গত শতকে সমাপ্তি ঘটা অটোমান সাম্রাজ্যের নান্দনিকতা, জনজীবন এবং সংস্কৃতি আজকের দিনের মানুষদেরও বিমুগ্ধ করে। আজকের দিনে সারা পৃথিবী নৃশংসতায় ভরপুর। এই নৃশংসতার শিকার শুধু মানুষই নয়, পশুপাখিও। বর্তমানে অনেক ব্যক্তি এবং সংগঠন পশুপাখির অধিকার নিয়ে সারা দুনিয়ায় কাজ করছে। পশুপাখির প্রতি নৃশংসতা বন্ধে এবং অধিকারের জন্য পশু অধিকার কর্মীরা আন্দোলন গড়ে তুলছেন। কিন্তু ভাবলে অবাক হতে হবে, আজ থেকে কয়েকশত বছর আগে যখন কিনা পশু অধিকার কী- সেটাই মানুষ ভালো করে জানত না, যখন ছিল না কোনো পশু অধিকার সংস্থা বা কর্মী, তখন অটোমান সাম্রাজ্যের জনগণ পশুপাখিদের সাথে গড়ে তুলেছিল এক অকৃত্রিম হৃদ্যতার সম্পর্ক।
তখন সাধারণ মানুষ রাস্তার বেওয়ারিশ বিড়াল-কুকুরের জন্য নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থা করত। আশপাশে কোনো অভুক্ত কুকুর কিংবা বিড়াল থাকলে সেটাকে না খাইয়ে ঘুমাতে যেত না। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, এ ব্যাপারে অনেক উদার ছিল অটোমান সরকারও। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল কুকুর আর নেকড়ের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র, আহত পাখির জন্য হাসপাতাল ইত্যাদি। এমনকি প্রাসাদের দেয়ালে পাখির জন্য বাসা তৈরি করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। চলুন তাহলে, এ লেখার মধ্য দিয়ে একবার ঢুঁ মেরে আসা যাক সেই সময়ে।
কুকুর এবং নেকড়ের আশ্রয়কেন্দ্র
অটোমান সরকার কুকুর ও নেকড়ের জন্য পাহাড়ে তৈরি করেছিল আশ্রয়কেন্দ্র। নিয়মিত রাস্তায় কুকুর এবং বিড়ালের জন্য খাবার দেওয়া হতো। এজন্য গড়ে তোলা হয়েছিল অনেকগুলো সংগঠন। ১৫৪৪ সালে লুতফি পাশা নামের এক ব্যক্তি ইজমির প্রদেশের তিরি জেলায় একটি ঝর্ণা, জলাশয় এবং কুয়া নির্মাণ করেন, যাতে পথচারী, অভিযাত্রী এবং তাদের সাথে থাকা পোষা প্রাণীরা পানি পান করতে পারে।
১৫৫৮ সালে আদানা প্রদেশের গভর্নর রামাজানুগ্লু পিরি পাশা পশুদের জন্য একটি চারণভূমি দান করেন। হাজী সাইদ মুস্তফা ফাউন্ডেশন নামক একটি দাতব্য সংগঠনের আদেশপত্রে লেখা ছিল, নেড়ি কুকুরদের প্রতিদিন ৩০ রৌপ্যমুদ্রা দামের ভালো মানের রুটি খাওয়াতে হবে।
বিড়ালের মসজিদ
রাস্তার বেওয়ারিশ বিড়ালদের জন্য সিরিয়ার দামেস্কে তৈরি করা হয়েছিলো বিড়াল মসজিদ যেটি ‘ক্যাদিলার মসজিদ’ নামে পরিচিত। তুর্কি ভাষায় ক্যাদি মানে হলো বিড়াল। প্রতিদিন নামাজ আদায়ের পাশাপাশি সেখানে খাওয়ানো হতো শত শত বিড়ালকে।
সেই যুগে প্রতিটি তুর্কি বাড়িতে একটি ছোট বাগান থাকত। পাখিরা সেই বাগানের ফলমূল খেলে বাগানের মালিক কিছু বলত না। প্রতিটি বাড়িতে বিড়াল লালনপালন করা হতো। কেউ পালন করতেন শখ করে, কেউ বা বাড়িতে ইঁদুরের উৎপাত থেকে বাঁচতে। বিড়াল নিয়ে বাচ্চাদের আনন্দের শেষ ছিল না।
অনেক ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে শত শত বিড়াল পালন করতেন। বিশেষ করে যাদের সন্তান ছিল না। ইস্তানবুলের বেয়াজিদ জেলায় অবস্থিত ‘ইস্তানবুল ন্যাশনাল লাইব্রেরি’কে বলা হতো বিড়ালের লাইব্রেরি। লাইব্রেরির ব্যবস্থাপক ইসমাইল সাইব সেঞ্জের শতাধিক বেওয়ারিশ বিড়ালের দেখাশোনা করতেন।
বিড়ালের প্রতি এই ভালোবাসা আজকের দিনেও ধরে রেখেছে তুর্কিরা। আপনি ইস্তানবুল শহরে ঘুরে বেড়ালেই দেখতে পাবেন, শহরে চড়ে বেড়াচ্ছে অগণিত বিড়াল। সাধারণ মানুষ সেগুলোর কোনো ক্ষতিই করে না। সিটি কর্পোরেশন থেকেই তৈরি করে দেয়া হয়েছে থাকার জন্য ছোট ছোট ঘর।
পাখির রাজপ্রাসাদ
পাখির প্রতি অটোমানদের ভালোবাসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মজার আর নান্দনিক দিকটি হচ্ছে পাখির রাজপ্রাসাদ। এগুলো মূলত ছিল বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে তৈরি করা প্রাসাদ, মসজিদ এবং বিভিন্ন ভবনের রেপ্লিকা, যা তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল সেখানে যাতে পাখি বসবাস করতে পারে।
এ ধরনের প্রাসাদ এবং মসজিদের রেপ্লিকাগুলো হয়ে উঠেছিল অটোমান স্থাপত্যকলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব প্রাসাদ ছোট হলে কী হবে, এদের নকশা ছিল অনেক জটিল। কিছু কিছু স্থাপনার দেয়ালে পাখির বাসাগুলো তৈরি করা ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধ্যতামূলক।
রাজপ্রাসাদ, মসজিদ, পাঠাগার, বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, সেতু ইত্যাদির গায়ে কিংবা দেয়ালে এই পাখির বাসাগুলো দেখা যেত। তখন এমন কোনো বড় অটোমান শহর ছিল না, যেখানে এই ক্ষুদ্র প্রাসাদ আকৃতির পাখির বাসাগুলো ছিলো না। এই প্রাসাদগুলো পাখিদের বসবাস নিরাপদ করেছিল এবং ঝড়-বৃষ্টি থেকে পাখিদের রক্ষা করত।
প্রাসাদগুলোতে বসবাস করতো চড়ুই, কবুতরের মতো নানা জাতের পাখি। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, আজকের দিনে প্রাসাদগুলোর মাত্র কয়েকটাই টিকে আছে। এই পাখির প্রাসাদ শুধু পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়ই দেয়নি; হয়ে উঠেছিল নান্দনিকতার অংশ। পাশাপাশি এটি প্রতিফলিত করত ধর্মীয় দর্শনকেও।
সারস পাখির হাসপাতাল
উনিশ শতকে অটোমান তুর্কির বুরসা প্রদেশে ওসমান গাজী পৌর এলাকায় স্থাপিত হয় আহত সারস পাখির চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ‘গুরবাহান-ই-লাকলাকান’। এটি ছিল তুরস্কের প্রথম পশুপাখির হাসপাতাল এবং পৃথিবীর প্রথম বিশেষায়িত পাখি হাসপাতাল। মূলত আহত সারস পাখিদের এখানে নিয়ে এসে চিকিৎসা দেবার জন্য এই হাসপাতাল তৈরি করা হলেও সব ধরনের পাখিকেই এখানে চিকিৎসা দেয়া হতো।
পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ এবং দাঙ্গার কারণে হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই ভবনটি এখনও টিকে আছে এবং কিছুদিন আগে এই হাসপাতালটি আবার চালু করা হয়েছে। গুরবাহান-ই-লাকলাকান নামটি দেয়া হয়েছিল জনপ্রিয় তুর্কি কবি আহমেত হাসিমের একটি বইয়ের নাম অনুসারে।
এছাড়াও পাখির প্রতি ভালোবাসার আরো অনেক নজির পাওয়া যায়। ১৩০৬ সালের দিকে ইজমির প্রদেশের মুরসালিন ইব্রাহিম আগা প্রতি বছর ১০০ কুরুশ (তুর্কি মুদ্রা) ওদেমিস ইয়েনি মসজিদকে দিতেন, মসজিদের আঙিনায় সারস পাখি প্রতিপালনের জন্য। ১৭০৭ সালে কন্দরলুজেদ মেহেমেত বে ফাউন্ডেশন কবুতর পালনের জন্য পুরো একটি বাগানবাড়ি দান করে।
ইতিহাসের গল্পগুলো আমাদের বলার চেষ্টা করে, মানুষের ফেলে আসা দিনগুলো অতটা খারাপ ছিল না। মানুষ এবং পশুপাখির এই ভালোবাসার গল্পকে আমরা যদি নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারি, তাহলে আমাদের সুন্দরতম দিনগুলো আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে অদূর ভবিষ্যতে।