রোম সাম্রাজ্যের উত্থান (পর্ব-২৮): জুগুর্থাইন যুদ্ধ

মনে আছে ম্যাসিনিসার কথা?

রোমের সাহায্যে নুমিডিয়ার অধিপতি বনে যাওয়া ম্যাসিনিসা তার জীবদ্দশায় রোমানদের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে নুমিডিয়ার তরফ থেকে রোমকে সহায়তাও প্রদান করেন। ১৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কুশলী যোদ্ধা ও সেনাপতি ম্যাসিনিসার মৃত্যুর পর তার রাজ্যের ক্ষমতা তার তিন ছেলে মিসিপ্সা (Micipsa), গুলুসা (Gulussa) ও ম্যাস্টারনেবল (Mastarnable) ভাগাভাগি করে নেয়। বড় ছেলে মিসিপ্সার ভাগে পড়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা, যার মধ্যে ছিল রাজধানী সির্টা (Cirta) ও রাজকোষ। বাকি দুই ভাই সেনাবাহিনী আর বিচার বিভাগের দায়িত্ব বুঝে নেয়। অল্প সময় পরে গুলুসা আর ম্যাস্টারনেবলের মৃত্যু হলে মিসিপ্সা একক রাজা হিসাবে নুমিডিয়া শাসন করতে থাকেন। ম্যাস্টারনেবলের ছেলে জুগুর্থার লালন পালনের ভারও তিনি নিজের হাতে তুলে নেন।

মিসিপ্সার নামে মুদ্রিত কয়েন; Image Source: imperioromanodexaviervalderas.blogspot.com

মিসিপ্সা রোমের সাথে মৈত্রী বহাল রেখেছিলেন। নুম্যান্টাইন যুদ্ধের সময় নুমিডিয়ানদের পক্ষে পূর্ণবয়স্ক জুগুর্থার নেতৃত্বে একটি সেনাদল সিপিও অ্যামেলিয়ানাসের পক্ষে লড়াই করে। সিপিও জুগুর্থার উদ্যম ও সমরকুশলতার প্রশংসা করেন। এরপরে মিসিপ্সা তাকে নিজের সন্তান হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তার নিজ পুত্র হিয়েম্পসাল (Hiempsal) এবং অ্যাধেরবালের (Adherbal) সাথে তাকে যৌথভাবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারি মনোনীত করলেন।

জুগুর্থার ক্ষমতা দখল

১১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসিপ্সার মৃত্যু হল। নুমিডিয়া ভাগ হয়ে গেল জুগুর্থা আর তার দুই চাচাত ভাইয়ের মধ্যে। কিন্তু জুগুর্থা ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। সকল ক্ষমতা একলা কুক্ষিগত করাই তার লক্ষ্য ছিল। জুগুর্থার চক্রান্তে হিয়েম্পসাল আততায়ীর হাতে নিহত হলেন। অ্যাধেরবাল বেঁচে গেলেও জুগুর্থার সমর্থকদের সাথে লড়াইতে পরাজিত হয়ে শীঘ্রই তিনি রোমে পালিয়ে যান। এখানে সিনেটের কাছে অ্যাধেরবাল রোমের হস্তক্ষেপের আর্জি পেশ করলেন।

রাজা জুগুর্থা; Image Source: trendolizer.com

এদিকে জুগুর্থার পক্ষ থেকে তার প্রতিনিধিদল রোমে এসে উপস্থিত হলো। তারা প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে প্রভাবশালি অনেক সিনেটর ও রোমান নাগরিকদের আনুকূল্য আদায় করে নেয়। ফলে সিনেট যখন অ্যাধেরবালের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য লুসিয়াস অপিমিয়াসের (Lucius Opimius) অধীনে দশজনের কমিশন গঠন করল তখন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য জুগুর্থার পক্ষ নেয়। ফলে সিনেট জুগুর্থাকে কোনো দণ্ড না দিয়ে নুমিডিয়া দুই ভাগ করল। রাজ্যের অধিক সম্পদশালী পশ্চিমাঞ্চল জুগুর্থার হাতে আর রাজধানী সির্টা ও পূর্ববর্তী কার্থেজের কিছু অংশসহ পূর্বাঞ্চল অ্যাধেরবালের হাতে ন্যস্ত করা হয়।

অ্যাধেরবালের পতন

জুগুর্থা নুমিডিয়ার অংশবিশেষ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার মাথায় ছিল পুরো নুমিডিয়ার ক্ষমতা দখল করার চিন্তা। তিনি অ্যাধেরবালের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন। ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজধানী সির্টা অবরোধ করা হল। এখানে অ্যাধেরবালের হয়ে অনেক ইটালিয়ান, যারা সেখানে বসতি করেছিলেন, তারা লড়াই করছিলেন। রোম এই সময় দুবার প্রতিনিধি প্রেরণ করে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করে। কিন্তু  জুগুর্থার কূটচাল আর উপঢৌকনের লোভে তার বিপক্ষে কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিতে বিরত থাকে। ফলে সমঝোতার সমস্ত উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। হাতে সির্টার পতন হলে তার নির্দেশে অ্যাধেরবালকে হত্যা করা হয়। অ্যাধেরবালের বহু সমর্থক, যার মধ্যে এই ইটালিয়ান বসতি স্থাপনকারীরাও ছিল, তারাও জুগুর্থার অনুসারীদের হাতে প্রাণ হারায়। এই ঘটনায় রোমান নাগরিকদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হলো।

রোমান সিনেটের দ্বন্দ্ব

সির্টার ঘটনায় সিনেট অধিবেশনে বসতে বাধ্য হয়। জুগুর্থার উপহার প্রাপ্ত অনেক সিনেটর চেষ্টা করছিল সিনেটের আলোচনা দীর্ঘায়িত করার জন্য। তাদের আশা ছিল আস্তে আস্তে জনরোষ কমে আসবে এবং তখন পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু মেমিয়াস (Caius Memmius) নামে এক ট্রিবিউন তা হতে দিলেন না। তার নেতৃত্বে রোমান নাগরিকরা সিনেটের কাছে জুগুর্থার বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানাতে থাকে। অনেকটা বাধ্য হয়েই সিনেট ১১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু কন্সাল নির্বাচন আসন্ন থাকায় সাথে সাথে কোনো অভিযান প্রেরণ করা হয়নি। ১১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের জন্য সিপিও ন্যাসিকা (Scipio Nasica) এবং লুসিয়াস বেস্টিয়া (Lucius Bestia) কন্সাল নির্বাচিত হলে বেস্টিয়াকে নুমিডিয়া প্রদেশ হিসেবে অর্পণ করা হয়। তিনি সেখানে অভিযান চালাতে সৈন্য সমাবেশ করতে শুরু করলেন।

এদিকে রোমের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করার কোনো অভিলাষ জুগুর্থার ছিল না। তিনি আবারো ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইলেন। এই লক্ষ্যে মূল্যবান উপহার নিয়ে জুগুর্থার ছেলে রোমের উপকণ্ঠে হাজির হলে সিনেট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের প্রতিশ্রুতি ব্যতিরেকে তাদের শহরে ঢুকতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অন্যথায় দশ দিনের মধ্যে তাদের ইটালি ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বিফল হয়ে জুগুর্থার প্রতিনিধিদল ফেরত এলো।

বেস্টিয়ার যুদ্ধযাত্রা

কন্সাল বেস্টিয়া তার সেনাদল নিয়ে প্রথমে সিসিলি পাড়ি জমান, সেখান থেকে তার নৌবহর আফ্রিকার উপকূলে এসে ভিড়ল। তিনি নুমিডিয়ায় প্রবেশ করার আগে আশেপাশের বেশ কিছু নগর দখল করে নেন। জুগুর্থা রোমান বাহিনীর সাথে শক্তির পরীক্ষায় না গিয়ে আলোচনার রাস্তা ধরলেন। বলা হয় তিনি বেস্টিয়াকে প্রচুর অর্থসম্পদ ঘুষ দিয়ে অত্যন্ত নমনীয় শর্তে শান্তিচুক্তি করতে সক্ষম হন। জুগুর্থা নামেমাত্র আত্মসমর্পণ করেন এবং সামান্য কিছু উপঢৌকন রোমকে প্রদান করে তার রাজত্ব অটুট রাখতে সফল হলেন।

সিনেটের তদন্ত

বেস্টিয়া রোমে ফিরে গেলে মেমিয়াস কঠোরভাবে এই চুক্তির নিন্দা করলেন। তিনি প্রকাশ্যে বেস্টিয়া ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ আনলে রোমান সিনেট তদন্ত শুরু করে। জুগুর্থাকে নিরাপত্তার অঙ্গীকার প্রদান করে সাক্ষী দিতে রোমে আহ্বান করা হল।

জুগুর্থা রোমে এসে তার চরিত্র বদলালেন না। তিনি আবারও সিনেটকে ঘুষ দিয়ে কিনে নিতে চেষ্টা করলেন। তবে তার সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল রোমে থাকা অবস্থায় চাচাত ভাই ম্যাসিভাকে (Massiva) হত্যার ষড়যন্ত্র করা। তার উদ্দেশ্য ছিল সিংহাসনের অন্য দাবিদারদের সরিয়ে দিয়ে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা। ম্যাসিভাকে হত্যা করতে তার আততায়ী সমর্থ হয়, কিন্তু তার এই চক্রান্ত প্রকাশ হয়ে গেলে তার রোমান বন্ধুরাও মুখ ফিরিয়ে নিল। নিরাপত্তার অঙ্গীকার থাকায় সিনেট তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি, তবে অবিলম্বে তাকে রোম থেকে চলে যেতে আদেশ করা হয়। তার সাথে করা চুক্তিও সিনেট প্রত্যাখ্যান করে।

অ্যালবিনাসের পরাজয়

কন্সাল পস্টুমিয়াস অ্যালবিনাস ১১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নুমিডিয়াতে প্রবেশ করলেন। চতুর জুগুর্থা বুঝেছিলেন পস্টুমিয়াস বেশিদিন এখানে অবস্থান করতে পারবেন না, কারণ কন্সাল নির্বাচনে দাঁড়াতে তাকে পরের বছর আসার আগেই আবার রোমে ফিরে যেতে হবে। তাই তিনি সময়ক্ষেপণের কৌশল নিলেন। রোমানদের সাথে সম্মুখ সংঘর্ষে না জড়িয়ে তিনি মাঝে মাঝে অতর্কিত হামলা এবং নিস্ফল আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী করতে লাগলেন। তার কৌশল কাজে দিল। পস্টুমিয়াস রোমে ফিরে গেলেন তার ভাই অউলাস অ্যালবিনাসকে (Aulus Postumius Albinus) দায়িত্ব দিয়ে। তিনি সেনাদল নিয়ে ১০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সুথুল (Suthul)শহর অবরোধ করলেন, যেখান নুমিডিয়ার রাজকোষ ছিল।

১১০-১১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের রোমান ক্যাম্পেইন; Image Source: erenow.net

জুগুর্থা এই প্রথমবার সরাসরি রোমানদের সাথে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ সেনাপতি। তিনি অ্যালবিনাসকে অ্যামবুশের ভেতর টেনে নিয়ে এসে রোমানদের শিবিরে আক্রমণ চালালেন। বিশৃঙ্খল রোমান বাহিনী পরাজিত হলো। অ্যালবিনাস জুগুর্থার সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হলেন এবং রোমান সেনাদলকে নুমিডিয়া ত্যাগ করতে দশ দিনের সময় বেধে দেয়া হলো। অনুমিতভাবেই সিনেট এই চুক্তি উড়িয়ে দিয়ে জুগুর্থাকে দমন করতে বদ্ধপরিকর হলো।

মেটেলাসের আগমন এবং রোমানদের সাফল্য

১০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কন্সাল মেটেলাস (Caecilius Metellus) নুমিডিয়ার ব্যাপারে হেস্তনেস্ত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আফ্রিকায় অবতরণ করলেন। তার অন্যতম সহকারি মারিয়াস (Gaius Marius)। মেটেলাস সেনাবাহিনীর ভঙ্গুর মনোভাব চাঙ্গা করতে এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু সময় ব্যয় করলেন। জুগুর্থা মেটেলাসের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করতে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার আফ্রিকান শুভানুধ্যায়ীদের লোভ দেখিয়ে নিজের দলে টানতে চেষ্টা করলেন।

যথাযথ প্রস্তুতি শেষে মেটেলাস পূর্ব নুমিডিয়াতে অনুপ্রবেশ করে সেখানকার অন্যতম নগরী ভেগার (Vaga) নিয়ন্ত্রন নেন। জুগুর্থা মুথুল (Muthul) নদীর কাছে তাকে অ্যামবুশ করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। মেটেলাস এরপর নুমিডিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলিতে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকলেন। কিন্তু জুগুর্থা কিছুতেই সরাসরি যুদ্ধে জড়াচ্ছিলেন না। অনন্যোপায় হয়ে মেটেলাস যামা অবরোধ করলেন। জুগুর্থা আবারো সরাসরি লড়াই না করে পেছন থেকে রোমান শিবিরে দুবার হামলা পরিচালনা করে তাদের প্রায় পরাজিত করে ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মেটেলাস অবরোধ তুলে নিয়ে শীতকালীন আবাসে চলে গেলেন।

ব্রমিলকারের বিশ্বাসঘাতকতা

সিনেট ১০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দেও রোমান কমান্ডার হিসাবে মেটেলাসকে বহাল রাখে। সোজা আঙ্গুলে ঘি না ওঠায় মেটেলাস এবার আঙ্গুল বাঁকা করলেন। ম্যাসিভার হত্যাকারী ব্রমিলকারকে ক্ষমার ও ধন-দৌলতের আশ্বাস দেয়া হলো, যদি সে জুগুর্থাকে রোমের হাতে তুলে দিতে পারে। ব্রমিলকারের প্রচেষ্টায় দুই পক্ষ আবার আলোচনার টেবিলে বসে। এবার জুগুর্থা সদিচ্ছার দৃষ্টান্তস্বরূপ বেশ কিছু হাতি ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র, রৌপ্যমুদ্রা এবং রোমের দলত্যাগি সৈনিকদের মেটেলাসের হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু মেটেলাস তাকে সশরীরে হাজির হতে বললে আলোচনা ভেস্তে যায়।

জুগুর্থা এবার রোমানদের দখলকৃত শহরগুলো ছিনিয়ে নিতে চাইলেন। ভেগার অধিবাসীদের সহায়তায় শহরে থাকা রোমান বাহিনীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হলো। তবে মেটেলাস দ্রুতই নুমিডিয়ানদের পরাস্ত করে শহরের দখল আবার বুঝে নিলেন।

এদিকে ব্রমিলকার নুমিডিয়ান অভিজাত ন্যাবডালসার (Nabdalsa) সাথে জুগুর্থাকে উৎখাতের প্ল্যান সাজালেন। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা প্রকাশ পাবার উপক্রম হলে ন্যাবডালসা সাহস হারিয়ে জুগুর্থার কাছে সবকিছু বলে দেন। তাকে ক্ষমা করে জুগুর্থা ব্রমিলকারকে প্রাণদণ্ড দিলেন।

মেটেলাস ও মারিয়াসের দ্বন্দ্ব

১০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কন্সাল নির্বাচনে মারিয়াস অংশ নিতে চাইলে মেটেলাসের সাথে তার বচসা হয়। মেটেলাস মারিয়াসকে কন্সাল পদের জন্য যথেষ্ট অভিজ্ঞ মনে করতেন না। তার কথা ছিল আরো দশ-বিশ বছর পর হয়তো মারিয়াস কন্সাল হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপযুক্ততা অর্জন করবেন। তাই তিনি মারিয়াসকে রোমে যেতে দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের বারো দিন আগে মারিয়াস রোমে আসার অনুমোদন পান। ১০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মারিয়াস জয়ী হন।  সিনেট নুমিডিয়ার কমান্ড মেটেলাসের হাতে রাখতে ইচ্ছুক থাকলেও মারিয়াস রাজনৈতিক চাল চেলে নিজের হাতে কমান্ড তুলে নিলেন। ১০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেটেলাসকে প্রতিস্থাপন করতে মারিয়াস আফ্রিকাতে এসে পৌঁছলেন।

মারিয়াস; Image Source: Franz Venhaus/Ancient History Encyclopedia

মেটেলাসের অভিযানের পরিসমাপ্তি

এদিকে মারিয়াস যখন রোমে ব্যস্ত তখন মেটেলাস জুগুর্থাকে আরো একটি যুদ্ধে পরাজিত করেন। জুগুর্থা মরুভুমির ভেতর তার শক্ত ঘাঁটি থেলাতে (Thala) পালিয়ে গেলেন। তিনি মনে করেছিলেন মেটেলাস তাকে মরুভূমিতে ধাওয়া করবেন না। কিন্তু তার আশা ভুল প্রমাণ করে মেটেলাস থেলা অবরোধ করে বসলেন। জুগুর্থা পালিয়ে যান। ওদিকে চল্লিশ দিনের অবরোধ শেষে থেলার পতন ঘটল।

জুগুর্থা নুমিডিয়ান অঞ্চল থেকে বের হয়ে দক্ষিণ দিকে গেটুলিয়ানদের (Gaetulians) এলাকাতে চলে এলেন। তিনি এদের মধ্য থেকে অনেককে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। একই সময় তিনি তার শ্বশুর ও পার্শ্ববর্তী মৌরিতানিয়ার রাজা ব্রকাসের (Bocchus) সাথে রোমের বিরুদ্ধে সহায়তার আবেদন জানালেন।

এদিকে মেটেলাস সির্টা দখল করে ব্যাপক লুটপাট চালালেন। জুগুর্থা ও ব্রকাসের যৌথ বাহিনীর অগ্রসরের খবর পেয়ে তিনি শহর সুরক্ষিত করে এর নিকটে শিবির ফেলে অপেক্ষা করতে থাকলেন। এমন সময় রোম থেকে নুমিডিয়াতে অভিযানের কমান্ড মারিয়াসের কাছে হস্তান্তরের আদেশ এসে পৌঁছলে তিনি নতুন করে যুদ্ধ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। ব্রকাসের সাথে শান্তি আলোচনা চলতে থাকে। মারিয়াস এসে পৌঁছানো অবধি কোনো লড়াই আর হলো না। মেটেলাস রোমে ফিরে এলেন এবং তাকে বিজয়ীর সম্বর্ধনা দেয়া হলো, যা ট্রায়াম্ফ (Triumph) নামে পরিচিত। ট্রায়াম্ফ যেকোনো জেনারেলের জন্য ছিল সর্বোচ্চ মর্যাদার পুরস্কার।   

মারিয়াসের প্রস্তুতি

মারিয়াস সেনাবাহিনীতে নতুন সেনা ভর্তি করলেন। তিনি বেকার লোকজন, যারা ছিল রোমান সিটিজেনদের সর্বনিকৃষ্ট শ্রেণী, তাদেরকে বেতনভোগী সেনা হিসাবে বাহিনীতে যোগ দেবার সুযোগ করে দেন।

নিজের সেনাদল নিয়ে মারিয়াস উটিকাতে এসে জাহাজ ভেড়ালেন। তার  সাথে প্রধান সহকারি উচ্চাভিলাষী রোমান অফিসার লুসিয়াস কর্ণেলিয়াস সুলা (Lucius Cornelius Sulla)। মারিয়াস প্রথমে নুমিডিয়ার অরক্ষিত এলাকাগুলো আক্রমণ করলেন। ছোট ছোট সংঘর্ষের মাধ্যমে তার সেনারা প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করলে তিনি জুগুর্থার মূল ঘাটিগুলোতে হামলা করা শুরু করল। কিন্তু জুগুর্থা ও ব্রকাস কেউই তাকে বাধা দিতে এগিয়ে এলেন না। জুগুর্থাকে যুদ্ধে টেনে আনতে মারিয়াস এবার তিন রাত মার্চ করে মরুভুমির অভ্যন্তরে ক্যাস্পা  আক্রমণ করলেন। বাসিন্দাদের হত্যা করে শহর জ্বালিয়ে দেয়া হলো। বেঁচে থাকাদের স্থান হলো দাস বেচা-কেনার মার্কেটে।

মারিয়াসের অভিযান; Image Source: erenow.net

মারিয়াস ক্রমশ নুমিডিয়ার ভেতরে ঢুকে গেলেন। তিনি জুগুর্থার প্রতি বিশ্বস্ত শহর পেলেই তা পুড়িয়ে দিতে দিতে এগোতে থাকলেন। ১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মুলুচ্চা (Muluccha) নদীর ধারে মারিয়াস পাহাড়ের ঢালে জুগুর্থার একটি শক্তিশালী দুর্গের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। রোমান সৈনিকেরা দুর্গের পেছন দিক দিয়ে পাহাড়ে উঠার একটি পথ খুঁজে পেলে এর পতন ঘটে।      

সির্টার প্রথম যুদ্ধ (১০৬/১০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

শীত ঘনিয়ে আসতে থাকলে মারিয়াস সির্টায় রোমান ঘাঁটি থেকে বের হয়ে পূর্বদিকে তার শীতকালীন আবাসের দিকে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে জুগুর্থা ও ব্রকাসের মিলিত বাহিনী তার উপর হামলা করে। এখানে লড়াইয়ের ঘটনাক্রম সম্পর্কে স্যালুস্ট ও অরোসিউসের দুই রকম মত পাওয়া যায়।

স্যালুস্টের মত: অতর্কিত আক্রমণে প্রথমে রোমানরা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লেও দ্রুতই মারিয়াসের উৎসাহে তারা ঘুরে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা নেমে আসতে থাকলে নুমিডিয়ান বাহিনী ক্ষান্ত দিল। মারিয়াস নিকটবর্তী এক পাহাড়ে ক্যাম্প করলেন। তার নির্দেশে সৈন্যরা খুব ভোরে পাহাড় থেকে নেমে অতর্কিতে জুগুর্থার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নুমিডিয়ানদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে রোমান বাহিনী আবার আগের পথে রওনা হলো।

অরোসিউসের মত: জুগুর্থার মতো অভিজ্ঞ জেনারেল স্যালুস্টের বর্ণিত কৌশলে ধোঁকা খাবেন একথা মেনে নেয়া কঠিন। অরোসিউসের দাবী করেন সির্টার সামনেই জুগুর্থা ও ব্রকাসের ৬০,০০০ সেনা রোমানদের ঘিরে ফেলে। তিনদিন ধরে জুগুর্থার অশ্বারোহী বাহিনী রোমান পদাতিকদের নাগালের বাইরে থেকে উত্যক্ত করতে থাকে। মারিয়াস নুমিডিয়ানদের ব্যূহ ভাঙতে সর্বাত্মক হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। রোমান সেনাদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তারা ধীরে ধীরে পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় তুমুল বৃষ্টি নামে। এই অবস্থায় যুদ্ধ করা ছিল অসম্ভব। কাজেই নুমিডিয়ানরা শিবিরে ফিরে গেলে রোমানরা দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করে।

সির্টার প্রথম যুদ্ধ; Image Source: wallpaperaccess.com

দুই ক্ষেত্রেই এ কথা মেনে নেয়া হয়েছে যে সির্টার প্রথম যুদ্ধ শেষ হয় অমীমাংসিতভাবে। তবে রোমানদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেই তুলনায় নুমিডিয়ানদের বড় কোনো ক্ষতি হয়নি।

সির্টার দ্বিতীয় যুদ্ধ

মারিয়াস সেনাদলের সব মালামাল মাঝখানে রাখলেন। সামনে আর পেছনে পদাতিক ব্যূহ গঠন করা হলো, ডান পাশে সুলার নেতৃত্বে অশ্বারোহী আর বামে ম্যানলিউসের অধীনে অন্যান্য সেনা। জুগুর্থা ও ব্রকাস প্রায় চারদিন তাড়া করে তাদের ধরে ফেলতে সক্ষম হলেন।

জুগুর্থা বাহিনীকে চার ভাগে ভাগ করলেন। ব্রকাসের নেতৃত্বে একদল রোমানদের পেছন দিকে আক্রমণ করলে, জুগুর্থা হামলা করলেন সামনের দিকে, যেখানে মারিয়াস ছিলেন। বাকি দুই অংশ রোমানদের দুই পাশে আঘাত করল।

সির্টার দ্বিতীয় যুদ্ধ; Image Source: mediafire.com

সুলা ডান বাহুতে হামলাকারীদের পরাস্ত করে তাদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাড়িয়ে নিয়ে গেলেন। মারিয়াসের অধীনে সম্মুখভাগও শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলল। কিন্তু পেছনভাগে ব্রকাস রোমান ব্যূহ প্রায় ভেঙে ফেলার উপক্রম করলেন। এই সময় সুলা ফিরে এসে তাকে পাশে থেকে আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। মারিয়াসও জুগুর্থাকে হটিয়ে দিলেন। নুমিডিয়ানরা পরাজিত হলো। মারিয়াস বছরের বাকি সময় তার শীতকালীন কোয়ার্টারে কাটালেন।

যুদ্ধের পরিসমাপ্তি

শীত শেষ হলে মারিয়াস মূল সেনাদল সুলার অধীনে রেখে কিছু সেনা নিয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকাতে অভিযান চালান। ইতোমধ্যে ব্রকাস রোমানদের সাথে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার দূতেরা সুলার মাধ্যমে মারিয়াসের সাথে যোগাযোগ করে।

সুলা; Image Source: Carole Raddato/Ancient History Encyclopedia

সিনেটের অনুমোদন নিয়ে ব্রকাসের সাথে কথাবার্তা চলতে থাকে। সিনেট শর্ত দেয় যে ব্রকাসের সদিচ্ছা প্রমাণ করতে জুগুর্থাকে রোমের হাতে তুলে দিতে হবে। সুলার প্ররোচনায় ব্রকাস রাজি হন। শান্তি আলোচনার কথা বলে জুগুর্থাকে ডেকে আনা হয়। ব্রকাসের ইশারায় তার লোকেরা জুগুর্থার সাথীদের হত্যা করে। জুগুর্থাকে সুলার হাতে তুলে দেয়া হয়। শেষ হয়ে যায় জুগুর্থাইন যুদ্ধ। বন্দি জুগুর্থাকে রোমে আনা হয় এবং ১০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারিয়াসের জন্য আয়োজিত ট্রায়াম্ফ শেষে তাকে হত্যা করা হয়।

বন্দি জুগুর্থা ; Image Source: Ancient History Encyclopedia

নুমিডিয়ার পরিণতি

বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার হিসেবে নিজ রাজ্যের পাশাপাশি নুমিডিয়ার পশ্চিমের এক বড় অংশ ব্রকাসের হস্তগত হয়। বাকি অংশের রাজা হিসেবে জুগুর্থার সৎ ভাই গওডাকে (Gauda) ক্ষমতায় বসান হয়। নুমিডিয়া এবং মৌরিতানিয়া পরিণত হয় রোমের বশংবদ রাষ্ট্রে।

Related Articles

Exit mobile version