রোম ও সাসানিদরাই ছিল প্রাক ইসলামিক এবং ইসলামের উত্থানের যুগের সর্বপ্রধান শক্তি। তবে অন্যান্য কিছু সাম্রাজ্যও উল্লেখের দাবিদার। প্রাচীন এক পার্সিয়ান লেখক তার সময়ে পৃথিবীর চারটি প্রধান পরাশক্তির কথা বলেছেন- রোম, পারস্য, আক্সাম আর চীন। রোম আর পারস্য নিয়ে আমরা গত পর্বগুলোতে বলেছি, বাকি রইল চীন আর আক্সাম।
আক্সাম
আক্সাম (Aksum) সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল প্রাচীন আক্সাম শহরকে কেন্দ্র করে। মূলত খ্রিষ্টীয় প্রথম থেকে সপ্তম শতাব্দী ছিল তাদের সময়কাল। তবে এখানে মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বহু আগে থেকেই। এর অবস্থান ছিল আফ্রিকাতে, লোহিত সাগরের উত্তর উপকূল ঘেঁষে। বর্তমান ইথিওপিয়া এবং ইরিত্রিয়ার মধ্যে এই জায়গা পড়েছে। নিজেদের চরম উৎকর্ষের সময়ে এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া এবং আরো কিছু আফ্রিকান রাষ্ট্র। আক্সামের অন্তর্ভুক্ত ছিল ইথিওপিয়া, যাকে আরবরা বলত আবিসিনিয়া। আক্সাম সাম্রাজ্য ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে নিজেদের জন্য আলাদা মুদ্রা চালু করে, এছাড়াও তারা গিজ নামে নিজস্ব লেখার ভাষা তৈরি করেছিল (Ge’ez) যা এখনও ইথিওপিয়ার অনেক জায়গাতে ব্যবহৃত হয়।
আক্সাম নগরীর অবস্থান ছিল লোহিত সাগরের পাড়ে এমন এক স্থানে, যেখান দিয়ে ভারত মহাসাগর এবং পূর্ব আফ্রিকা থেকে মিশর হয়ে ইউরোপের দিকে যাওয়া যেত। অধিবাসীরা কৃষিকাজের পাশাপাশি তাই প্রচুর ব্যবসা বাণিজ্যের কাজ করতে পারত। এদিকে রোমের সাথে পার্সিয়ান অঞ্চলগুলোর সংঘাতের ফলে প্রাচ্য থেকে বিলাস সামগ্রী নিরাপদে পরিবহনের জন্য তারা নিরাপদ কোনো রাস্তা খুঁজতে থাকে, যা পার্সিয়ান বা সাসানিদদের আওতার বাইরে। ফলে আক্সাম খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং এর অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে।
প্রতিষ্ঠা এবং প্রসার
বলা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর শেষে কোনো এক শক্তিশালী নেতা আশেপাশের সমস্ত গোত্রপ্রধানের উপর প্রভুত্ব স্থাপনে সক্ষম হন। তিনিই আক্সামের প্রথম রাজা। এরপর বংশানুক্রমে রাজার শাসন জারি থাকে। ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বর্তমান ইয়েমেনের কিছু অংশে তাদের ক্ষমতা বিস্তৃত হয়। দক্ষিণ-পূর্বে সোমালিয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার বহু এলাকাও আক্সামের রাজা অধিকার করে নেন। এখাকার বাসিন্দাদের নির্দিষ্ট বার্ষিক করের বিনিময়ে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়। সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির সাথে তাল মিলিয়ে আক্সামের শাসক নেগুসা নেগাস্ট (Negusa Negast / ‘king of kings’) উপাধি ধারণ করলেন।
চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যভাগে আক্সাম বিপদের মুখোমুখি হলো। বর্তমান সুদানকে ঘিরে থাকা নুবিয়া রাজ্য তাদের আক্রমণ করে। আক্সামের রাজা তখন প্রথম এজানা, তিনি বিশাল এক বাহিনী নিয়ে শত্রুদের রাজধানী মেরো (Meroe) অবরোধ করে একে তছনছ করে দেন। আক্সামের তীব্র আঘাতে নুবিয়া ভেঙে পড়ে, এর সাম্রাজ্য তিনভাগ হয়ে যায়। ফলে এই এলাকায় আক্সামের শক্তি চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ থাকল না।
ষষ্ঠ শতকের শুরুতে আক্সামের রাজা প্রথম ক্যালেবের নজর পরে ইয়েমেনের দিকে। আক্সামের মূল চালিকাশক্তি ছিল বাণিজ্য, ইয়েমেন দখল করতে পারলে অনেক বানিজ্যপথের উপরই আক্সামের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। এই সময় আক্সাম সাম্রাজ্য খ্রিষ্টীয় ধর্মমতে দীক্ষিত হয়েছিল। ফলে ইয়েমেনের তৎকালীন রাজা ইউসুফ (Yusuf As’ar Yathar) খ্রিষ্টান নাগরিকদের অত্যাচার শুরু করলে তাদের রক্ষার ছুতোয় ক্যালেব ইয়েমেনের দিকে সসৈন্যে যাত্রা করেন। লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে ক্যালেব সেখানে আক্সামের শক্ত ঘাটি স্থাপন করেন, যা টিকে ছিল ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সাসানিদরা এই এলাকাতে প্রবেশ করবার আগপর্যন্ত।
তৃতীয় শক্তি-আক্সাম
বিরাজমান পরাশক্তি রোম ও সাসানিদদের তুলনায় আয়তন এবং সামরিক শক্তিতে দুর্বল হলেও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকায় তৎকালীন বিশ্বে আক্সামের আলাদা সমাদর ছিল। আফ্রিকান প্রধান সভ্যতা মিশর তখন পতনের দিকে, সেই সময় সাহারার এই নতুন সাম্রাজ্য আফ্রিকার পতাকা আরেকবার উচিয়ে ধরল। দাবি করা হয়, নিজস্ব ভাষারীতি ও জ্ঞানবিজ্ঞানে আক্সাম প্রাচ্যিয় বা পাশ্চাত্য সভ্যতার থেকে কোনো দিক থেকেই পিছিয়ে ছিল না। ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন রাজা, যার অধীনে ছিলেন অধীন রাজ্যের শাসকেরা, অভিজাত সম্প্রদায় এবং সেনাবাহিনী। এই সভ্যতা মূলত নগর কেন্দ্রিক বলে মনে করা হয়, প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখন পর্যন্ত সাম্রাজ্যে ১০-১২টি শহরের সন্ধান পেয়েছেন।কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে আক্সাম সম্পর্কে আমদের জ্ঞান খুবই সীমিত। তাদের সামাজিক আচার, দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ কোনো কিছু সম্বন্ধেই আমরা খুব ভালো জানি না।
ধর্ম
চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দের আগপর্যন্ত আক্সামের লোকেরা বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসনা করত। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন:
- মাহরাম- যুদ্ধ আর রাজবংশের দেবতা। তিনিই সম্ভবত ছিলেন প্রধান দেবতা।
- হাবাস- চন্দ্রদেবি
- আস্তার- শুক্রগ্রহ, বা ভেনাসের প্রতিরূপ
- পাতালের দেবতা, বেহের আর মেডের
দেব-দেবীর মন্দিরে আক্সামের নাগরিকেরা পূজো দিত। আচার অনুষ্ঠানে দেবতাদের খুশি করতে পশু বলি দেবার রীতিও প্রচলিত ছিল। পুরোহিতরা এসব ধর্মীয় কাজ পরিচালনা করতেন।
খ্রিস্টধর্ম: চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রুমেন্তিয়াস নামে এক নাবিক জাহাজডুবি হয়ে আক্সামে আশ্রয় নেন। তিনি ছিলেন বর্তমান লেবাননের অন্তর্গত প্রাচীন ফিনিশিয়ান নগরী টাইরের মানুষ। টাইরে তখন খ্রিষ্টধর্মের জয়জয়কার। ফ্রুমেন্তিয়াস লেখাপড়া জানা লোক ছিলেন, ফলে তৎকালীন রাজা এলা আমিদা তাকে রাজপরিবারের বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব দেন। এলা আমিদার মৃত্যুর পরে প্রথম এজানা অভিষিক্ত হন, ফ্রুমেন্তিয়াস ছিলেন যার ছেলেবেলার শিক্ষক। ফলে তিনি সহজেই নতুন রাজাকের প্রভাবিত করে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করেন। এরপর ফ্রুমেন্তিয়াস আলেক্সান্দ্রিয়ার প্রধান ধর্মগুরুর সাথে দেখা করেন এবং তার কাছ থেকে আক্সামে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের আনুষ্ঠানিক অনুমতি এবং পদ আদায় করে নেন।
তিনি ফিরে এলে তাকে আক্সামের বিশপ নিযুক্ত করা হয়। এজানার আদেশে আক্সামের বহু নর-নারী খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করল। পরবর্তীতে রাজা ক্যালেব যখন ইয়েমেনে খ্রিষ্টানদের রক্ষার কথা বলে অভিযান চালান, তখন তৎকালীন বাইজান্টাইন সম্রাট তাকে খ্রিষ্টীয় নানা উপাধিতে ভূষিত করেন। তবে ষষ্ঠ শতাব্দী অবধি অনেক পৌত্তলিক নাগরিক আক্সামে ছিল, এবং চার্চের পাশাপাশি দেব-দেবীদের মন্দিরও দেখা যেত। আক্সামে সবচেয়ে প্রধান চার্চের নাম ছিল মেরি সিয়নের গির্জা (The Church of Maryam Tsion)। প্রাচীন ইথিওপিয়ান কিছু কিছু কাহিনীতে বলা হয় এখানে নাকি ইহুদিদের আর্ক অফ কভেন্যান্ট রক্ষিত ছিল।
ইহুদি ধর্ম
ইথিওপিয়ানদের একাংশ ইহুদি ধর্ম পালন করত। এদের বলা হত বেটা ইসরাইল (House of Israel)। তারা কৃষ্ণবর্ণের ইহুদি (Black Jews) নামেও পরিচিত ছিল। ইহুদিদের রীতিনীতি তারা সবই মানত, তবে হিব্রুর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ ছিল স্থানীয় ভাষায় রচিত। প্রার্থনাও তারা নিজদের ভাষাতেই করত। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, তারা আসলে ইহুদি বলতে আমরা যা বুঝি তা ছিল না, বরং এরা ছিল প্রাচীন একটি সেমিটিক গোষ্ঠী যাদের ধর্ম ইহুদিদের খুব কাছাকাছি।
আক্সামের ইতিহাসে রাজা সলোমন
সলোমন (ইসলাম ধর্মমতে নবী সোলায়মান আঃ) আর শেবার রানীর কাহিনী কুরআন, বাইবেলসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও বলা আছে। শেবা রাজ্যের অবস্থান নিশ্চিত নয়, তবে বেশ কিছু জায়গাকে শেবা মনে করা হয় যার একটি হলো আক্সাম। ইথিওপিয়ান ঐতিহ্যমতে আক্সামের রানীই নাকি ছিলেন সেই রানী, যিনি সলোমনের সাথে দেখা করেছিলেন। বলা হয়, তাদের প্রথম দেখা হয় জেরুজালেমে। সলোমন আর শেবার রানীর সন্তান প্রথম মেনেলিক থেকে সলোমনের রাজবংশের উৎপত্তি হয়, যারা যুগের পর যুগ ধরে ইথিওপিয়া আর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল শাসন করে গেছে। এমন গল্পও আছে যে, মেনেলিক নাকি পিতার সাথে দেখা করবার সময় আর্ক অফ কভেন্যান্ট সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। আজও ইথিওপিয়ার প্রতিটি গির্জাতে আর্ক অফ কভেন্যান্টের রেপ্লিকা রাখা আছে।
আবিসিনিয়া
ষষ্ঠ শতকের শেষ দিক থেকেই আক্সামের পতন শুরু হয়ে যায়। দুর্বল রাজাদের হাত থেকে ফস্কে যেতে থাকে সমস্ত এলাকা। খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায় পুরো রাজ্য। তবে আক্সাম নগরী প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে হিসেবে থেকে যায়, একে ঘিরে নতুন রাজ্য আবিসিনিয়ার উৎপত্তি হয়। ইসলামের আগমনের পর আবিসিনিয়ার সাথে মুসলিমদের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।
চীন
আরবে মহানবী (সা.) এর জন্মগ্রহণের পূর্বে চিন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ব্যাপক উন্নতি করছিল। বহুদিন বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক রাজাদের চলতে থাকা দ্বন্দ্ব দমন করে উত্থান ঘটেছে তখন সুই রাজবংশের। যদিও তাদের শাসনকাল তুলনামূলকভাবে খুব বেশি দিন ছিল না, তথাপি চীনের একত্রীকরণ এবং নতুন স্বর্ণালী যুগের সূচনা করতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের দেখানো পথেই পরবর্তীতে ট্যাং রাজবংশ এগিয়ে যায়। ইসলামের আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্বে সম্ভবত চীনই ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে সবচেয়ে অগ্রসর সাম্রাজ্য। তাদের ছিল কেন্দ্রীয় সুশৃঙ্খল একটি শাসনব্যবস্থা, নয়নাভিরাম স্থাপত্য, সাংস্কৃতিক এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আর সাম্রাজ্যের চারদিক দিয়ে চলে যাওয়া বাণিজ্যপথ, যা ব্যবহার করে দূর-দূরান্তে বণিকেরা ভ্রমণ করত। তাদের ছিল নিজস্ব ধর্ম ও শিক্ষাব্যবস্থা।
ভারত
পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পরে ভারত উপমহাদেশে বিরাজ করছিল গোলযোগপূর্ণ আবহাওয়া। শক্তির ভারসাম্য ভাগ হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু আঞ্চলিক রাষ্ট্রের কাছে। হিন্দু ধর্মই ছিল তাদের প্রধান ধর্ম, তবে জৈন ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যাও কম ছিল না। এছাড়া এই সময় চীন ও ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম বেশ প্রসার লাভ করে। কিন্তু উপমহাদেশে কোনো কেন্দ্রীয় শক্তি না থাকায় এবং নানা রাজ্যের মধ্যে বিবাদের জের ধরে বহিঃশত্রু প্রতিরোধের সক্ষমতা কিন্তু কমে গিয়েছিল। এই সূত্র ধরেই আস্তে আস্তে মুসলিমরা ভারতে প্রবেশ করে।