ডিসেম্বর ১৫, ১৯০০। আর্চটর (Archtor) নামের স্টিমারটি এগিয়ে চলেছে লাইথের (Leith) দিকে। আশেপাশের কালিগোলা পরিবেশের মাঝে জাহাজের ক্যাপ্টেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত বাতিঘরের আলো। ফ্লান্নান দ্বীপপুঞ্জে বসানো নতুন বাতিঘরের আলো তার নজরে না পড়ায় একইসাথে অবাক আর হতাশ হলেন তিনি। নিজের লগবুকে লিখে রাখলেন বিষয়টি। তিন দিন পর ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ বন্দরে এসে ভিড়লো স্টিমারটি। সেখানে পৌঁছে নর্দান লাইট হাউজ বোর্ডের কাছে ফ্লান্নান দ্বীপপুঞ্জে আলো দেখতে না পাওয়ার বিষয়টি জানান স্টিমারের ক্যাপ্টেন।
তাৎক্ষণিক যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা সেসময় ছিল না। তাই লাইট হাউজ বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়, ফ্লান্নান দ্বীপপুঞ্জের যে অঞ্চলে বাতিঘরটি রয়েছে সেখানে একটি উদ্ধারকারী দল পাঠাবে। বাতিঘরের রহস্যময় আচরণের খবর পাবার দুদিন পর অর্থাৎ ডিসেম্বরের ২০ তারিখ রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত হতে বলা হয় উদ্ধারকারী দলকে, যার নেতৃত্ব দেবেন ক্যাপ্টেন জেমস হার্ভি। ‘হেস্পুরাস’ নামের একটি উদ্ধারকারী জলযানে করে তার দল ফ্লান্নান দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপ এইলিন মোরে (Eilean Mor) যাবে বলে ঠিক করা হয়। কিন্তু অশান্ত হয়ে ওঠে সমুদ্র, আবহাওয়ার অবনতি ঘটায় যাত্রা পিছিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না উদ্ধারকারী দলের। অবশেষে ১৯০০ সালের ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ বাতিঘরে পৌঁছায় তারা।
স্কটল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমের ফ্লান্নান দ্বীপপুঞ্জের এইলিন মোর নামের ছোট একটি দ্বীপে এই বাতিঘরটি নির্মাণ করা হয় ১৮৯৯ সালে। সেই সময়ের জন্য আধুনিক শক্তপোক্ত স্থাপনা সেটি। প্রায় ৭৫ ফুট উঁচু, সাদা রঙ করা বাতিঘরটি সত্যি বহুদূর থেকে নাবিকদের চোখে পড়তে বাধ্য। তীরে পৌঁছার সময় থেকেই কোনো একটা গোলমেলে ব্যাপার যে এখানে ঘটেছে সেই বিষয়ে সন্দেহ হতে থাকে হেস্পুরাসের উদ্ধারকারী দলটির।
বাতিঘরের উপর থেকে তাদের আসতে দেখেও কেন কেউ এখনও আসছে না সেটাই হয় সন্দেহের প্রথম কারণ। ডকের আশেপাশেও কোনো ধরনের চিহ্ন নেই যা থেকে বোঝা যেতে পারে ডক প্রস্তুত রাখা হয়েছে তাদের আসার জন্য। পতাকা রাখার দণ্ডও ফাঁকা পড়ে আছে। কে জানে কবে থেকে!
এইলিন মোর দ্বীপটি একেবারেই নীরব আর নির্জন। নতুন বানানো এই বাতিঘরটি বাদে সেখানে স্থাপনা বলতে ছিল কেবল সপ্তম শতাব্দীতে সেন্ট ফ্লান্নানের নির্মাণ করা একটি চ্যাপেল। এই দ্বীপে স্থায়ীভাবে কোনো মানুষ বসবাসের নজির পাওয়া যায় না। নেহায়েত বাতিঘর আছে বলে একটি পরিচালনার দলকে সেখানে থাকতে হয়। ক্যাপ্টেন জেমস হার্ভি আর তার দল দ্বীপে নেমে তাদের কাজ শুরু করে। তাদের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য বাতিঘরটির তিন পরিচালক থমাস মার্শাল, জেমস ডুকাট এবং ডোনাল্ড ম্যাকআর্থারকে খুঁজে বের করা। সেই সাথে জানার চেষ্টা করা কী কারণে বাতিঘরে আলো জ্বালানো বন্ধ রাখা হয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তের জন্য বাতিঘরের দিকে এগিয়ে যান উদ্ধারকারী দলের সদস্য জোসেফ মুর। বাহ্যিকভাবে কোনো ধরনের সমস্যা নজরে না আসায় ভেতরে প্রবেশ করেন তিনি। দরজা-জানালাগুলো বেশ সাবধানতার সাথেই বন্ধ করে রাখা আছে। কিন্তু নাম ধরে ডেকেও সাড়া পাওয়া যায় না কারও। শোবার ঘরে উঁকি দিয়ে তিনি দেখতে পান- বিছানাগুলো অগোছালো পড়ে আছে। শেষবার ঘুমানোর পর কেউ সেগুলো নতুন করে গুছিয়ে রাখেনি। বাতিঘরের ঘড়িগুলোও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে থেমে আছে।
আলো না দেখা যাবার সাথে বাতিঘরের পরিচালকদের গায়েব হয়ে যাওয়ার স্পষ্ট একটা সংযোগ আছে সেটা বেশ বুঝতে পারেন মুর। শোবার ঘর ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যান তিনি। টেবিলের উপর রাখা আছে মাংস, আলু আর পিকেলের প্লেট। যেন একটু পরেই কেউ এসে খেতে বসবে সেখানে। একটা উল্টে পড়া চেয়ার বাদে সেখানে আর কোনো অসামাঞ্জস্য চোখে ধরা পড়লো না তার। কাজের ঘরে তিনি খুঁজে পান বাতিঘরের লগবই। সেখানের লেখাগুলো বর্তমান পরিস্থিতি পরিষ্কার তো করেই না, বরং আরো বেশি ঘোলাটে করে তোলে।
আরো একটু ঘুরে তিনি আবিষ্কার করেন, বাতিঘরের মূল বাতি জ্বলবার জন্য প্রস্তুত অবস্থাতেই আছে। নেই শুধু বাতি জ্বালাবার মানুষ। তিনজন কর্মীর জন্য সংরক্ষিত তিনটি অয়েল স্কিন কোট (রাবারের তৈরি একধরনের রেইন কোট জাতীয় পোশাক) এর মাঝে একটি এখনও ঝোলানো অবস্থাতেই রয়েছে। তার মানে এখানে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, সেজন্য বাতিঘরের পরিচালকরা আগে থেকে প্রস্তুতি নেবার সময় পাননি। কারণ, নাহলে দুজন অয়েল স্কিন কোট পরে বাইরে গেলেও একজন সেটা ছাড়া যাবার কথা নয়। তাছাড়া লাইট হাউজ বোর্ড থেকে দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী ন্যূনতম একজন কর্মীকে অবশ্যই সবসময় বাতিঘরে অবস্থান করতে হবে। তাহলে কী এমন ঘটেছিল এখানে যে নিয়মের তোয়াক্কা না করে তিনজনই একসাথে বাইরে বের হয়ে গিয়েছিল?
বাতিঘরের ভেতরের অনুসন্ধান শেষে মুর ফিরে আসেন বাকি দলের কাছে। ক্যাপ্টেন আর বাকি দল দ্বীপের সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করেন বাতিঘরের কর্মীদের। এমনকি নিজেদের অবস্থান জানান দিতে এবং কেউ জীবিত থাকলে তাদের সাড়া পাবার আশায় আকাশের দিকে রকেট ছোঁড়ে তারা। কিন্তু কোনো খোঁজ মেলে না হারিয়ে যাওয়া তিনজনের। ততক্ষণে উদ্ধারকারী দলের সবাই নিশ্চিত হয়ে যায় চরম খারাপ কিছুই ঘটেছে বাতিঘরে অবস্থান করা দলের তিনজনের সাথে। কিন্তু একেবারে কোনো ধরনের চিহ্ন না রেখে গায়েব হয়ে যাবার কারণ তারা কোনোভাবেই মেলাতে পারছিল না। ক্যাপ্টেন সিদ্ধান্ত নেন লাইট হাউজ কর্তৃপক্ষকে যত দ্রুত সম্ভব এই ঘোলাটে অবস্থা সম্পর্কে জানানো প্রয়োজন। সেজন্য তিনি টেলিগ্রাম করতে ছুটে যান নিকটবর্তী দ্বীপের টেলিগ্রাফ অফিসে। দলের বাকিরা অর্থাৎ মুর, ম্যাক ডোনাল্ড, বয়া মাস্টার আর দুজন নাবিক সেই রাতে দ্বীপেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রাথমিক তদন্তে ফলাফল পাওয়া গেলেও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে আরো বিস্তারিত তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয় উদ্ধারকারী দলকে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে তারাও নেমে পড়ে আরো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে। বাতিঘরে খুঁজে পাওয়া লগবুকের লেখাগুলো বিশ্লেষণের চেষ্টা করে তারা।
ডিসেম্বরের ১২ তারিখের লেখায় বাতিঘরের কর্মী মার্শাল উল্লেখ করে, প্রচন্ড বাতাস বইছে, এমন বাতাস যা বিগত বিশ বছরেও সে কখনও দেখিনি। সেই সাথে মার্শাল আরো লেখে, ডুকাট একেবারে চুপচাপ হয়ে পড়েছে আর ম্যাকআর্থার কাঁদছে! এই ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত ঠেকলো সবার কাছেই। একজন অভিজ্ঞ নাবিক এবং বাতিঘরের পরিচালক ঝড়ের বাতাসে কান্নাকাটি করছে সেটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে মার্শালের লেখায় ঝড়ের আরো বিবরণ পাওয়া যায়। সেই সাথে সে উল্লেখ করে, তারা তিনজন বাতিঘরে প্রার্থনায় বসেছে দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবার জন্য। কিন্তু নব্যনির্মিত শক্তিশালী এই বাতিঘরের ভেতরে বসে থাকা সমুদ্র বিষয়ে অভিজ্ঞ তিনজন মানুষ প্রার্থনায় মশগুল হবার মতো ঝড়ের ব্যাপারটাও কেমন রহস্যময় মনে হতে থাকে । তদন্ত কমিটি খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, এই অঞ্চলে ডিসেম্বর ১২, ১৩ এবং ১৪ তারিখে কোনো রকম ঝড়ের নজির নেই। সমুদ্র শান্ত অবস্থায় ছিল ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ পর্যন্ত।
লগবুকে শেষ লেখাটি পাওয়া যায় ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে। সংক্ষিপ্ত সেই লেখায় বলা হয়, ঝড় থেমে গেছে, সমুদ্র শান্ত, সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান। সেদিন থেকেই বাতিঘরে আর আলো জ্বলতে দেখেনি ‘আর্চটর’ স্টিমারের নাবিকেরা।
ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে বাতিঘর কর্মীদের এই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার রহস্য। দ্বীপে নৌকা ভেরার যে দুটি ল্যান্ডিং রয়েছে তার একটি বহাল তবিয়তেই রয়েছে, যেখানে উদ্ধারকারী দলটি নেমেছিল। কিন্তু দ্বীপের অপরপাশে থাকা ল্যান্ডিংটি ঝড়ের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে দেখতে পায় উদ্ধারকারী দলটি। লোহার তৈরি রেলপথ ঢালাই থেকে উপড়ে এসেছে, লোহার তৈরি রেলিংগুলোর আকারও বদলে গেছে বেশ কিছু জায়গাতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০৮ ফুট উপরে থাকা পণ্যের একটি বাক্সও পাওয়া যায় ভাঙা অবস্থায়। দ্বীপের পশ্চিমপার্শ্বে অবস্থিত সেই ল্যান্ডিংয়ের কাছে পড়ে থাকা প্রায় টনখানেক ওজনের একটি পাথর এর অবস্থান থেকে বেশ কিছুটা দূরে সরে গেছে বলেও দেখতে পায় তারা। কিন্তু বাতিঘরের পরিচালনা দলটির কোনো চিহ্ন সেখানেও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয় তারা।
উদ্ধারকারী দলের তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। অতিপ্রাকৃত কিছু কি ঘটেছিল দ্বীপটিতে? সমুদ্র থেকে উঠে আসা কোনো ভয়াল দানব কি ধরে নিয়ে গেছে বাতিঘরের পরিচালকদের? ভিনগ্রহের প্রাণীর কথাও স্থান পায় অনেকের চিন্তাজগতে।
একটু যুক্তিবাদী কল্পনাকারীদের চিন্তায় আসে, একা একা বাতিঘরে বাস করে কি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল বাতিঘরের কর্মীরা? এরপর হয়তো একে অপরকে খুন করে তারা? লগবুকের অসংলগ্ন এন্ট্রিগুলোও তো তারই আভাস দেয়। কিন্তু তেমনি যদি হতো তাহলে কোনো ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ন কোথাও পাওয়া গেল না কেন? সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার অনেকের মতে, একইসাথে তিনজন কর্মীর নিখোঁজ হবার পেছনে সরকারের হাত থাকতে পারে কিংবা বিদেশি কোনো গোয়েন্দার!
অবশেষে লাইট হাউজ কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে সবচেয়ে বাস্তবভিত্তিক আর স্বাভাবিক ব্যাখ্যা। সম্ভবত ঝড়ের মাঝে পশ্চিম ল্যান্ডিংয়ের জিনিসপত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাতিঘরের কর্মীরা সেখানে যায় এবং ঝড়ের কবলে পড়ে সমুদ্রে ভেসে যায়। কিন্তু সেই ব্যাখ্যাও আসলে যুক্তিতে টেকে না, কারণ নিজেদের কাজে অভিজ্ঞ বাতিঘরের কর্মীরা কী কারণে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ঝড়ের মুখে সেখানে যাবে? যদি গিয়েও থাকে তাহলে কেন তিনজনকেই সেখানে যেতে হবে? কারণ নিয়ম অনুযায়ী অন্তত একজনের বাতিঘরে অবশ্যই থাকার কথা।
বাতিঘরে খুঁজে পাওয়া অয়েল স্কিন কোটটি প্রমাণ করে অন্তত একজন বিনা প্রস্তুতিতে বাইরে গিয়েছিল। আবার হারিয়ে যাওয়া কর্মীদের রহস্যময় লগবুকের হিসেব অনুযায়ী ঝড় শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা বাতিঘরেই অবস্থান করছিল এবং শেষবারের রিপোর্ট তারা লেখে ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে। কিন্তু সেদিন থেকেই বাতিঘরে আলো দেখতে না পাওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়। পশ্চিমের ক্ষতিগ্রস্থ ল্যান্ডিং ঠিক কবে ঝড়ের কবলে পড়ে সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করা যায়নি।
এসব প্রশ্ন বিগত ১২০ বছর ধরে তাড়া করে ফিরছে অনেক রহস্যপ্রেমীকে। কিন্তু এর কোনো সঠিক উত্তর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার পর বাতিঘর আবারও চালু করা হয় এবং নতুন কর্মীরা সেখানে কাজে যুক্ত হয়। তবে মানসিক চাপের কারণে হোক বা রহস্যময় অতীত ইতিহাসের কারণে, তাদের অনেকেই অভিযোগ করে তারা নাকি শুনতে পেয়েছে হারিয়ে যাওয়া বাতিঘর কর্মীদের নাম ধরে কারা যেন ডেকে বেড়ায় সেখানে!