এপ্রিল মাসে সাগরে নেমে ডি রুইটার অনুসরণ করছিলেন ট্রম্পকে। জুনের শুরুতে ট্রম্প কেন্টের ডোভার উপকূলের ধার ঘেঁষে কিছু ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ ছিনিয়ে নিয়ে সেখান থেকে এসে নেদারল্যান্ডসের ওয়ালচেরেন দ্বীপের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। মঙ্ক আর ডুয়ানের ব্রিটিশ বহর তখন হল্যান্ড প্রদেশের উত্তরের সাগরে। সেখান থেকে নেদারল্যান্ডসের উপকূল জুড়ে কিছুদিন তারা অবরোধ জারি রাখেন, উদ্দেশ্য ট্রম্পকে খোলা সাগরে লড়াইয়ে বাধ্য করা।
কিন্তু অনেকদিন ধরে ডাচ সেনানায়কের দেখা না পেয়ে ব্রিটিশরা হতাশ হয়ে পড়ে। তারা দেশে ফিরে যাবে ভাবছিল। ব্রিটিশরা যখন ফিরতি পথে তখন ওয়ালচেরেন থেকে ট্রম্প তাদের পিছু নিলেন। তার পতাকাবাহী জাহাজ ছিল ব্রেডেরোড (Brederode)। সাফোকের নিকটবর্তী সাগরে গ্যাবার্ড এলাকাতে দুই পক্ষের দেখা হয়ে যায়। ব্রিটিশ তথ্যমতে ট্রম্পের সাথে ৯৮টি যুদ্ধজাহাজ আর ৬টি ফায়ারশিপ। ব্রিটিশ বাহিনীতে আছে:
- ডুয়ান আর মঙ্কের অধীনে ৩৮টি জাহাজ, ১,৪৪২টি কামান, ৬,১৬৯ জন সদস্য (রেড স্কোয়াড্রন)
- পেনের অধীনে ৩৩টি জাহাজ, ১,১৮৯টি কামান, ৫,০৮৫ জন সদস্য (হোয়াইট স্কোয়াড্রন)
- লসনের নেতৃত্বে ৩৪টি জাহাজ, ১,১৮৯টি কামান আর ৫,০১৫ জন সদস্য (ব্লু স্কোয়াড্রন)
ব্রিটিশ জাহাজ ছিল উন্নতমানের। তাদের কামানও ছিল অধিক শক্তিশালী এবং দূর থেকে লক্ষ্যভেদে পারদর্শী। তাদের রণকৌশলও আধুনিক। অন্যদিকে ডাচ জাহাজ বেশিরভাগই জোড়াতালি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বানানো। তাদের কামানের সংখ্যা আর শক্তি অনেক কম। তাদের যুদ্ধকৌশল এখনও প্রাচীনপন্থী।
ব্যাটল অব গ্যাবার্ড
১৬৫৩ সালের ১২ জুন, সকাল এগারোটা।
সকাল থেকেই কুয়াশা পাক খেয়ে উঠছে। দৃষ্টিসীমা বেশ সীমিত, তারপরেও কোনো পক্ষেরই হাল ছেড়ে দেবার ইচ্ছে নেই। অনুকূল বাতাসে ডুয়ান আর মঙ্কের নেতৃত্বে রেড স্কোয়াড্রন তীব্র বেগে ছুটে এল ডাচ বহরের দিকে। ট্রম্প কামান দাগার নির্দেশ দিলেন। জাহাজের ডেকে দাঁড়ানো ডুয়ান দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলেন কামানের আঘাতে। নির্বিকার চিত্তে তার ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ কাপড় দিয়ে ঢেকে একাই হাল ধরলেন মঙ্ক।
ওদিকে ব্লু স্কোয়াড্রন নিয়ে লসন হামলে পড়েছেন চতুর্থ ডিভিশনের উপর। মূলত ডি রুইটারের জাহাজই তার লক্ষ্য। একের পর এক গোলাতে ডি রুইটারের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে উঠলে ট্রম্প বাধ্য হন তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যেতে। এ সময় বাতাস পড়ে গেলে লসন ঝুঁকিতে পড়ে যান। মঙ্ক এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করলেন। কুয়াশার মধ্যে অনেকটা বিশৃঙ্খল ভাবে দুই পক্ষ একে অপরের উপর গোলাগুলি করতে থাকে।
এদিকে নতুন করে বাতাস বইতে শুরু করল। ডাচ তথ্যমতে প্রথমে তাদের পক্ষে থাকলেও পরবর্তীতে বাতাস ঘুরে যায় ব্রিটিশদের দিকে। রাত নয়টা অবধি সংঘাত বজায় ছিল। এরপর দুই দলই নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে পরবর্তী দিনের জন্য প্রস্তুতি নেয়।
ডাচদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসছিল। ডি রুইটার আগেই এস্টেট জেনারেলদের হুঁশিয়ার করেছিলেন তাদের দেয়া সরঞ্জাম অপ্রতুল। রণাঙ্গনে তার কথাই অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। ব্রিটিশ সরকার কিন্তু তাদের নৌবাহিনীকে যুদ্ধের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম দিয়েছিল। আবার রাতে ব্লেক নিজে মঙ্কের সাথে এসে যোগ দিলে তাদের শক্তিও অনেক বেড়ে যায়।
১৩ তারিখ দুই পক্ষই জাহাজ চালিয়ে সরে যেতে থাকে। বেলজিয়ামের উপকূলের ধারে নিউপোর্টের কাছে এসে ট্রম্প অফিসারদের নিয়ে সভা করলেন। ডি রুইটার তাকে জানালেন, তার হাতে মাত্র তিন ঘণ্টা যুদ্ধ করার গোলাবারুদ আছে। অন্য ক্যাপ্টেনদের অবস্থাও মোটামুটি একইরকম। ট্রম্প আক্রমণের ফয়সালা করলেন। তার জানা ছিল যুদ্ধের ফলাফল বিপক্ষে চলে যেতে থাকলে নিকটবর্তী উইলিঙ্গেন আর অস্টেন্ডের অগভীর খাঁড়িতে ডাচ জাহাজ আশ্রয় নিতে পারবে, কিন্তু নিজেদের বিশালাকার জাহাজ নিয়ে ব্রিটিশরা সেখানে তাদের তাড়া করতে পারবে না।
ওয়েদার গেজ পক্ষে নিয়ে ট্রম্প প্রচন্ড আঘাত হানলেন ব্রিটিশ বহরে। তিনি ব্রিটিশদের ব্যুহ প্রায় ভেদ করে ফেলেছিলেন, এমন সময় হঠাৎ বাতাস নেমে গিয়ে সাগর শান্ত হয়ে গেল। সকাল এগারোটার দিকে বাতাস ব্লেকের দিক থেকে বইতে শুরু করলে ব্রিটিশ বহর তুমুল আক্রমণ করে বসে। অনেক ডাচ জাহাজ মূল বহর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শত্রু দিয়ে ঘেরাও হয়ে যায়। ট্রম্পের নিজের জাহাজ ব্রেডেরোড ঝাঁঝরা, তাকে বাঁচালেন ডি রুইটার এবং ভাইস অ্যাডমিরাল ডি উইথ নামে আরেক অফিসার।
পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে ট্রম্প সোজা রওনা দিলেন খাঁড়ির দিকে। ব্লেক তাদের এত সহজে ছেড়ে দিলেন না। সন্ধ্যা অবধি কামান দেগে ডাচ বহরের প্রভূত ক্ষতি করেন তিনি। এই সংঘর্ষে ডাচদের ৮টি জাহাজ ডুবে যায়, ১১টি দখল করে ব্রিটিশরা। ১,৩৫০ জন ডাচ বন্দী হলো ব্লেকের হাতে। সুস্পষ্টভাবে এই লড়াইয়ে বিজয়ের পর রয়্যাল নেভি সাগরে প্রায় একাধিপত্য জারি করে। নেদারল্যান্ডসের উপকূল জুড়ে অবরোধ চালু হলো।
ব্রিটিশ অবরোধ
১১০টি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে মঙ্ক নেদারল্যান্ডস উপকূলে পাহারা বসালেন। সর্বময় ক্ষমতা ব্লেকের হাতে থাকলেও অসুস্থতার দরুন তিনি সরাসরি অবরোধের কমান্ড নিতে উপস্থিত ছিলেন না। তবে মঙ্ক ছিলেন যোগ্য অফিসার। ২০টির মতো ডাচ বাণিজ্য জাহাজ ছিনিয়ে নেন তিনি। সাগরে ব্রিটিশরা ডাচ বণিকদের পেলেই আটক করতে থাকে। বাল্টিক আর ইস্ট ইন্ডিয়া থেকে আসা বাণিজ্য বহর তারা আটকে দেয়। নেদারল্যান্ডসের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হলো। খাদ্যদ্রব্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বেশ কিছু প্রদেশ, বিশেষ করে হল্যান্ডের মানুষের মাঝে ব্রিটিশদের সাথে সন্ধি করবার ইচ্ছা প্রবল।
নৌবাহিনী পুনর্গঠন
ডাচ নৌবাহিনী এস্টেট জেনারেলদের জানাল- শীঘ্রই যদি ডাচ বহরে উন্নতমানের নতুন জাহাজ আর পর্যাপ্ত সরঞ্জাম যোগান দেয়া না যায়, তাহলে সাগরের রাজা হবার স্বপ্ন ঝেড়ে ফেলাই ভাল। বিশেষ করে ডি রুইটার নতুন করে যেকোনো অভিযানে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রিটিশ বহরের সমকক্ষ জাহাজ ডাচরা ফ্লিটে যোগ না করে।
নিউপোর্ট থেকে পালিয়ে নেদারল্যান্ডসের উত্তর উপকূলে টেক্সেল দ্বীপের বন্দরে ডি উইথ ২৫-২৭টি জাহাজ প্রস্তত করেছিলেন। কিন্তু মঙ্ক টেক্সেলের কাছে অবস্থান নিয়ে তাকে আটকে রেখেছিলেন। এদিকে ট্রম্প আশ্রয় নিয়েছিলেন জিল্যান্ডে। সেখানে আট সপ্তাহ ধরে কাজ করার পর ৮০-৯০টি জাহাজ তার বহরে যুক্ত করা সম্ভব হলো।
এদিকে জুলাই মাসের ১৫ তারিখে ট্রম্পের অজান্তেই মঙ্ক তার বেশিরভাগ জাহাজ নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান রসদপত্র আনতে। আগস্টের ৫ তারিখ তিনি ফিরে এলেন। ৬ তারিখ ট্রম্প পাল তুললেন খোলা সাগরে, উদ্দেশ্য ডি উইথের বহরকে বের করে আনা। ৮ আগস্ট সকাল আটটার দিকে ট্রম্প আর মঙ্কের বাহিনী মুখোমুখি হয়। তবে বাতাস প্রতিকূলে থাকায় ট্রম্প পিছিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু তার অগ্রবর্তী বহরের কয়েকটি জাহাজের সাথে প্রায় চার ঘণ্টা ব্রিটিশদের সংঘর্ষ হলো। ট্রম্পের উদ্দেশ্য ছিল মঙ্ককে সরিয়ে আনা, যাতে ডি উইথ এই ফাঁকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।
ব্যাটল অব শেভেনিঙ্গেন
ট্রম্পের কৌশল কাজ দিয়েছিল। ৮ তারিখ রাতেই ডি উইথ টেক্সেল থেকে বেরিয়ে এলেন। পরদিন ঝড়ের মধ্যে কোনো পক্ষই যুদ্ধ করেনি। এর মধ্যেই বিকাল পাঁচটার দিকে ডি উইথ ট্রম্পের দলে যোগ দেন।
১০ আগস্ট, ১৬৫৩। শেভেনিঙ্গেন গ্রামের অদূরের সাগর। তীরে জড়ো হওয়া ডাচ নাগরিকরা তাকিয়ে আছে সমরসজ্জায় সজ্জিত দুই নৌবহরের দিকে।
মঙ্কের ১০৬টি জাহাজ ডাচদের মোকাবেলায় সারিবদ্ধ হলো। মঙ্ক নির্দেশ দিলেন কোনো বন্দী নেয়া হবে না। সুতরাং কেউ আত্মসমর্পণ করতে চাইলেও গোলাবর্ষণ করে যেতে হবে। ওদিকে ডাচ ডানবাহুর নেতৃত্বে ট্রম্প, বামদিকে ডি রুইটার, মধ্যভাগে এভারস্টজুন আর রিয়ার বা পশ্চাতে অবস্থান নেন ডি উইথ। যুদ্ধ শুরু হলে তুমুল সংঘাতে চার চারবার দুই পক্ষ একে অপরের ব্যুহ ভেদ করে ফেলে। ব্রিটিশ পতকাবাহী রণতরী রেজল্যুশন দুটি শত্রু জাহাজের মাঝখানে পড়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এদিকে প্রথমবার ব্রিটিশ লাইনে আক্রমণের সময় ব্রিটিশ জাহাজ থেকে বন্দুকধারির ছোঁড়া গুলি ট্রম্পের বুক বিদীর্ণ করে চলে গেল। গুরুতর এই আঘাতে ট্রম্প একটু পরেই মৃত্যুবরণ করেন। রীতি ছিল বহরের নেতার মৃত্যু হলে তার জাহাজের পতাকা নামিয়ে নেবার। কিন্তু ট্রম্পের অফিসাররা সাধারণ নাবিকদের মনোবল যাতে না ভেঙে যায় সেজন্য এই খবর গোপন রাখেন। এভারস্টজুন ট্রম্পের দায়িত্ব বুঝে নেন।
ডি রুইটার চালাচ্ছিলেন লাম জাহাজ। ১৫০ নাবিক আর ৩০-৪০টি কামান নিয়েই তিনি শত্রুদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেন। গ্যাবার্ডের মতো আবারও লসন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ভয়াবহ লড়াই বেধে যায়। ৪৩ জন নিহত আর ৩৫ জন আহত লোক নিয়ে ডি রুইটার সাময়িক বিরতি নিতে বাধ্য হন। কিন্তু অনতিবিলম্বে তিনি আবার যুদ্ধে যোগদান করেন। দুই পক্ষের মধ্যে সমানে সমান লড়াই চলতে থাকে। তীর থেকেও ডাচ নাগরিকেরা নিজেদের দলকে চিৎকার করে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল।
ব্রিটিশ কমান্ডার মঙ্ক লড়াই করেন বীরত্বের সাথে। এদিন তার কামানের আঘাতেই ট্রম্প, এভারস্টজুন আর ডি রুইটারের জাহাজের পতাকা উড়ে যায়। বেলা দুটা-তিনটার মধ্যে নিরাশ হয়ে বেশ কয়েকটি ডাচ জাহাজ পিছিয়ে যেতে থাকলে ডি উইথ তাদের সাহস দেবার জন্য ব্রিটিশ বহরের রিয়ারে হামলা করে বসেন। কিন্তু পলায়নরত ক্যাপ্টেনরা ফিরে এলেন না। ডি উইথ শেষ পর্যন্ত বাধ্য হন মূল ডাচ বহরের সাথে সরে যেতে। তিনি টেক্সেলের দিকে চলে যান। অন্যান্য ডাচ জাহাজ নিকটবর্তী মাস নদীতে প্রবেশ করল, যেখানে গভীর সাগরে চলাচলের উপযোগী ব্রিটিশ জাহাজের প্রবেশ সম্ভব নয়। তবে ব্রিটিশদেরও ক্ষয়ক্ষতি প্রচুর, ফলে তারা মেরামতের জন্য বন্দরে ফিরে যায়।
ব্রিটিশ তথ্যমতে, ২০টির বেশি ডাচ জাহাজ ধ্বংস হয় এই লড়াইয়ে। মঙ্কের কোনো বন্দি না নেবার আদেশ সত্ত্বেও ১২০০ ডাচকে আটক করে ব্রিটিশরা। রয়্যাল নেভির দুটি জাহাজ ডুবে যায় আর ১,১০০ নাবিক হতাহত হয়। ব্রিটিশদের চোখে তারাই বিজয়ী, অন্যদিকে ডাচরা দাবি করে যেহেতু শত্রুরা লড়াই জারি না রেখে চলে গেছে কাজেই এই সংঘাত অমীমাংসিত।
শেভেনিঙ্গেনই ছিল প্রথম অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধের সর্বশেষ বড় লড়াই। এরপর ছোটখাট কিছু সংঘর্ষ হলেও কোনোটাই বলার মতো না। ডাচ নৌশক্তি শেভেনিঙ্গেনের পর প্রবলভাবে হ্রাস পেয়েছিল, তবে কিছুটা হলেও বাণিজ্য তারা ধরে রাখতে পারে। ওদিকে নেদারল্যান্ডসে জোরেশোরেই শান্তির কথা উচ্চারিত হচ্ছিল।
শান্তিচুক্তি
১৬৫২ সালের নভেম্বর থেকেই ইংল্যান্ডের সাথে কোনো চুক্তির কথা আড়ালে আবডালে আলোচনা হচ্ছিল। ১৬৫৩ সালের তেসরা জুলাই ব্যাটল অব গ্যাবার্ডের পর পরই ডাচ দূতরা ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করেছিলেন। কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি। শেভেনিঙ্গেনের পর ক্রমওয়েল শান্তির ব্যাপারে মত দেন। বিনিময়ে তিনি ব্রিটিশ জলসীমায় ডাচ জাহাজের মাছধরার জন্য বার্ষিক কর দাবি করেন।
তার অন্যান্য শর্ত ছিল ডাচ ফ্লিটের সংখ্যা সীমিত করা, সাগরে ব্রিটিশ জাহাজের সম্মুখীন হলে প্রথমে ডাচ জাহাজের পতাকা নামিয়ে নেয়া এবং যেকোনো সময় ডাচ জাহাজে ব্রিটিশ তল্লাশির অধিকার স্বীকার করা। একইসাথে তিনি ১৬২৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার আম্বোন দ্বীপে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্টদের কর্তৃক ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১০ জনসহ ২০ জন লোককে নির্যাতন করে হত্যার (The Amboyna massacre) বিচার নিশ্চিত করতে চাপ দেন। গ্র্যান্ড পেনশনার জোহান ডি উইটের কাছে তিনি বলে পাঠান আম্বোনার হত্যাকারিদের শাস্তি দিতে এবং নিহত সবার পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
তবে ক্রমওয়েলের সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিল প্রিন্স অব অরেঞ্জ তৃতীয় উইলিয়াম আর কোনদিন তার পূর্বপুরুষদের পদমর্যাদা ফিরে পাবেন না। তাকে কোনো সামরিক দায়িত্বের জন্যেও বিবেচনা করা হবে না। ডি উইট জানতেন- ক্রমওয়েলের অপমানজনক শর্তের এই লম্বা তালিকা ডাচ জনগণ কোনদিনই মেনে নেবে না। ফলে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু ক্রমওয়েল দেশের নানা সমস্যায় জর্জরিত, ডাচদের সাথে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে গেলে লাভের থেকে ক্ষতিই বেশি। ফলে তিনি ছাড় দিতে রাজি হন। ডি উইট জানতেন- প্রিন্স অফ অরেঞ্জ জনগণের কাছে অত্যন্ত সম্মানের। ফলে প্রকাশ্যে তাকে নিয়ে দেয়া শর্ত মেনে নিলে বরঞ্চ তার গদিই নড়ে যেতে পারে। ফলে তিনি এই শর্ত গোপন ধারা হিসেবে চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ দেন। বন্ধু ভ্যান বেভেরনিং তার পক্ষে সঙ্গোপনে ক্রমওয়েলের সাথে এই ব্যাপারে আলোচনা চালাতে থাকলেন। রফা হলো- প্রিন্স অফ অরেঞ্জের ব্যাপারে শর্ত নেদারল্যান্ডসের সাথে নয়, হল্যান্ড প্রদেশের সাথে স্বাক্ষরিত হবে। সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী প্রদেশ হিসেবে হল্যান্ড প্রিন্স অব অরেঞ্জের ব্যাপারে ক্রমওয়েলের চাওয়া কার্যকর করতে সক্ষম।
প্রকাশ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো ১৬৫৪ সালের ১৫ এপ্রিল ওয়েস্টমিনিস্টারে (Treaty of Westminster)। ডি উইট আম্বোনার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হন, সেই সাথে খুঁজে পাওয়া গেলে হত্যাকারীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন। নেদারল্যান্ডস নেভিগেশন আইন মেনে নিয়ে বার্ষিক কর প্রদান করতে সম্মত হয়, সেই সাথে সাগরে ব্রিটিশ জাহাজ দেখলে প্রথমে পতাকা নামিয়ে নেয়ার শর্ত মেনে নেয়। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে বার্ষিক পাঁচ লাখ পাউন্ড ধার্য করেন ক্রমওয়েল।
প্রথম অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললো ইংল্যান্ড। কিন্তু এই লড়াই জানান দিয়ে গেল মিখিয়েল ডি রুইটারের আবির্ভাব, সাজিয়ে দিল দ্বিতীয় অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট।