গল্পটা আমি শুনেছি ইসমাইল নাখুদার কাছ থেকে। তিনি ইংল্যান্ডের প্রিস্টন শহরের বাসিন্দা, এবং একজন পেশাদার লেখক ও সাংবাদিক। তিনি আবার গল্পটা শুনেছেন তার প্রয়াত বাবা মোহাম্মদ নাখুদার কাছ থেকে।
ঘটনার সূত্রপাত ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি কোনো একসময়ে। ইসমাইলের বাবা সেদিন আরো কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে মিলে শহরের গোরস্থান পরিষ্কারের কাজ করছিলেন। হঠাৎ করেই তিনি গোরস্থানের মুসলিম অংশে আবিষ্কার করেন একটি কবরের নামফলক, যেটির উপর আরবিতে কিছু কথা খোদাই করা রয়েছে।
আরবি কথাগুলোর অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “তিনি, যিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, এবং যার নাম উচ্চারিত হবে চিরকাল।” আর তার নিচে ইংরেজিতে যা লেখা ছিল তার তর্জমা অনেকটা এমন, “এখানে বিশ্রাম করছে মারাক্কেশ, মরক্কোর আহমেদ বিন ইব্রাহিমের নশ্বর দেহাবশেষ। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ২৪ জানুয়ারি, ১৯০৬, ৬০ বছর বয়সে।”
এটিই ওই গোরস্থানের সবচেয়ে পুরনো মুসলিম নামফলক।
কবরের নামফলকটি প্রথমবার দেখার পর থেকেই ইসমাইলের বাবার মাথায় একটি চিন্তা ঘুরপাক খেতে শুরু করে। তিনি ভাবতে থাকেন, কেন ওই নামফলকটি ওখানে, আর কী-ই বা ওই কবরে চিরশায়িত মানুষটির পরিচয়।
সেই বিশেষ দিনটিতে ইসমাইলের বাবা ও অন্যান্য মুসলিম স্বেচ্ছাসেবীরা আরো যে বিষয়টি খেয়াল করেছিলেন তা হলো, গোরস্থানের যে জায়গায় আহমেদকে কবর দেয়া হয়েছে, সেটি তখনকার দিনে নির্ধারিত ছিল সহায়সম্বলহীন ব্যক্তি এবং প্রচলিত ধর্মে অবিশ্বাসীদের জন্য। তাছাড়া কবরটি কিবলার দিকেও মুখ করা ছিল না।
প্রিস্টন শহরের বর্তমান জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৪০ হাজারের মতো, যাদের মধ্যে ১৫ হাজার মুসলিম। এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে ওই কবরের নামফলকটি, এবং আহমেদ নিজেও, সবসময়ই এক রহস্য হয়ে থেকেছেন।
তবে নাখুদা বাসগৃহে প্রায়ই কথা হতো তাকে নিয়ে। মোহাম্মদ নাখুদা ইংল্যান্ডে এসেছিলেন ভারত থেকে। তিনি মাঝেমধ্যেই তার ছেলে ইসমাইলের সাথে আলাপ করতেন ওই ‘নিঃসঙ্গ আরব মানুষটির’ ব্যাপারে। তারা কল্পনা করতেন, কেমন ছিল মানুষটির জীবন।
মোহাম্মদ নাখুদা মারা গেছেন, কিন্তু তিনি তার কৌতূহল গচ্ছিত রেখে গেছেন ছেলে ইসমাইলের কাছে। তাই তো ইসমাইল, যিনি ইতিহাসের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী, খুঁড়তে শুরু করেন মাটিচাপা পড়া অতীত। জানার চেষ্টা করেন আহমেদের ব্যাপারে। আর তা করতে গিয়ে কয়েক বছর আগে যেসব তথ্য তিনি উদঘাটন করেন, তার মাধ্যমে উন্মোচিত হয় ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে মুসলিম বসতির চমকপ্রদ ইতিহাস।
এবং আরো চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হলো, ওই ইতিহাসের সাথে বর্তমানেরও যোগসূত্র স্থাপন করেছে একটি জিনিস—খেলা। কেননা আহমেদের পরিচয় হলো, জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন একজন পেশাদার অ্যাক্রোব্যাট, অর্থাৎ সার্কাসের দড়াবাজিকর!
প্রিস্টনের খুব কাছেই অবস্থিত লিভারপুল মেট্রোপলিটন এলাকা, যার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে বিরল শ্রেণীবৈচিত্র্যের কারণে। লিভারপুল আজ স্বীকৃত বিশ্বের অন্যতম বন্ধুভাবাপন্ন শহর হিসেবে। এবং এখানকার নগরায়নের পরতে পরতেও ছড়িয়ে রয়েছে ঔদার্য্য ও সহনশীলতার ছাপ।
তাই তো বর্তমানে এই শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত বাসিন্দা যে মানুষটি, তিনি একজন পেশাদার ক্রীড়াবিদ। তার নাম মোহাম্মদ ‘মো’ সালাহ। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের তারকা মিডফিল্ডার তিনি। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ফুটবলে তিনি মাঠ কাঁপান মাতৃভূমি মিশরের জার্সি গায়ে।
ইসমাইল প্রথম যখন তার গবেষণা শুরু করেন, স্থানীয়ভাবে আহমেদের ব্যাপারে কোনো নথিই তিনি খুঁজে পাননি। কিন্তু অনলাইনে ব্রিটিশ নিউজপেপার আর্কাইভের মাধ্যমে তিনি যেন হাতে ঈদের চাঁদ পেয়েছেন। ১৮৯৫ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে তিনি পত্রিকায় বেশ কিছু রিভিউ, আর্টিকেল ও বিজ্ঞাপন দেখতে পান একটি ভ্রাম্যমাণ সার্কাস দলের ব্যাপারে। সেই সার্কাস দলটি মরক্কোর, নাম ‘দ্য আহমেদ ইব্রাহিম ট্রুপ’।
ইসমাইল তার সংগৃহীত তথ্যগুলো টুইটারে পোস্ট করেন, এবং শীঘ্রই অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। ল্যাঙ্কাশায়ার ভিত্তিক ‘এশিয়ান ইমেজ’ নামক সংবাদপত্র তার প্রাপ্ত তথ্যগুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদনও ছাপিয়ে ফেলে। প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু ছিল ওই অঞ্চলে মুসলিম কবরের ইতিহাস।
তবে সবচেয়ে বড় লাভ যেটি হয় তা হলো, জুলি নিফটন নামে প্রিস্টন গোরস্থানের একজন ক্লার্ক যোগাযোগ করেন ইসমাইলের সঙ্গে। তিনি আহমেদের দাফন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য দেন। নিশ্চিত করেন যে ইব্রাহিমকে আসলেই গোরস্থানের আউটার সেকশনে দাফন করা হয়েছিল, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ৩০৫ নম্বর কবরে। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি ইসমাইলকে ব্যাখ্যা করেন, গোরস্থানের সকল কবরই তখন পূর্ব-পশ্চিম দিকে খনন করা হতো। এর মাধ্যমে ইসমাইল একটি কারণ খুঁজে পান, কেন আহমেদকে কিবলামুখী করে দাফন করা হয়নি।
গোরস্থানের নথি থেকে আরো জানা যায়, আহমেদের জন্য কবরের প্লটটি কিনেছিলেন চার্লস হাচিনসন নামের প্রিস্টনের এক কামার, এবং তার স্ত্রী, মেরি অ্যান হাচিনসন। পরবর্তীতে তাদেরকেও অ্যাংলিকান সেকশনের পরিবর্তে আহমেদের কাছাকাছি দাফন করা হয়। তাছাড়া হাচিনসনের বাড়ির ঠিকানা, ৭২ নর্থ রোডই, উল্লেখ করা হয় আহমেদের ডেথ সার্টিফিকেটে।
ইসমাইল যারপরনাই অবাক হন এ কথা ভেবে, হাচিনসনের মতো একজন লোহার কারিগর কেন একজন বিদেশি, মুসলিম, সার্কাসের দড়াবাজিকরের সাথে এক বাড়িতে থাকতেন। তবে কি হাচিনসনও ছিলেন প্রিস্টনের তৎকালীন মুষ্টিমেয় ইংরেজ মুসলিমদের একজন?
এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরো অনেকগুলো প্রশ্ন এসে হাজির হয় ইসমাইলের সামনে। প্রশ্নগুলোর উত্তর অন্বেষণ অব্যাহত রাখেন তিনি। এবং এরই মাধ্যমে তার পরিচয় হয় আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম নামটির সঙ্গে। উনবিংশ ও বিংশ শতকের সন্ধিলগ্নে, যখন লিভারপুল ছিল ব্রিটেনের সবচেয়ে জনবহুল, দ্রুত শিল্পায়নমুখী নগরীগুলোর একটি, তখন আব্দুল্লাহ ছিলেন সেখানকার বহুজাতিক মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা।
ইসমাইলের মতে, আহমেদ বিন ইব্রাহিমকে পুরোপুরি চিনতে ও বুঝতে হলে, আব্দুল্লাহর সম্প্রদায়কে বোঝার কোনো বিকল্প নেই। কেননা আজ হয়তো লিভারপুলের অনেক মানুষই মনে করে, মো সালাহ যে একজন মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার মস্ত বড় তারকা, সেটি বুঝি একটি অভূতপূর্ব ব্যাপার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, লিভারপুলে ইসলামি ইতিহাস ও প্রভাবের সূচনা ঘটেছে মো সালাহরও অনেক, অনেক আগে।
ব্রিটিশ ইসলামি ইতিহাস বিশেষজ্ঞ এবং ‘ইসলাম ইন ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেন : দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অভ আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম’ (কিউব পাবলিশিং, ২০০৯) গ্রন্থের রচয়িতা রন জিভস জানান, ব্রিটেনের প্রথম দিককার মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা হবার আগে ও পরে, আব্দুল্লাহ ছিলেন উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের সফলতম আইনজীবীদের একজন।
১৮৮৭ সালে মরক্কো সফরের পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, এবং নিজের পিতৃপ্রদত্ত নাম উইলিয়াম হেনরি বদলে আব্দুল্লাহ হয়ে যান, যার অর্থ হলো ‘আল্লাহর বান্দা’। ওই একই বছরই তিনি লিভারপুল মসজিদ ও মুসলিম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম সোসাইটির অধীনে সেটির পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ চলছে।
আব্দুল্লাহর সমগ্র জীবনকালেই, লিভারপুলের ক্রমবিকাশ ঘটছিল, এবং এটি পরিণত হচ্ছিল ট্রান্সআটলান্টিক জাহাজ ব্যবস্থার মূল প্রাণকেন্দ্রে। তাছাড়া এটি ছিল সমগ্র ব্রিটিশ কমনওয়েলথেরও অন্যতম ব্যস্ততম বন্দর। এই শহরেরই জাহাজঘাটায় এসে পা রাখত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অভিবাসীরা। ফলে লিভারপুলই ছিল অভিবাসনের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের শীর্ষ শহর।
মোটাদাগে লিভারপুলের মুসলিম সম্প্রদায়ের ছিল দুটি অংশ। কেউ ছিল শহরের নতুন বাসিন্দা, আবার কেউ ছিল নিছকই পর্যটক, যারা আসত আরব উপদ্বীপ, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে। তাছাড়া স্থানীয় ইংরেজদের মধ্যেও অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। সব মিলিয়ে শহরে মুসলিমের পরিমাণ বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় উন্নীত হয়, এবং ১৮৯৬ সালে ‘লন্ডন সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা লিভারপুলকে আখ্যা দেয় “সমগ্র ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে ইসলামের কেন্দ্র” হিসেবে।
একটি সম্প্রদায় হিসেবে ক্রমশ লিভারপুলের মুসলিমদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বাড়তে থাকে। তারা শুক্রবার জুম্মার নামাজে একত্র হয়, ঘটা করে ঈদ উদযাপন করে, প্রায়ই সন্ধ্যাকালীন খুৎবা ও বিতর্কে শামিল হয়, মাঝেমধ্যে পিকনিক কিংবা প্রমোদ ভ্রমণে বের হয়। পরস্পরের বিয়ে ও শেষকৃত্যেও অংশ নেয় তারা।
যদিও আব্দুল্লাহ অংশগ্রহণ করতে পারেননি আহমেদের শেষকৃত্যে, তবে তিনি নিজের পত্রিকা ‘দ্য ক্রিসেন্ট’-এ লেখেন আহমেদ ও তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান প্রসঙ্গে। আহমেদকে তিনি অভিহিত করেন একজন “খাঁটি মুসলিম” হিসেবে, যিনি নিয়মিতই লিভারপুলের মসজিদে হাজির হতেন নামাজ আদায় করতে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে আহমেদ মৃত্যুকালে রেখে গেছেন এক স্ত্রীকে, যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তবে ইসমাইল এ প্রসঙ্গে এখন অবধি আর কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি।
এদিকে আব্দুল্লাহ তার রচনায় ইউরোপজুড়ে আহমেদের বহু বছরের “সক্রিয় জীবন”-এরও বর্ণনা দেন। তিনি লেখেন, ‘দ্য আহমেদ ইব্রাহিম ট্রুপ’ নামক একটি কোম্পানির সাথে ছিলেন আহমেদ, যেখানে তার সঙ্গী ছিল অত্যন্ত চালাক-চতুর সব আরব দড়াবাজিকর ও ক্রীড়াবিদ।
ফুটবল কিংবা অন্যান্য সংগঠিত খেলা মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হতে পারে, কিন্তু আহমেদদের সময়কার সার্কাসের খেলাতেও ছিল যথেষ্ট প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতা ছিল দর্শকদের মনোরঞ্জন ও সম্মান অর্জনের জন্য। দড়াবাজি ছাড়াও সার্কাসে প্রায়ই আমন্ত্রণ জানানো হতো সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, জাদুকর, কুস্তিগীর এবং অন্যান্য বিনোদনদাতাদের।
দড়াবাজিকরদের মধ্যে একটা বড় অংশ আসত মরক্কো থেকে। এর পেছনে যথেষ্ট কারণও ছিল বলে মনে করেন মরক্কোর সিদি মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লায়াচি এল হ্যাবুশ। তার মতে, তৎকালীন দড়াবাজিকরদের কাজ কেবল দর্শককে বিনোদন প্রদানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা বিশ্বের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক বিস্তারকে এক নতুন রূপ দেয়ার ক্ষেত্রেও সাহায্য করত।
এল হ্যাবুশ বলেন, “আমরা চিন্তা করে অভ্যস্ত যে ব্রিটিশরা ভিন্ন সংস্কৃতির ব্যাপারে বিমোহিত। তা তারা সত্যিই, কিন্তু মরোক্কান দড়াবাজিকরদের দলটি এক ভিন্ন গল্পও বলে। সেই গল্প হলো মোকাবিলা ও বিনিময়ের।”
‘দ্য টাইমস’, ‘দ্য এরা’ এবং ‘ব্রিস্টল মার্কারি’র মতো পত্রিকায় মরক্কোর দড়াবাজিকরদের ডাকা হতো ‘বেদুইন আরব’ কিংবা ‘মরক্কান আরব’ হিসেবে। তাদের সবচেয়ে বেশি খ্যাতি ছিল মানব পিরামিড এবং মঞ্চে রাইফেল ও তলোয়ার ব্যবহারের জন্য। তাছাড়া এল সার্কাসের সেই খেলাগুলো ছিল শরীরী সক্ষমতা, পৌরাণিক কাহিনী এবং বিভিন্ন উন্নত যন্ত্রের সমন্বয়ে এক অসাধারণ প্রদর্শনী, যা প্রাচ্যের অনুসন্ধিৎসা এবং ভিক্টোরিয়ান যুগের উৎপাদন শিল্পের সামর্থ্যের সাথে ভালোই মানাত।
অধ্যাপকের ভাষ্যমতে, এই বিষয়গুলো ব্রিটিশদের মনে ঔপনিবেশিক সাম্প্রদায়িক প্রদর্শনী সম্পর্কে কিছু গৎবাঁধা ধারণার জন্ম দিয়েছে বটে, কিন্তু এর মাধ্যমে এক নতুন ধরনের আন্তঃসাংস্কৃতিক মেলবন্ধনও ঘটেছে, যা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক ডিসকোর্সকে।
মরক্কো থেকে আগত প্রথম পরিচিত দড়াবাজিকর হলেন সিদি আহমেদ ঔ মুসা, যিনি ছিলেন পঞ্চদশ শতকে মরক্কোর দক্ষিণে লেসার অ্যাটলাস পর্বতমালার একজন ধর্মীয় নেতা। তার অনুসারীরা ক্রীড়া ও শৈলীর সমন্বয়ে এমন এক ধরনের খেলা দেখাত, যা তাদেরকে একই সাথে প্রস্তুত করে তুলত যুদ্ধ ও পেশাজীবনের জন্য। তারা যে মানব পিরামিড তৈরি করত, সেটি এককালে মূলত ব্যবহৃত হতো পর্তুগিজ যুদ্ধজাহাজ শনাক্তকরণে।
যেহেতু এই পিরামিডের লক্ষ্য ছিল নিজেদের ভূমিকে বিদেশি শক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা করা, তাই একে একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী খেলাও বলা চলে।
পরবর্তী সময়ে, যখন ঔপনিবেশিক শক্তির পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে, তখন এ ধরনের দড়াবাজি অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের পেশায় পরিণত হয়। মরক্কান দড়াবাজিকরদের ডাকা হতো “সিদি আহমেদ ঔ মুসার সন্তান” হিসেবে। তারা খেলা দেখাত স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি ও ব্রিটেনের দর্শকদের সামনে।
তাদের ক্রীড়ানৈপুণ্যের ভিন্নতা ভিনদেশি দর্শকরা সাদরে গ্রহণ করত। সার্কাস দেখতে এসে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি থাকত না। যেমন- ‘ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ’ একবার সংবাদ করে, এই দড়াবাজিকরদের পারফরম্যান্স নাকি এতটাই অবিশ্বাস্য ও অভাবনীয় ছিল যে, আগত দর্শক পুরো রাত মুহুর্মুহু করতালিতে ভাসিয়েছে তাদের।
এভাবেই বিদেশে গিয়ে খেলা দেখাতে দেখাতে অনেক দড়াবাজিকরই একসময় স্থায়ী হতে শুরু করে বিভিন্ন ইউরোপীয় ও ব্রিটিশ এলাকায়। তবে সেক্ষেত্রে তাদেরকে নানাবিধ স্টেরিওটাইপের সম্মুখীন হতে হয়, এবং তাদের ব্যাপারে যেসব ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। লিভারপুলের মুসলিমদেরও প্রাথমিকভাবে এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি সেসবের কিছু কিছু আজকের দিনেও বিদ্যমান।
ইসমাইল মনে করেন, আহমেদ একজন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যে ইংল্যান্ডে একজন সংখ্যালঘু মুসলিম ব্যক্তির জীবন কেমন হতে পারে। এবং তিনি আরো বিশ্বাস করেন, লিভারপুল গোটা ব্রিটেনের মধ্যেই একদম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি স্থান। এখানে মানুষের হৃদয় খুবই কোমল ও উষ্ণ। তারা খুবই আন্তরিকতার সাথে সবাইকে গ্রহণ করতে পারে। আর এই সবকিছুকে ছাপিয়ে, ফুটবল তো একটি বাড়তি পাওনা, যার প্রভাব খুবই ইতিবাচক। ইসমাইলের নিজের ছেলেও লিভারপুল ও মো সালাহর একজন ‘ডাইহার্ড ফ্যান’। তবে ইসমাইল এ-ও বলেন যে, “আমি মোটেই এ কথা বলতে চাই না যে এখানে প্রতিকূল কিছুই নেই।”
“মো সালাহর ক্ষেত্রে, তার যে পরিমাণ যোগাযোগ রয়েছে এবং তিনি বিশ্বব্যাপী যত মানুষকে চেনেন, তা থেকে আক্ষরিক অর্থেই বোঝা যায় যে এখানে আসলেই একটি ইসলামি ঐতিহ্য রয়েছে।”
গোটা বিশ্বজুড়ে অজস্ব ভক্ত-সমর্থক রয়েছে ২৮ বছর বয়সী ‘ইজিপশিয়ান কিং’ মো সালাহর। ২০১৭ সালে লিভারপুলে যোগদানের পর থেকেই তিনি নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে চলেছেন। ২০১৯ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির করা এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, একজন তারকা ফুটবলার হিসেবে তিনি কেবল লিভারপুলেই নয়, পুরো ব্রিটেনেই, মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে অমুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পর্কের উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন। গবেষণাটিতে একে আখ্যায়িত করা হয়েছে “দ্য মো সালাহ ইফেক্ট” হিসেবে।
গবেষকরা যুক্তরাজ্যের ফুটবল ভক্তদের সর্বমোট ১৫ মিলিয়ন টুইট বিশ্লেষণ করেছেন, যার মধ্যে ৮,৬০০টি ছিল লিভারপুলের মূল শহরের বাসিন্দাদের। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, সালাহ যখনই অমুসলিমদের কাছে সাড়া ফেলেছেন, মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুরা আরো বেশি করে সালাহর ব্যাপারে একাত্মতা পোষণ করেছে। এর ফলে আরো যা ঘটেছে তা হলো, লিভারপুল ও এর আশেপাশের অঞ্চলে ঘৃণা ও ধর্মান্ধতা-কেন্দ্রিক অপরাধের পরিমাণ ১৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, এবং লিভারপুলের ভক্তদের মধ্যে মুসলিমবিরোধী টুইটের প্রবণতা কমেছে ৫৩ শতাংশ। তবে এই ‘ইফেক্ট’ যে কেবল সালাহতেই সীমাবদ্ধ নয়, তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণাটিতে। বলা হয়েছে, “ধারণা করা যায় যে দীর্ঘদিন ধরেই রোল মডেল গুণসম্পন্ন তারকারা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কাঠামো নির্মাণে ভূমিকা রেখে আসছেন।”
একাধারে সালাহ যেমন আহমেদের ভূমিকাটাকেই আরো বড় পরিসরে পালন করে চলেছেন, পাশাপাশি যে চার বছর ধরে তিনি লিভারপুলে বসবাস করছেন, এই সময়ে নাগরিক সমাজের অংশ হিসেবেও যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। ইতোমধ্যেই তিনি পরিণত হয়েছেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবকে। তিনি কাজ করছেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের সঙ্গে, এবং ভোডাফোন ফাউন্ডেশনের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করছেন ইনস্ট্যান্ট নেটওয়ার্ক স্কুলের জন্যও, যারা শরণার্থী তরুণ সমাজের জন্য ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে দেয়।
কিন্তু যেমনটি বলছিলাম, মো সালাহ ইফেক্টের বহু আগে থেকেই, আহমেদ এবং দ্য আহমেদ ইব্রাহিম ট্রুপ এই প্রভাবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে দিয়ে গেছে।
ইসমাইলের মতে, প্রিস্টন ও তার বাসিন্দাদের উপর আহমেদ কতখানি প্রভাব ফেলেছিলেন, তা হয়তো আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বলা মুশকিল। কিন্তু আজ যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসী হিসেবে যুক্তরাজ্যে বাস করছে, আহমেদের কাহিনী তাদের জন্য এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। সেই দিগন্ত থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় তারা জানতে পারে তাদের সংস্কৃতির অতীত সম্পর্কে, তাদের পূর্বসূরীদের সম্পর্কে।
প্রিস্টনের বাসিন্দা, সমাজকর্মী এবং আন্তঃবিশ্বাস সম্পর্কের সক্রিয় কর্মী মোহাম্মদ আলিও আহমেদ ও সালাহর মতো ব্যক্তিত্বদের দেখেন একটি শক্তিশালী নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি মনে করেন, যত সময় যাবে, মানুষ আরো ভালোভাবে চিনতে পারবে পরস্পরকে।
“দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত পরবর্তী প্রজন্মের অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায়ের গুরুত্ব আমরা অনুভব করতে পারছি। তবে আহমেদের মতো ব্যক্তিরাও আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যুক্তরাজ্যে আমাদের ইতিহাসের গভীরতা সম্পর্কে। শুধু বিখ্যাত মুসলিমরাই নন, এমনকী অতি সাধারণ মুসলিমরাও, যেমন আমি, আমার বাবা, আমার কন্যা, অথবা আহমেদ বিন ইব্রাহিম, সবাই মিলেই অবদান রাখছি এই দেশের বহুসংস্কৃতিবাদী ঝাণ্ডা বহনে।”
মোদ্দাকথা হলো, লিভারপুলেরও রয়েছে নিজস্ব মানব পিরামিড। আহমেদ ও সালাহরা সেই পিরামিডের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছেন বলে হয়তো তাদেরকে বেশি চোখে পড়ে, কিন্তু পিরামিডের অংশীদার প্রত্যেকেরই অবদান অনস্বীকার্য। পিরামিডের নিচের সারির মানুষরা না থাকলে যে তাদের কাঁধে চড়ে অন্যরাও আরো উপরে উঠত পারত না!
মূল লেখক : কেন চিটউড, পিএইচডি; ধর্ম, ভ্রমণ ও সংস্কৃতি বিষয়ক লেখক।
(লেখাটি The Liverpool Effect শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে AramcoWorld-এ।)