আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম চ্যাম্পিয়ন জেমস বি. কনোলি। অলিম্পিকের প্রথম স্বর্ণপদকজয়ী অবশ্য শুধু একজন অ্যাথলেটই নন, ছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিকও; সাহিত্যিক হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে তার। লিখেছেন ২৫টি উপন্যাস, দুই শতাধিক ছোটগল্প। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের রাজধানী শহর বোস্টন। দক্ষিণ বোস্টনে জন্মগ্রহণ করেন কনোলি, ১৮৬৮ সালের ২৮ অক্টোবর। তার পুরো নাম জেমস ব্রেন্ডন বেনেট কনোলি। জেমস বি. কনোলি তার ব্যবহৃত নাম।
১৮৯৬ সালে গ্রিসের এথেন্সে আধুনিক কালের প্রথম অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয়। তখন কনোলি আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য তিনি বিশ্ববিদালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটির আবেদন করেন। ছুটি মঞ্জুর করতে অস্বীকৃতি জানায় বিশ্ববিদ্যালয়টি। অলিম্পিকে অংশগ্রহণের অদম্য ইচ্ছা ছিল তার। ফলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বাদ দিয়ে ছোটেন স্বপ্নের পেছনে। ২৭ বছর বয়সে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া কনোলি সেখানে একটি মাত্র সেমিস্টার শেষ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী ও ক্রীড়াপ্রেমিক কনোলি অলিম্পিকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো রকম শর্ত ছাড়াই তাকে সম্মানসূচক ডিগ্রির প্রস্তাব করে, যদিও কনোলি তা গ্রহণ করেননি। এমনকি পঞ্চাশ বছরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পা পর্যন্ত রাখেননি।
কনোলি অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করবেন। যেতে হবে আমেরিকা থেকে ইউরোপে। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ। মাঝে আটলান্টিক মহাসাগর। তাকে একটি মহাসাগর পাড়ি দিতে হবে। এটি কম কথা নয়, কারণ তখন ১৮৯৬ সাল, পৃথিবী তখনও যোগাযোগের দুনিয়ায় ছোট হয়ে ওঠেনি। আবিষ্কৃত হয়নি এরোপ্লেন। যোগাযোগব্যবস্থা আজকের মতো এত সহজ ছিল না। আরো ১৩ জন প্রতিযোগীর সাথে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের জাহাজে করে গ্রীসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
খেলাধুলার প্রতি যার এত তীব্র ভালোবাসা, তার পক্ষে খেলাধুলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ত্যাগ করাও যেন কিছু না। মহাসাগর, দেশ অতিক্রম করে তবেই গ্রিসের এথেন্স। দীর্ঘ পথ। মহাসাগর পার হয়ে একসময় তিনি উপস্থিত হন ইতালির নেপলসে। এখানে ঘটে আরেক ঘটনা। তার ওয়ালেট চুরি হয়ে যায়। অলিম্পিক আসর শুরু হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টাও নেই তখন। পরে পুলিশ ওয়ালেটটি উদ্ধার করে। পুলিশ তাকে চোরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরামর্শ দেন। অভিযোগ করতে গিয়ে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে যায়। ট্রেন মিস হয়ে যাবে- এই ভয়ে কনোলি পুলিশের কাছ থেকে দ্রুত চলে আসেন। দেখেন, স্টেশন ছেড়ে দেয়া ট্রেন পড়িমরি করে ধরতে সক্ষম হন। সেদিন ট্রেন মিস করলেই আজকের গল্পের নায়ক বদলে যেত আমূল।
দীর্ঘ যাত্রা শেষে কনোলি অলিম্পিক গেমসের আয়োজক শহর এথেন্সে উপস্থিত হন। তিনি ভেবেছিলেন, প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য দু’সপ্তাহের মতো সময় পাবেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন- গ্রিকরা ভিন্ন ক্যালেন্ডার মেনে চলে, এবং সেদিনই শুরু হবে অলিম্পিক আসর! ফলে তিনি প্র্যাকটিস করার সময় পাননি।
ইভেন্ট শুরু হয়। কনোলি ট্রিপল জাম্পে অংশগ্রহণ করে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে এক মিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে চ্যাম্পিয়ন হন। কিন্তু পুরষ্কার হিসেবে দেয়া হলো সিলভার মেডেল। আজকের বিশ্বে দাঁড়িয়ে এটা খটকার মতো লাগতেই পারে। ১৮৯৬ সালের অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়নদের সিলভার মেডেলই প্রদান করা হয়। কারণ তখনো গোল্ড মেডেল দেওয়ার নিয়ম চালু হয়নি। আর রানার্স-আপদের প্রদান করা হয় কপার অথবা ব্রোঞ্জ মেডেল। এছাড়া ১৯০০ সালের অধিকাংশ বিজয়ীকে কাপ বা ট্রফি দেওয়া হয়।
অলিম্পিক গেমসে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে যথাক্রমে গোল্ড, সিলভার, ব্রোঞ্জ মেডেল দেওয়ার প্রথা চালু হয় ১৯০৪ সালে। ১৯০৪ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আসর বসে যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরিতে। তবে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি ১৮৯৬ ও ১৯০০ সালের অলিম্পিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের জন্যও বিধিটি কার্যকর করেন। ফলে আধুনিক অলিম্পিকে প্রথম স্বর্ণপদকজয়ী হিসেবেই সম্মানিত কনোলি। এছাড়া তিনি হাই জাম্পে সিলভার মেডেল ও লং জাম্পে ব্রোঞ্জ মেডেলও অর্জন করতে সক্ষম হন।
ইতিহাস সৃষ্টিকারী কনোলির বাবা ছিলেন একজন জেলে। তারা বারো ভাই-বোন ছিলেন। দশ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। মায়ের আদর-ভালোবাসা পেয়ে বড় হন তারা। মায়ের ভালোবাসায় বড় হওয়া সেই সুযোগ্য সন্তানটিই (জেমস বি. কনোলি) হয়ে উঠলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের ভালোবাসার পাত্র। যখন তিনি এথেন্স থেকে সাউথ বোস্টনে ফেরত আসেন, সবাই তাকে আগ্রহভরে স্বাগত জানায়। উপহার দেয় একটি স্বর্ণের ঘড়ি।
কনোলি ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকেও অংশগ্রহণ করেন। এবার ট্রিপল জাম্পে তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন এবং ব্রোঞ্জ মেডেল নিয়ে ঘরে ফেরেন। তিনি ১৯০৪ সালের অলিম্পিকেও অংশগ্রহণ করেন। তবে অ্যাথলেট ভূমিকার বদলে একজন সাংবাদিক হিসেবে। একজন লেখক হিসেবে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন।
অলিম্পিকে কনোলির অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে নির্মাণ করা হয়েছে তার ভাস্কর্য। সাউথ বোস্টনের জো মোকলি পার্কে রয়েছে এটি।
জেমস বি. কনোলি ১৯৫৭ সালের ২০ জানুয়ারি নিউ ইয়র্কে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। ছোটবেলায় স্কুল থেকেও ঝরে পড়েছিলেন ব্রেন্ডন কনোলি। একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে কেরানির কাজ শুরু করেছিলেন। তার এক ভাইয়ের সহায়তায় তিনি ইউএস আর্মিতেও চাকরি পান। তিনি যেমন খেলাধুলা করতেন, তেমনি খেলাধুলা বিষয়ে লেখালেখিও করতেন। খেলোয়াড় হলেও খেলার বাইরে তিনি রচনা করেছেন তার বৈচিত্র্যময় জীবন।