প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে যে ক’জন শাসক তাদের আপন আলোয় ইতিহাসে সমুজ্জ্বল, তাদের মধ্যে অন্যতম পাল বংশীয় শাসক ধর্মপাল। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ইতিহাসের বিখ্যাত ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের পেছনে মূল নিয়ামক ছিলেন তিনিই। ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে পরাজিত হয়েও তিনি ভোগ করতে সমর্থ হয়েছিলেন জয়ের স্বাদ।
ধর্মপালের পরিচয়
ধর্মপাল ছিলেন পাল বংশের দ্বিতীয় শাসক। পাল বংশীয় শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবেই ধরা হয় তাকে। কারণ তিনিই পাল বংশকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিলেন। প্রথম পাল শাসক গোপালের পুত্র ছিলেন ধর্মপাল। তার পিতা গোপালকে ধরা হয় প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত শাসক। শশাঙ্কের পর বাংলা অঞ্চল দীর্ঘদিন শাসকবিহীন থাকায়, এ অঞ্চলে একটি দীর্ঘ সময় ধরে ‘মাৎস্যন্যায়’ বা অরাজক পরিস্থিতি চলতে থাকে। তিব্বতীয় ঐতিহাসিক লামা তারানাথের মতে, এসময় ‘প্রকৃতিপুঞ্জ’ কর্তৃক রাজা নির্বাচিত হন গোপাল। তবে প্রকৃতিপুঞ্জ বলতে তারানাথ জনসাধারণ না নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বুঝিয়েছেন, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতবিরোধ আছে। যা-ই হোক, গোপাল ৭৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মৃত্যুবরণ করলে সিংহাসনে আরোহণ করেন ধর্মপাল।
ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের সূত্রপাত
ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ হিসেবে পরিচিতি পেলেও আদতে এটি ছিল চতুর্শক্তি সংঘর্ষ। পালদের সাথে সাথে ভারতে আরো দু’টি রাজবংশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল তখন। মালব ও রাজস্থনের গুর্জর-প্রতীহার ও আরেকটি দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ। মাঝখানের কনৌজ সে সময় খুবই বিখ্যাত জায়গা হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিল। পালপূর্ব যুগে বিখ্যাত শাসক হর্ষবর্ধনের শাসনাঞ্চল ছিল কনৌজ। আর এই অঞ্চলের প্রতি লোভ তিনটি রাজবংশেরই ছিল। কাজেই কনৌজ তথা মধ্যাঞ্চলে তেমন শক্তিশালী শক্তির অনুপস্থিতি, এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করে তিনটি রাজবংশের শাসকদের মধ্যেই। পাল রাজা গোপাল তার সীমানা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছিলেন। রাজা ধর্মপালের সময় পালদের শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। একারণেই ধর্মপাল দুঃসাহস করেন কনৌজ দখল করার। তিনদিকে তিনটি শক্তিশালী রাজবংশ আর মধ্যখানে দুর্বল আয়ুধ বংশ। ফলে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে চারটি পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে।
এ যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল মূলত ধর্মপালের হাত ধরেই। তিনি প্রথম তার পশ্চিমদিকে রাজ্য বিস্তারে বেরিয়ে পড়েন। সেই ধারাবাহিকতায় মগধ জয়ের পর দোয়াবের এলাহাবাদ পর্যন্ত গঙ্গা নদীর উপকূল ঘেঁষে এগিয়ে যেতে থাকেন। অপরদিকে প্রতীহার রাজা বাৎসরাজও মধ্যাঞ্চলে তার আধিপত্য বিস্তারে এগিয়ে আসেন এবং দোয়াবে এসে বাধা প্রদান করেন রাজা ধর্মপালকে। দু’পক্ষের প্রচণ্ড যুদ্ধে পরাজিত হন ধর্মপাল।
কিন্তু এ সময় দৃশ্যপটে আগমন ঘটে রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুবধারাবর্ষের। তিনিও তখন বেরিয়েছেন উত্তরের দিকে সাম্রাজ্য বিস্তারে। এসময় তার মুখোমুখি হন প্রতীহার রাজা বাৎসরাজ! ধ্রুবধারাবর্ষ এগিয়ে এসে আক্রমণ করেন বাৎসরাজকে। বাৎসরাজ কেবলই ধর্মপালের সাথে যুদ্ধে শক্তি ক্ষয় করেছেন। এসময় আবারো যুদ্ধের মুখে পড়ে ধ্রুবধারাবর্ষের নিকট পরাজিত হন। ধ্রুবধারাবর্ষ পরাজিত বাৎসরাজকে বিতাড়িত করেন রাজপুতনার মরু অঞ্চলের দিকে। তারপর তিনি এগিয়ে আসেন ধর্মপালের দিকে। গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে ধ্রুবধারাবর্ষ ও ধর্মপালের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে হেরে যান ধর্মপাল।
কিন্তু ধ্রুবধারাবর্ষ এ যুদ্ধে জিতলেও, তার নিজ রাজ্য দাক্ষিণাত্যের নিরাপত্তা বিধানে এ অঞ্চলে আধিপত্য স্থায়ী করার কোনো ব্যবস্থা না করেই নিজ রাজ্যে ফেরত যান। ত্রিপক্ষীয় এ যুদ্ধে বাৎসরাজ ও ধ্রুবধারাবর্ষ দুজনেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও ধর্মপাল ছিলেন মোটামুটি সুবিধাজনক অবস্থানে। কারণ কুশলী ভূমিকার জন্য যুদ্ধগুলোতে তার তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ধ্রুবধারাবর্ষ ফেরত যাওয়ার পর খালি মাঠে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন ধর্মপাল। কিছুদিনের মধ্যেই কনৌজরাজ ইন্দায়ুধকে পরাজিত করে ক্ষমতায় বসান তার অনুগত চক্রায়ুধকে। এর মাধ্যমে ধর্মপাল বাংলা, বিহারের সীমানা ছাড়িয়ে আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হন উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে। কিন্তু এর কিছু সময়ের মধ্যেই বাৎসরাজ ও ধ্রুবধারাবর্ষ মৃত্যুবরণ করলে তাদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা শুরু হয়। আর তার ফলস্বরূপ নতুন করে শুরু হয় ত্রিপক্ষীয় এই যুদ্ধ, তবে নতুন রূপে।
ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের দ্বিতীয় পর্ব
ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের প্রথম পর্যায়ে বাৎসরাজ ও ধ্রুবধারাবর্ষ দু’জনেই ধর্মপালের বিরুদ্ধে জয়ী হলেও কেউই সেই জয় ঘরে তুলতে পারেননি। তাদের মৃত্যুর পর তাদের আসনে ক্ষমতাসীন হন যথাক্রমে বাৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট ও ধ্রুবধারাবর্ষের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ।
দ্বিতীয় নাগভট্ট ক্ষমতায় আসীন হয়ে সাম্রাজ্যের অবস্থান শক্তিশালী ও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে অভিযানে নামেন। তারপর একে একে সিন্ধু, অন্ধ্র, কলিঙ্গ ইত্যাদি অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে কনৌজ অধিকার করেন। কনৌজে তখন ক্ষমতায় আসীন ধর্মপালের অনুগত চক্রায়ুধ। চক্রায়ুধকে পরাজিত করে নাগভট্ট ধর্মপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত হন। মুঙ্গেরে অনুষ্ঠিত যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন আবারো।
তবে পরাজিত হলেও তার ভাগ্য খুলে যায় আবারো। এবারে তার ত্রাণকর্তা হিসেবে মঞ্চে আসেন রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুবধারাবর্ষের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ। যদিও তিনি ধর্মপালের আমন্ত্রণেই নাগভট্টের উপর আক্রমণ করেছিলেন কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতবিরোধ আছে। যা-ই হোক, তৃতীয় গোবিন্দ এগিয়ে এসে আক্রমণ করেন দ্বিতীয় নাগভট্টের উপর। পিতার মতোই এ যুদ্ধে দ্বিতীয় নাগভট্টও পরাজিত হন। তৃতীয় গোবিন্দ নাগভট্টকে পরাজিত করার পর ধর্মপাল ও কনৌজের চক্রায়ুধ আত্মসমর্পণ করেন তৃতীয় গোবিন্দের কাছে। মজার বিষয় হচ্ছে, বিজয়ী হয়ে তৃতীয় গোবিন্দও ৮০১ খ্রিস্টাব্দের দিকে পিতার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ফেরত যান নিজ রাজ্যে। ধর্মপালের ভাগ্য আবার সুপ্রসন্ন হয় তাতে। মধ্যাঞ্চলে তার প্রভাব টিকে থাকে আগের মতোই।
ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের ফলাফল
ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের ফলাফল বেশ অদ্ভুত। রাষ্ট্রকূট কিংবা প্রতীহার কোনো বংশই এই বিজয়ে তেমন সুফল না পেলেও মাঝখান থেকে পরাজিত হয়েও প্রায় সমুদয় সুবিধা ভোগ করতে সমর্থ হন রাজা ধর্মপাল। এই সংঘর্ষে রাষ্ট্রকূটরা বলা চলে একরকম ধর্মপালের ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করে এবং পাল বংশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। যার ফলে বারংবার পরাজিত হয়েও ধর্মপাল তার আঞ্চলিক রাজ্যকে উত্তর ভারতের উত্তর ভারতের একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত করতে সমর্থ হন।
তবে যে কনৌজ নিয়ে এ যুদ্ধের সূত্রপাত, ধর্মপালের মৃত্যুর পর প্রতীহাররাজ দ্বিতীয় নাগভট্ট পুনরায় কনৌজের দখল নিয়ে নেন। এমনকি তিনি কনৌজকে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। এবার অবশ্য রাষ্ট্রকূটরা প্রতীহারদের আর প্রতিহত করতে আসেননি। কারণ রাষ্ট্রকূটরা তখন নিজেরাই অন্তর্কোন্দলে ব্যস্ত ছিল। এসময় পাল সাম্রাজ্যের হাল ধরেন দেবপাল। তিনিও সেসময় কনৌজের দিকে আর নজর দেননি। পরবর্তীকালে প্রতীহারদের সাথে তার বেশ কিছু যুদ্ধ হয়। তবে দেবপাল কতটুকু সাফল্য পেয়েছিলেন, তা ঠিক স্পষ্ট নয়।
যা-ই হোক, ধর্মপাল প্রায় চল্লিশ বছর ধরে শাসন ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। পাল বংশের প্রায় চারশ’ বছরের ইতিহাসে তার চল্লিশ বছরই সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বলতর হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের সময় তিনি সাহসী ও কুশলী ভূমিকা এবং কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে পাল রাজ্যকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিস্তৃত ও শক্তিশালী অবস্থানে।