ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন কার্টুন আর সিনেমার বদৌলতে ‘মমি’ শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আসলে মমি আমাদের মাথায় এমনভাবে গেঁথে গেছে যে মিশরের নাম শুনলে আমাদের চোখে শুরুতেই এই মমি আর সেই সাথে পিরামিডের ছবি ভেসে উঠে। মমি বলতে সাধারণত আমরা বুঝি একটি মৃতদেহ যাকে এক ‘বিশেষ প্রক্রিয়ায়’ সংরক্ষণ করা হয়েছে। একটি মৃতদেহকে মমি বানানোর সেই বিশেষ প্রক্রিয়াটি নিয়ে আলোচনা করতেই আজকের এই লেখা।
মমিকরণ প্রক্রিয়ার শুরুর দিকে এর সাথে জড়িত ব্যক্তিরা মৃতদেহটিকে রজনে (গাছের আঠালো রস) সিক্ত পাটের কাপড় দিয়ে ভালোভাবে মুড়িয়ে দিতেন। এভাবে ব্যান্ডেজ করার ফলে মৃতদেহটি অনেকটা জীবিত মানুষের দেহাবয়ব পেলেও এর পচন প্রক্রিয়াকে ব্যান্ডেজ রোধ করতে পারে নি। ব্যান্ডেজের ভেতরে ঠিকই ব্যাকটেরিয়া থেকে যেত। একসময় মৃতদেহটি তাই কঙ্কালে পরিণত হয়ে যেত যা ছিলো একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে মিশরীয়রা বুঝতে পারে যে, শরীরের ভেতরে থাকা অঙ্গগুলোর পচনই তাদের হতাশার মূল কারণ। তাই তারা শরীরের ভেতরের সেই অঙ্গগুলো অপসারণ করে মৃতদেহ সংরক্ষণের চমৎকার, বুদ্ধিদীপ্ত এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। চমৎকার সেই পদ্ধতিটিই এখন ধাপে ধাপে সচিত্র বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরছি।
মৃতদেহকে মমি করার আগে শুরুতেই তাকে নিয়ে যাওয়া হতো ‘ইবু (Ibu)’ বা বিশুদ্ধিকরণ স্থানে। এখানে দেহটিকে প্রথমে সুগন্ধযুক্ত তাড়ি (তালের রস থেকে তৈরি মদ) দিয়ে ধোয়া হতো। এরপর নীল নদের পানি দিয়ে দেহটিকে ভালোভাবে পরিষ্কার করা হতো।
এখান থেকে দেহটিকে নিয়ে যাওয়া হতো ‘পার-নেফার (Per-Nefer)’ বা মমিকরণ কক্ষে। এখানেই মৃতদেহকে মমিতে পরিণত করার মূল কাজটি শুরু হতো। পার নেফারে নেবার পর দেহটিকে একটি কাঠের টেবিলের উপর রাখা হতো। এবার মৃতদেহকে পচনের হাত থেকে রক্ষার জন্য চলতো এর ভেতরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপসারণের কাজ। শুরু করা হতো মস্তিষ্ক দিয়ে। এজন্য তারা প্রথমে নাকের ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ম কোনো কিছু একেবারে মাথার খুলি পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিতো। এরপর লম্বা, লোহার তৈরি হুকের সাহায্যে তারা নাকের ভেতর দিয়েই পুরো মগজটুকু বের করে আনতো। বোঝাই যায় যে, একটি হুক দিয়ে পুরো মগজ ঠিক মতো বের করে আনা সম্ভব নয়। তাই তারা এরপর লম্বা একটি চামচের সাহায্যে মগজের অবশিষ্টাংশ বের করে আনতো। মজার ব্যাপার হলো, মিশরীয়রা কিন্তু এত কসরত করে বের করা মগজ সংরক্ষণ করতো না। তারা আসলে বুঝে উঠতে পারে নি যে, মগজ কী কাজে লাগে! তবে তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলো যে, পরকালে এ মগজ আর কোনো কাজেই আসবে না!
এবার মমিকরণ প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিরা অবসিডিয়ান (Obsidian) নামক শক্ত পাথরে তৈরি ব্লেডের সাহায্যে মৃতের দেহের বাম পাশে সামান্য একটু জায়গা কেটে ফেলতেন। সেখান দিয়ে একে একে যকৃত, ফুসফুস, পাকস্থলী এবং অন্ত্র বের করে আনতেন তারা। প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করতো হৃৎপিণ্ডই মানুষের সকল আবেগ আর অনুভূতির মূল কেন্দ্র। তাই শরীরের এ অংশটিকে তারা কিছু করতো না। পৃথক করা অংশগুলো ভালোমতো ধুয়ে, রজনের প্রলেপ দিয়ে, পাটের কাপড়ে পেঁচিয়ে এক বিশেষ ধরণের পাত্রে সংরক্ষণ করতেন তারা। মিশর বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ এ পাত্রকে ‘ক্যানোপিক জার (Canopic Jar)’ বলে থাকেন। প্রাচীন মিশরের অধিবাসীদের মতে- এ পাত্রগুলোতে সংরক্ষণ করা অঙ্গগুলো পরকালে মৃতব্যক্তির সঙ্গী হতো।
ক্যানোপিক জারের কথা যখন আসলো তাহলে এরকম কয়েকটি জারের সাথে পরিচিত হয়ে নেওয়া যাক (বাম থেকে):
(১) মানুষের মাথার মতো এ জারটির নাম ইমসেটি। এখানে যকৃত রাখা হতো।
(২) হাপি নামের বেবুনের মাথার মতো দেখতে এ জারে ফুসফুস রাখা হতো।
(৩) ডুয়ামেটেফ নামের খেঁকশেয়ালের মাথার মতো এ জারে পাকস্থলী রাখা হতো।
(৪) কেবেহ্সেনুয়েফ নামের বাজপাখির মাথা সদৃশ এ জারে অন্ত্র রাখা হতো।
এখন শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলো অপসারণের জন্য যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হলো, পরিশুদ্ধির জন্য সেই জায়গাটি আবারো তাড়ি দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হতো। এরপর মৃতদেহকে যেন জীবিতের মতোই দেখায়, যেন চামড়া শুকিয়ে গেলে পেটের দিকে তা ভেতরে ঢুকে না যায়, সেজন্য ফাঁকা জায়গাটি ধুপ এবং অন্যান্য পদার্থ দিয়ে ভরাট করে দেয়া হতো।
এবার পুরো দেহটিকে ন্যাট্রন (Natron) পাউডারে (এক ধরণের লবণ) ঢেকে দেওয়া হতো। এ ন্যাট্রন পাউডার চামড়ার রঙ খুব বেশি পরিবর্তন করা অথবা শক্ত করা ছাড়াই মৃতদেহের জলীয় পদার্থ শোষণ করে নিতো। দেহটিকে এভাবে ৩৫-৪০ দিন ন্যাট্রনের মাঝে রাখা হতো। এ সময়ের মাঝে দেহটি পুরোপুরি শুকিয়ে যেত। তবে মৃতদেহের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তো বলে নানা রকম শবভূক প্রাণির আগমনও ঘটতো। এদের হাত থেকে মৃতদেহকে বাঁচাতে পাহারাদার নিযুক্ত করা হতো।
৪০ দিন পর দেহটি নিয়ে আসা হতো ‘ওয়াবেট (Wabet)’ বা বিশুদ্ধিকরণ ঘরে। এখানে এনে এতদিন ধরে মৃতের দেহের শূণ্যস্থান পূরণ করতে থাকা সব পদার্থ বের করে ফেলা হতো। এরপর সেই জায়গাটি ন্যাট্রন, রজনে সিক্ত পাটের কাপড় এবং অন্যান্য পদার্থ দিয়ে পূর্ণ করে দেয়া হতো। এরপর কাটা স্থানগুলো সেলাই করে আর্দ্রতা শোষণের জন্য পুরো শরীরের উপর রজনের আস্তরণ দেয়া হতো। এরপর শুরু হতো ব্যান্ডেজ দিয়ে দেহটিকে মুড়িয়ে দেওয়ার কাজ।
ব্যান্ডেজ করার পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিলো বেশ জটিল এবং এজন্য প্রায় এক থেকে দু’সপ্তাহ সময় লেগে যেতো। শুরু করা হতো মাথা ও গলা দিয়ে। এরপর একে একে হাত, পা এবং পুরো শরীরটিকে ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হতো। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আলাদা আলাদা করে ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেলে পুরো শরীরটি আরেকবার ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো হতো। নতুন নতুন স্তর দেয়ার সময় সেগুলোর মাঝে রজনকে আঠা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এ ব্যান্ডেজ করার পুরো প্রক্রিয়াটির সময় মমিকরণে জড়িত লোকজন নানা মন্ত্র উচ্চারণ করতো আর মৃতের দেহে নানা মন্ত্রপূত কবচ ছড়িয়ে দিতো। হাত-পা একসাথে বেঁধে দেয়া হতো। হাতের মাঝে ‘বুক অফ ডেড’ থেকে সংগৃহীত প্যাপিরাসে লেখা মন্ত্র আটকানো থাকতো।
পুরো দেহটিকে ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো শেষ হলে শরীরের বিভিন্ন অংশে শক্ত খাঁচা আর মাথার অংশে একটি মুখোশ পড়িয়ে দেওয়া হতো। মুখোশটি দেখতে হয় মৃতের মুখের মতো অথবা কোনো মিশরীয় দেবতার মুখের মতো হতো। তাদের ভাষ্যমতে- এটি তাদের পরকালে যাত্রার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। এটি মৃতের আত্মাকে সঠিক দেহ খুঁজে বের করতে সাহায্য করতো।
মমি করা খাঁচায় আবদ্ধ দেহটিকে এবার একটি কফিনে রেখে দেয়া হতো। কফিনে মৃতব্যক্তির পরকালে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, মূল্যবান গয়না ইত্যাদি দিয়ে দেওয়া হতো।
এভাবেই শেষ হতো একটি মৃতদেহকে মমিতে পরিণত করার পুরো প্রক্রিয়াটি। এতক্ষণ ধৈর্য ধরে মমিদের সাথে সময় কাটানোর জন্য নির্বাক মমিদের পক্ষ থেকে আপনাকে একটি সবাক ধন্যবাদ।