১
চারিত্রিক দিকে থেকে সম্রাট আকবর একজন কৌতূহলী মানুষ ছিলেন। সম্রাট হিসেবে মসনদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ও নিরাপদ করার পর তিনি দেখলেন ইসলাম ছাড়াও তার আশেপাশের মানুষগুলো অন্যান্য কিছু ধর্মের অনুসারী। বিভিন্ন ধর্মের প্রতি তার আগ্রহের সূত্রপাত এখান থেকেই। তবে আকবরের জীবনের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাও ধর্ম সম্পর্কে তাকে কৌতূহলী করে তোলে। রাজপুতদের সাথে সম্পোর্কন্নয়নের সময় তিনি বেশ কিছু হিন্দু রমণীকে বিয়ে করেন। মুঘল প্রাসাদেও তাদের নিজস্ব রীতিনীতিতে ধর্ম পালনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিলো। মূলত এই সময়েই তিনি হিন্দু ধর্মকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পান এবং ধর্মটি সম্পর্কে তিনি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন।
আবার রাজপুতানায় হিন্দুরা ছাড়াও জৈন ধর্মালম্বীরা বেশ শক্তিশালী অবস্থানে ছিলো। রাজপুতদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সময় তিনি এসব জৈনদের সংস্পর্ষে আসেন, যা তাকে ধর্মটি সম্পর্কে কৌতূহলী করে তোলে।
অন্যদিকে গুজরাট অভিযানের সময় সুরাট বন্দরে তিনি প্রথমবারের মতো খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের দেখা পান, যা তাকে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে জানার ব্যাপারে কৌতুহলী করে তোলে। মোটকথা, আকবর নিজের ধর্মের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মগুলো সম্পর্কেও মন থেকে জানতে চাইতেন।
২
গুজরাটে সফল অভিযান শেষ করে ফিরে এসে আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে ধর্মীয় আলাপ-আলোচনার জন্য একটি ইবাদতখানা খোলেন। প্রথমদিকে মুসলিম স্কলাররা এসে আকবরের সাথে ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনা করতেন। মাখদুম-উল-মুলক আব্দুল্লাহ সুলতানপুরি আর সদর-ই-সুদুর শেখ আবদুন নবীর নেতৃত্বে দুটি দল এসময় আকবরের সাথে আলোচনায় অংশ নিতেন। তবে সমস্যা হলো, তাদের ব্যক্তিজীবনে সম্পর্কের তিক্ততা থেকে নানা বিষয়েই তারা একে অপরের সাথে উত্তপ্ত বাদানুবাদে লিপ্ত হতেন। তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়ে তাদের এই তুমুল তর্কে আকবর প্রায়ই বিরক্ত হতেন। এমনকি ইসলামের নামে নানা দল-উপদলের অস্তিত্বেও আকবর বেশ বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। পরে সব ধর্মের পন্ডিতদের জন্যই তিনি ইবাদতখানার দরজা উন্মুক্ত করে দেন। আদর্শিক দিকের চেয়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মুসলিম স্কলাররা যে বিরাট ভুলটি করেছিলেন, তার খেসারত পরবর্তী কয়েক দশক পর্যন্ত দিতে হয়েছিলো।
যা-ই হোক, ইবাদতখানায় আসার সুযোগ পেয়ে সব ধর্মের পন্ডিতরাই নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে সম্রাটের সামনে তুলে ধরার সুযোগ পেতেন। এসময় এ পন্ডিতরা নিজেদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টার পাশাপাশি অন্য ধর্মগুলোকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা চালাতেন। আলোচনা কখনো কখনো যুক্তি বা প্রজ্ঞা ছেড়ে তর্কের মাঠে গড়াত। সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী মনোভাব দেখাত পর্তুগীজ জেসুইট পাদ্রীরা। সম্রাটের সামনেই তারা ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে কটুক্তি করতো। সম্রাট অবশ্য তাদের প্রতি সহনশীলতার মনোভাব দেখিয়েছিলেন। একই সাথে তিনি ধর্ম নিয়ে আলোচনার সময় সবাইকে সংযত হওয়ার কথা বললেন। কিন্তু এক ধর্মের প্রতি আরেক ধর্মের বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ বন্ধ হলো না। শেষপর্যন্ত ১৫৮২ সালে সম্রাট বাধ্য হলেন ইবাদতখানার এই আলোচনা বন্ধ করে দিতে।
তবে বিদ্বেষপূর্ণ সব কথাবার্তার মাঝেও বিভিন্ন ধর্মের পন্ডিতদের আলোচনা শুনতে শুনতে সম্রাট ভাবলেন সবগুলো ধর্মই যেহেতু ভালো ভালো কথা বলে, তাহলে সবগুলো ধর্মের মূলভাব নিয়ে নতুন একটি ধর্মের প্রচলন করলে কেমন হয়? যুক্তি হিসেবে সুন্দর হলেও আদর্শিক ঝামেলা কিন্তু রয়েই যায়। সবগুলো ধর্মকে মিলিয়ে মিশিয়ে একটি নতুন ধর্ম তৈরি করলেই তো আর সব ধর্মের ঈশ্বর একসাথে সত্য হয়ে যায় না! যা-ই হোক, ১৫৮২ সালে আকবর তার নতুন ধর্মমতটি প্রচার শুরু করলেন। ধর্মটির নাম দিলেন ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ বা ‘স্রষ্টার ধর্ম’।
৩
সর্বেশ্বরবাদী এ ধর্মটিতে আকবর নিজের মতো করে সবগুলো ধর্মের মূল ও ভালো ভালো বিষয়গুলো একত্রিত করেছিলেন। দার্শনিক দিক থেকে ধর্মটির ভিত্তি হলো আকবরের প্রচারিত ‘সুলহ-ই-কুল’ মতবাদটি। এর মানে হলো, সবগুলো ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা। একই সাথে দর্শন আর ঐশ্বরিক সত্তার বিশ্বাস যেমন এ ধর্মে ছিলো, ঠিক তেমনই ছিলো প্রকৃতিপূজার মতো বিষয়গুলো। পুরো হ-য-ব-র-ল একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ালো ধর্মটি।
দ্বীন-ই-ইলাহি ধর্মটিতে আধ্যাত্মিকতার চেয়ে মূলত নৈতিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছিলো। যৌনতা, লোভ-লালসা, আত্মঅহংকারের মতো বিষয়গুলো এই ধর্মে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। অবৈধ যৌনতাসহ অন্য বিষয়গুলো সাধারনত বেশিরভাগ ধর্মেই নিষেধ করা হয়েছে। আবার দয়া-মায়া, আত্মসংযম, ভালো কাজ করার মতো বিষয়গুলো অন্যান্য ধর্মের মতোই এই ধর্মেও প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। সে হিসেবে এই ধর্মে মৌলিক কোনো সংযোজন নেই। আকবর অবশ্য ধর্মটিকে সেভাবে প্রবর্তনও করেননি। নিজের ইচ্ছামাফিক খামখেয়ালিপনা থেকে তার কাছে বিভিন্ন ধর্মের যা ভালো লেগেছে, তা-ই তিনি একত্রিত করেছিলেন।
দ্বীন-ই-ইলাহির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্মটি যে কারও জন্য উন্মুক্ত ছিলো না। সম্রাটের অনুমতি ছাড়া কেউ এ ধর্ম গ্রহণ করতে পারতো না। দ্বীন-ই-ইলাহি গ্রহণ করতে আগ্রহী এমন কাউকে সম্রাটের অনুমতিসাপেক্ষে রবিবার (সম্রাট রবিবারের ধারণাটি পেয়েছিলেন খ্রিস্টানদের কাছ থেকে) আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাটের কাছে আসতে হতো। এরপর আসন গ্রহণ করে বসা সম্রাটের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে হতো। এই ‘আল্লাহু আকবার’-এর অর্থ ‘আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ’ নাকি ‘আকবরই আল্লাহ’ তা-ও এক বিভ্রান্তির বিষয়। এসময় একটি শপথও করতে হতো যে, ধর্মটি গ্রহণকারী ব্যক্তি যেকোনো অবস্থায় সম্রাটের আনুগত্য প্রকাশ করবে। প্রয়োজনে নিজের ধন-সম্পদ, সম্মান এবং জীবন পর্যন্ত সম্রাটের জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকবে।
দ্বীন-ই-ইলাহীর তেমন কোনো আচার-অনুষ্ঠান না থাকলেও কিছু কিছু বিষয়ে অনুসারীদের উৎসাহ দেওয়া হতো। যেমন- আমিষ জাতীয় খাবার বর্জন করা, সম্পদের মোহ ত্যাগ করা, অন্য কোনো ধর্মীয় বাণী পাঠ না করা, মানুষকে বেশি বেশি খাওয়ানো, সম্মান-আত্মমর্যাদার মোহ ত্যাগ করা ইত্যাদি। এই দিকটি বিবেচনায় রেখে অনেক সূত্রই ধর্মটিকে নতুন ধর্ম না বলে কোনো একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্মের শাখাই বলতে চেয়েছেন।
দ্বীন-ই-ইলাহি ধর্মালম্বীদের আরও বেশ কিছু উদ্ভট রীতিনীতি ছিলো। যেমন, নিজেরা আমিষ গ্রহণ না করলেও অন্যদের খাওয়ানোর ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা ছিলো না। তবে কেউ যদি আমিষ গ্রহণ করে থাকেও, সেক্ষেত্রে নিজের জন্মমাসে আমিষ গ্রহণ না করার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোরতা ছিলো। তারা মৃত্যুর আগেই নিজের চল্লিশার আয়োজন করতো। হিন্দু রীতি অনুরকণে এ ধর্মালম্বীরা পেয়াজ-রসুন খেতো না। নিয়মিত সূর্যের প্রতি প্রার্থনা করা হতো, এক্ষেত্রে সূর্যের বিভিন্ন নাম জপ করে প্রার্থনা করার অদ্ভূত এক রীতি তারা পালন করতো। জরাথুস্ত্র ধর্মের অনুকরণে এই ধর্মে সূর্যকে খুবই ক্ষমতাশালী ভাবা হতো, যা আবার ইসলামী মূল্যবোধের বিপরীত। ইসলামী মূল্যবোধ অনুযায়ী স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মর্যাদা এক নয়। সুতরাং, সর্বশক্তিমান স্রষ্টা আল্লাহ, আর আল্লাহর সৃষ্টি সূর্যের মর্যাদা এক হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
এছাড়াও দ্বীন-ই-ইলাহি ধর্মে মদ পান, জুয়া খেলা তেমন দোষনীয় কিছু ছিলো না, যা ইসলাম অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
৪
দ্বীন-ই-ইলাহি প্রবর্তনের আগে মুঘল সাম্রাজ্যসহ অন্যান্য মুসলিম শাসনামলে টাকশাল থেকে জারিকৃত মুদ্রাগুলোয় ইসলামের ঘোষণাসম্বলিত বাণী কালেমা খোদাই করা থাকতো। নতুন এ ধর্মটি প্রবর্তনের পর আকবর এই নিয়মের পরিবর্তন করে ‘আল্লাহু আকবার’ খোদাই করার নির্দেশ দেন, যার অর্থ ‘আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ’ বা ‘আকবরই আল্লাহ’ দুই রকমই করা যায়। তবে বিষয়টা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। আকবর কখনো নিজেকে সর্বশক্তিমান স্রষ্টা দাবী করা তো দূরের কথা, তার প্রবর্তিত নতুন ধর্মটির নবীও নিজেকে দাবী করেননি।
কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিচারে ধর্মটি প্রচারের সময় আকবর আক্ষরিক অর্থেই নিজেকে সবকিছুর উর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেন। ১৫৮২ সাল নাগাদ তার বেশিরভাগ শত্রুই তার পদানত হয়, আকবরের ধর্মত্যাগের সূত্র ধরে বিভিন্ন প্রান্তে যে বিদ্রোহের সূচনা হয়, তা-ও মোটামুটি দমন করে ফেলা হয়। পুরো মুঘল সাম্রাজ্য সবদিক থেকেই নিরাপদ হয়ে যায়। সবদিক মিলিয়ে আকবর নিজেকে প্রচন্ড ক্ষমতাশালী ভাবতে শুরু করে। সুতরাং আকবর যদি নিজেকে আল্লাহু আকবারের অর্থ ‘আকবরই আল্লাহ’ বুঝিয়ে থাকেন, এটা তাহলে তার আরেকটি খামখেয়ালীপনা আর অবিবেবচনা প্রসূত আত্মঅহংকার থেকেই করেছেন।
মুসলিমরা একে অপরের সাথে দেখা হলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বা ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’ সম্বোধন করে যেভাবে একে অপরের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি, বরকত ও রহমত কামনা করা হয়, দ্বীন-ই-ইলাহির জন্যও তেমনি আলাদা সম্বোধন পদ্ধতি ছিলো। এই ধর্মের অনুসারীরা দেখা হলে একজন বলতো ‘আল্লাহু আকবার’, অন্যজন জবাব দিতো ‘জাল্লা জালালুহু’, যার অর্থ হচ্ছে ‘সম্রাট মহান’। এভাবেই ইসলামের একটি সুন্দর নিয়ম রদ করে আকবর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার চেষ্টা করেছিলেন।
কিছু কিছু সময় মনে হতো আকবরের সমস্ত আক্রোশ যেন ইসলাম ও ইসলামের রীতিনীতির প্রতি। ওয়াজিব দাঁড়ি রাখার নিয়মকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হতো, দাঁড়ি কেটে ফেলতে উৎসাহিত করা হতো। শুধুমাত্র হিন্দুদের মন রক্ষার্থে গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়। আকবরের এই ধর্মমত মেনে না নেওয়ায় ও এতে ভিন্নতম পোষণ করায় বহু আলেমকে নানাভাবে হেনস্থা থেকে শুরু করে কান্দাহার, সিন্ধু থেকে শুরু করে দূরবর্তী প্রদেশগুলোতে নির্বাসন দেওয়া শুরু হয়।
৫
মুঘল শাসনামলে ‘সদর-উস-সুদুর’ নামে একটি আলাদা পদ ছিলো। কখনো কখনো এই পদটিকে ‘শায়খ-উল-ইসলাম’ বলা হতো। ‘শায়খ-উল ইসলাম’ পদটি কুরআন, হাদীস ও ইসলামী আইন সম্পর্কে ব্যাপক ধারনা রাখেন, এমন কাউকে দেওয়া হতো। তিনি মূলত সাম্রাজ্যের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে বিবেচিত হতেন। ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী সাম্রাজ্য পরিচালনায় সম্রাট ইসলামের নিয়ম-কানুনের বাইরে যেতে পারবেন না। আল্লাহর প্রদত্ত আইন অনুযায়ী তাঁকে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে হবে। কাগজে-কলমে সম্রাট সার্বভৌম হলেও প্রকৃত সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্যই। শাসক হিসেবে সম্রাট শুধুমাত্র মানুষ ও রাষ্ট্রের প্রতি নিজ দায়িত্ব পালন করবেন, রাষ্ট্রের সীমানা রক্ষা করবেন, ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন।
কাজেই একজন শাসককে শরীয়াহ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা রাখাও প্রয়োজন ছিলো। একই সাথে সাম্রাজ্য পরিচালনায় কোনো সমস্যার মুখে পড়লে আলেমদের পরামর্শ নিয়ে কাজ করার ব্যপারেও জোর দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় কাজে সুবিধার জন্য যেসব আলেম নিয়োজিত থাকতেন, একত্রে তাদের ‘সুদুর’ বলা হতো। ‘সদর-ই-সুদুর’ বা ‘শায়খ-উল-ইসলাম ছিলেন এই ‘সুদুর’-দের নেতা। তিনি একই সাথে সাম্রাজ্যের প্রধান কাজী বা বিচারক হিসেবে নিযুক্ত থাকতেন। শায়খ-উল-ইসলাম তার কাজকর্মের জন্য আলাদা বাজেট পেতেন, প্রয়োজন মতো অনুদান ও জায়গীর বিতরণ করতে পারতেন।
সম্রাট আকবরের শাসনামলে ১৫৬৫ সাল থেকে শায়খ-উল-ইসলাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন আবদুননবী। সুন্নি আক্বিদায় বিশ্বাসী এই মানুষটি ইসলামের আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন একেবারে অনমনীয়। কাজেই ধর্মের প্রসঙ্গে নিজের মর্জিমাফিক চলা আকবরের সাথে দ্বন্দ্বে জড়াতেও বেশি সময় লাগেনি। যখন স্পষ্ট হয়ে গেলো যে শায়খ-উল-ইসলাম আবদুননবী আকবরের ধর্মীয় মতবাদের সাথে কখনোই একমত হবেন না, তখন তাঁকে এই পদটি থেকে অপসারণ করা হলো। পদটি দেওয়া হলো সুলতান খ্বাজাকে, যিনি আবার পরবর্তীতে দ্বীন-ই-ইলাহি গ্রহণ করেছিলেন!
১৫৭৯ সালের মজহর অধ্যাদেশটি আকবরকে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কাজে সকল ধরনের জবাবদিহিতার উর্ধ্বে নিয়ে যায়। এ অধ্যাদেশটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে তাতে শায়খ-উল-ইসলাম আবদুননবী ও আরেকজন ধর্মীয় নেতা আব্দুল্লাহ সুলতানপুরীকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। পরে আবদুল্লাহ সুলতানপুরীকে দেশত্যাগ করে মক্কায় যেতে বাধ্য করা হয়।
মূল বিষয়টি হলো, আকবরের ধর্মীয় নীতির সাথে ইসলাম সাংঘর্ষিক হওয়ায় আলেমরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, বিদ্রোহও করেছিলেন। ফলে আকবরের পুরো আক্রোশ গিয়ে পড়ে মুসলিম আলেমদের উপর ও ইসলামের উপর।
৬
দ্বীন-ই-ইলাহির প্রবর্তক হলেও আকবর নিজেকে কখনো এ ধর্মের নবী হিসেবে দাবী করেননি, বা স্পষ্ট করে বলেননি যে তিনি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছেন। এমনকি অনেক সময় মনে হতো আকবর এই ‘দ্বীন-ই-ইলাহীকে’ কোনো ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করার চেয়ে সাম্রাজ্যের জন্য একটি ধর্মীয় নীতিমালা হিসেবেই বিবেচনা করছেন।
আকবর একটি নতুন ধর্মের প্রবর্তন করলেও ধর্মের প্রচারে তেমন উৎসাহ বোধ করেননি। এই ধর্মের নির্দিষ্ট কোন উপাসনার স্থান ছিলো না, এমনকি তেমন উপাসনাও ছিলো না। ধর্মের ছিলো না কোনো ধর্মীয় পবিত্র গ্রন্থ, ছিলো না কোন যাজকশ্রেণীও। এমনকি আকবর নিজেকে যেমন এই ধর্মের নবী বা পয়গম্বর দাবী করেননি, ঠিক তেমনই কাউকে এই নতুন ধর্মমত গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে চাপও দেননি। আবার আকবরের পর এই ধর্মের কোনো উত্তরাধীকারীও ছিলো না। সম্রাট আকবরের পুত্র পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গীর এই ধর্মের প্রতি শীতল ভাব দেখিয়েছিলেন, এবং পরবর্তী জীবনে তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন।
সম্রাট আকবর প্রবর্তিত এই ধর্মের অনুসারী সংখ্যা মোট ১৪-২০ জনের মাঝেই আবদ্ধ ছিলো। অনুসারীদের মাঝে হিন্দুদের মাঝে এক বীরবল ছাড়া বাকী সবাই মুসলিম ছিলেন। এদের মাঝে অনেকেই ধর্মটি গ্রহণ করেছিলো আকবরকে খুশি করতে, কেউ সম্রাট রাগ করতে পারেন এই ভয়ে। অনুসারীদের মাঝে আক্ষরিক অর্থে এই ধর্মের প্রতি তেমন কোনো টান ছিলো না। আকবরের মৃত্যুর সাথে সাথেই এই ধর্মটি বিপুপ্ত হয়ে যায়। এই ধর্মের বেশিরভাগ অনুসারীই আকবরের জীবদ্দশায় মারা যান। আকবরের মৃত্যুর পরেও যে চারজন জীবিত ছিলেন, তারা পুনরায় তাওবাহ করে ইসলামে প্রবেশ করেন।
৭
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো, যদি ধর্ম হিসেবে প্রচার করার তেমন ইচ্ছাই না থাকতো তাহলে আকবর এই নতুন ধর্মমত কেন প্রবর্তন করেছিলেন?
সম্রাট আকবর সম্ভবত হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপনের জন্যই এই ধর্মমত প্রবর্তন করেছিলেন। দীর্ঘদিন মুসলিমরা এই হিন্দুস্তান শাসন করলেও কখনো ইসলাম গ্রহণের জন্য অমুসলিমদের চাপ প্রয়োগ করেননি। সনাতন ধর্মালম্বীদের আগমনের সাথে সাথেই হিন্দুস্তান থেকে যেমন বৌদ্ধধর্ম প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়, ইসলামের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। ধর্ম গ্রহণের জন্য মুসলিম বিজেতারা কখনোই চাপ প্রয়োগ করতেন না। আবার মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের দাওয়াতও এই অঞ্চলে তেমন জোরদার ছিলো না। ফলে তুলনামূলক দিক দিয়ে এ অঞ্চলে মুসলিমের সংখ্যার তুলনায় অমুসলিমই ছিলেন বেশি।
আকবর চেয়েছিলেন এই সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিমের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভের। যার ফলে সব ধর্মের মিশ্রণে একটি নতুন ধর্মমত তৈরি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই সম্প্রদায়কে কাছাকাছি আনার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। নতুন ধর্মের এই ধারণা মুসলিমদের পছন্দ হয়নি তা বলাই বাহুল্য। মজার বিষয় হচ্ছে, আকবরের কারণে মুসলিমরা চাপে পড়ে গেলেও আকবরের এই ধর্মের প্রতি হিন্দুরাও সন্তুষ্ট ছিলো না। যে কারণে দেখা যায়, অল্প কয়েকজন মুসলিম বাদে সম্রাটের অন্যান্য সভাসদ বা কর্মচারীরা এই ধর্ম তো গ্রহণ করেনইনি, এমনকি সম্রাটের ঘনিষ্টদের মাঝে বীরবল বাদে মানসিংহ, ভগবান দাস, টোডরমলের মতো ব্যক্তিরাও নিজ ধর্ম ছেড়ে এই ধর্মটি গ্রহণ করেননি।
সম্রাট আকবরের পুত্র এবং পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গীর আকবরের এই ধরনের কর্মকান্ডের পেছনে আবুল ফজল আর তার ভাই আবুল ফয়েজকে দায়ী করেন। আবুল ফজল নিজেই একজন বিভ্রান্ত মানুষ ছিলেন। সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হওয়ার সুবাদে তিনি আকবরকে প্রাভাবিত করতে পেরেছিলেন সবচেয়ে বেশি। ধারণা করা হয়, ধর্মীয় এসব নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি ছিলো।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দ্বীন-ই-ইলাহি সবগুলো ধর্মের ভালো বিষয়গুলো নিয়ে তৈরি করার কথা বলা হলেও ইসলাম ও ইসলামী রীতিনীতি এই ধর্মে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, উপেক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও আকবর এই ধর্ম মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি, এমনকি বিদ্বেষবশত রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেননি।
এর কারণ হতে পারে, উসমানী সাম্রাজ্যের (অটোমান এম্পায়ার) সাথে মুঘল দরবারের কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ ভালো ছিলো। উসমানীয়রা তখন মুসলিম বিশ্বের স্বীকৃত খলিফা। আকবর মুসলিমদের দমন পীড়নের চেষ্টা চালালে তা ভালো কোনো ফল বয়ে আনতো না। অন্যদিকে মুঘল সীমান্ত ঘেঁষা পারস্যভিত্তিক সাফাভী সাম্রাজ্য আদর্শের দিক থেকে শিয়া হলেও হিন্দুস্তানের মুসলিমদের দমনপীড়ন করলে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর সম্ভাবনা ছিলো। আবার দ্বীন-ই-ইলাহী প্রচারের পূর্বেই আকবরের এই ধর্মীয় ইস্যুকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যের নানা প্রান্তে বিদ্রোহ ঘোষণা করে হয়েছিলো। এতে আকবর বেশ চাপে পড়ে গিয়েছিলেন। বিশেষত বাংলার বিদ্রোহ তাকে বেশ ভুগিয়েছিলো। আকবর তাই নতুন করে বিদ্রোহ উস্কে দিতে চাননি।
সাম্রাজ্যের ভেতরের ও বাইরের সফট পাওয়ার আকবরের সম্ভাব্য বিদ্বেষমূলক আচরণ থেকে এ অঞ্চলের মুসলিমদের রক্ষা করেছিলো।
৮
সম্রাট আকবরের সবথেকে বড় দুর্ভাগ্য হলো, তিনি এমন একটি মহান রাজপরিবারে জন্মেছিলেন, যে রাজপরিবার একটি ধর্মের অনুসারী আর সেই সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ প্রজা অন্য ধর্মের অনুসারী। সম্রাট হওয়ার পর আকবরের মাথায় ঢুকলো যে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের কারণে এই দুটি ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে একসাথে চলার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে।
সত্যিকার অর্থে হয়েছিলোও তা-ই। শুধুমাত্র মুসলিম হওয়ার কারণে আকবরকে বিদেশী শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা হতো, তাঁকে শত্রু ভাবা হতো। অথচ, সম্রাট বাবর আর হুমায়ুনের জন্ম হিন্দুস্তানের বাইরে হলেও আকবর থেকে শুরু করে পরবর্তী সব মুঘল শাসকই জন্মসূত্রে হিন্দুস্তানী ছিলেন। মহান মুঘল সম্রাট বাবর বিদেশী কোনো আক্রমণকারীর মতো হিন্দুস্তান লুটেপুটে নিয়ে যাননি, বরং তিনি তার ও তার ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য হিন্দুস্তানকে আপন করে নিয়েছিলেন। অথচ সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা ব্রিটিশ, ফরাসী বা পর্তুগীজদের মতোই মুঘল সাম্রাজ্যকে বিদেশী শক্তি ভাবা হয়। অপপ্রচার, বিদ্বেষ কিংবা ওরিয়েন্টালিস্ট বয়ান এতোটাই শক্তিশালী যে, আজও বার বার প্রমাণ দিতে হয় যে মুঘল সাম্রাজ্য বিদেশী কোনো লুটেরা শক্তি ছিলো না। বরং মুঘলরা তো আপন মহিমায় হিন্দুস্তানকে গড়ে তুলেছিলেন, হিন্দুস্তানকে নিয়ে গিয়েছিলেন এর স্বর্ণশিখরে, যার চিহ্ন আজও হিন্দুস্তানের আনাচে কানাচে দেখতে পাওয়া যায়, পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়।
যা-ই হোক, নিজের হিন্দু প্রজাদের সন্তুষ্টির জন্য আকবর দ্বীন-ই-ইলাহির প্রচলন করলেন, যেন সাম্রাজ্য থেকে মুসলিম প্রভাব কিছুটা হলেও খর্ব হয়। একই সাথে সাম্রাজ্যে তিনি হিন্দুদের প্রভাব নিশ্চিত করলেন। সমস্যা হলো, দ্বীন-ই-ইলাহি মুসলিমরা তো গ্রহণ করেইনি, এমনকি হিন্দুরাও এই ধর্মটি গ্রহণ করেনি। আদৌ এই ধর্মটিকে ধর্ম বলা যায় কি না তা নিয়েও সংশয় আছে। দ্বীন-ই-ইলাহিকে সম্ভবত একটি মুসলিম সাম্রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভিন্ন ধর্মালম্বী প্রজাদের সন্তুষ্টির জন্য গৃহীত একটি ব্যর্থ ধর্মীয় নীতিমালা হিসেবে ভাবাই বেশি যুক্তিসংগত হবে।
[এই সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]