‘দালাইলামা’ পৃথিবীর ছাদে থাকা এককালের নিষিদ্ধ রাজ্য তিব্বতের ধর্মগুরুর পদবী। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ‘গেলুগ’ নামের যে শাখাটি প্রচলিত আছে, তার প্রধান ধর্মগুরুকে দালাইলামা নামে অভিহিত করা হয়। মোঙ্গলীয় ভাষায় ‘দালাই’ শব্দের অর্থ সমুদ্র আর সংস্কৃত ‘লামা’ শব্দের অর্থ গুরু বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক। অর্থাৎ দালাইলামা শব্দটির পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় এমন এক শিক্ষক যার জ্ঞান বা আধ্যাত্মিকতা সমুদ্রের মতোই গভীর। অন্যদিকে দালাইলামাদের নামের সাথে গিয়াৎসু শব্দটি যুক্ত থাকে। যেমন বর্তমান দালাইলামার নাম তেনজিন গিয়াৎসু। তিব্বতীয় ভাষায় এই ‘গিয়াৎসু’ শব্দের অর্থও সমুদ্র। যে শব্দটি আসলে দালাইলামার সাথে অনেকটাই সমার্থক। কিন্তু তাহলে দালাইলামা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিলো কীভাবে? চলুন জেনে নিই কে এই দালাইলামা?
দালাইলামার সাথে জড়িয়ে আছে তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের ইতিহাস
রাজা নামরি সংজেন এর হাত ধরে তিব্বত রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় সপ্তম শতাব্দীতে। সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীতে সংজেন এর বংশধরেরা প্রতিবেশী চীন সাম্রাজ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে আয়তন বাড়াতে থাকে। নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি মধ্য এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এই তিব্বত রাজ্য। প্রতিবেশী চীনের সাথেও বাড়তে থাকে সংঘর্ষ। তাই ৮২২ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বত চীনের সাথে সীমান্ত সংঘাত এড়াতে শান্তিচুক্তি করে।
পঞ্চম শতাব্দীতে প্রথম তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার শুরু হয়। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর আগে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের তেমন প্রচার হয়নি। অষ্টম শতাব্দীতে রাজা ত্রাইসং দাস্তেন বৌদ্ধধর্মের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং একে রাজধর্ম হিসেবে মর্যাদা দেন। রাজার আমন্ত্রণে চীন আর ভারত থেকে বৌদ্ধভিক্ষুরা দলে দলে তিব্বতের রাজসভায় এসে যোগ দেন। পাশাপাশি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। কিন্তু তখনকার দিনে তিব্বতের অধিবাসীরা ‘বন’ নামক এক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন।
কোনো ঐতিহাসিকের মতে ‘বন’ ধর্মের অনুসারী আর পুরোহিতরা এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের সাথে তাদের সংঘর্ষের জের ধরে তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় বিদ্রোহ। বিশাল রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে একই সাথে শুরু হওয়া বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হওয়ায় তিব্বতজুড়ে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধে কবলিত তিব্বতের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট স্বাধীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বিদ্রোহীরা। তবে তিব্বতের চীন এবং ভারত সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে বৌদ্ধ ধর্মানুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
লামা এবং দালাইলামা
তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসবিদদের মতে আভালোকিতেসাভ্রা নামক বুদ্ধের এক অনুসারী ছিলেন, যিনি হিমালয়ের পাদদেশের মানুষকে বুদ্ধের শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবেন বলে বুদ্ধকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তার অনুসারীরাই পরবর্তীতে তিব্বতের রাজার আমন্ত্রণে ভারতবর্ষ থেকে তিব্বতের লাসায় এসে বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর শিক্ষকেরা ‘লামা’ নামে পরিচিত ছিলেন। লামাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে প্রবীণ তার হাতেই শিক্ষাকেন্দ্রের সকল দায়িত্বভার অর্পিত থাকতো। তিব্বতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে একদিকে অখন্ড তিব্বত রাজ্যের পতন ঘটে, অন্যদিকে তিব্বতজুড়ে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচারের কারণে ধীরে ধীরে প্রধান লামাদের হাতেই তিব্বতের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়।
১২৭১ সালে মোঙ্গল সম্রাট কুবলাই খান চীনে প্রতিষ্ঠা করেন ইউয়ান সাম্রাজ্য। ধীরে ধীরে পরিধি বড় হতে থাকা ইউয়ান সাম্রাজ্যের দখলে আসে তিব্বতও। ১৫৬৯ সালে তৎকালীন ইউয়ান সম্রাট আটলান খান তৎকালীন তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মগুরু লামাদের প্রধান সোনাম গিয়াৎসুকে তার সাথে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। তবে প্রধান লামা তার বদলে তার কয়েকজন শিষ্যকে আলটান খানের রাজদরবারে পাঠান। তার শিষ্যরা তাকে ফিরে এসে আলটান খান এবং তার রাজ্যসদস্যদের বৌদ্ধধর্মের ব্যাপারে আগ্রহের কথা জানায়। অবশেষে ১৫৭৭ সালে সোনাম গিয়াৎসু আটলান খানের রাজদরবারে আসেন। আটলান খান সোনাম গিয়াৎসুর জ্ঞান আর প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দালাইলামা উপাধি দেন।
তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের বিশ্বাসীদের মতে প্রধান লামা ‘গেনদুন দ্রুপ’ এর তৃতীয়বার জন্ম নেন সোনাম গিয়াৎসুর মাধ্যমে। তাই সোনাম গিয়াৎসুকে মূলত আখ্যায়িত করা হয় তৃতীয় দালাইলামা হিসাবে। দালাইলামা উপাধির পাশাপাশি আটলান খান তিব্বতের শাসনক্ষমতার ভারও তাদের হাতেই অর্পণ করেন। ১৬৪২ সালে পঞ্চম দালাইলামা লবসাং গিয়াৎসুর সময়ে দালাইলামাদের ক্ষমতায় কিছু সংস্কার আনা হয়। এরপর থেকে ৩৭৫ বছর ধরে তিব্বতের প্রধান আধ্যাত্মিক আর ধর্মীয় গুরু হিসাবে তিব্বতের ক্ষমতার বিধিবিধান অপরিবর্তিতভাবে ন্যস্ত আছে দালাইলামাদের হাতে।
দালাইলামা কি নির্বাচিত হয়ে থাকেন ?
কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং একজন দালাইলামার মৃত্যুর পর এক আশ্চর্য প্রথা অনুসরণ করে খুঁজে বের করা হয় আরেকজন দালাইলামাকে। তিব্বতের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ১৪ জন দালাইলামাকে খুঁজে বের করা হয়েছে। তিব্বতের বৌদ্ধ ‘গেলুগ’ শাখার বিশ্বাস অনুসারে দালাইলামা একবার দেহত্যাগ করলেও তাদের বার বার র্জন্ম হয়। পৃথিবীর অনাগত মানুষকে বুদ্ধের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতেই তার এই পুনর্জন্ম। তাই একজন দালাইলামার মৃত্যুর সাথে সাথে তিব্বতের প্রধান লামারা একত্র হয়ে খোঁজ শুরু করেন নতুন দালাইলামারূপী শিশুকে। মূলত তিনটি প্রক্রিয়ায় খুঁজে বের করা শিশু দালাইলামাকে।
- প্রধান লামাদের স্বপ্নপ্রাপ্ত আদেশ: একজন দালাইলামার মৃত্যুর পরেই প্রধান লামাদের কেউ একজন তাদের স্বপ্নে শিশু দালাইলামাকে খুঁজে পাবার জন্য কী করতে হবে তার ইঙ্গিত পান। সেই অনুসারে কাজ করে শিশু দালাইলামাকে খুঁজে বের করা হয়।
- ধোঁয়ার গতিপথ অনুসরণ করা: প্রধান লামাদের কেউ যদি স্বপ্নে কোনো নির্দেশ না পান তাহলে পূর্ববর্তী দালাইলামার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় যে ধোঁয়া নির্গত হয়, লামারা তার গতিপথ অনুসরণ করেন। সেই ধোয়ার গতিপথ অনুসরণ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন জন্ম নেয়া শিশুর মধ্যে দালাইলামাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন তারা।
- ‘লামও-লা-সো’ নামক এক সরোবরের পারে ধ্যান: যখন অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় শিশু দালাইলামাকে খুঁজে পাওয়া না যাবে, তখন লামও-লা-সো নামক পাহাড়ঘেরা এক সরোবরের পাড়ে ধ্যান শুরু করেন লামারা। ৫,৩০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ২ বর্গ কিলোমিটারের এই সরোবরের ব্যাপারে তিব্বতে প্রচলিত আছে অনেক রূপকথা।
তবে তিব্বতের বৌদ্ধধর্ম অনুসারীদের মতে এই সরোবরের দেবী পালদেন লামো প্রথম দালাইলামাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি দালাইলামাদের পুনর্জন্মের ধারাকে অব্যাহত রাখবেন। তাই প্রধান লামারা শিশু দালাইলামার ব্যাপারে কোনোরূপ ইঙ্গিত পাওয়ার আগ পর্যন্ত অব্যাহত রাখেন সেই ধ্যান। ১৯৩৫ সালে বর্তমান ১৩ তম দালাইলামার মৃত্যুর পর তার পরবর্তী তেনজিন গিয়াৎসুকে খুঁজে বের করতে ৪ বছর ধ্যানরত ছিলেন প্রধান লামারা। ৪ বছরের মাথায় লামারা তার ব্যাপারে অবহিত হয়ে তাকে খুঁজে বের করেন। শিশু দালাইলামাকে খুঁজে বের করার পর তার সামনে অন্যান্য জিনিসের সাথে পূর্ববর্তী দালাইলামার ব্যবহৃত কিছু জিনিস উপস্থাপন করা হয়। যদি সেই শিশু পূর্ববর্তী দালাইলামার ব্যবহৃত কোনো জিনিস বাছাই করে, তবেই তাকে পরবর্তী দালাইলামা হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে দালাইলামার এই অনুসন্ধান শুধুমাত্র তিব্বতেই সীমাবদ্ধ।
বর্তমান দালাইলামার শিক্ষা আর জীবন
প্রধান লামাদের অধীনে রাজধানী লাসায় ৬ বছর বয়সে বর্তমান দালাইলামার শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৫৯ সালে তিনি বৌদ্ধ দর্শনের সর্বোচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
ইতোমধ্যে ১৯৫০ সালে চীন তিব্বতের দখল নেয়। কিন্তু মার্চ ১৯৫৯ এ তিব্বতের জনগণ তাদের স্বায়ত্ত্বশাসন পুনরায় আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তায় নামে এবং চীনের সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। হাজারখানেক তিব্বতী জনগণ হতাহত হয়। দালাইলামাকে তার বাসস্থান পোতালা প্যালেস থেকে উৎখাত করা হয়। দালাইলামা তিব্বত থেকে ভারতে পাড়ি জমালে তাকে আশ্রয় দেয় ভারত সরকার।
সেই থেকে ভারতের ধর্মশালায় অবস্থান করছেন দালাইলামা। চীনের সাথে সংঘাত এড়াতে সবসময়ই সমঝোতা আর অহিংসার কথা বলে আসছেন তিব্বতের এই নেতা। ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকা হাজার হাজার তিব্বতি লামা আর লক্ষাধিক অনুসারীদের শান্তভাবে চীন সরকারের এই অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহবান জানিয়ে আসছেন এই নেতা।
নিজের জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত হয়েও জীবনের শেষ দিনগুলোতে এই নেতা বিশ্ববাসীর কাছে পৌছে দিচ্ছেন অহিংসার বাণী। আর এজন্য তাকে ১৯৮৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। হিমালয়ের কোলে বাস করা সাধারণ তিব্বতীদের আস্থা আর বিশ্বাস জুড়ে দালাইলামার অহিংসার বাণীগুলো হিমালয়ের মতোই অবিচল থাকুক- শান্তিকামী বিশ্ববাসী এ কামনাই করে।