২০১৯ সালের ২৯ মে, বিশ্বখ্যাত বিমান প্রস্তুতকারী কোম্পানি এয়ারবাস তাদের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করে। এই পাঁচ দশকের পথচলায় নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে তারা বিমান শিল্পে নিজেদের এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে, যেখানে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে রয়েছে শুধুমাত্র আর একটি কোম্পানিই, বিমান তৈরি শিল্পের আরেক জায়ান্ট বোয়িং। আদতে এই দুই কোম্পানি মিলেই বর্তমানে শাসন করছে গোটা বাণিজ্যিক বিমান তৈরি শিল্পকে।
এয়ারবাস কোম্পানির পঞ্চাশ বছরের পথচলা কেমন ছিল – তা নিয়েই আজকের এই লেখা।
ষাটের দশকে ইউরোপের বিমান কোম্পানিগুলো অসাধরণ কিছু বিমান তৈরি করেছিল। এসবের মধ্যে ব্রিটেনের তৈরি Hawker Siddeley Trident, De Havilland Comet এবং ফ্রান্সের তৈরি Sud Aviation Caravelle উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ব্রিটেন ও ফ্রান্স মিলিতভাবে ১৯৭৬ সালে ‘কনকর্ড’ নামের একটি সুপারসনিক বিমান তৈরি করেছিল যা আজ পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে সফল একমাত্র সুপারসনিক বিমান হিসেবে সুপরিচিত।
কিন্তু ইউরোপের তৈরি বিমানগুলো ছিল আকারে ছোট এবং সেগুলোর ধারণক্ষমতাও অনেক কম। তার ওপর আমেরিকান বিমান কোম্পানিগুলোর দ্রুত অগ্রগতির ফলে বিমানের বৈশ্বিক বাজারে ইউরোপের দেশগুলো অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে আমেরিকার Douglas DC-8 ও Boeing 707 বিমান দুটো ততদিনে বিশ্ববাজারে রাজত্ব করা শুরু করেছিল।
এছাড়াও বড় আকারের নতুন মডেলের কিছু বিমান বোয়িংয়ের বহরে যুক্ত হতে যাচ্ছিল। এসবের মধ্যে চার ইঞ্জিনের Boeing 747 Jumbo jet উল্লেখযোগ্য। ইতোমধ্যে আমেরিকার ম্যাকডোনেল এবং লকহিড কোম্পানিও বড় আকারের কিছু বিমান, যেমন- McDonnell Douglas DC-10 ও Lockheed L-1011 Trisatar তৈরি করে। অর্থাৎ বিমান তৈরি শিল্পে টিকে থাকতে হলে ইউরোপের দেশগুলোকে তখন কম ধারণক্ষমতার বিমানের পরিবর্তে বড় আকৃতির বাণিজ্যিক বিমান তৈরির দিকে মনোনিবেশ করতে হতো। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত ইউরোপের কোনো দেশের বড় ধরনের বাণিজ্যিক বিমান তৈরির কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না।
তাই বিমান তৈরি শিল্পে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন ১৯৬৯ সালের দিকে একটি কনসোর্টিয়াম গড়ে তুলতে সম্মত হয় যা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এয়ারবাস’ নামে যাত্রা শুরু করে ১৯৭০ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাদের পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ পথচলা।
বিমানের বিশাল বাজারে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে শুরু থেকেই নিজেদের এয়ারক্রাফটে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয় এয়ারবাস। এরই ফলশ্রুতিতে তারা তাদের প্রথম এয়ারক্রাফট্ A300 তে প্রথমবারের মতো কম্পোজিট ম্যাটারিয়াল ব্যবহার করে, যা নিয়ে তখনো অন্যান্য বিমান কোম্পানি কাজই শুরু করেনি।
এয়ারবাস কোম্পানিতে ইউরোপের একাধিক দেশের শেয়ার থাকায় বিমান তৈরির বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ অনেকাংশেই সহজ হয়ে যায় তাদের জন্য। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিমানের বিভিন্ন অংশের ম্যাটারিয়াল সংগ্রহ করে গোটা ইউরোপ জুড়ে বিস্তৃত তাদের বিভিন্ন এয়াসেম্বলি প্ল্যান্টে নিয়ে এসে এসেম্বল করা শুরু করে তারা। ফলে বিমান তৈরির কাজ এগোতে থাকে দ্রুতগতিতে।
১৯৭০ সালের মধ্যে এয়ারবাস বিক্রয়যোগ্য বেশ কিছু এয়ারক্রাফট্ তৈরি করে। পরবর্তীতে ঐ বছরের ৩ সেপ্টেম্বর তারা প্রথমবারের মতো ‘এয়ার ফ্রান্স’এর’ কাছে ২৫০ সিটের ছয়টি A300B মডেলের বিমান বিক্রি করতে সক্ষম হয়। এটিই ছিল এয়ারবাসের প্রথম বিমান বিক্রয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ২৮ অক্টোবর একটি A300B বিমান আকাশে ডানা মেলে এবং প্রথমবারের মতো আকাশের বুকে লিখে দেয় একটি নাম– এয়ারবাস।
এশিয়া এবং ইউরোপে A300B ভালোই সাড়া ফেলে। ফলে লুফথানসা, থাই এয়ারওয়েজ, কোরিয়ান এয়ারসহ বিভিন্ন দেশের বিমান কোম্পানি থেকে A300B এর জন্য অর্ডার আসতে থাকে এয়ারবাসের কাছে। কিন্তু A300B এয়ারক্রাফট্টি এশিয়া-ইউরোপে সাফল্য পেলেও আমেরিকার বাজার ধরতে পারেনি। আমেরিকার কোনো বিমান কোম্পানিই A300B এর প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। ফলে সেবারের মতো আমেরিকার বাজার অধরাই থেকে যায় এয়ারবাসের কাছে।
আমেরিকার বাজারে ঢুকতে না পারার ব্যর্থতা ভাবিয়ে তোলে এয়ারবাসের কর্মকর্তাদের। পরবর্তীতে অনেক ভেবে-চিন্তে তারা একটি উপায় বের করেন। সে অনুযায়ী ১৯৭৮ সালে এয়ারবাস একটি আমেরিকান বিমান কোম্পানি – ‘ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স’কে ছয় মাসের জন্য চারটি নতুন A300S মডেলের এয়ারক্রাফট্ একদম বিনামূল্যে উপহার দেয়! ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স্কে শুধুমাত্র বিমানের ভেতরের সাজসজ্জা নিজেদের মতো করে নেয়ার জন্য যা একটু খরচ করতে হয়েছিল!
এয়ারবাসের পরিকল্পনা কাজে লেগে যায়। A300S এর ছয় মাসের উড্ডয়নে ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স এতটাই খুশি হয় যে তাদের সিইও ফ্র্যাঙ্ক বোরম্যান এয়ারবাসের কাছে একসাথে ২৩টি A300S এর জন্য অর্ডার করে ফেলেন! স্বপ্ন সত্যি হয় এয়ারবাসের। প্রথমবারের মতো তারা প্রবেশ করে আমেরিকার বাজারে।
১৯৭৮ সালে এয়ারবাস তাদের দ্বিতীয় মডেল A310 তৈরি করে। এটি আকারে A300 এর চেয়ে কিছুটা ছোট হলেও সমান জ্বালানীতে অনেক বেশি দূরত্ব যেতে পারত।
আমেরিকায় নিজেদের ঘাঁটি গাড়লেও আশির দশকের আগপর্যন্ত পুরো বৈশ্বিক বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি এয়ারবাস। এই অবস্থা আস্তে আস্তে পরিবর্তন হওয়া শুরু করে যখন তারা তাদের সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের এয়ারক্রাফট ‘A320′ এর সাথে বিশ্ববাসীকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই মডেলের বিমানেই প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ককপিট এবং সেমি-অটোমেটিক কন্ট্রোলিং সিস্টেমের ব্যবহার করা হয়। ১৯৮১ সালে ‘এয়ার ফ্রান্স’ A320 এর ২৩টি বিমানের অর্ডার পাঠায় এয়ারবাসের কাছে।
১৯৮৯ সালে A320 এর একটি বৃহৎ মডেল তৈরি করে এয়ারবাস। এর নাম রাখা হয় A321. ১৯৯৩ সালের মধ্যে তারা A320 এর আরও দুটি ছোট মডেল – A318 ও A319 তৈরি করে A320 মডেলের একটি পূর্ণাঙ্গ ফ্যামিলি তৈরি করে। তৈরির পর থেকে আজ পর্যন্ত এয়ারবাসের A320 ফ্যামিলির বিমানগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বিমানের মর্যাদা লাভ করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৪,০০০ এর বেশি এই ফ্যামিলির বিমান বিক্রি করেছে এয়ারবাস।
১৯৮৫ সালে এয়ারবাস একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ঐ বছর ‘পাইপার এয়ারক্রাফট’ এর মার্কেটিং অফিসার জন লেহিকে ভাগিয়ে এনে তাদের উত্তর আমেরিকা অঞ্চলের বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়। ১৯৯৪ সালে তিনি এয়ারবাসের বৈশ্বিক বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পান। জন লেহির নিয়োগ এয়ারবাসের জন্য বিরাট সৌভাগ্য বয়ে আনে। তিনি তার দক্ষতা ও মেধার সাহায্যে বোয়িংয়ের অনেক বিশ্বস্ত ক্রেতাকে এয়ারবাসের ছায়াতলে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। ফলে ২০১৮ সালে অবসরের আগপর্যন্ত তার অধীনে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বিমান বিক্রয় করতে সক্ষম হয় এয়ারবাস।
নব্বইয়ের দশকে দুটি নতুন মডেলের জেট– A330 ও A340 তৈরি করে এয়ারবাস। এদের মধ্যে A330 ছিল দুই ইঞ্জিন ও A340 ছিল চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট। তবে মাত্র ৩৭৭টি A340 মডেলের এয়ারক্রাফট্ বিক্রি করতে সক্ষম হয় এয়ারবাস। ফলে তাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। অন্যদিকে A330 ভালোই জনপ্রিয় হয় এবং এই মডেলের প্রায় ১৭০০টি বিমান বিক্রি করে এয়ারবাস।
আমেরিকায় এয়ারবাসের ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকা জনপ্রিয়তা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়ে বোয়িং। ফলে এয়ারবাসের অগ্রগতিকে থামাতে তারা আদা-জল খেয়ে মাঠে নামে। এর অংশ হিসেবে তারা আমেরিকান এয়ারলাইন্সের সাথে ২০ বছরের একটি চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তী ২০ বছরের জন্য আমেরিকান এয়ারলাইন্সের প্রধান বিমান সরবরাহকারী কোম্পানি বনে যায় বোয়িং। তারা একই ধরনের ২০ বছরের চুক্তি করে অপর দুই আমেরিকান কোম্পানি ডেল্টা ও কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের সাথে। ১৯৯৭ সালের দিকে বোয়িং তাদের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ম্যাকডোনেল ডগলাস’কে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয়।
বোয়িংয়ের এই ধরনের একের পর এক নতুন চুক্তির ফলে আমেরিকান বাজারে এয়ারবাসের এমন এক অবস্থা দাঁড়ায় যে, ২০১১ সালের আগপর্যন্ত আর কোনো আমেরিকান বিমান কোম্পানি তাদের থেকে বিমান কিনতে পারবে না! ফলে যাত্রা শুরুর পর প্রথমবারের মতো এয়ারবাসকে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।
বোয়িংয়ের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এয়ারবাস। তারা বোয়িংয়ের অন্যতম সেরা জাম্বো-জেট 747-400 এর চেয়ে বৃহৎ ও উত্তম একটি বিমান তৈরি করে বোয়িংকে একটি প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয়ার পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতেই ২০০০ সালে এয়ারবাস বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করে তাদের অসাধারণ সৃষ্টি সুপারজাম্বো A380 মডেলের বিমানকে। এটিই এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক এয়ারক্রাফট।
এয়ারবাস আশা করেছিল, A380 এর মাধ্যমে তারা আমেরিকান বাজার হারানোর ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু তাদের আশা দ্রুতই নিরাশায় পর্যবসিত হয়। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ও এমিরেটস এর মতো বিমান কোম্পানিগুলো আগ্রহ দেখালেও এয়ারবাস A380 এর জন্য আশানরূপ সাড়া পায়নি। তারা মাত্র ৩০০টির মতো এই সুপারজাম্বো বিমানটি বিক্রি করতে সক্ষম হয়। অনেক বিশ্লেষকের মতে, A380 ই ছিল এয়ারবাসের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
ব্যর্থতায় দমে না গিয়ে এয়ারবাস নতুন মডেলের বিমান তৈরির দিকে মনোনিবেশ করে। ফলশ্রুতিতে ২০০৬ সালে তারা তৈরি করে দুই ইঞ্জিনের A350XWB (Extra Wide Body) মডেলের একটি বিমান। ২০১৫ সালে A350XWB মডেলের বিমান কাতার এয়ারওয়েজে যুক্ত হয়। এছাড়াও এ সময়ের মধ্যে তারা আরও একটি নতুন মডেল – A320neo (New Engine Option) উন্মোচন করে। এই A320neo ২০১৬ সালে জার্মানির লুফথানসার বহরে যুক্ত হয়।
সম্প্রতি ২০১৮ সালে কানাডার বিমান তৈরি কোম্পানি বোম্বারডিয়ার এর ‘সি সিরিজ (C series) প্রোগ্রাম’টি অধিগ্রহণ করে এয়ারবাস। এই প্রোগ্রামের অধীনে তারা তৈরি করে কার্বন কম্পোজিট ম্যাটারিয়ালের তৈরি অপর একটি মডেল – A220। অবশ্য বাজারে A220 এর অবস্থাও খুব একটা মসৃণ হয়নি।
বোয়িংয়ের মতো জায়ান্টের সাথে বাজারে টিকে থাকতে হলে এয়ারবাসকে ক্রমাগত উন্নত প্রযুক্তির অসাধারণ টেকসই সব এয়ারক্রাফট বাজারে আনতে হবে প্রতিনিয়ত। এয়ারবাস সেই পথেই আছে। অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির বিমানের ক্ষেত্রে তাদের ভবিষ্যতের খেলোয়াড় হবে A320neo ফ্যামিলির বিমানগুলো এবং জাম্বো জেটের ক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোয় এয়ারবাসের ব্যাটন বহন করবে A350XWB ফ্যামিলির একেকটি এয়ারক্রাফট। সামনের পথচলায় সাধারণ যাত্রী হিসেবে এয়ারবাসের জন্য আমরা শুভকামনা জানাতেই পারি!
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে পড়ুন এই বইটি
১) Boeing versus Airbus: The Inside Story of the Greatest International Competition in Business