ক্ষমতার লড়াইয়ে নিহত নিষ্পাপ শিশু দিমিত্রি ও অন্যান্য

রাজপরিবারের ইতিহাস যেন সবসময়ই বিশ্বাঘাতকতা আর খুনোখুনির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ইতিহাস। রক্তাক্ত সেসব ইতিহাস একদিকে যেমন আমাদের বাস্তব জগতেই অন্য এক উন্মাদনার স্বাদ উপহার দেয়, তেমনি আমাদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছুও আছে সেখানে। রাজপরিবারে গুপ্তহত্যা নিয়ে তাই আজ থাকছে আমাদের দ্বিতীয় পর্ব।

তৃতীয় চার্লস (নেপল্‌সের রাজা)

প্রিন্স অ্যান্ড্রুকে গুপ্তঘাতকদের মাধ্যমে খুন করিয়েছিলেন তার স্ত্রী জোয়ানা। এর প্রায় চল্লিশ বছর পর তৃতীয় চার্লসের লেলিয়ে দেয়া সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারান জোয়ানা নিজেই। আবার এরও প্রায় চার বছর পর একইভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হন চার্লস নিজেই! এ যেন তাদের অদৃষ্টের এক নির্মম পরিহাস।

বেটে চার্লস নামে পরিচিত তৃতীয় চার্লস জোয়ানার মৃত্যুর পর নিজেই নেপল্‌সের সিংহাসনে গিয়ে বসেন। ১৩৮২-১৩৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি তৃতীয় চার্লস নাম নিয়ে জেরুজালেমের রাজা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

তৃতীয় চার্লস

জোয়ানাকে হত্যার মাধ্যমে নেপল্‌সের সিংহাসনে বসে বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন রাজা তৃতীয় চার্লস। কিন্তু ‘সুখে থাকলে ভুতে কিলায়’ প্রবাদটিই একসময় তাকে পেয়ে বসে। হাঙ্গেরীর তৎকালীন রাজা লুইসের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার মেয়ে মেরি। আর তখনই মেরিকে সরিয়ে হাঙ্গেরীর রাজপ্রাসাদ দখলের কুবুদ্ধি চেপে বসে চার্লসের মাথায়। মূলত জোয়ানাকে সরিয়ে নেপল্‌সের ক্ষমতা দখলই তাকে অতটা আত্মবিশ্বাসী করে তুলছিলো।

১৩৮৫ সালে তাই হাঙ্গেরী আক্রমণ করে বসেন চার্লস। নিজের আত্মবিশ্বাসকে সঠিক প্রমাণ করে জিতেও যান তাদের বিপক্ষে যুদ্ধে। ফলে নেপল্‌সের পর হাঙ্গেরীও এসে যায় চার্লসের রাজত্বাধীনে। কিন্তু আফসোস! সদ্যই গত হয়ে যাওয়া রাজা লুইসের স্ত্রী এলিজাবেথকে একেবারেই হিসেবের মাঝে আনেন নি হাঙ্গেরী জয় করে ‘দ্বিতীয় চার্লস’ উপাধি ধারণ করা নতুন রাজা। পোল্যান্ডে নিজের বড় মেয়ে জডউইগার সিংহাসন পাকাপোক্ত করেছিলেন এ এলিজাবেথ। মেরির বেলায়ই বা এর ব্যতিক্রম ঘটবে কেন? মেরির হারানো সিংহাসন ফিরিয়ে দিতেও মা এলিজাবেথ তাই দৃঢ় শপথ গ্রহণ করেন।

১৩৮৬ সালের কথা। বুদা দুর্গে নতুন রাজা চার্লসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এলিজাবেথ। শত্রুর মায়ের কাছ থেকে এমন দাওয়াত পেয়ে একেবারেই গলে যান রাজা। তিনি ভেবে নেন যে, তারা বোধহয় অতীতের সব ঘটনা ভুলে গিয়ে নতুন করে সম্পর্ক পাতাতে চাইছে। তাই সরল মনেই সেই দাওয়াত গ্রহণ করে সেখানে গিয়ে হাজির হন তিনি। আর এটাই ছিলো তার মস্ত বড় ভুল। কারণ আলাপচারিতার এক পর্যায়ে সুযোগ মতো এলিজাবেথের ঠিক করা গুপ্তঘাতক কুড়াল বসিয়ে দেয় চার্লসের ঘাড়ে! তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

এ ঘটনাটি হাঙ্গেরীর সিংহাসনে মেরির পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ নিশ্চিত করে দেয়। কিন্তু মেয়ের সেই সৌভাগ্য দেখে যেতে পারেন নি মা এলিজাবেথ। কারণ স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চার্লসের স্ত্রীও সাথে সাথেই শ্বাসরোধ করে এলিজাবেথকে খুন করেন!

দিমিত্রি ইভানোভিচ

আইভান দ্য টেরিবল খ্যাত রাশিয়ার জার চতুর্থ আইভান ভাসিল্‌য়েভিচ ১৫৪৭ থেকে ১৫৮৪ সালে তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন। তার শাসনামলেই রাশিয়া মঙ্গোলীয় খানদের অধীনে থাকা কাজান, আস্ত্রাখান ও সিবির অঞ্চলগুলো দখলে সক্ষম হয়। বহুজাতিক ও বহুমহাদেশীয় বিশাল এ ভূখন্ড ছিলো প্রায় ৪০,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। সমস্যা বাধে আইভানের মৃত্যুর পরই। আর সমস্যার কারণও ছিলো সেই আগের মতোই- সাম্রাজ্যের নতুন শাসক হবেন কে?

দিমিত্রি ইভানোভিচ ছিলেন আইভানের সবচেয়ে ছোট ছেলে। আইভানের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসে দিমিত্রির বড় ভাই প্রথম ফিওদর। কিন্তু ফিওদরের মানসিক বৈকল্যের দরুণ তার পক্ষে রাজ্য পরিচালনা করতেন তার স্ত্রী ইরিনার বড় ভাই বরিস ফিওদরোভিচ গদুনভ।

মূলত ফিওদরের পক্ষে রাজ্যের শাসন পরিচালনা করলেও ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করতেন বরিসই। তাই এ ক্ষমতার ভিত সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলেন তিনি। আর এ ভিত গড়ার পথে সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলো ফিওদরের ভাই দিমিত্রি। তাই দিমিত্রিকে খুন করে পথের শেষ কাঁটাটিও সরাবার উদ্যোগ নেন তিনি।

দিমিত্রি ইভানোভিচ

১৫৮৪ সালে দিমিত্রি, তার মা ও মামাদের উগ্লিচ শহরে নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন বরিস। অবশেষে ১৫৯১ সালের ১৫ মে ছুরিকাঘাতে মৃত্যু ঘটে দিমিত্রির। এ মৃত্যুটি যে ঠিক কীভাবে ঘটেছিলো তা নিয়ে মূলত দুটি মত প্রচলিত রয়েছে।

১) বরিস গদুনভের নির্দেশে গুপ্তঘাতকেরা খুন করে দিমিত্রিকে। তারা খুনের ঘটনাটি এমনভাবে সাজায় যাতে করে একে একটি দুর্ঘটনার মতো মনে হয়। তবে এ মতবাদের ভিত খুব একটা মজবুত না। কারণ রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের নিয়ম অনুযায়ী সর্বোচ্চ তিনটি বিয়ে করা সম্ভব। সেখানে দিমিত্রি ছিলেন আইভানের পঞ্চম কিংবা সপ্তম স্ত্রীর সন্তান। তাই রাশিয়ার রাজা হবার কোনো আইনগত বৈধতা ছিলো না তার।

২) দ্বিতীয় ধারণানুযায়ী- ছুরি দিয়ে খেলতে থাকা অবস্থায় সম্ভবত মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়েছিলো দিমিত্রি। তখন দুর্ঘটনাবশত সে নিজের গলায় নিজেই ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছিলো! অবশ্য এ ধারণাও খুব একটা ভিত্তি পায় নি। কারণ মৃগীরোগীর হাতের তালু আক্রান্ত অবস্থায় খোলা ও টানটান হয়ে থাকে। তখন এভাবে হাতে একটি ছুরি ধরে তা আবার নিজের গলায় ঢুকিয়ে দেয়ার কথা কতটা যুক্তিপূর্ণ তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই।

দিমিত্রির মৃত্যু

এখানেই মারা গিয়েছিলো দিমিত্রি

অফিসিয়াল তদন্ত শেষে বলা হয়েছিলো যে, ছুরি দিয়ে খেলতে থাকা অবস্থায়ই দুর্ঘটনাবশত মৃত্যু হয় দিমিত্রির। সেখানে অবশ্য মৃগীরোগ কিংবা গুপ্তঘাতকের তত্ত্ব টেনে আনা হয় নি। তবে এটাও ছিলো কেবলই অনুমান।

প্রথম চার্লস (কাউন্ট অফ ফ্ল্যান্ডার্স)

ডেনমার্কের রাজা ৪র্থ কানুটের একমাত্র পুত্র চার্লসের জন্ম হয় ১০৮৪ সালে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। চার্লসের বয়স যখন মাত্র দুই বছর, তখনই খুন হন তার বাবা। তখন জীবন রক্ষার্থে তাকে নিয়ে ফ্ল্যান্ডার্সে চলে আসেন তার মা অ্যাডেলা, ডেনমার্কে রেখে আসেন দুই জমজ মেয়ে ইঙ্গেবর্গ ও সেসিলিয়াকে। সেখানেই দাদা-চাচাদের আদর যত্নে বড় হতে থাকেন চার্লস। ১১১১ সালে চাচা দ্বিতীয় রবার্টের মৃত্যু হলে কাউন্টের দায়িত্ব পান চার্লসের চাচাত ভাই সপ্তম বাল্ডউইন। ১১১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এক যুদ্ধে মারাত্মক আহত হন বাল্ডউইন। আর এ ঘটনাই মোড় ঘুরিয়ে দেয় চার্লসের জীবনের। সন্তানহীন বাল্ডউইন চার্লসকেই তার উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচন করে যান। ১১১৯ সালের জুলাইয়ে তাই বাল্ডউইনের মৃত্যুর পর ফ্ল্যান্ডার্সের কাউন্টের দায়িত্ব পান প্রথম চার্লস। অত্যন্ত অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে এতিম হওয়া চার্লসের জন্য এমন পদে আসীন হতে পারাটা ছিলো সৌভাগ্যেরই এক নিদর্শন।

১১২৫ সালে তার রাজ্যে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন চার্লস নিজে দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণের মাঝে খাবার বিতরণে অংশ নেন। আবার কেউ যাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার মজুদ করে রাখতে না পারে এবং সেই সাথে বেশি দামে খাবার বিক্রি করতে না পারে সেজন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তিনি। এসব কারণে অল্পদিনের মাঝেই জনগণের আপনজনে পরিণত হন চার্লস। লোকে তাকে ডাকতো ‘চার্লস দ্য গুড’ নামে।

প্রথম চার্লস

দুর্ভাগ্যজনকভাবে একই সময়ে তৎকালীন প্রভাবশালী এরেম্‌বাল্ড পরিবারের সাথে চার্লসের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। অবশ্য এরেম্‌বাল্ড পরিবারের ক্ষমতা লাভের ইতিহাসও কম বিচিত্র ছিলো না। পরিবারের গোড়াপত্তনকারী ছিলেন এরেম্‌বাল্ড নামক একজন ভূমিদাস যিনি ব্রুগেস দুর্গের অধিপতির জমিতে কাজ করতেন। তবে গোপনে গোপনে মালিকের স্ত্রীর সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন তিনি। একসময় তাদের সম্পর্কের গাঢ়ত্ব বৃদ্ধি পেলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন সেই দুর্গাধিপতিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার। একদিন নৌকার পাশে প্রকৃতির ছোট ডাকে সাড়া দিচ্ছিলেন সেই অধিপতি। তখন চুপিসারে তার পেছনে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে পানিতে ফেলে দেন এরেম্‌বাল্ড। আর এতেই মৃত্যু ঘটে ব্রুগেস দুর্গের অধিপতির। এরপর তার বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেন এরেম্‌বাল্ড, নিজেই হয়ে ওঠেন নতুন দুর্গাধিপতি। এভাবেই গোড়াপত্তন ঘটে এরেম্‌বাল্ড পরিবারের।

একসময় এরেম্‌বাল্ডরা যখন বেশ ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে, তখন চার্লস সিদ্ধান্ত নেন যে তাদেরকে আবারো ভূমিদাস অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। অবশ্য এ সিদ্ধান্ত চার্লসের মাথায় এমনি এমনিই আসে নি। তার পরামর্শদাতারাই তার কানে এমন পরিকল্পনার কথা তুলে দিয়েছিলো।

চার্লসের এমন ঘোষণা শুনে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষেপে যায় এরেম্‌বাল্ড পরিবারের সদস্যরা। তবে সেইন্ট ডোনাশিয়ান চার্চের প্রভোস্ট বার্টাল্‌ফ ফিট্‌জ এরেম্‌বাল্ডের রেগে যাওয়ার মাত্রাটা একটু বেশিই ছিলো। তাই তিনি কাউন্ট চার্লস ও তার সভাসদদের খুনের পরিকল্পনা আঁটতে শুরু করে দেন।

১১২৭ সালের দোসরা মার্চ সকালের কথা। সেইন্ট ডোনাশিয়ান চার্চে প্রার্থনারত অবস্থায় হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন চার্লস। এমন সময় একদল নাইট প্রবেশ করে সেখানে। তাদের তলোয়ারের আঘাতে নিমিষে প্রাণ হারান কাউন্ট চার্লস, মেঝেতে এখানে সেখানে পড়ে থাকে তার মগজের টুকরো!

এমন একজন ভালো মানুষের এভাবে মৃত্যুকে মেনে নিতে পারে নি কেউই। ষড়যন্ত্রে জড়িত এরেম্‌বাল্ড পরিবারের সদস্যদের আটক করে ব্রুগের ও ঘেন্টের উত্তেজিত জনতা। তাদের গণপিটুনিতেই পরে প্রাণ হারায় সেসব ষড়যন্ত্রকারী।

এ সিরিজের পূর্ববর্তী পর্ব

১) রাজপরিবারে গুপ্তহত্যা

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/Charles_III_of_Naples
২) en.wikipedia.org/wiki/Dmitry_of_Uglich
৩) en.wikipedia.org/wiki/Charles_I,_Count_of_Flanders

 

 

Related Articles

Exit mobile version