আজ থেকে ৬ বছর আগে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলের ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী প্রচারমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২০১৩–১৪ সালে ইউক্রেনে প্রচণ্ড সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দেখা দেয়, যেটিকে সমর্থকরা ‘ইউরোমাইদান’ বা ‘ইউরোমাইদান বিপ্লব’ হিসেবে এবং বিরোধীরা ‘পশ্চিমা–সমর্থিত অভ্যুত্থান’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে। এই বিপ্লব/অভ্যুত্থানের ফলে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ, যিনি ছিলেন তুলনামূলকভাবে রুশপন্থী, ক্ষমতাচ্যুত হন এবং রাশিয়ায় পালিয়ে যান। তার সরকারের স্থলে একটি তীব্র রুশবিরোধী ও পশ্চিমাপন্থী সরকার ক্ষমতা লাভ করে এবং ইউক্রেনে রুশ ভাষা নিষিদ্ধকরণসহ বিভিন্ন রুশবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০১৪ সালের মার্চে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয় এবং পূর্ব ইউক্রেনে রুশপন্থীরা ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখল ছিল ১৯৪৫ সালের পর মস্কোর প্রথম সরাসরি রাজ্য বিস্তার। স্বভাবতই এটি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় নতুন করে রুশভীতি সৃষ্টি করে। পশ্চিমা বিশ্ব এটি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং রাশিয়ার ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা এখনও বিদ্যমান। ইউক্রেন এবং বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র এখনো ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে দাবি করে। অন্যদিকে, রাশিয়া ক্রিমিয়াকে ‘ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র’ ও ‘সেভাস্তোপোল’ কেন্দ্রশাসিত শহর হিসেবে নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামোতে অঙ্গীভূত করে নিয়েছে। রুশদের মতে, ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত সরকার ‘অবৈধভাবে’ ক্রিমিয়াকে রাশিয়া থেকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করার আগ পর্যন্ত ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্গত ছিল এবং ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত দিক থেকে ক্রিমিয়া ‘রুশ ভূমি’।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, সোভিয়েত সরকার কেন ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়া থেকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর বোঝার আগে ক্রিমিয়ার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জেনে নেয়া দরকার।
ভৌগোলিকভাবে ক্রিমিয়া মূলত প্রায় ২৭,০০০ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট একটি উপদ্বীপ, যেটি পূর্ব ইউরোপে কৃষ্ণসাগরের উত্তর উপকূলে অবস্থিত। ক্রিমিয়া প্রায় সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণসাগর ও আজভ সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। ক্রিমিয়া বর্তমান ইউক্রেনের খেরসন প্রদেশের দক্ষিণে অবস্থিত এবং পেরেকোপ ইস্থমাস দ্বারা খেরসনের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে, ক্রিমিয়া বর্তমান রাশিয়ার কুবান অঞ্চলের পশ্চিমে অবস্থিত এবং কের্চ প্রণালী দ্বারা অঞ্চলটি থেকে বিভক্ত, যদিও ২০১৮ সালে নির্মিত ক্রিমিয়ান সেতু ক্রিমিয়াকে কুবানের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। কৃষ্ণসাগর ক্রিমিয়াকে পশ্চিমে রুমানিয়া এবং দক্ষিণে তুরস্ক থেকে পৃথক করেছে।
ক্রিমিয়ায় বহু আগে থেকে মানুষের বসবাস। ১৪৪১ সালে বৃহত্তর তুর্কি জাতির অন্তর্গত জাতিগত তাতাররা ক্রিমিয়ায় বসতি স্থাপন করে এবং চেঙ্গিস খানের একজন বংশধরের নেতৃত্বে ‘ক্রিমিয়ান খানাত’ প্রতিষ্ঠা করে। ১৪৭৫ সালে খানাতটি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে রাষ্ট্রটির যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল। ১৭৬৮–৭৪ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধের পর রাষ্ট্রটি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু কার্যত রুশ সাম্রাজ্যের আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৭৮৩ সালে রাশিয়া সরাসরি ক্রিমিয়া দখল করে নেয় এবং তখন থেকে অঞ্চলটি রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকরা ক্রিমিয়ার তাতারদেরকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে এবং ১৯২১ সালে ক্রিমিয়ায় ‘ক্রিমিয়ান স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্রটিকে ‘রুশ সোভিয়েত ফেডারেল সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে’র অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ক্রিমিয়ার তাতারদের একাংশ জার্মান আক্রমণকারীদের সহায়তা করে এবং এর শাস্তিস্বরূপ সোভিয়েত সরকার ১৯৪৪ সালে ক্রিমিয়ার তাতারদের মধ্য এশিয়া ও সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে। ক্রিমিয়ার নাম পরিবর্তন করে ‘ক্রিমিয়ান প্রদেশ’ রাখা হয় এবং এটিও রুশ প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কিন্তু ১৯৫৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট দলের প্রেসিডিয়াম ক্রিমিয়াকে রুশ প্রজাতন্ত্রের কাছ থেকে ‘ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে’ হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত আইনসভা সুপ্রিম সোভিয়েতের প্রেসিডিয়াম এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে এবং ক্রিমিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়া থেকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হয়। এসময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলের মহাসচিব ছিলেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের নিকট হস্তান্তর করার সিদ্ধান্তটি ছিল তার ব্যক্তিগত। সোভিয়েত সরকারের এই সিদ্ধান্তটি আইনসঙ্গত ছিল কিনা সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ, সোভিয়েত সংবিধান অনুযায়ী কোনো ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রের সীমানার পরিবর্তন করার আগে প্রজাতন্ত্রটির অনুমোদন নেয়া প্রয়োজন, যেটি এক্ষেত্রে নেয়া হয়নি। তদুপরি, ক্রিমিয়াকে হস্তান্তর করার আগে অঞ্চলটির অধিবাসীদের মতামতও নেয়া হয়নি।
এমতাবস্থায় ঠিক কী কারণে সোভিয়েত সরকার ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটি স্পষ্ট নয়, যদিও ইতিহাসবিদরা এই সিদ্ধান্তের পশ্চাতে বিভিন্ন ধরনের কারণ তুলে ধরেছেন।
প্রথমত, সোভিয়েত সরকার ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করার পর সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলের পত্রিকা ‘প্রাভদা’য় এই সিদ্ধান্তের পিছনে ৩টি কারণ ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে একটি কারণ ছিল ‘ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনের অর্থনীতি পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত’ হওয়া। কিন্তু বস্তুত ক্রিমিয়ার অর্থনীতি রাশিয়া বা ইউক্রেন কোনো প্রজাতন্ত্রের সঙ্গেই সংযুক্ত বা অঙ্গীভূত ছিল না। সোভিয়েত শাসনামলে ক্রিমিয়ার অর্থনীতি ছিল মূলত পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল অংশ থেকে মানুষ ক্রিমিয়ায় বেড়াতে আসত। এজন্য ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের নিকট হস্তান্তরের কোনো জোরালো ‘অর্থনৈতিক যুক্তি’ ছিল না।
দ্বিতীয়ত, ‘প্রাভদা’য় উল্লিখিত ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছ হস্তান্তরের আরেকটি কারণ ছিল ‘ইউক্রেন ও ক্রিমিয়ার ভৌগোলিক নৈকট্য’। কিন্তু বস্তুত ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপটি একদিকে যেমন ইউক্রেনের সন্নিকটে, অন্যদিকে তেমনি রাশিয়ারও সন্নিকটে। সুতরাং এই যুক্তিটিও যথার্থ বলে প্রতিপন্ন হয় না।
তৃতীয়ত, ‘প্রাভদা’য় উল্লিখিত ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তরের তৃতীয় কারণটি ছিল ‘ইউক্রেনের সঙ্গে ক্রিমিয়ার সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য’। এই যুক্তিটিও অত্যন্ত দুর্বল, কারণ ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৭৫% ছিল জাতিগত রুশ, আর প্রায় ২৫% ছিল জাতিগত ইউক্রেনীয়৷ অর্থাৎ, ‘সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যে’র দিক থেকে ক্রিমিয়া ছিল ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়ার অনেক বেশি নিকটবর্তী।
চতুর্থত, অনেকের ধারণা, ইউক্রেনের রুশ সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্তির ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে ‘উপহার’ হিসেবে সমর্পণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৬৫৪ সালের জানুয়ারিতে ইউক্রেনের কসাকরা পোলিশ–লিথুয়ানীয়দের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাশিয়ার জার আলেক্সেইয়ের কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করেছিল এবং এসময় রাশিয়া ও ইউক্রেনীয় কসাকদের মধ্যে ‘পেরিয়াস্লাভ চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ইউক্রেনীয় কসাকরা রাশিয়ার জারের আনুগত্য স্বীকার করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৪ সালে পেরিয়াস্লাভ চুক্তির ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন বলে ধরে নেয়া হয়।
কিন্তু এই ব্যাখ্যাটিকেও পুরোপুরি সঠিক হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কারণ, ক্রুশ্চেভ বা অন্য কোনো সোভিয়েত নেতা কখনো এই ব্যাখ্যা প্রদান করেন নি। তাছাড়া, ইউক্রেনের সঙ্গে ক্রিমিয়ার সরাসরি কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং ইউক্রেন রুশ সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আরো প্রায় ১৩০ বছর পর ক্রিমিয়া রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এজন্য রুশ ও ইউক্রেনীয় জাতিদ্বয়ের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অন্য কোনো অঞ্চলকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর না করে ক্রিমিয়াকেই কেন হস্তান্তর করা হলো, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
পঞ্চমত, ক্রুশ্চেভের প্রপৌত্রী নিনা ক্রুশ্চেভার মতে, ক্রুশ্চেভ ইউক্রেনকে খুবই পছন্দ করতেন এবং ইউক্রেনের প্রতি তাঁর আকর্ষণের ‘স্মারক’ হিসেবে তিনি ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। তদুপরি, ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণে আগ্রহী ছিলেন এবং ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করা ছিল এই লক্ষ্যে গৃহীত একটি পদক্ষেপ। উল্লেখ্য, ক্রুশেভ ছিলেন জাতিগতভাবে রুশ, কিন্তু তাঁর কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছিল ইউক্রেনে এবং তাই ইউক্রেনের প্রতি তাঁর টান থাকা অস্বাভাবিক নয়।
ষষ্ঠত, অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে ক্রুশ্চেভের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল। ১৯৫৩–৫৫ সালে ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী গিওর্গি মালেনকভের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন এবং এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিজয়ী হওয়ার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলোর নেতৃবৃন্দের সমর্থন লাভের চেষ্টা করছিলেন। ইউক্রেন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রজাতন্ত্র এবং এই প্রজাতন্ত্রটির নেতৃবৃন্দের সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে তাদেরকে তুষ্ট করার জন্য ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
সর্বোপরি, কিছু কিছু বিশ্লেষকের মতে, ইউক্রেনীয় কমিউনিস্ট নেতাদের সমর্থন লাভের পাশাপাশি ইউক্রেনকে সোভিয়েত রাষ্ট্রের সঙ্গে সুদৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করাও ছিল ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে ক্রুশ্চেভের উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিম ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পশ্চিম ইউক্রেনকেন্দ্রিক ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই যুদ্ধে হাজার হাজার সোভিয়েত সৈন্য ও ইউক্রেনীয় বিদ্রোহী প্রাণ হারিয়েছিল। এজন্য ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করে (এবং এর মাধ্যমে ইউক্রেনীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের আয়তন বৃদ্ধি করে) ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন।
এছাড়া, সেসময় ইউক্রেনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাতিগত রুশ বসবাস করত এবং ক্রিমিয়া ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় আরো প্রায় ১০ লক্ষ রুশ ইউক্রেনের অধিবাসীতে পরিণত হয়। বিশ্লেষকদের ধারণা, এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত সরকার ইউক্রেনের ওপর সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তিশালী করতে চেয়েছিল।
সোভিয়েত সরকারের উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়াকে যখন রাশিয়া থেকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল, তখন রুশ বা ইউক্রেনীয় জনসাধারণ এ নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করেনি। কারণ তখন রাশিয়া ও ইউক্রেন ছিল একই দেশের অংশ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যে পরবর্তীতে ভেঙে যাবে এই ধারণা তখন কেউই করতে পারেনি। এজন্য সেসময় এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি আলোচিত হয়নি বললেই চলে।
কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে এবং ক্রিমিয়া নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত রুশ–ইউক্রেনীয় চুক্তির ফলে এই বিরোধ সাময়িকভাবে দৃষ্টির আড়ালে চলে গিয়েছিল, কিন্তু ২০১৩–১৪ সালের ইউক্রেনীয় সঙ্কটের ফলে এই বিরোধ আবার প্রকাশ্যে চলে আসে এবং রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়ার ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তির ৬০ বছর পর ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া আবার রাশিয়ার ‘অবিচ্ছেদ্য অংশে’ পরিণত হয়।