আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কো, সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবি আর রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের উচ্চপদস্থ এক বহিষ্কৃত গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ১৯৯৮ সালে ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কপালে জুটেছিলো এই বহিষ্কার। পুতিন তখন সেই ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের প্রধানের পদে। রাশিয়াতে ধীরে ধীরে ক্ষমতাশালী হতে থাকা এই ব্যক্তির সাথে লড়াই করে সেখানে বেঁচে থাকা লিটভিনেঙ্কোর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
তাই ২০০০ সালের অক্টোবরে পরিবারসহ পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। এয়ারপোর্টে নেমেই তার গোয়েন্দা পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন,
“I am KGB officer and I’m asking for political asylum.”
যুক্তরাজ্য এই সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করেনি। তাকে এনং তার পরিবারকে প্রথমে রাজনৈতিক আশ্রয় পরে নাগরিকত্বও দেওয়া হয়।
আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কো অনেকটা প্রকাশ্যেই ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্স (MI6) এর সাথে কাজ শুরু করেন।
এডউইন রেডওয়াল্ড কার্টার ছদ্মনামে আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কো তখন রাশিয়ান মাফিয়াদের সাথে স্প্যানিশদের যোগাযোগের ব্যাপারটি উদঘাটনের চেষ্টা করছিলেন। মূলত রাশিয়ান এই গোয়েন্দা সংগঠিত অপরাধের কারণ খুঁজে বের করায় বেশ দক্ষ ছিলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের হয়ে কাজ শুরু করায় রাশিয়ানদের কাছে অনেকটা পথের কাটায় পরিণত হয়েছিলেন লিটভিনেঙ্কো।
এককালে কেজিবি এবং তার পরবর্তীতে এফএসবিতে উচ্চপদস্থ এই গোয়েন্দার এই দলত্যাগের ব্যাপারে রাশিয়া যে মোটেও খুশি হয়নি সেটিই স্বাভাবিক। আর রাশিয়ার ক্ষমতায় ততদিনে ভ্লাদিমির পুতিন, যার সাথে আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কোর মূল দ্বন্দ্ব। পুতিন যে তার শত্রুদের নির্মূল করতে কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তা বোঝা যায় ২০০৬ সালেই। আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কোর দীর্ঘদিনের পরিচিত সাংবাদিক এবং পুতিনের কর্মকান্ডের সমালোচক আন্না পলিটকোভস্কায়া সেই বছর লন্ডনে তার সাথে দেখা করার জন্য এসেছিলেন। সেখানে অন্য অনেক আলোচনার পাশাপাশি আন্না তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন লিটভিনেঙ্কোর কাছে। তার আশঙ্কাকে সত্যি করে দিয়ে ২০০৬ সালের অক্টোবরে মস্কোতে তার বাসার কাছেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় তিনি বেশ উদ্বিগ্নও হয়েছিলেন। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তার দিকেও ঘনিয়ে আসছে কোনো দুর্যোগ।
২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর, দুই রাশিয়ান অতিথি মস্কো থেকে পৌঁছালেন লন্ডনে। তারা সাথে করে নিয়ে আসলেন এমন এক দ্রব্য যেটি লন্ডনের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ধরতেই পারলো না। কোনো ড্রাগ কিংবা বিষাক্ত কোনো রাসায়নিকও নয়, এমন এক জিনিস যেটি হয়তো ব্রিটিশ কাস্টমসের ধারণার বাইরেই ছিলো। আন্দ্রে লুগোভই আর দিমিত্রি কভতুন নামের দুই রাশিয়ান গোয়েন্দা তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন পোলোনিয়াম নামের একধরনের তেজস্ক্রিয় ধাতব আইসোটোপ।
এই পোলোনিয়ামের আইসোটোপ হাইড্রোজেন সায়ানাইড নামক মারাত্মক রাসায়নিক বিষের চেয়ে কম করে হলেও একশত বিলিয়ন গুণ বেশি বিষাক্ত। উপযুক্ত পাত্রের অভ্যন্তরে পোলোনিয়ামের এই আইসোটোপ মোটামুটি নিরাপদ, তবে একবার পাত্র খুললেই এর তেজস্ক্রিয়তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাই এর বহনকারী কিংবা আশেপাশের মানুষের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকগুণে বেশি। আর কোনোকিছুর সাথে এই আইসোটোপ খেয়ে ফেললে সেই মানুষটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
যেহেতু এয়ারপোর্ট কিংবা অন্যান্য স্থানে এই তেজস্ক্রিয় বিষ শনাক্ত করা খুব কঠিন, তাই রাশিয়া আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কোকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে এই বিষের শরণাপন্ন হয়। তবে এই বিষের পান থেকে চুন খসলেই যে বহণকারীর জন্য যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু বয়ে আনতে পারে এবং ভালোভাবে বহন না করলে যে তেজস্ক্রিয়তা মেপে পরবর্তীতে শনাক্ত করা যাবে মস্কো কর্তৃপক্ষ এই বিষয়টি তাদের কাছে খোলাসা করেনি। অন্তত ব্রিটেন পৌঁছে তারা যা করলেন তা থেকে তা-ই প্রমাণিত হয়। তারা সর্বত্রই নিজেদের তেজস্ক্রিয়তার ছাপ রেখে যেতে লাগলেন।
গ্যাটউইক এয়ারপোর্ট থেকেই আন্দ্রে লুগোভই আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কোর সাথে তার মিটিং ঠিকঠাক করে নিলেন। আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কোর সাথে ব্যবসায়িক ব্যাপারে আলোচনা করার আগ্রহ জানালেন ব্যবসায়ী ছদ্মবেশী এই রাশিয়ান গোয়েন্দা। লিটভিনেঙ্কোর মনে হয়েছিলো, আর দশজন সাধারণ রাশিয়ান ব্যবসায়ীর মতই কেউ একজন হবেন এই আন্দ্রে লুগোভই। গ্রসভেনর স্ট্রিটের অফিসে সে ব্যবসায়িক সাক্ষাৎ যে ধূর্ত এক গোয়েন্দা চাল, তা হয়তো আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কো ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেননি।
১৬ তারিখ বিকাল তিনটায় আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কোর সাথে দেখা করতে গ্রসভেনর স্ট্রিটের অফিসে গেলেন লুগোভই আর কভতুন। লুগোভই ইচ্ছাকৃতভাবেই আলোচনার মোড় চা, কফি কিংবা অন্য কোনো পানীয়ের দিকে নিয়ে গেলেন। লিটভিনেঙ্কোর অফিসের কর্মচারী তিন কাপ চা দিয়ে গেলেন। আলোচনার কোনো একসময় সুচতুরভাবে লিটভিনেঙ্কোর কাপে কভতুন পোলোনিয়াম মিশিয়ে দিলেন। কিন্তু লিটভিনেঙ্কোর ভাগ্য এই যাত্রায় তার সহায় হয়েছিলো।
লিটভিনেঙ্কো সেই কাপটি ছুঁয়েও দেখেননি। তবে কাপে মিশিয়ে দেওয়া পোলোনিয়াম থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিলো তিনজনের শরীরেই। তারা যেখানেই গেছেন সেখানে তারা তেজস্ক্রিয়তার চিহ্ন রেখে গেছেন।
তবে তেজস্ক্রিয় পোলোনিয়ামের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকায় লিটভিনেঙ্কোর ক্ষতি হয়েছিলো একটু বেশি। বাসায় ফিরে অসুস্থতা অনুভব করছিলেন তিনি। বেশ কয়েকবার বমিও করেছিলেন অন্যদিকে লুগোভই আর কভতুনের হোটেলরুমেও পাওয়া গেছে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার প্রমাণ।
প্রথম যাত্রায় ব্যর্থ হয়ে লুগোভই ফিরে গেলেন রাশিয়ায়, নতুন করে পোলোনিয়াম নিয়ে আসার জন্য ২৫ অক্টোবর ব্রিটিশ এয়াওয়েজের ফ্লাইট-৮৭৫ এ রওনা দিলেন মস্কোর দিকে। মস্কো থেকে পোলোনিয়াম নিয়ে ফিরে আবারো লিটভিনেঙ্কোর সাথে দেখার করার ব্যবস্থা করে ফেললেন লুগোভই।
প্রথমবার সফল না হলেও দ্বিতীয়বার আবারো চেষ্টা চালায় লুগোভই আর কভতুন। নভেম্বরের ১ তারিখ মিলেনিয়াম হোটেলে দেখা করার জন্য মিলিত হয়েছিলেন তিনজন। সেখানে খুবই সুচতুরভাবে লুগোভই লিটভিনেঙ্কোর কাপে আবারো পোলোনিয়াম মিশিয়ে দিলেন। লিটভিনেঙ্কো সেই কাপ থেকে ২-৩ চুমুকের মতো চা পান করেছিলেন।
চা পান করে বাসায় পৌঁছেই অসুস্থ হয়ে পড়েন লিটভিনেঙ্কো। ক্রমান্বয়ে বমি হতে থাকে, তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে। লিটভিনেঙ্কো ও তার পরিবারের সদস্যরা শুরু থেকেই সন্দেহ করেছিলে যে তাকে হয়তো বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। তাই দেরি না করে তাকে ভর্তি করা হয়েছিলো হাসপাতালে। তবে ডাক্তাররা তার অসুখের ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। দুই সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা একদল ডাক্তার বুঝতে পারলেন তার উপসর্গগুলো একটু যেন পরিচিত মনে হচ্ছে। লিউকোমিয়া আক্রান্ত রোগীকে রেডিওথেরাপি অর্থাৎ তেজক্রিয় বিকিরণ দিয়ে চিকিৎসা করার পরে তার শরীরে যে ধরনের উপসর্গ দেখা যায় তার সাথে লিটভিনেঙ্কো যেন কোথায় মিল আছে। কিন্তু লিটভিনেঙ্কোকে তো সেইরকম কোনো থেরাপি দেওয়া হয়নি।
ইতোমধ্যে লিটভিনেঙ্কোকে বিষ প্রয়োগের ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছিল বিখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। তারাও এই ঘটনার কূলকিনারা করতে বেশ হিমশিম খাচ্ছিলেন। কারণ কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ কিছুই নেই যা দিয়ে আন্দ্রে লুগোভই আর দিমিত্রি কভতুনকে লিটভিনেঙ্কোর অবস্থার জন্য দায়ী করা যাবে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের সূত্র যাচাই বাছাই করে রহস্য সমাধানের কাজ করে যাচ্ছিলো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দক্ষ এজেন্টরা। কিন্তু আসলে কোন ধরনের বিষ দিয়ে লিটভিনেঙ্কোকে মারার চেষ্টা করে হয়েছিলো সেই ব্যাপারে কারোই কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিলোনা। তাই লিটভিনেঙ্কো নিজেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তদন্ত শুরু করলেন। তার নিজের ডাক্তারি রিপোর্ট দেখে আর বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে তিনি নিজেই খুঁজে বার করলেন যে তাকে তেজস্ক্রিয় কোনো ধাতুর বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদের জন্য তিনি একটি নোট রেখে গিয়েছিলেন। যেখানে আন্দ্রে লুগোভই আর দিমিত্রি কভতুন গিয়েছে সেখানের সম্ভাব্য সকল জায়গায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পরীক্ষা করা। পাশাপাশি আরো অনেক ব্যাপারে তিনি গোয়েন্দাদের সহায়তা করতে থাকেন।
নভেম্বরের ২০ তারিখের দিকে তার শরীরের অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। হার্ট রেটে গড়মিল দেখা যায়, অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ঠিকঠাক কাজ বন্ধ করে দেওয়া শুরু করে। ২৩ তারিখ রাতে তিনি যখন মারা গেলেন তার মাত্র ছয় ঘন্টা আগে সবধরণের সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কর্মকর্তারা নিশ্চিত হলেন যে লিটভিনেঙ্কোকে পোলোনিয়াম প্রয়োগ করা হয়েছে। রাশিয়ার এভানগার্ডে অবস্থিত ফেডারেল নিউক্লিয়ার এজেন্সি ‘রোসাটম’ এর পোলোনিয়াম-২১০ তৈরীর কারখানাটি থেকেই যে লিটভিনেঙ্কোকে মারার জন্য এই কোটি টাকা মূল্যের পোলোনিয়াম এসেছে সেই ব্যাপারে মৃতুশয্যাতেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন সাবেক রাশিয়ান এই গোয়েন্দা। তাই মৃত্যুর আগে পুতিনকেই দায়ী করে গিয়েছিলেন তার এই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর জন্য,
“You may succeed in silencing one man, but the howl of protest from around the world will reverberate, Mr Putin, in your ears for the rest of your life.”
ফিচার ইমেজ: cbc.ca