ডুলিটল রেইড: পার্ল হারবার হামলার জবাব ও চাইনিজ ভুক্তভোগীদের করুণ কাহিনি

৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সাল। যুক্তরাষ্ট্রকে হতভম্ব করে দিয়ে তাদের প্রশান্ত মহাসাগরীয় সামরিক ঘাঁটি পার্ল হারবারে বিমান হামলা চালায় জাপান। এরই মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ভয়ংকর এই হামলাটি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও সামরিক বাহিনীর মনোবল একেবারে তলানীতে নামিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট তার বাহিনীর চীফ অফ স্টাফদের সাথে একটি মিটিংয়ে বলেন,

“Japan should be bombed as soon as possible to boost public morale after Pearl Harbor”

ফলে তড়িঘড়ি করে জাপানের রাজধানীতে বিমান হামলার এই ঝুঁকিপূর্ণ ও আত্মঘাতী অপারেশন শুরু হয়। মিশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেমস ডুলিটলের নামানুসারে একে ‘ডুলিটল রেইড‘ নামকরণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল জাপানিদের মনে তাদের নেতাদের নেতৃত্ব নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করা। জেনারেল ও রাজনৈতিক নেতারা নাগরিকদের আশ্বস্ত করেছিল যে জাপানিদের উপর পাল্টা হামলা করার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। কিন্তু তাদের হোম আইল্যান্ডের উপর বিমান হামলা প্রমাণ করে দেয় যে তাদের মূল ভূখণ্ড এখন আর নিরাপদ নয়।

পার্ল হারবার আক্রমণের পর এডমিরাল ইয়ামামোতো মত দেন যে মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো জাপানের জন্য হুমকিস্বরূপ। এদেরকে অবিলম্বে ধ্বংস করা দরকার। কিন্তু জাপানি হাইকমান্ড তা অনুমোদন করেনি। কিন্তু ডুলিটল রেইডের পর ইয়ামামোতোর ধারণা সঠিক বলে প্রমাণিত হয় যা যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের মধ্যে বড় ধরনের নৌযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌযুদ্ধ ব্যাটল অফ মিডওয়ের নেপথ্য কারণ ছিল এই ডুলিটল রেইড।

পার্ল হারবারে জাপানি বিমান হামলার কিছু দুর্লভ রঙিন ছবি; Image source : dailymail.co.uk

আক্রমণের প্রস্তুতি

এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার শ্রেণীর জাহাজ তুলনামূলক হালকা ‘ফাইটার-বোম্বার’ শ্রেণীর বিমান ওড়ানোর জন্য উপযোগী। কিন্তু পুরোদস্তুর বোমারু বিমান উড়ানোর এই অদ্ভুত আইডিয়া ঐ মিটিংয়ের সময় মাথায় আসে অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ অভ স্টাফ ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস এস.লো-র মাথায়। আইডিয়াটি এডমিরাল আর্নেস্ট কিংয়ের পছন্দ হয় এবং তিনি এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ইউএস আর্মি এয়ারফোর্সের (আগে মার্কিন বিমানবাহিনী সেনাবাহিনীর অংশ ছিল) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেমস ডুলিটলকে নির্দেশ দেন। তিনি হিসাব করে দেখেন যে এই মিশনের জন্য ২,৪০০ নটিক্যাল মাইল (৪,৪০০ কি.মি.) রেঞ্জের বিমান দরকার। কিন্তু দু’হাজার পাউন্ড বোমা বহনে সক্ষম ডাবল ইঞ্জিনের বি-২৫ মিডিয়াম বোমারু বিমানের রেঞ্জ মাত্র ১,৩০০ নটিক্যাল মাইল। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ছোট্ট ডেক থেকে এর উড্ডয়ন সক্ষমতা আছে, কিন্তু অবতরণ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

শেষপর্যন্ত এই বিমানকেই বেছে নেয়া হয়। ঠিক করা হয় যে হামলার পর বিমানগুলো মিত্রবাহিনীর অন্যতম সদস্য সোভিয়েত ইউনিয়নে অবতরণ করবে। কিন্তু দেশটির সাথে জাপানের ‘অনাক্রমণ চুক্তি’ থাকায় তারা রাজি হয়নি। উল্লেখ্য, চীনে জাপানি আগ্রাসনের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীন-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। তারা জাপানি প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে হামলার পর বিমানগুলোকে চীনে অবতরণ ও রিফুয়েলিং সুবিধা দেয়ার জন্য রাজি হয়।

 B-25B Mitchell বোমারু বিমানকে এই মিশনের জন্য নির্বাচন করা হয়; Photographer: Lukas skywalker
 

সবকিছু ঠিকঠাক হতেই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও আত্মঘাতী এই মিশনের জন্য ভলান্টিয়ার পাইলট ও ক্রু খোঁজা শুরু হয়।

মিশনের জন্য ২৪টি বিমানকে মডিফাই করা শুরু হয়। বিমানের পেটের (ফিউজলাজের) নিচে থাকা মেশিনগান টারেট অপসারণ করে এন্টি এয়ারক্রাফট কামানের গোলা থেকে বাঁচতে স্টিলের ব্লাস্টপ্লেট লাগানো হয়। বিমানের নাকের সামনে ও পিঠের উপর দুটো মেশিনগান টারেট বহাল রেখে লেজের দিকে একটি নকল মেশিনগান বসানো হয়। হামলার ভিডিও ফুটেজ পেতে দুটো বিমানে ক্যামেরা ইন্সটল করা হয়। বিমানের ওজন কমানোর জন্য বিভিন্ন বাড়তি জিনিস (যেমন- মেশিনগান, লংরেঞ্জ রেডিও সেট) অপসারণ করা হয়। চীনে ল্যান্ড করতে হলে অতিরিক্ত ৬০০ নটিক্যাল মাইল আকাশ পাড়ি দিতে হবে। তাই পেটের নিচে বাড়তি ১৬০ গ্যালনের ফুয়েল ট্যাংক লাগানো হয়। এমনকি বিমানের ভেতরে তেলের বড় বড় জার নেয়া হয় যা ম্যানুয়ালি তেলের ট্যাংকে ঢেলে ফুয়েল বাড়াতে হতো যা এভিয়েশন ইতিহাসে নজিরবিহীন ব্যবস্থা। ফলে বি-২৫ বোম্বারগুলোর ফুয়েল ক্যাপাসিটি ২,৪৪৫ লিটার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪,৩১৯ লিটারে পায়।

রেইডার পাইলটদের তিন সপ্তাহ ট্রেনিং দেয়ার পর এই মিশন গ্রিন সিগন্যাল পায়। কিন্তু জায়গার অভাবে মাত্র ১৬টি বিমান এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ‘ইউএসএস হরনেট’ এ ক্রেন দিয়ে উঠানো হয়। বিমানবাহী এই জাহাজটি জাপানি জলসীমায় ঢুকে বি-২৫ বোমারু বিমানগুলোকে লঞ্চ করবে। গ্রাউন্ড এবং এয়ার ক্রু মিলিয়ে মোট ২০১ জনকে এই মিশনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। প্রতিটি বি-২৫ চালানোর জন্য পাঁচজন ক্রু দরকার ছিল। একটি বিমানে চারটি করে ৫০০ পাউন্ডের হাই-এক্সপ্লোসিভ বোমা বহন করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, রেইডের আগে মার্কিন সেনাদের জাপানের দেয়া ফ্রেন্ডশিপ মেডেলগুলো বোমায় বেঁধে দিয়েছিল। মার্কিনিদের রসবোধ আছে বলতেই হবে!

নিজের বিমানের ক্দেরুর সাথে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেমস ডুলিটল (বাম থেকে দ্বিতীয়)। জাপানের দেয়া ফ্রেন্ডশিপ মেডেলগুলো বোমায় বেঁধে দিচ্ছেন তিনি (ডানে); Image source :  www.af.mil
এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ডেকে গাদাগাদি করে রাখা বি-২৫ বোমারু বিমানগুলো; Image source : National Museum of the U.S. Air Force

বিমান হামলা ও পাইলটদের পরিণতি

২ এপ্রিল, ১৯৪২ সালে ইউএসএস হরনেট যুক্তরাষ্ট্র থেকে যাত্রা শুরু করে। কয়েকদিন পর এটি হাওয়াই দ্বীপের কাছে ভাইস এডমিরাল উইলিয়াম হ্যালসির ব্যাটল গ্রুপ ‘টাস্কফোর্স ১৬’ এর সাথে যোগ দেয়। উল্লেখ্য, ইউএসএস হরনেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল অপর এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইউএসএস এন্টারপ্রাইজসহ চারটি ক্রুজার ও আটটি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর জাহাজ। ফ্লাইট ডেকে বোম্বারগুলো থাকায় হরনেট নিজের ফাইটারগুলো আকাশে ওড়াতে সক্ষম ছিল না। এরা নিজেদের মধ্যে সম্পূর্ণ রেডিও সাইলেন্স বজায় রাখে।

১৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে সাতটায় জাপানের মূল ভূখণ্ড থেকে ১,২০০ কি.মি. দূরে থাকতেই মার্কিনিরা একটি জাপানি পেট্রোলক্রাফটের চোখে ধরা পড়ে যায়। যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ন্যাশভাইল কামান দাগিয়ে একে ডুবিয়ে দেয় এবং পাঁচ নাবিককে বন্দি করে। জাপানি ক্যাপ্টেন ধরা পড়া এড়াতে আত্মহত্যা করার আগে সম্ভাব্য মার্কিন হামলার তথ্য রেডিওতে নেভি হেডকোয়ার্টারকে জানিয়ে দেয়। ইউএসএস হরনেটের ক্যাপ্টেন মার্ক মিটস্কের সঙ্গে আলোচনা করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেমস ডুলিটল অবিলম্বে টেকঅফ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যদিও বাজে আবহাওয়ার কারণে তখন আকাশে ওড়া ছিল বেশ কষ্টকর ব্যাপার। 

জাহাজের ডেকে পাইলট-ক্রুদের পিছনে রেখে ক্যাপ্টেন মার্ক মিটস্কের সঙ্গে কথা বলছেন জেমস ডুলিটল। ডানের ছবিতে ডুবে যাওয়া জাপানিজ পেট্রোল বোট ‘নিত্তো মারু’; Image source : U.S.Navy

ফলে নির্ধারিত সময়ের দশ ঘন্টা আগেই টেকঅফ জোন থেকে ১৭০ নটিক্যাল দূরে থাকতেই একে একে আকাশে ওড়ে ১৬টি বি-২৫ বিমান। জাপানি বিমানের চোখে ধরা পড়া এড়াতে এরা চারটি বিমানের গ্রুপ করে অধিক উচ্চতায় উড়তে শুরু করে। ছয় ঘন্টা ফ্লাইটের পর এরা দুপুরের দিকে জাপানের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছায়। এবার বিমানগুলো মাত্র ১৫০০ ফুট উচ্চতায় নেমে এসে বোমা ফেলতে শুরু করে। রাজধানী টোকিওর ১০টি সামরিক ও শিল্প কারখানায় বোমা ফেলা হয়। অপর বিমানগুলো ইয়াকোহামা, ইয়োসুকা, নাগোয়া, কোবে, ওসাকা শহরের ছয়টি টার্গেটে বোমা ফেলে। বিমানগুলো অল্প কিছু এন্টি এয়ারক্রাফট মেশিনগান ও কয়েকটি ফাইটারের সামান্য প্রতিরোধের কবলে পড়ে। জাপানিদের ধারণাই ছিল না এতদূর এসে কেউ আক্রমণ করবে। মার্কিনিরা তিনটি জাপানি বিমান ভূপাতিত করার দাবি করে। বোম্বারগুলোর সাথে কোনো নিরাপত্তা প্রদানকারী (এসকর্ট) ফাইটার না থাকলেও তাদের সঙ্গে দুটি করে মেশিনগান ছিল। সেগুলোর গুলিতেই জাপানি ইন্টারসেপ্টর ভূপাতিত হয়েছিল। লে. কর্নেল ডুলিটল তার আফটার একশন রিপোর্টে লিখেছেন যে তাদের বি-২৫ বোম্বারের লেজের দিকে থাকা নকল মেশিনগান দেখে জাপানি ফাইটার পাইলটরা ধোঁকা খেয়ে পেছন থেকে আক্রমণ করার সাহস করেনি।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেমস ডুলিটল চালিত প্রথম বিমানটি আকাশে উড়তে ব্যর্থ হলে মিশনটি
বাতিল করে দেয়া হতো! Image source : National Museum of the U.S. Air Force
এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইউএসএস হরনেট থেকে বি-২৫ এর টেকঅফ ও বোমা ফেলার দৃশ্য
Image source : U.S. Army Air Force
 

হামলা শেষ করে পাইলটরা পরিকল্পনা মোতাবেক চীনের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জে. ইয়র্কের বিমানটির ফুয়েল খুবই কমে গিয়েছিল। তিনি বাধ্য হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে যাত্রা শুরু করেন। তিনি নিরাপদে ল্যান্ড করলেও জাপানের সাথে অনাক্রমণ চুক্তির কারণে তাকে ও তার ক্রুদের যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায় দেশটি। তবে তাদেরকে বন্দী করা হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে তখন যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক ছিল। ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড ও তার ক্রুদের ইরান সীমান্তে পাঠানো হয়। সেখান থেকে  ব্রিটিশ দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে ফেরেন।

বাকি পনেরটি বিমান চীনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ঝেইজিয়াং অঞ্চলে একদল চাইনিজ সিগন্যালম্যান মার্কিন বি-২৫ বিমানগুলোকে হোমিং বিকন (লাইট) দিয়ে চংকিং এয়ারফিল্ডে যাওয়ার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু টাস্কফোর্স ১৬ এর এডমিরাল হ্যালসি নিজের পজিশন ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাদের সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করেননি। ফলে রাতের অন্ধকারে ও পূর্ব চীন সাগরের প্রচন্ড খারাপ আবহাওয়ায় ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে দিকভ্রান্ত বিমানগুলো। জ্বালানী এতটাই কম ছিল যে চীনের কাছাকাছি গিয়ে সাগরে ক্রাশ করতে পারবে কিনা তা নিয়েও পাইলটদের সন্দেহ ছিল। শেষ পর্যন্ত ঝড়ো হাওয়ায় বিমানগুলো বাড়তি ৪৬ কি.মি./ঘন্টা গতি পায়। ১৩ ঘন্টার ফ্লাইট শেষে চীনের উপকূলে গিয়ে কেউ কেউ ক্রাশ ল্যান্ড করেন, কেউ সাগরেই বেইল আউট (প্যারাশুট জাম্প) করেন। অন্যান্য ক্রুদের চাইনিজ সেনা ও বেসামরিক নাগরিকগণ উদ্ধার করেন। প্যাট্রিক ক্ল্যারি ও জন ব্রিচ নামে একজন খ্রিস্টান পাদ্রী তাদের আশ্রয় দেন। লে. কর্নেল জেমস ডুলিটল ধানক্ষেতে ল্যান্ড করতে গিয়ে গোড়ালি ভেঙেছিলেন। এই মিশনে বি-২৫ বোম্বারগুলো তাদের ইতিহাসে দীর্ঘতম ফ্লাইট (২,২৫০ নটিক্যাল মাইল) সম্পন্ন করে!

ম্যাপে দেখুন বি-২৫ বিমানগুলোর আক্রমণ ও চীনে ফিরে যাওয়ার গতিপথ; Image source : www.nationalmuseum.af.mil
 
সোভিয়েত ইউনিয়নে ল্যান্ড করা ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডের বিমান ও চাইনিজ কর্মকর্তাদের সাথে
জেমস ডুলিটল ও তার বিমানের ক্রুরা; Image source : www.history.navy.mil

ক্ষয়ক্ষতি ও রেইডের ফলাফল 

মার্কিনিদের ১৫টি বিমানই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ল্যান্ড করা সেই বিমানটি আর ফেরত দেয়া হয়নি। চীনে প্যারাসুট জাম্প করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে বিশ বছর বয়সী কর্পোরাল লিল্যান্ড ফাকটর নিহত হন। এছাড়া বোম্বারডিয়ার স্টাফ সার্জেন্ট উইলিয়াম ডাইটের এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ডোনাল্ড ফিটজমাউরিচ সাগরে ক্রাশ করে ডুবে মারা যান। তাদের দেহাবশেষ যুদ্ধের পর উদ্ধার করে সমাহিত করা হয়। জাপানিরা ব্যাপক অভিযান চালিয়ে আটজন ক্রুকে বন্দী করে। বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বন্দীদের মধ্যে তিনজনকে ফায়ারিং হত্যা করা হয়, একজন ব্যাপক নির্যাতন ও অভুক্ত থেকে অসুস্থ হয়ে মারা যান। ১৯৪৬ সালে এই যুদ্ধাপরাধের দায়ে চারজন জাপানি অফিসারের শাস্তি হয়। বাকি চার বন্দী তিন বছর পর উদ্ধার হন। এদের একজন জাপানিদের নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারান। আরেকজন যুদ্ধের পর জাপানেই পাদ্রী হিসেবে ৩০ বছর ধর্মপ্রচার করেন!

অন্যদিকে বিমান হামলায় জাপানিদের মধ্যে ৫০ জন নিহত, বেসামরিক ব্যক্তিসহ ৪০০ জন আহত হয়। পাঁচটি পেট্রোল বোট ডুবে যায়, একটি রূপান্তরিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫ জন নাবিক গ্রেফতার হয়। মার্কিনিরা ৩টি বিমান ভূপাতিত হওয়ার দাবি করলেও জাপানিরা তা স্বীকার করেনি। মিশন কমান্ডার লে. কর্নেল জেমস ডুলিটল ভেবেছিলেন জাপানিদের এই সামান্য ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে ১৬টি বিমান হারানোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরলে তাকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হতে হবে।

কিন্তু এই হামলা আমেরিকানদের মনোবল ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মার্কিনীরা ডুলিটল রেইডকে পার্ল হারবারের প্রতিশোধ হিসেবে ব্যাপক ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়। তাকে কোর্ট মার্শালের বদলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল থেকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বানিয়ে দেয়া হয়! শুধু তা-ই নয়, জেমস ডুলিটলকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘মেডেল অব অনার’ দেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। এছাড়া অন্যান্য রেইডার ক্রুদের ডিস্টিংগুইস ফ্লাইং ক্রস পদক ও প্রমোশন দেয়া হয়। চাইনিজ সরকারের পক্ষ থেকেও তাদেরকে পদক দেয়া হয়। এই ক্রুরা পরবর্তীতে ইন্ডিয়া-বার্মা থিয়েটার, ভূমধ্যসাগর ও উত্তর আফ্রিকায় যুদ্ধ করে নিহত/বন্দী হন।

জেমস ডুলিটলকে পদক দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। ডানের ছবিতে চার তারকা জেনারেল হিসেবে
প্রমোশন দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন; Image source : White House Photo Office
পদক দেয়া হচ্ছে অন্যান্য আহত পাইলটদের। ডানের ছবিতে জাপানিদের হাতে ধরা পড়া (পরে উদ্ধারকৃত) পাইলট
রবার্ট হাইটকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; Image source : National Museum of the USAF

অপারেশন সেই-গো

আমেরিকান এয়ার ক্রুদের আশ্রয় ও পলায়নে সাহায্য করার অপরাধে চাইনিজ বেসামরিক নাগরিকরা জাপানিদের ব্যাপক প্রতিহিংসার শিকার হয়। ঝেইজিয়াং-জিয়াংজি অঞ্চল ব্যবহার করে জাপানের মূলভূমিতে উপর যেন আবার হামলা না হয় সেজন্য শুরু হওয়া অপারেশন সেই-গোতে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি। তারা প্রায় পঞ্চাশ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। এ সময় দশ হাজার চীনা নাগরিক নিহত হন। মার্কিন পাইলট-ক্রুদের সাহায্য করেছে- এমন লোকদের ব্যাপক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

এসময় সংগঠিত ইতিহাসের ভয়ংকরতম ধর্ষণকান্ড ‘রেইপ অফ নানকিং‘। উল্লেখ্য, ১৯৩৭ সালে একবার এই অঞ্চলে ব্যাপক হত্যা ও ধর্ষণের মহোৎসব চালিয়েছিল জাপানি সেনারা। ডুলিটল রেইডের প্রেক্ষাপটে একই অঞ্চলে এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তিন মাস ধরে হাজার হাজার চীনা নারীকে ধর্ষণ করা হয়। জাপানিদের বর্বরতার কোনো তুলনাই ছিল না। বৃদ্ধ কিংবা বাচ্চাদেরও ছাড় দেয়নি তারা। সত্তর হাজার চীনা সৈনিকের পাশাপাশি আনুমানিক আড়াই লাখ বেসামরিক মানুষ এই অপারেশনে নিহত হয়।

সরাসরি হত্যা ছাড়াও কুখ্যাত জাপানি বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার গবেষণা সংস্থা ‘ইউনিট ৭৩১’ এর ভয়ংকর মানব এক্সপেরিমেন্ট এর গিনিপিগ হয় চীনারা। তাদের ছড়ানো কলেরা, টাইফয়েড, প্লেগ (জীবাণুবহনকারী মাছি চাষ করে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে) ও আমাশয় রোগের জীবাণু পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়ার ফলে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। শুধুমাত্র টাইফয়েড ও অ্যানথ্রাক্সের জীবাণুই নাকি ৩০০ পাউন্ডের সমপরিমাণ ছড়ানো হয়। এসব কুকীর্তিতে অংশ নিতে গিয়ে দশ হাজার জাপানি সেনা আক্রান্ত ও প্রায় ১,৭০০ সেনা মারা যায়। একটিমাত্র মার্কিন অপারেশনে সাহায্য করার অপরাধে ব্যাপক মূল্য চুকাতে হয়েছিল চীনা জনগণকে। তবে এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মিত্রতা বৃদ্ধি করে। চীনা সশস্ত্র বাহিনীর জন্য মার্কিন সরকার বিভিন্নভাবে সামরিক সাহায্য প্রেরণ করে। ইউনিট ৭৩১ এর ভয়াবহ নির্যাতনের গা শিউরে ওঠা ইতিহাস পড়ুন এখানে

সব মিলিয়ে ডুলিটল রেইড ছিল ইম্পেরিয়াল জাপানের ভিত্তি কাঁপিয়ে দেয়া একটি অপারেশন। এটি জাপানি সেনাদের মনোবল দুর্বল করে দেয়। এই হামলার পরপরই জাপানিরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের সাম্রাজ্যবাদ নীতি বন্ধ করে মূল ভূখণ্ডের নিরাপত্তা জোরদার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিমানঘাঁটি করতে পারে এমন দ্বীপগুলো দখলে নেয়ার কাজে সাপোর্ট দিতে দুটো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার মোতায়েন করে। ফলে কয়েকমাস পরে সংগঠিত হওয়া যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের প্রথম বড় ধরনের নৌযুদ্ধ ‘ব্যাটল অব কোরাল সি’-তে নিজেদের সম্পূর্ণ শক্তিমত্তা ব্যবহার করতে পারেনি ইম্পেরিয়াল জাপানিজ নেভি। এছাড়া জাপানিদের দুর্বল জায়গা তাদের মূল ভূখণ্ডে বারবার বিমান হামলা চালানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরিচালিত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী এয়ার রেইড ‘অপারেশন মিটিংহাউজ‘। সেই ইতিহাস জানতে থাকুন রোর বাংলার সাথেই।

ডুলিটল রেইড নিয়ে দেখুন একটি সংক্ষিপ্ত অ্যানিমেটেড ডকুমেন্টারি

 

Related Articles

Exit mobile version