লেপান্টোর যুদ্ধ: ভূমধ্যসাগরে মুখোমুখি উসমানী ও ইউরোপীয় নৌবাহিনী

অক্টোবর ৭, ১৫৭১; ভূমধ্যসাগরের মৃদুমন্দ বাতাসে ভাসছে আসন্ন উত্তেজনার গন্ধ। নিজের জাহাজ থেকে শত্রুবাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন উসমানী নৌবাহিনীর সেনাপতি আলি পাশা (Müezzinzade Ali Pasha)। প্রতিপক্ষ অস্ট্রিয়ার ডন জুয়ান ইতোমধ্যে সাজিয়ে ফেলেছেন বাহিনী, খুব শীঘ্রই শুরু হবে যুদ্ধ। কামানের গর্জন আর আহতদের আর্তনাদ শুনবার প্রতীক্ষায় কান পেতে আছে চরাচর। তখনও কেউ জানে না, তবে লেপান্টো হতে যাচ্ছে নৌ-ইতিহাসে দাঁড়টানা জাহাজের মধ্যে সর্বশেষ বৃহৎ সংঘর্ষ।  

আলি পাশা ইঙ্গিত দিতেই ছপাৎ করে পানিতে পড়লো সমস্ত দাঁড়, পতাকা উড়িয়ে সারি সারি জাহাজ রওনা দিল শত্রুর দিকে। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান উসমানী নৌবাহিনী, ১৫৩৮ সালে খাইরুদ্দিন বারবারোসার হাতে প্রেভেজায় ইউরোপীয়রা নাকাল হবার পর থেকে ভূমধ্যসাগর তো আদতে ‘উসমানী লেকে’ পরিণত হয়েছে। ইউরোপীয়রা ব্যর্থ হয়েছে বড় কোনো নৌযুদ্ধে জয়ী হতে। আজ কি সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হবে?

পটভূমি

ষোড়শ শতককে বলা যায় উসমানী সালতানাতের স্বর্ণযুগ। জল-স্থলে তাদের প্রতাপে কাঁপছে ইউরোপীয় সব শক্তি।সুলতান দ্বিতীয় সেলিম তার পিতা সুলাইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের পথ অনুসরণ করে সাম্রাজ্য বিস্তারে ব্যস্ত। তার নিশানায় ভেনিসের শাসনাধীন সাইপ্রাস দ্বীপ। ১৫৭০ সালে তার আদেশে প্রায় চারশো জাহাজে এক লাখের বেশি লোক নিয়ে রওনা দিল সেদিকে, আরম্ভ হলো চতুর্থ উসমানী-ভেনেশিয়ান যুদ্ধ।  

সাইপ্রাসকে কেন্দ্র করে শুরু হয় চতুর্থ উসমানী-ভেনেশিয়ান যুদ্ধ; Image Source: mappr.co

কোণঠাসা ভেনিস সামরিক সাহায্যের আবেদন জানালো পোপ পঞ্চম পায়াসের কাছে। পাঁচ বছর ধরে তিনি চেষ্টা করছিলেন তুর্কিদের বিরুদ্ধে রোমান ক্যাথলিক জোট গঠন করতে, কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মাঝে বিরাজমান বিবাদ তাকে সফল হতে দিচ্ছিল না। এবার তিনি আটঘাট বেধে নামলেন।

দ্য হলি লীগ

পায়াসের ক্যাথলিক পরাশক্তি ও হাবসবুর্গ শাসিত স্পেনকে নিয়ে জোট করা হলো। ইতালির দখল নিয়ে ভেনিসের সাথে তাদের মধ্যে উত্তেজনা আছে, ফলে যথেষ্ট কাঠখড় পুড়িয়ে দু’পক্ষকে এক বিন্দুতে আনতে হলো। শেষ পর্যন্ত জোটে পোপের নিজস্ব বাহিনীর সাথে অন্তর্ভুক্ত হলো ভেনিস, স্পেন, জেনোয়া, স্যাভোয় আর আর্বিনো ডাচি, টাস্কানির গ্র্যান্ড ডাচি আর মাল্টার অর্ডার অব সেইন্ট জনের নাইটবাহিনী। গঠিত হলো হলি লীগ। স্পেনের রাজা ফিলিপের সৎ ভাই ডন জন অব অস্ট্রিয়া (John of Austria) হলেন সর্বাধিনায়ক।

ইটালির মেসিনাতে ডন জনের মূর্তি; Image Source: encirclephotos.com

পোপ যখন লীগ গড়তে দৌড়ঝাঁপ করছেন, ততদিনে সেলিমের সৈন্যরা রাজধানী নিকোসিয়াসহ বেশ কিছু ভেনেশিয়ান দুর্গ ধ্বংস করে দিয়েছে। ১৫৭০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে অবরোধ করা হয়েছে সাইপ্রাসের ভেনিসের শেষ ঘাঁটি ফামাগুস্তা (Famagusta)। প্রায় এক বছর পর আগস্টে এর পতন হয়, ততদিনে উসমানী নৌবাহিনী প্রবেশ করেছে অ্যাড্রিয়াটিকে।

শক্তির বিচার

হলি লীগের জাহাজ জড়ো হয় সিসিলির মেসিনাতে। এখানে ১৫৭১ সালের ২৪ আগস্ট অবধি তাদের অপেক্ষা করতে হয় স্প্যানিশ বহরের জন্য। সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখ সম্মিলিত বহর চললো কর্ফু দ্বীপের উদ্দেশ্যে। ততদিনে ফামাগুস্তার পরাজয়ের সংবাদ এসে পৌঁছেছে, খবর এসেছে আলি পাশার নেতৃত্বে তুর্কি জাহাজ নোঙ্গর করে আছে পাত্রাইকোস উপসাগরে, গ্রীসের লেপান্টোর (বর্তমান Návpaktos) কাছে।

ডন জনের হাতে সব মিলিয়ে ২১১টি গ্যালি জাতীয় জাহাজ, যার ৬টি বড় গ্যালি। নাবিক আর সৈন্য মিলিয়ে প্রায় সত্তর হাজার লোক তার, কামানের সংখ্যা প্রায় দু’হাজার। আলি পাশার নিয়ন্ত্রণে ২৫৫টির মতো গ্যালি, যার ৪৫টি ছোট গ্যালি বা গ্যালিয়ট (Galliot)। লোকলস্কর প্রায় ৮০,০০০ হলেও কামান মাত্র ৭৫০টি। উসমানী নৌবাহিনীর শৃঙ্খলাও ইউরোপীয়দের মতো অতটা শক্ত নয়।  

গ্যালি; Image Source: sketchfab.com

রণকৌশল

আলি পাশার পরিকল্পনা ছিল নিজে ৯৫টি জাহাজ নিয়ে মজবুত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলা। দুই বাহুতে থাকা গ্যালি নেবে আক্রমণাত্মক ভূমিকা। ষাট-সত্তরটি জাহাজ রাখা থাকবে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে।

ডন জন তার কামানের সংখ্যাধিক্যের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তিনি চান ভারী গ্যালি ও অন্যান্য জাহাজ দিয়ে আলি পাশার ব্যূহ গুঁড়িয়ে দিতে। প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকাতে দু’পাশে রাখা হবে পর্যাপ্ত সংখ্যক জাহাজ, সংরক্ষিত বাহিনী হিসেবে তার পেছনে থাকবে ৩০টি গ্যালি এবং দু’পাশে চার চার করে আটটি।  

লড়াই

অক্টোবরে যুদ্ধের আদেশ পেয়ে প্রস্তুত হলেন ডন জন। ৭ তারিখে মুখোমুখি হলো দুই বাহিনী। চার স্কোয়াড্রনে ভাগ হয়ে অগ্রসর হলো হলি লীগ। ডন জুয়ান মধ্যে, বামে ভেনেশিয়ান সেনাপতি বারবারিগো (Agostino Barbarigo), ডানে স্প্যানিশ অ্যাডমিরাল জিওভান্নি আন্দ্রিয়া ডোরিয়া, এবং রিজার্ভে তার সতীর্থ আলভারো ডি বাজান (Álvaro de Bazán, marqués de Santa Cruz)।

আলি পাশা প্রথমে অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে বহর সাজালেও জনের রণকৌশল বুঝে নিজেকেও একইভাবে সাজিয়ে নেন। তিনি থেকে যান লীগের সর্বাধিনায়কের মোকাবেলা করতে, ডানে জায়গা দেন আলেক্সান্দ্রিয়ার গভর্নর শৌলাককে (Mohammed Saulak)। আলজিয়ার্সের পাশা, উলুখ আলি গেলেন বামে।  

বারবারিগো আর শৌলাকের মধ্যে প্রথম শুরু হলো গোলাবর্ষণ। উসমানী জাহাজের আঘাতে টালমাটাল হয়ে পড়লো লীগের বাম বাহু, মারা পড়লেন বারবারিগো ও তার সহকারী কন্তারিনি। অবস্থা সঙ্গিন দেখে সক্রিয় হলেন বাজান, তার পাঠানো অতিরিক্ত জাহাজ সংঘর্ষে যোগ দিলে মোড় ঘুরে যায় লড়াইয়ের। তুর্কি বহর তীর এবং শত্রুজাহাজের মাঝে ফেঁসে যায়, নিহত হন শৌলাক। নেতার অভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আলি পাশার ডানবাহু, বেশ কয়েকটি জাহাজ তীরে উঠিয়ে পালিয়ে যায় বেঁচে থাকা উসমানি সেনারা।

শুরু হলো ব্যাটল অব লেপান্টো; Image Source: dailysabah.com

ওদিকে, মধ্যভাগে জন আর আলি পাশা লিপ্ত মরণপণ সংঘর্ষে। মুহুর্মুহু গোলায় পরস্পরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। আলি পাশা সরাসরি নিজের পতাকাবাহী জাহাজ সুলতানা দিয়ে ধাক্কা লাগিয়ে বসেছেন ডন জুয়ানের রিয়ালে। আটকে যাওয়া দুই জাহাজের ডেকে চলছে হাতাহাতি। তাদের চারপাশে রণক্ষেত্র পরিণত হয়েছে নরকে।   

আলি পাশার জাহাজ সরাসরি ধাক্কা মেরেছে জনের জাহাজে; Image Source: historyextra.com

আবারো বাজান হস্তক্ষেপ করলেন, তার পাঠানো সংরক্ষিত জাহাজ জনের হাত শক্তিশালী করলো। কিন্তু তারপরেও আলি পাশার বহর জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। তবে তাদের সাহসিকতায় চিড় ধরলো যখন উসমানি কমান্ডার নিহত হন। সুলতানা দখল করে টেনে নিয়ে যান জন। এরপর ধসে পড়ে উসমানি বহরের মধ্যভাগ।

হলি লীগের ডানপাশের পরিস্থিতি কিন্তু পুরো উল্টো। উলুখ আলি সংরক্ষিত শক্তি দিয়ে কাবু করে ফেলছেন ডোরিয়াকে। তার সাথে সমান সমান লড়াই করতে গিয়ে ডোরিয়া সরে গেছেন খোলা সাগরের দিকে, ফলে জুয়ানের জমাট ব্যুহের মাঝে তৈরি হয়েছে ফাঁক। উসমানি সেনাপতি সুযোগ বুঝে কোপ মারতে যাচ্ছেন, তিনি সফল হলে জয়ের পাল্লা হেলে পড়বে উসমানি পক্ষে। আলির জাহাজ দ্রুত এগিয়ে এলো, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ইউরোপিয়ান গ্যালি পরিণত হলো তার শিকারে। তিনি এবার নিশানা করলেন জুয়ানের মধ্যভাগে।  

তবে মাল্টার নাইটদের বহর প্রাণপণে ঠেকিয়ে রাখলো তাকে। বাজান নিজে এগিয়ে এলেন তাদের সাহায্যে। প্রচুর রক্তক্ষয়ের পর পিছু হটলেন আলজিয়ার্সের পাশা, নিরাপদে বের করে নিয়ে গেলেন নিজের বহর। দু’পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৮,০০০। তবে জয়ী হয় হলি লীগ। তুর্কিদের প্রায় শ-খানেক গ্যালি দখল করে নেয় তারা, ধ্বংস করে দেয় আরো ৫০টি। তাদের ক্ষয়ক্ষতি ছিলো মাত্র ১২টি গ্যালি।

প্রভাব

উসমানি নৌবাহিনীর বিপক্ষে ইউরোপীয়দের প্রথম বড় বিজয় ছিল লেপান্টো। স্বভাবতই পোপ এবং ক্যাথলিক রাজারা একে বিশাল এক জয় বলে প্রোপাগান্ডা চালান। তবে সামরিক দিক থেকে এই বিজয় খুব বেশি গুরুত্ববহ ছিল না, কারণ এর সুফল নিতে ব্যর্থ হয় হলি লীগ। লেপান্টোর পর যদি তারা অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতো, তাহলে সম্ভব ছিলো উসমানি নৌশক্তি চূড়ান্তভাবে দুর্বল করে দেয়ার, কিন্তু নিজেদের ঝগড়ার কারণে যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় তারা। ফলে অব্যাহত থাকে উসমানীয় সাম্রাজ্যবিস্তার।

সুলতান সেলিম ও তার প্রধান উজির মেহমেদ পাশা (Sokollu Mehmed Pasha) লেপান্টোর পরাজয়কে গুরুত্ব দিতে রাজি হননি। পরবর্তীতে উসমানি সেনাদের সাইপ্রাস দখল তাদের কথাই প্রমাণ করে। ভেনেশিয়ান দূতের কাছে মেহমেদ পাশা বলেন, “লেপান্টোর পরাজয় আমাদের দাড়ি কামানোর মতো, কিন্তু সাইপ্রাস কেড়ে নিয়ে আমরা তোমাদের একটা বাহু কেটে ফেলেছি। দাড়ি আবার গজাবে, কিন্তু বাহু আর নতুন তৈরি হবে না।”

প্রধান উজির মেহমেদ পাশা; Image Source:  turkisharchaeonews.net

মেহমেদ পাশার কথা সত্য প্রমাণ করে পরাজয়ের মাত্র ছয় মাসের ভেতর নতুন করে নৌবাহিনী পুনর্গঠন করে তুর্কিরা। প্রায় ২৫০টি নতুন জাহাজ পানিতে নামায় তারা, যার আটটি তৎকালীন ভূমধ্যসাগরে দেখতে পাওয়া সর্ববৃহৎ জাহাজ।

পরবর্তীকালে তুর্কি ইতিহাসবিদেরা অবশ্য লেপান্টোর লড়াইকে গুরুত্ব দিয়েছেন, কারণ উসমানী নৌবাহিনীর এটাই প্রথম বড় পরাজয়। এর মাধ্যমে ভুমধ্যসাগরের পশ্চিম অংশে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপীয় আধিপত্য। তাছাড়া, তুর্কিদের হারানো সম্ভব, এই আত্মবিশ্বাস তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে লেপান্টোই। এর ফলে উসমানীয় অগ্রযাত্রা বন্ধ না হলেও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে, ধীরে ধীরে শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে তাদের প্রতিপক্ষ।

This is a Bengali language article about the battle of Lepanto. Necessary references are mentioned below.
1. Battle of Lepanto. Encyclopedia Britannica.
2. Angus Konstam. Lepanto 1571. The greatest naval battle of the Renaissance. Osprey Publishing Ltd., Oxford, 2003.
3. Hess, A. C. (1972). The Battle of Lepanto and Its Place in Mediterranean History. Past & Present No. 57, pp. 53-73. Oxford University Press.

Feature Image: washingtontimes.com

Related Articles

Exit mobile version