তুতেনখামেনের সোনার মুখোশ দেখে কত রহস্যই না জাল বুনেছে আমাদের কল্পনায়। যে শিল্পীর যত্নে এই সূক্ষ্ম মুখোশ তৈরি, যে করেছিল এর পরিকল্পনা, তার দক্ষতা, ফারাওদের ঐশ্বর্য আর না জানা অনেক রহস্যময়তায় ঘেরা তাদের রেখে যাওয়া চিহ্ন- সবই পৃথিবীর মানুষের কৌতূহলের বিষয়। তাদের হায়ারোগ্লিফিক আর ব্যবহার্য আসবাবের উপাদান, তাৎপর্য অনেকাংশে অনুমান করা সম্ভব হলেও, হাজার হাজার বছর আগে যে মানুষটা এই সোনার মুখোশ মুখে পরেছিলেন, তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মানুষের জানার সীমানায় কালো পর্দা হয়ে দাঁড়ায় সময়।
এই এত সময় পার হয়ে গেছে, তখন কেমন ছিল ফারাও তুতেনখামেন, তা কে বলতে পারবে? এমনকি খুব কম মানুষই জানেন যে ফারাওয়ের ব্যক্তি জীবনকে সামনে আনার জন্য প্রত্নতত্ত্ববিদেরা তুতেনখামেনের মাথা কেটে মুখোশ খুলেছিলেন। বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন মুখোশের আড়ালে থাকা ব্যক্তি তুতেনখামেনকে। সেই তুতেনখামেন, যে ফারাও হওয়ার পাশাপাশি কারো ভাই, কারো বন্ধু, কারো পুত্র, কারো স্বামী।
খুব সম্ভবত ১৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তুতেনখামেন জন্ম নেন আমারনায়। বংশপরিচয় নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সর্বাধিক প্রচলিত ধারণা মতে, তার পিতা আখেনাতেন (২০১০ সালে ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত) এখানকার শাসক ছিল। আখেনাতেন প্রবল প্রতাপশালী শাসক ছিলেন আমারনায়, আর সেই প্রতাপের উত্তাপে চলে আসা কাল্ট পরিবর্তন করে দেবতা আতেনের উপাসনার দিকে নিয়ে যান। অনেকেই আখেনাতেনকে একেশ্বরবাদী বলে ভুল করেন। কারণ তিনি অন্য সব দেবতার প্রার্থনার রীতি বন্ধ করে দিলেও সর্বোচ্চ দেবতা আতেনকে রাজসম্পদ বানিয়ে ফেলেন। তিনি আর রাজপরিবারের সদস্য বাদে কোনো ব্যক্তির আতেনের প্রার্থনার অধিকার ছিল না। আতেনকে প্রার্থনা করতে হলে তাদের সম্রাট আখেনাতেনকে পূজা করতে হবে, অর্থাৎ আতেন আর জনগণের মাঝামাঝি মাধ্যম হলেন আখেনাতেন, যিনি কি না মর্যাদায় আতেনের প্রায় সমকক্ষ। সুতরাং এক ঈশ্বরের প্রশ্ন রইল না।
আখেনাতেন ছিলেন বেশ ঘরকুনো রাজা। শহরের বাইরে যেতে চাইতেন না, নিজের গড়া কাল্টে মেতে থাকতেন। একজন পুরোহিত এমন করলে সমস্যা হয় না, কিন্তু রাজার এমন স্বভাব রাজ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
সুযোগ ছাড়লো না বিরোধী শক্তি। রাজার অলক্ষ্যেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল তারা। ফলে রাজত্ব না গেলেও পুরো মিশর জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলো।
চারদিকে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক ঈর্ষা, সংঘর্ষ, তার মাঝে জন্মালেন তুতেনখামেন। এত সব মানুষের তৈরি দুর্যোগ থাকতেও প্লেগের আক্রমণ হলো মিশরে। আরো অনেক মানুষের সাথে মারা গেল তুতেনখামেনের পরিবারের বেশিরভাগ মানুষ। তার বয়স তখন কেবল ৮। বালক তুতেনখামেনকে জোর করে ঠেলে দেওয়া হলো রাজনীতির কুয়ায়, নতুন রাজা করে।
তুতেনখামেন মিশরের শাসন করেছিলেন ১০ বছর। ১৮ বছর বয়সে মারা যাওয়া এই কিশোর রাজার জীবনের সমাপ্তিকে প্রাকৃতিক বলে ধরে নিতে পারেন না অনেক গবেষক। দাবী করা হয়, খুন করা হয়েছিল তাকে। দিন দিন চঞ্চল আর অবাধ্য হয়ে উঠছিল সে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার রাস্তাও বন্ধ হয়ে আসছিল। তার ১৮ বছরের জীবন নিয়ে খুব কমই গবেষণা হয়েছে। শুধু তার সমাধিতে পাওয়া জিনিসগুলোর বিশ্লেষণ করলেও তার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
তুতেনখামেন মোটেও তার বাবার মতো ঘরকুনো ছিল না। সে আর দশটা চঞ্চল ছেলের মতোই বাইরে ঘুরতে ভালবাসতো। কাদা মাখানো সব জুতা এমন কথাই বলে। জীবনসংগ্রামে টিকতে হলে রাজপুত্রদের যেসব প্রশিক্ষণ নিতে হয়, সেসব শিখেছিল সে-ও। হাঁটতে সাহায্য করে এমন ছড়ির সংগ্রহে একটা লাঠিতে লেখা ‘এই লাঠি মহামান্য সম্রাট নিজ হাতে কেটেছিলেন’। ধারালো কোনো কিছু দিয়ে এর গায়ে নকশা করেছিল বালক তুতেনখামেন। নিজের এই অর্জন নিয়ে সে এতটাই গর্বিত ছিল যে তার কোনো কর্মচারী সেই কথা আবার স্বর্ণের হাতলে খোদাই করে দিয়েছে। হয়তো কর্মচারী তার চাকরি বাঁচাতে মহান ফারাওয়ের তোষামোদ করেছিল, নতুবা সত্যিই ফারাওয়ের গুণে সে মুগ্ধ ছিল! তার সমাধিতে পাওয়া যায় বিশেষ রকম আগুন জ্বালানোর যন্ত্র। যন্ত্রটিতে ছোট ছোট ছিদ্র করা, এই অংশে লাঠির সাহায্যে ঘষে আগুন ধরানো যায়। এই যন্ত্রটিও তুতেনখামেনের প্রাসাদের বাইরে অনেকটা সময় কাটানোর প্রমাণ।
এসব শিক্ষা শাসক তুতেনখামেনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। শিকার করতে আর রথের প্রতিযোগিতার শখ ছিল তার। তার সমাধিতে এমন বহু ছবি আছে যেখানে দেখানো হয়েছে সাধারণ প্রজাদের পাশাপাশি তুতেনখামেন এসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে। প্রথম দিকের গবেষকরা ভেবেছিলেন, এটা শুধুমাত্র সম্রাটের ভালো প্রচারণার উপায়। কিন্তু পরে তার এসব শখ থাকার যথেষ্ট প্রমাণ সমাধিতেই মেলে।
রাজপরিবারের শিশু হিসেবে যুদ্ধবিদ্যা আর রথচালনা আবশ্যিক ছিল তুতেনখামেনের জন্য। যখন বয়স কেবল পাঁচ, তখন থেকেই সে ছোট ছোট অস্ত্র ব্যবহার শেখে, রপ্ত করে যুদ্ধের নানা কৌশল। তার সমাধিতে ছোটবেলায় ব্যবহৃত তীর ধনুক, বর্শা, ছোট ছুরি, হালকা তলোয়ার পাওয়া যায়। রথ আর ঘোড়া চালাতে যে দস্তানা ব্যবহার করতেন সেগুলোকেও কবর দেওয়া হয়েছে তার সাথে। আমারনায় আখেনাতেন নিজেকে ও নিজের দেবতুল্য পরিবারসহ প্রজাদের দর্শন দিতে রথে চেপে বের হতেন রোজ। আর প্রতিদিন সেখানে উপস্থিত থাকতো তুতেনখামেন।
তুতেনখামেনের সমাধিতে আরও পাওয়া যায় চারটি অনেক ব্যবহারে জীর্ণ রথ। এই রথগুলো ব্যবহার করা হতো শিকারে। তুতেনখামেন যত বড় হয়েছেন, তার সাথেই বেড়েছে তার শিকারের আকৃতি। কারনাকের সূর্যমন্দিরে খোদাই করা এক ছবিতে দেখা যায়, তিনি সিংহ আর ষাঁড় শিকার করছেন। বিখ্যাত স্বর্ণের পাখায় থাকা পালকগুলোর মালিক পাখিটাকেও তুতেনখামেন হত্যা করেছিলেন। ছবিতে দেখা যায়, তার শিকারের পশুর মাংস দিয়ে প্রাসাদে ভোজের আয়োজন করা হত। অথবা, এর কিছুই সত্য নয়, তুতেনখামেন হয়তো নিতান্ত সাধারণ এক সদ্য তরুণ ছিল, যার অত বড় ষাঁড় মারার ক্ষমতা না থাকলেও ধাওয়া করার যে রোমাঞ্চ, সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি।
আখেনাতেনের সময়ের রাজ্যে কূটনৈতিক দুর্বলতার সমাধান করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তুতেনখামেন। বড়সড় সব সংস্কারের মাঝে দিয়ে তিনি আগের ফারাওদের রীতি ফেরত নিয়ে আসেন। আখেনাতেনের শহর ছেড়ে থিবসকে রাজধানী করা হয়। ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে থিবস।
মুখোশের আড়ালে তুতেনখামেন বিশাল পিরামিডে চিরনিদ্রায় যাওয়া যুবক নন। তিনি এমন কেউ নন যার মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন করতে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। খুন, ষড়যন্ত্র, নাকি যুদ্ধের ময়দানে স্বাভাবিক মৃত্যু এই বিতর্কের সমাধানে আসতে লেগে গেছে বহু বছর। মুখোশের আড়ালে তুতেনখামেন এমন কেউ নন, যিনি তুতেনাখাতেন থেকে তুতেনখামেন হয়েছেন। মিশরের ইতিহাসের দিক পাল্টে আতেনকে সরিয়ে আমুনকে দেবতা করেছেন, তৈরি করেছেনে কারনাকের মন্দির।
মুখোশের আড়ালে তুতেনখামেন, খুব সাধারণ এক যুবক, হয়তো আশেপাশে কারো সাথে তুলনা করলে দৃশ্যায়ন সহজ হবে। সেই তুতেনখামেন ভালোবাসে আনাখসানামুনকে, তার মাথায় ধর্মীয় বিপ্লব আর রাজনৈতিক দাঙ্গা নেই। শুধু সামনে পড়ে আছে বিশাল এক মরুপ্রান্তর, দস্তানা পরা হাতে ধরা রথের রাশ, এই রথ দিয়ে মরুপথে ছুটে চলা যায় অনন্ত সময়ের জন্য, বাধা শুধু একটাই, প্রিয়তমা আনাখসানামুনের কালো চোখ।
ফিচার ইমেজ: NATGEO