প্রুশিয়া থেকে জার্মানি (পর্ব-২৪): ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের প্রুশিয়ান রাষ্ট্র

ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটকে বলা যেতে পারে আধুনিক প্রুশিয়ার জনক। ১৭৫২ সালে প্রকাশিত তার পুস্তকপলিটিক্যাল টেস্টামেন্টে তিনি রাষ্ট্রকে রাজা বা সম্রাট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিমূর্ত অস্তিত্ব বলে মত প্রকাশ করেন, যার সর্বপ্রধান ভৃত্য তিনি নিজে।

১৭৭৬ সালে ভাই হেনরির সাথে আলাপচারিতায় রাষ্ট্রের আপাত অবিনশ্বরতার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন যেকোনো রাজাই মৃত্যুর পর বিলীন হয়ে যাবেন, কিন্তু টিকে থাকবে রাষ্ট্র। ফলে ইউরোপিয়ান অনেক দেশেই যেমন রাজাকে রাষ্ট্রের উপরে রাখা হত, ফ্রেডেরিক তার পক্ষপাতি ছিলেন না। তার কাছে রাজা ছিলেন রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী মাত্র, কাজের বিনিময়ে যিনি বেতন পেয়ে থাকেন। ফ্রেডেরিকের এই ধারণা, যা আরো অনেক নামজাদা পণ্ডিতই বর্ণনা করেছেন, ইউরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্টের  প্রতিনিধিত্ব করত। এজন্য অনেকে তাকে আলোকিত একনায়ক (Enlightened Despot) হিসেবেও বর্ণনা করেন।

বলা হয়, রাষ্ট্রের বিষয়ে ফ্রেডেরিকের অনেক ধারণাই প্রথিতযশা জার্মান দার্শনিক ক্রিশ্চিয়ান উলফে’র (Christian Wolff) প্রভাবান্বিত, যুবরাজ থাকাকালীন ফ্রেডেরিক একটা বড় সময় যার লেখাতে বুঁদ হয়ে থাকতেন। শুধু তা-ই নয়, তরুণ যুবরাজ ফ্রিম্যাসন (Freemasonry) সংঘের নৈতিকতা এবং সুশাসনের চিন্তাধারার প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে তাদের সদস্যপদ নিয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন ফ্রেডেরিক যে সর্বদাই বহুল ব্যবহৃত একটি মিলিটারি কোট পরে থাকতেন তার কারণ ছিল তিনি এর দ্বারা রাষ্ট্রের প্রতি নিজের আনুগত্য বোঝাতে চাইতেন, কারণ তার কাছে সামরিক বাহিনী ছিল প্রুশিয়ার প্রধান চালিকাশক্তি।

ক্রিশ্চিয়ান উলফ; Image Source: Wikimedia Commons

ফ্রেডেরিক রাষ্ট্রের ধারণা এমনভাবে মানুষের মধ্যে প্রতিস্থাপন করেছিলেন যে তার অধীনস্থরা ফ্রেডেরিক এবং রাষ্ট্রের অধীনে কাজ করাকে একসাথে করে ফেলে। ফলে ফ্রেডেরিক যা চেয়েছিলেন, রাজা এবং রাষ্ট্রের আলাদা অস্তিত্ব, তা কিন্তু হয়ে ওঠেনি। তার কর্মচারীরা রাজা এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিত এবং রাজার সেবাকেই রাষ্ট্রের সেবা মনে করত। কিন্তু ফ্রেডেরিক চাইতেন তারা তাকে দেখবে কেবলই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে, যিনি তাদের বেতনের ব্যবস্থা করেন। 

ফ্রেডেরিক তার কর্মচারীদের চোখে কেমন ছিলেন? এই প্রসঙ্গে তার একজন কর্মকর্তা হেইনিটজের কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি ছিলেন স্যাক্সোন গোত্রীয়, প্রুশিয়ান নন। ১৭৭৬ সালে বায়ান্ন বছর বয়সে তিনি ফ্রেডেরিকের সাথে কাজ শুরু করেন। তার ব্যক্তিগত ডায়রিতে দোসরা জুন ১৭৮২ সালের একটি এন্ট্রি থেকে জানা যায় ফ্রেডেরিক যেভাবে কাজ করতেন তা তার অধীনস্থদের জন্য ছিল দৃষ্টান্ত স্বরূপ। রাজা ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী ও নিয়মানুবর্তী। নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য তার কাছে ছিল সবার আগে। হেইনিটজ দাবি করেছেন তিনি এমন আর কোনো রাজাকে দেখেননি। 

ফ্রেডেরিক শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রাজা হবার সাথে সাথেই তার আদেশে প্রখ্যাত জার্মান স্থাপত্যবিদ কনবেলসদর্ফ (Georg Wenceslaus von Knobelsdorff) বার্লিনে নির্মাণ করেন বিশাল এক অপেরা হাউজ। এখানে একসাথে ২,০০০ লোক বসতে পারত।  

বর্তমান বার্লিন অপেরা হাউজ; Image Source: mondodrawards.com

অপেরা হাউজের দক্ষিণে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের জন্য ফ্রেডেরিক বানিয়েছিলেন সেন্ট হিডভিগ’স ক্যাথেড্রাল (St Hedwig’s Cathedral)। প্রোটেস্ট্যান্ট অনেক রাজ্যেই যেখানে ক্যাথলিকদের নানা বৈষম্যের স্বীকার হতে হত, সেখানে ফ্রেডেরিকের এই কাজ তার ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচিতি বহন করছিল। আসলে ফ্রেডেরিক ব্যক্তিগতভাবে ধর্মের ব্যাপারে গোঁড়া ছিলেন না, কখনো কখনো তিনি ধর্মকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেছেন, তবে ধর্মের ভিত্তিতে নিজ প্রজাদের ভেতর বিভেদে তিনি রাজি ছিলেন না। লেখাপড়ার ব্যাপারেও তার ব্যাপক উৎসাহ ছিল। ১৭৭০ সালে ক্যাথেড্রালের পশ্চিমে তিনি একটি বিশাল রাজকীয় লাইব্রেরি স্থাপন করেন। অপেরা হাউজ, ক্যাথেড্রাল, লাইব্রেরি এসবই তৈরি হয়েছিল একটি চত্বর ঘিরে, যাকে সেসময় বলা হত অপেরা হাউজের চত্বর (Platz am Opernhaus/ বর্তমান Bebelplatz)। সেই সময়ের তুলনায় এই পুরো পরিকল্পনাতে প্রাসাদের অনুপস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমী। প্রাসাদের প্ল্যান থাকলেও দ্বিতীয় সিলিসিয়ান যুদ্ধের পর ফ্রেডেরিক সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন।

সেন্ট হিডভিগ’স ক্যাথেড্রাল; Image Source: gpsmycity.com

ফ্রেডেরিক বিচার বিভাগকে সুবিন্যস্ত করেন। দায়িত্ব নিয়েই প্রথমে তিনি নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের পন্থার প্রয়োগ সীমিত করে দেন, ১৭৫৪ সালে তিনি এই পদ্ধতি একেবারেই বাতিল করেন। এছাড়া প্রাণদণ্ডযোগ্য অপরাধের সংখ্যা তিনি হ্রাস করেন। তার নির্দেশে ককেজি (Samuel von Cocceji) নামে এক নামকরা আইনজ্ঞের নেতৃত্বে প্রস্তুত হলো প্রুশিয়ানদের জন্য লিখিত আইনবিধি (Prussian General Code of Law)। এর কাজ শেষ হয় তার মৃত্যুর পর, ১৭৯৪ সালে।

স্যামুয়েল ভন ককেজি © Getty Images

সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের পর যুদ্ধাহতদের সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে ফ্রেডেরিক সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমেরও সূচনা করেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রুশিয়ার স্বার্থই ফ্রেডেরিকের কাছে ছিল সবার আগে। এজন্য তিনি প্রয়োজন মনে করলেই যেকোনো জোটে যোগদান বা জোট ত্যাগ করতেন। সম্পাদিত চুক্তি মেনে চলা যদি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হয় তাহলে সাথে সাথেই ফ্রেডেরিক চুক্তি ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। একই কারণে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কাও তিনি করতেন না। এরই প্রমাণ দেখা যায় সিলিসিয়া আক্রমণের সময়। হলি রোমান এম্পায়ারকেও তিনি অচল একটি বোঝা মনে করতেন।    

মিলার আর্নল্ডের ঘটনা

রাষ্ট্রকে সবার উপরে রাখার কথা বললেও ফ্রেডেরিকের কিছু কাজকর্ম ছিল তার মতামতের সাথে সরাসরিভাবে সাংঘর্ষিক। এর অন্যতম প্রমাণ মিলার-আর্নল্ডের ঘটনা (Miller Arnold Affair) ।

এই গল্প ১৭৭৯-৮০ সালের। জুলাইকেন (Züllichan) গ্রামে (বর্তমান পোল্যান্ডের অংশ) আর্নল্ড নামে এক ব্যক্তি ভাড়া করা জমিতে একটি কারখানা বা মিল চালাত। জমির মালিক ছিলেন কাউন্ট স্মেটাউ (Schmettau)। কারখানার জন্য পানি ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কারণ এর দ্বারাই চালিত হত আর্নল্ডের উইন্ডমিল (এখনো এই উইন্ডমিল সংরক্ষিত আছে জার্মানিতে)। কিন্তু স্থানীয় কমিশনার ব্যারন গিয়েসডর্ফ (Baron von Gersdorff) পার্শ্ববর্তী এলাকায় কয়েকটি পুকুর কাটলে আর্নল্ডের জমিতে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কারখানা তো আর চলে না, আর কারখানা না চললে উপার্জনও বন্ধ। ফলে আর্নল্ড স্মেটাউকে ভাড়া পরিশোধে ব্যর্থ হন। যদিও তিনি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন, তথাপিও দরিদ্র আর্নল্ডের কথায় কান না দিয়ে স্থানীয় আদালত জমির মালিকের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে অবিলম্বে সেই স্থান ত্যাগের নির্দেশ জারি করে। উচ্চ আদালতে আপিল করেও আর্নল্ড ব্যর্থ হন। এখানে ধনী জমি মালিক এবং ক্ষমতাশালী কমিশনারের প্রতি সুস্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব ছিল।   

পটসড্যামে আর্নল্ডের উইন্ডমিল © Brücke-Osteuropa

নিরুপায় আর্নল্ড এবং তার স্ত্রী ১৭৭৫ সালে রাজার কাছে আবেদন জানালেন। কিন্তু সেই আবেদন ফ্রেডেরিক পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তাদের ভিটেমাটি ছাড়া করা হলো। এদিকে আর্নল্ডের ভাই কাজ করত প্রুশিয়ান সেনাদলে, ফ্রেডেরিকের ভাই লিওপোল্ডের অধীনে। তিনি সেনাপ্রধানের কাছে ভাইয়ের ঘটনা জানালেন। এককান-দু’কান হয়ে সেই খবর গেল রাজার কাছে। তখন ১৭৭৯ সাল। আর্নল্ড আরেকটি আবেদন পেশ করলেন, এবার তা রাজা পর্যন্ত পৌঁছে। ফ্রেডেরিক নিজের হাতে বিচার বিভাগের কাছে দুইবার পত্র পাঠান যাতে আর্নল্ডের সমস্যা দ্রুততার সাথে নিষ্পত্তি করা হয়। দুবারই বিচার বিভাগ জানালো রায় সঠিক। ফ্রেডেরিক এই রায়কে দেখলেন ধনী দ্বারা দরিদ্রের নিষ্পেষণের উদাহরণ হিসেবে। তিনি রেগে আগুন হয়ে গেলেন।  

১৭৭৯ সালের ডিসেম্বরের ১১ তারিখ প্রধান বিচারপতি ফাউর্স্ট (Fürst) এবং আরো তিনজন বিচারক, যারা আর্নল্ডের আপিলের নিষ্পত্তি করেছিলেন, তারা রাজার তলব পেয়ে উপস্থিত হলেন। ফাউর্স্ট রাজার সাথে তর্ক করবার চেষ্টা করলে ফ্রেডেরিক সাথে সাথে তাকে বরখাস্ত করেন। অন্য তিনজন বিচারককে প্রচন্ডভাবে তিরস্কার করলেন দরিদ্র এক লোকের জীবিকার পথ বন্ধ করে দেয়ার জন্য। তাদের শাস্তি হিসেবে এক বছর এক দুর্গে অন্তরিন রাখার নির্দেশ দিলেন। রাজার আদেশে আর্নল্ডকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি ও কারখানা ফিরিয়ে দেয়া হয়। যে পুকুরের কারণে এত সমস্যা সেই পুকুর ভরাট করে ফেলা হলো। যদিও বিরাজমান আইন অনুসারে বিচারকেরাই ঠিক ছিলেন, কিন্তু ফ্রেডেরিক নৈতিকভাবে নিজের কাজকে যুক্তিযুক্ত দাবি করলেন।

আইনের চোখে, তিনি মত দিলেন, সবাই হবে সমান। কোনো দিক থেকেই প্রুশিয়ান নাগরিকদের মধ্যে আইনের ভিত্তিতে বৈষম্য করা চলবে না। গ্যাজেট আকারে এই নির্দেশ প্রকাশিত হলো (Protocol of December), যা সুযোগ করে দেয় সবার জন্য সমভাবে আইন প্রয়োগের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় সংস্কারের, যাতে অভিজাত আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ না হয়। এই ঘোষণা ছিল ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত আমেরিকার ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাশান সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন তার বিচারকদের এই নীতির খসড়া প্রদান করেন। পরবর্তীকালে ফরাসি বিপ্লবের সময়ও ফ্রেডেরিকের এই গ্যাজেট মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।

ফ্রেডেরিকের এই কাজ নিঃস্বার্থ ছিল না। ইউরোপের হাওয়া কোন দিকে বইছে আর কেউ না বুঝলেও ফ্রেডেরিক ঠিকই বুঝেছিলেন। রাষ্ট্রের ধনিক শ্রেণীকে খুশি রাখতে গিয়ে সাধারণ জনতাকে শোষণ করলে তার ফল ভাল হয় না। কাজেই জনগণের মন বজায় রাখলে তার সিংহাসনও অক্ষত থাকবে। কয়েক বছর পর ফরাসি বিপ্লব ফ্রেডেরিকের দূরদর্শিতাকেই আরেকবার প্রমাণ করে। 

ফ্রেডেরিকের মৃত্যুর পর আর্নল্ডের কেস আবার পুনর্জীবিত করা হয়। তাকে নির্দেশ দেয়া হলো বিচারক এবং কমিশনারকে ক্ষতিপূরণ দিতে। ফ্রেডেরিকের উত্তরসূরি নীরবে আর্নল্ডের হয়ে এই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে পুরো ব্যাপারটি ধামাচাপা দিয়ে দেন।

প্রাদেশিক ব্যবস্থা

ফ্রেডেরিক চারটি প্রদেশকে প্রুশিয়ার মেরুদণ্ড মনে করতেন- ব্র্যান্ডেনবার্গ, ম্যাগডেবার্গ, সিলিসিয়া এবং হাইবার্স্টডাট (Halberstadt)। এগুলো ছিল সব কেন্দ্রে। বিদেশী আগ্রাসনের ক্ষেত্রে ফ্রেডেরিকের সমরনীতি ছিল পূর্ব এবং পশ্চিমের প্রান্তিয় অঞ্চলগুলির পেছনে বেশি সময় না দিয়ে এই চারটি প্রদেশকে ঘিরে প্রতিরক্ষা সাজানো। এর পেছনে অতীত ইতিহাসেরও ভূমিকা ছিল। সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের সময় রাশিয়া যখন পূর্ব প্রুশিয়া প্রায় দখল করে নিয়েছিল, তখন সেখানকার বাসিন্দারা ক্যাথেরিনের আনুগত্য স্বীকার করে। ১৭৬৩ সালের পর থেকে ফ্রেডেরিক কখনোই পূর্ব প্রুশিয়া সফর করেননি।    

ফ্রেডেরিকের বাবা দক্ষ একটি মন্ত্রীপরিষদ বা ক্যাবিনেট তৈরি করেছিলেন, যারা রাজাকে রাষ্ট্রীয় কাজে পরামর্শ দিত। ফ্রেডেরিক একে কখনোই পূর্ণভাবে কাজে লাগাননি। তিনি বেশি নির্ভর করতেন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি, বা আমাদের ভাষায় সচিবদের উপর, যারা সরাসরি তার সাথে কাজ করত।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা

আজকের দিনের মতো সেরকম স্বাধীনতা না থাকলেও রাজনৈতিক বিতর্ক এবং ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ ফ্রেডেরিক দিয়েছিলেন একটি পর্যায় পর্যন্ত, যা তখনকার ইউরোপিয়ান সমাজে চিন্তা করা কঠিন ছিল। স্কটিশ পর্যটক জন মুর ১৭৭৫ সালে বার্লিন ভ্রমনের পর লিখেছেন যে তাকে সবচেয়ে অবাক করেছে লোকেরা যেভাবে সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করছে। অনেকে এমনকি স্বয়ং রাজার ব্যাপারে অভিযোগ জানাচ্ছে। বইপত্রের দোকানে সব রকম বই-ই বিক্রি হচ্ছে। সেখানে প্রুশিয়ান রাজার বিরুদ্ধে লেখা বইও আছে। ফ্রেডেরিকের প্রুশিয়া ছিল দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া অনেক দার্শনিক এবং চিন্তাবিদদের আশ্রয়। এমনকি বাইবেলের সমালোচনা করে চার্চের মতে ধর্মদ্রোহী মতবাদ প্রদান করা এডেলম্যানও (Johann Christian Edelmann) বার্লিনে আশ্রয় পেয়েছিলেন।

প্রুশিয়ান ইহুদি গোষ্ঠী

১৭৭০ সালের দিকে বার্লিনে ইহুদি জনগোষ্ঠী ছিল সম্ভবত সবচেয়ে ধনী এবং সংস্কৃতিমনা। তাদের মধ্যে ছিল ব্যাঙ্কার, ব্যবসায়ী, সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারীসহ অন্যান্য পেশার লোক। ইউরোপিয়ান শহরগুলোর মধ্যে একমাত্র বার্লিনেই তারা অন্যান্য নাগরিকদের সাথে একই অধিকার ভোগ করত এবং তাদের পাশাপাশি বসবাস করতে পারত।

তবে যদি মনে করে থাকেন এই সুবিধা সব ইহুদির জন্য প্রযোজ্য ছিল তাহলে ভুল ভাবছেন। ফ্রেডেরিকের আইনবিধি ইহুদিদের ছয় ভাগে ভাগ করেছিল। প্রথম ভাগে পড়েছিল সম্পদশালী ইহুদিরা, যাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা ফ্রেডেরিকের দরকার ছিল। এদেরকেই তিনি সবরকম সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন। এমনকি তাদের সন্তানেরা জন্মসূত্রে প্রুশিয়ান নাগরিকও হতে পারত, যা অন্যান্য রাষ্ট্রে ভাবাই অসম্ভব।

দ্বিতীয় ভাগের ইহুদিদের থাকার জায়গা সরকার নির্দিষ্ট করে দিত, এবং তাদের সন্তানদের কেবল একজনই হতে পারত জন্মসুত্রে প্রুশিয়ান। তৃতীয় ভাগে জায়গা হলো নির্দিষ্ট কিছু পেশার মানুষের, যেমন- ডাক্তার, হস্তশিল্পী, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি। ইহুদি ধর্মযাজক বা র‍্যাবাই, ইহুদি কসাই এরা ছিল চতুর্থ পর্যায়ে। এদের সন্তানদের জন্মসূত্রে প্রুশিয়ান নাগরিকত্ব পাবার অধিকার ছিল না। এই চার ভাগের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ইহুদিরা ছিল পঞ্চম স্তরে। ষষ্ঠ স্তরে থাকত ইহুদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সেসব ইহুদি, যারা অন্য কোনো ভাগে পড়ে না।

যত নিচের দিকে যাওয়া যেত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা ততই হ্রাস পেত। ষষ্ঠ পর্যায় তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় সেবাই পেত না। তবে তারপরেও বলা যায় তৎকালীন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় ফ্রেডেরিকের প্রুশিয়া ইহুদিদের প্রতি কিছুটা সহিষ্ণু ছিল। তবে এর পেছনে অর্থনৈতিক স্বার্থই ছিল বড়।

This is a Bengali language article about the rise and eventual downfall of Prussia and how it led to a unified Germany. Necessary references are mentioned below.

References

  1. Clark, C. M. (2007). Iron kingdom: The rise and downfall of Prussia, 1600-1947. London: Penguin Books.
  2. Abbott, J. S. C. (1882). The history of Prussia. New York, Dodd, Mead, and company.

Feature Image ©  Adolph Menzel

Related Articles

Exit mobile version