বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিখ্যাত শেষ উক্তি

কথিত আছে, একজন ব্যক্তির মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে নাকি পুরো জীবনটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমাদের প্রিয় মানুষদের মৃত্যুর আগে বলে যাওয়া কথা সবসময় আমাদের মনের উপর চিরস্থায়ী একটা প্রভাব ফেলে। মৃত ব্যক্তিটি না থাকলেও তাদের সেই কথাগুলো এবং সেই মুহূর্তের স্মৃতি আমাদের সাথে রয়ে যায়। যুগের পর যুগ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি পৃথিবীতে তাদের কাজের দ্বারা মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। তারা আমাদের খুব আপনজন না হলেও তাদের মৃত্যুতে আমরা সকলেই শোক প্রকাশ করি।

একজন বিজ্ঞানী তার উদ্ভাবন, সঙ্গীতজ্ঞ তার গানের সুর, অভিনেতা তার অভিনয় দিয়ে আমাদের মনে ও ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী জায়গা করে নেন। একজন লেখক চলে গেলেও তার লেখনী এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। এই বিখ্যাত মানুষগুলোর কাছে মৃত্যু কেমন ছিল ? মৃত্যু যখন তাদের দরজায় কড়া নাড়ে, তখন তারা কীভাবে একে অভিবাদন জানান ? আজকের এই লেখাটিতে আমরা আলোচনা করবো এমন বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির বলে যাওয়া শেষ বাক্য নিয়ে। এই মনীষীদের মাঝে কারো কারো শেষ উক্তি ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত। আবার কারোটা ছিল একেবারেই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। আবার কারো কথার মাঝে ফুটে ওঠে মানুষের ওপারে চলে যাওয়া কতটা কষ্টকর ও অনিবার্য।

চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯–১৯৭৭)

বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা ও চলচ্চিত্রকার চার্লি চ্যাপলিন ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে এক ধর্মযাজক তাকে শেষকৃত্যের নিয়ম সম্পর্কে বলতে থাকেন। এসময় যাজক ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন, যেন সৃষ্টিকর্তা চার্লির বিদেহী আত্মার উপর দয়া করেন। এই প্রার্থনার প্রত্যুত্তরে চার্লি চ্যাপলিন বলে বসেন,

কেন নয়, প্রকৃতপক্ষে তিনিই (ঈশ্বর) তো এর (আত্মার) প্রকৃত মালিক।

চার্লি চ্যাপলিন; Image Source: boredpanda.com

স্যার আর্থার কোনান ডয়েল (১৮৫৯–১৯৩০)

বিখ্যাত গোয়েন্দা গল্পের সিরিজ শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তিনি তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

তুমি চমৎকার একজন মানুষ।

স্যার আর্থার কোনান ডয়েল; Image Source: boredpanda.com

পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩)

বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো মৃত্যুর সময় তার পাশে থাকা মানুষগুলোর উদ্দেশে বলেন,

তোমরা আমার নামে পান করো, আমার সুস্বাস্থ্য কামনা করে পান করো। তোমরা জানো যে আমি আর কখনো পান করতে পারবো না।

পাবলো পিকাসো; Image Source: boredpanda.com

বব মার্লে (১৯৪৫-১৯৮১)

১৯৭৭ সালে বিখ্যাত জ্যামাইকান সঙ্গীতশিল্পী বব মার্লে মেলানোমা নামক এক ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া অবস্থাতেও তিনি বিভিন্ন সফরে অংশ নিতেন। ১৯৮১ সালে জার্মানি থেকে চিকিৎসা করিয়ে জ্যামাইকা ফেরত আসার পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩৬ বছর। মারা যাওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি তার সন্তান জিগি মারলের উদ্দেশে বলেন,

টাকা-পয়সা কখনো জীবন কিনে দিতে পারে না।

বব মার্লে; Image Source: boredpanda.com

কার্ল মার্ক্স (১৮১৮–১৮৮৩)

বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সকে মৃত্যুর আগে তার বাসার গৃহপরিচারিকা জিজ্ঞেস করেন যে, মারা যাওয়ার আগে তিনি শেষ কী বলতে চান। উত্তরে কার্ল মার্ক্স বলেন,

শেষ বাক্য সেসব বোকার জন্য, যারা সারা জীবনে যথেষ্ট কথা বলেনি।

কার্ল মার্ক্স; Image Source: boredpanda.com

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২–১৫১৯)

ইতালিয়ান রেনেসাঁ যুগের অন্যতম কারিগর লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন একজন উদ্ভাবক, চিত্রকর, ভাস্কর, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, গণিতবিদ ও স্থপতি। একই সাথে এতগুলো গুণের অধিকারী মানুষ ইতিহাসে দ্বিতীয় কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বহুগুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুশয্যায় তিনি নিজ কাজের পরিধি নিয়ে অনুতাপ প্রকাশ করেছেন,

আমি সৃষ্টিকর্তা ও মানবজাতিকে অসন্তুষ্ট করেছি, কারণ আমি আমার কাজগুলো সে পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারিনি, যত দূর যাওয়া উচিত ছিল।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি; Image Source: boredpanda.com

চার্লস ডারউইন (১৮০৯–১৮৮২)

চার্লস ডারউইন একজন ইংরেজ প্রকৃতিবিদ ও জীববিজ্ঞানী, যিনি তার বিবর্তন তত্ত্ব দিয়ে পুরো পৃথিবীতে তাক লাগিয়ে দেন। তার এই তত্ত্ব দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর সকল প্রজাতির জৈবিক উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী মৃত্যুশয্যায় বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি তার স্ত্রীকে বলেন,

আমি মৃত্যুকে ন্যূনতম ভয় করি না। মনে রেখো যে, তুমি স্ত্রী হিসেবে কতটা ভালো ছিলে। আমার সকল সন্তানদের স্মরণ করিয়ে দিও যে, তারা আমার প্রতি বেশ সদয় ছিল।

চার্লস ডারউইন ; Image Source: abcnews.go.com

মেরি অ্যানতোয়ান্ট (১৭৫৫–১৭৯৩)

ফ্রান্সের রানী মেরি অ্যানতোয়ান্টকে রাজ কোষাগার থেকে অর্থ চুরি ও শত্রুর সাথে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এবং দেশদ্রোহিতার জন্য তার ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। নিজের ওপর আরোপিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করলেও তিনি মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পান না। মনে প্রবল কষ্ট নিয়ে তিনি পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় শিরচ্ছেদের যন্ত্রটির দিকে এগিয়ে যান। এসময় তিনি ভারসাম্য হারিয়ে জল্লাদের পায়ে পাড়া দিয়ে বসেন। ক্ষমা চেয়ে তিনি জল্লাদকে বলেন,

আমাকে মাফ করে দেবেন, আমি এটি ইচ্ছে করে করিনি।

কথাটি তিনি জল্লাদকেই উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, নাকি তা প্রজাদের উদ্দেশে ছিল তা নিয়ে পরবর্তী সময়ে বেশ আলোচনা করা হয়।

মেরি অ্যানতোয়ান্ট; Image Source: boredpanda.com

রিচার্ড ফাইনম্যান (১৯১৮–১৯৮৮)

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান ১৯৭৮ সালে লিপোসারকোমা নামক এক বিরল প্রকৃতির ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ ১০ বছর এই ক্যান্সারের সাথে তিনি যুদ্ধ করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি বলেন,

আমি মোটেও দু’বার মরতে পছন্দ করি না। এটি অনেক বিরক্তিকর।

রিচার্ড ফাইনম্যান; Image Source: izquotes.com

থমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭–১৯৪১)

বিখ্যাত উদ্ভাবক থমাস আলভা এডিসন মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকদিন কোমায় ছিলেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তিনি কোমার ঘুম থেকে উঠে পড়েন। পাশে বসে থাকা স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

ঐ জায়গাটা না অনেক সুন্দর।

এখানে ‘ঐ জায়গা’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়। এ সময় তার চোখ জানালার দিকে ছিল বলে ধারণা করা হয় যে, তিনি তার বাগানকে ইঙ্গিত করে কথাটি বলেছিলেন। আবার অনেকে ধারণা করেন, কোমায় হয়ত তিনি কোনো সুন্দর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। কথাটি বলেই তিনি চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়েন।

থমাস আলভা এডিসন ; Image Source: wikipedia

লুডভিগ ভন বিটোফেন (১৭৭০–১৮২৭)

বিখ্যাত জার্মান সুরকার ও পিয়ানিস্ট বিটোফেনের শেষ বাক্য নিয়ে বেশ তর্ক রয়েছে। কেউ কেউ স্বীকার করেন, জীবনের শেষ মুহূর্তে বধির হয়ে কাটানো এই সুরকারের শেষ উক্তি ছিল,

আমি স্বর্গে শুনতে পাবো।

আবার কারো কারো মতে, তার উক্তিটি ছিল,

হাততালি দাও বন্ধুগণ, কৌতুক এখানেই শেষ।

এছাড়াও কিছু লোকের ধারণা, শয্যাশায়ী বিটোফেনের কাছে একজন প্রকাশক ১২ বোতল ওয়াইন নিয়ে গিয়েছিলেন। এতগুলো ওয়াইন দেখে বিটোফেন বলে ওঠেন,

ইশ, অনেক দেরি হয়ে গেল।

লুডভিগ ভন বিটোফেন; Image Source: boredpanda.com

এলভিস প্রিসলি (১৯৩৫–১৯৭৭)

বিখ্যাত সঙ্গীত তারকা এলভিস প্রিসলি কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার কারণে মারা যান। তার হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকের তুলনায় বড় ছিল এবং তার মাদক সেবনের অভ্যাসও ছিল। একদিন তিনি বাথরুমে প্রবেশ করার সময় তার বাগদত্তা তাকে বলেন, তিনি যেন বাথরুমেই ঘুমিয়ে না পড়েন। ঠিক পরপরই বাথরুমেই সে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ বাক্য ছিল,

আমি বাথরুমে বই পড়তে ঢুকলাম।

এলভিস প্রিসলি; Image Source: bumppy.com

স্টিভ জবস (১৯৫৫–২০১১)

স্টিভ জবস পৃথিবীকে বিদায় পাঠানোর সময় তার সাথে ছিল তার স্ত্রী, সন্তানেরা এবং তার বোন। শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যার কারণে তিনি আগেই অজ্ঞান ছিলেন। বোন মোনা থমসনের মতে, স্টিভের ঠিকই জ্ঞান ফেরে এবং তিনি ছোট ছোট বোঝা যায় না এমন অর্থ উচ্চারণ করছিলেন। অবশেষে তিনি নিজ দৃষ্টি বোনের কাঁধের পাশ কাটিয়ে পেছন দিকে নিবদ্ধ করেন এবং বলে ওঠেন,

ওহ ওয়াও, ওহ ওয়াও, ওহ ওয়াও।

এরকম উদ্ভট আচরণ করার পর তিনি পুনরায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং সাত ঘণ্টা পর নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মারা যান। তার ঐ সময় ওভাবে বিস্ময় প্রকাশের কারণ আর জানা সম্ভব হয়নি।

স্টিভ জবস; Image Source: boredpanda.com

মাইকেল জ্যাকসন (১৯৫৮–২০০৯)

২০০৯ সালের ২৫ জুন মার্কিন পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের অকালমৃত্যুতে পুরো পৃথিবী শোক প্রকাশ করে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণে তার মৃত্যু হয়। লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য কনসার্টের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে তিনি মারা যান। প্রোপোফল নামক এক চেতনানাশক মাদক অতিরিক্ত সেবনের কারণেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মাইকেলের মৃত্যু নিয়ে তখন একটি তদন্ত কমিটি বসানো হয়েছিল এবং সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের দিকে।

মৃত্যুর আগে মাইকেলের উচ্চারিত শেষ উক্তি ছিল ‘More milk’, অর্থাৎ ‘আরো দুধ’। এখানে দুধ বলতে তিনি প্রোপোফলকে বুঝিয়েছিলেন।

মাইকেল জ্যাকসন; Image Source: viralscape.com

বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন (১৭০৬–১৭৯০)

বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পেছনে একেবারে শুরুর দিকের কারিগর ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন। তিনি ছিলেন একাধারে একজন লেখক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ। অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার কারণে তিনি নানা সময়ে নানা রোগে আক্রান্ত হতেন। তার মৃত্যু হয় ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে। মৃত্যুশয্যায় তার কন্যা তাকে বলেন, বিছানায় একপাশ ফিরে শোয়ার জন্য। দুর্বল বেঞ্জামিন তখন বিরক্ত হয়ে বলেন,

একজন মৃতপ্রায় ব্যক্তি কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারে না।

বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন; Image Source: britannica.com

শেষ কথা

অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন, যারা মৃত্যুর আগে তাদের শেষ বাক্যটিকেও অমর করে রেখে গিয়েছেন। এই লেখাটিতে এমনই কিছু মানুষের শেষ নিঃশ্বাস নিঃসৃত বাণী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, কিছু ছিল মৃত্যু সম্পর্কে একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি। আসলে মৃত্যু এমন একটি বিষয়, যা যেকোনো মানুষকে দার্শনিক করে ফেলে। জীবনের সকল হিসাব-নিকাশ, সুখ-দুঃখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে।

This article is about some famous quotes made by famous peope in their death bed. Necessary links have been hyperlinked within the article.

Multiple sources have been used to make a collage of the featured image: 

getwallpapers.com

wallpaperfare.com

resetstrategies.com

drawingwork.com

cnn.com

Related Articles

Exit mobile version