁধানো ঠিক হবে না, কেনেডিও প্রভাবিত হন তার ভাইয়ের দ্বারা।
জর্জি বলশেকভের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট কেনেডি খবর পাঠান- প্রথম চালটা সোভিয়েতদের দিতে হবে। সোভিয়েতরা দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিলে তিনিও সাথে সাথে পদক্ষেপ নেবেন।
স্বরাষ্ট্র সচিব ডিন রাস্ক জেনারেল ক্লের সাথে যোগাযোগ করেন। পরিষ্কার করে তিনি জানিয়ে দেন, পূর্ব জার্মানি এত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু নয় যে এজন্য আমাদের যুদ্ধের জড়াতে হবে। কেনেডিও আগ্রাসী জেনারেলকে সাবধান করেন। অতি উৎসাহী হয়ে কাজ করার জন্য আমেরিকান রাজনীতিবিদদের রোষানলে পড়েন ক্লে।
সীমান্তে ট্যাংক মোতায়েনের ১৬ ঘণ্টা পর দুই পরাশক্তির সর্বোচ্চ স্তর থেকে নির্দেশ আসে। প্রথমে সোভিয়েত একটি ট্যাংক ৫ মিটার পিছিয়ে যায়। ট্যাংকের ইঞ্জিন বন্ধ না করেই সোভিয়েতরা অপেক্ষা করতে থাকে মার্কিনীদের প্রতিক্রিয়া দেখতে। এবার একটি এম-৪৮ ট্যাংকও পিছু হটলো। আস্তে আস্তে সবগুলো ট্যাংকই সরে যায় মুখোমুখী অবস্থান থেকে। ১৬ ঘণ্টা পর শেষ হয় স্বাসরুদ্ধকর সেই অবস্থার। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পায় বিশ্ব। কেনেডি পরে মন্তব্য করেছিলেন, দেয়াল কোনো ভালো সমাধান না হলেও যুদ্ধ থেকে অন্তত ভালো!