মঙ্গোলিয়া
‘মোঙ্গল রাষ্ট্র’ (মঙ্গোলীয়: Монгол Улс, ‘মোঙ্গল উলস’) পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত একটি বৃহৎ স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। ১৫,৬৪,১১৬ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রের উত্তরে রাশিয়া এবং দক্ষিণে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন অবস্থিত। প্রায় সাড়ে ৩৩ লক্ষ জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবিরল সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত। রাষ্ট্রটি যে কেবল স্থলবেষ্টিত তা-ই নয়, রাষ্ট্রটির ভূখণ্ড থেকে সমুদ্রের অবস্থান অনেক দূরে। সুতরাং ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটেনের পক্ষে এই অঞ্চলটিতে অভিযান পরিচালনা করা ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার। বস্তুত মঙ্গোলিয়া হচ্ছে সেই বিরল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি, যেটির ভূখণ্ডে ব্রিটিশরা কখনো আক্রমণ চালানো তো দূরে থাক, কোনো ধরনের সামরিক কর্মকাণ্ডই পরিচালনা করেনি।
উল্লেখ্য, মঙ্গোলিয়ার ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের সম্পূর্ণ অংশ বর্তমান মঙ্গোলীয় রাষ্ট্রের মধ্যে নেই। সময়ের সাথে সাথে মোঙ্গলদের ঐতিহাসিক ভূখণ্ড ক্রমশ দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এগুলো যথাক্রমে ‘বাহির মঙ্গোলিয়া’ (Outer Mongolia) ও ‘অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া’ (Inner Mongolia) নামে পরিচিতি লাভ করে। বাহির মঙ্গোলিয়ার ভূখণ্ড বর্তমানে স্বাধীন মঙ্গোলিয়া রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত, আর অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়ার ভূখণ্ড বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অধীনস্থ ‘অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে’র (Inner Mongolia Autonomous Region) অন্তর্ভুক্ত।
অতীতে বিভিন্ন সাম্রাজ্য বর্তমান মঙ্গোলিয়ার ভূখণ্ড শাসন করেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চেঙ্গিস খান মোঙ্গল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং চেঙ্গিসের সময়ে মঙ্গোলিয়া ছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। বস্তুত মোঙ্গল সাম্রাজ্য ছিল মানব ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাম্রাজ্য। চেঙ্গিসের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যটি ৪টি খানাতে (‘খান’ কর্তৃক শাসিত রাষ্ট্র) বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ক্রমশ এই খানাতগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এদের মধ্যে ইউয়ান বংশ চীনের কর্তৃত্ব লাভ করে এবং বর্তমান মঙ্গোলিয়ার ভূখণ্ডও ইউয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৩৬৮ সালে চীনে ইউয়ান বংশের পতন ঘটে, কিন্তু মঙ্গোলিয়ায় তাদের শাসন অব্যাহত থাকে এবং তারা ‘উত্তর ইউয়ান’ বংশ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে চীনকেন্দ্রিক চিং সাম্রাজ্য (Qing Empire) প্রথমে অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া ও পরবর্তীতে বাহির মঙ্গোলিয়াকে নিজেদের সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেয়, এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী জুড়ে সমগ্র মঙ্গোলিয়া চীনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে চিং সাম্রাজ্য কার্যত ব্রিটেনের (এবং অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রের) একটি আধা–উপনিবেশে (semi-colony) পরিণত হয়। এসময় চীনের ভূখণ্ডে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপিত হয়, কিন্তু মঙ্গোলিয়ার ভূখণ্ডে কোনো কার্যকর ব্রিটিশ সামরিক উপস্থিতি ছিল না। শুধু তাই নয়, ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে যে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, এগুলোর মধ্যে কোনোটিতেই মঙ্গোলিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনের প্রভাব ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখনও মঙ্গোলিয়ায় তাদের দৃশ্যমান কোনো প্রভাব ছিল না।
১৯১১–১২ সালে সংঘটিত চীনা বিপ্লব/অভ্যুত্থানের ফলে চীনে চিং রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে এবং এই সুযোগে বাহির মঙ্গোলিয়া ‘মঙ্গোলিয়া বোগদ খানাত’ নাম ধারণ করে চীনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। অবশ্য চীন মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। এসময় রাশিয়া মঙ্গোলিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেলে রাশিয়াকে ইউরোপে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয় এবং এজন্য তাদেরকে মঙ্গোলিয়ায় প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে হয়। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব/অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি রাশিয়ায় আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের অংশ হিসেবে ব্রিটেন রাশিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করে এবং ব্রিটিশ সৈন্যরা সাইবেরিয়ায় ইর্কুৎস্ক শহর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ইর্কুৎস্ক মঙ্গোলিয়ার সীমান্ত থেকে মাত্র ৫০ মাইল উত্তরে অবস্থিত, সুতরাং এসময় ব্রিটিশদের পক্ষে মঙ্গোলিয়া আক্রমণ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ব্রিটেন এই জাতীয় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।
অবশ্য এই সময়েই মঙ্গোলিয়ার ওপর ব্রিটেনের সর্বোচ্চ প্রভাব ছিল। এই পর্যায়ে ব্রিটিশরা অল্প সময়ের জন্য বলশেভিকবিরোধী ‘শ্বেত ফৌজে’র (White Army) স্থানীয় শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও কসাক নেতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল গ্রিগরি সেমিয়নভকে সমর্থন প্রদান করে। সেমিয়নভের পিতা ছিলেন একজন জাতিগত বুরিয়াত (একটি মঙ্গোলয়েড জাতি) এবং সেমিয়নভ মঙ্গোলীয় ও বুরিয়াত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। সেমিয়নভ মঙ্গোলিয়ার সীমান্তে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন এবং ১৯১৮ সালে তিনি একটি ‘বৃহৎ মোঙ্গল রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি বাহির ও অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া এবং রাশিয়া ও চীনের সকল মঙ্গোলয়েড–অধ্যুষিত ভূমিকে একত্রিত করে একটি বিরাট মোঙ্গল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তার পরিকল্পনা সফল হলে পূর্ব এশিয়ায় একটি সুবৃহৎ রাষ্ট্র স্থাপিত হতো এবং তার প্রতি ব্রিটেনের সমর্থনের কারণে এই রাষ্ট্রের ওপর ব্রিটেনের উল্লেখযোগ্য প্রভাব থাকত। কিন্তু সেমিয়নভের পক্ষে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি এবং এর মধ্য দিয়ে মঙ্গোলিয়ায় ব্রিটিশ প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যায়।
পরবর্তীতে সেমিয়নভ জাপানিদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন এবং রুশ দূরপ্রাচ্য ও ট্রান্সবৈকালিয়া অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের জন্য জাপানিরা তাকে একটি ‘পুতুল সরকারে’র (puppet government) প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত করে। অন্যদিকে, বলশেভিকদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ১৯২০ সালের মধ্যে ব্রিটেন সাইবেরিয়া (এবং রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল) থেকে সম্পূর্ণভাবে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং এর ফলে তাদের জন্য মঙ্গোলিয়ায় প্রভাব বিস্তারের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
এদিকে ১৯১৯ সালে চীন মঙ্গোলিয়া দখল করে নেয়, কিন্তু শ্বেত ফৌজের আরেক সমরনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ব্যারন রোমান ভন উনগের্ন–স্তের্নবের্গ ১৯২০ সালে নিজস্ব সৈন্যদল নিয়ে মঙ্গোলিয়ায় প্রবেশ করেন এবং ১৯২১ সাল নাগাদ চীনাদের পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। কিন্তু একই বছর রুশ ও মঙ্গোলীয় বলশেভিকরা উনগের্ন–স্তেনবের্গকে পরাজিত করে মঙ্গোলিয়া অধিকার করে নেয় এবং ১৯২৪ সালের মধ্যে মঙ্গোলিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ বলশেভিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পরবর্তী প্রায় সাত দশক ধরে মঙ্গোলিয়া দৃঢ়ভাবে সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯১৮–২০ সালের অভিযানের ব্যর্থতার পর ব্রিটিশরা আর কখনোই মঙ্গোলিয়ার ধারেকাছে সৈন্যসামন্ত প্রেরণ করতে পারেনি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯২৮ সালে নির্মিত একটি সোভিয়েত চলচ্চিত্রের কাহিনীর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে মঙ্গোলিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ব্রিটিশ প্রচেষ্টা। ভেসেভলোদ পুদোভকিন কর্তৃক পরিচালিত এবং ওসিপ ব্রিক ও ইভান নভোকশোনভের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের নাম ‘চেঙ্গিসের উত্তরাধিকারী’ (রুশ: Потомок Чингисхана, ‘পোতোমোক চিঙ্গিসখানা’), যদিও ইংরেজিভাষীদের কাছে চলচ্চিত্রটি পরিচিতি লাভ করেছে ‘স্টর্ম ওভার এশিয়া’ শিরোনামে। চলচ্চিত্রটির কাহিনীর সারমর্ম হচ্ছে, ১৯১৮ সালে ব্রিটিশরা একজন সাধারণ মোঙ্গল ব্যক্তিকে চেঙ্গিস খানের বংশধর হিসেবে প্রচার করে তাকে মঙ্গোলিয়ার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে এবং তার মাধ্যমে রাষ্ট্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা চালায়।
অবশ্য চলচ্চিত্রটিতে যা-ই দেখানো হয়ে থাকুক, বাস্তবতা হচ্ছে, ব্রিটিশ সৈন্যরা ১৯১৮ সালে মঙ্গোলীয় সীমান্তের সন্নিকটে পৌঁছেছিল ঠিকই, কিন্তু তারা কখনো সেই সীমান্ত অতিক্রম করে মঙ্গোলিয়ার ভূখণ্ডে প্রবেশ করেনি এবং সেখানে কখনোই তাদের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না। গ্রিগরি সেমিয়নভের মাধ্যমে মঙ্গোলিয়ায় ব্রিটিশ প্রভাব বিস্তারের যতটুকু সম্ভাবনা ছিল, সেটিও ব্রিটিশরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। এজন্য বিশ্বের যে অল্প কয়েকটি রাষ্ট্র ব্রিটিশ প্রভাব থেকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল, সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মঙ্গোলিয়া।
মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ
‘মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ প্রজাতন্ত্র’ (ইংরেজি: Republic of the Marshall Islands; মার্শালিজ: Aolepān Aorōkin Ṃajeḷ) ওশেনিয়া মহাদেশে অবস্থিত একটি অতি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র (island state)। ১৮১.৪৩ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটি প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। রাষ্ট্রটির অবস্থান নিরক্ষরেখার (Equator) অতি সন্নিকটে এবং আন্তর্জাতিক তারিখরেখা (International Date Line) থেকে সামান্য পশ্চিমে। ভৌগোলিকভাবে রাষ্ট্রটি বৃহত্তর মাইক্রোনেশিয়া অঞ্চলের অন্তর্গত। প্রশাসনিকভাবে রাষ্ট্রটি একটি রাষ্ট্রপতি–শাসিত সংসদীয় প্রজাতন্ত্র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘মুক্ত সহযোগী রাষ্ট্র’ (freely associated state)। কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে, দ্বীপপুঞ্জটির নামকরণ করা হয়েছে একজন ব্রিটিশ নাগরিকের নামানুসারে, কিন্তু ব্রিটিশরা কখনো এই দ্বীপপুঞ্জে আক্রমণ বা অন্য কোনো ধরনের সামরিক অভিযান পরিচালনা করেনি।
ইউরোপীয় জাতিগুলোর মধ্যে স্পেনীয়রা প্রথম বর্তমান মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের ভূখণ্ডে পৌঁছায়। ষোড়শ শতাব্দী থেকে এই দ্বীপপুঞ্জটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্পেনীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্র দ্বীপপুঞ্জটিকে স্পেনের ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। স্পেনীয়রা প্রথমে দ্বীপপুঞ্জটিকে মেক্সিকোকেন্দ্রিক ‘নিউ স্পেন ভাইসরয়্যাল্টি’র অংশ হিসেবে শাসন করে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ল্যাটিন আমেরিকার স্পেনীয় উপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর দ্বীপপুঞ্জটি ‘ফিলিপাইন্স ক্যাপ্টেন্সি–জেনারেলে’র অন্তর্ভুক্ত হয়। অবশ্য এ সময় দ্বীপপুঞ্জটি কার্যত নামেমাত্র স্পেনীয় শাসনাধীনে ছিল, কারণ সময়ে সময়ে দ্বীপপুঞ্জটিতে মিশনারিদের এক একটি দল প্রেরণ করা ছাড়া স্পেনীয়রা দ্বীপপুঞ্জটির অধিবাসীদের কার্যকলাপে বিশেষ হস্তক্ষেপ করত না।
১৭৮৮ সালে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ ‘স্কারবরো’র অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জন মার্শাল প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে বর্তমান মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন। ‘স্কারবরো’ জাহাজে করে ব্রিটেন থেকে নির্বাসিত ব্যক্তিদের ব্রিটিশ উপনিবেশ অস্ট্রেলিয়ার বোটানি উপসাগরে পৌঁছে দেয়া হতো। সেখান থেকে ব্রিটেনে ফেরার পথে উক্ত দ্বীপপুঞ্জটি মার্শালের নজরে আসে এবং তিনি দ্বীপপুঞ্জটির নামকরণ করেন ‘লর্ড মালগ্রোভস রেঞ্জ’ (Lord Mulgrove’s Range)। কিন্তু পরবর্তীতে এটি তার নামে ‘মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে।
ক্যাপ্টেন মার্শাল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি দ্বীপপুঞ্জটি দখল করেননি বা সেখানে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করেননি। তার দ্বীপপুঞ্জটি সফর ও সেটির নামকরণের পর ব্রিটিশরাও কখনো দ্বীপপুঞ্জটির মালিকানা দাবি করেনি। তদুপরি, ব্রিটেন ও স্পেনের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকার পরেও ব্রিটিশরা স্পেনীয়দের অধীনস্থ এই দ্বীপপুঞ্জটিতে কখনো আক্রমণ পরিচালনা করেনি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে দ্বীপপুঞ্জটির মালিকানা নিয়ে জার্মানি ও স্পেনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং অবশেষে ১৮৮৫ সালে স্পেন প্রায় ৪৫ লক্ষ (বা ৪.৫ মিলিয়ন) মার্কিন ডলারের বিনিময়ে জার্মানির কাছে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ বিক্রি করে দেয়। এর মধ্য দিয়ে দ্বীপপুঞ্জটি জার্মানির একটি উপনিবেশে পরিণত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর জাপানিরা জার্মানদের পরাজিত করে দ্বীপপুঞ্জটি দখল করে নেয় এবং ১৯২০ সালে জাতিপুঞ্জ (League of Nations) আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বীপপুঞ্জটির শাসনভার জাপানের ওপর ন্যস্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপান ও ব্রিটেনের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়, কিন্তু এসময় ব্রিটিশরা কখনো জাপানি–অধিকৃত মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করেনি। অবশ্য যুদ্ধের শেষদিকে ১৯৪৪ সালে মার্কিন সৈন্যরা জাপানিদের কাছ থেকে দ্বীপপুঞ্জটি দখল করে নেয়।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মার্শাল দ্বীপপুঞ্জকে জাতিসংঘের একটি ‘জাতিসংঘ অছি অঞ্চলে’ (United Nations Trust Territory) পরিণত করে এবং অঞ্চলটির শাসনভার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত করে। ১৯৭৯ সালে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু পরবর্তীতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ‘মুক্ত সহযোগিতা চুক্তি’তে (Compact of Free Association) স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে মার্কিন সরকার মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই চুক্তি অনুযায়ী, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া নিজেদের ভূখণ্ডে অন্য কোনো রাষ্ট্রকে সামরিক উপস্থিতি স্থাপনের সুযোগ প্রদান করতে পারবে না। সুতরাং মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ আইনত স্বাধীন হলেও সেখানে ব্রিটিশ সামরিক হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই।
বস্তুত মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের একটি কৌতূহলোদ্দীপক দিকের নির্দেশক। দ্বীপপুঞ্জটির নামকরণ করা হয়েছে একজন ব্রিটিশ নৌ কর্মকর্তার নামানুসারে, অথচ দ্বীপপুঞ্জটি কখনো ব্রিটেনের উপনিবেশ তো ছিলই না, তদুপরি, সেখানে ব্রিটিশরা কখনোই কোনো ধরনের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। এজন্য মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ হচ্ছে বিশ্বের সেই ২২টি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি, যেখানে ব্রিটেন কখনো আক্রমণ চালায়নি।