ছোটবেলা কেটে গেছে কিন্তু টুনটুনির গল্প পড়েনি, বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া দুষ্কর। যদিও বা পাওয়া যায়, তাহলে তার শৈশবটি যে এক অমূল্য রস আস্বাদন করা থেকে বঞ্চিত ছিল, সেটা আন্দাজ করে নেয়াই যায়। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের কাছে গল্প শুনতে গেলে কখনো না কখনো টুনটুনির গল্প আমরা শুনে থাকবোই। ছোটদের কাছে জনপ্রিয় এই গল্পটির রচয়িতা হচ্ছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
তার আরও পরিচয় আছে। তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের বাবা এবং চলচ্চিত্রের দিকপাল সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ। এই দুই পরিচয় না দিলেও সবাই এক নামে উপেন্দ্রকিশোর রায়কে চিনবে। আমাদের ছোটবেলা এবং ছোটবেলার গল্পের রাজ্যে প্রবেশ শুরুই হয় তার হাত ধরে। এত বছর হয়ে গেলেও তার রচনা করা গল্পগুলোতে এতটুকু মরিচা পড়েনি।
উপেন্দ্রকিশোর রায়ের নাম শুনলেই আমাদের টুনটুনির গল্পের কথা মনে পড়ে আর মনে হয় তিনি সুকুমার রায়ের বাবা। কারণ সুকুমার রায়ের জীবনের গল্পে উপেন্দ্রকিশোর রায়ের নাম চলে আসে। কিন্তু তিনি যে একজন বিজ্ঞানীও ছিলেন এটা কয়জন জানে? তিনি যে একজন বেহালা শিল্পী ছিলেন, একজন চমৎকার চিত্রশিল্পী ছিলেন, একজন রম্যগল্প রচয়িতা ছিলেন- এসব কয়জন জানে? আজকে আমরা যে সুকুমার রায় এবং সত্যজিৎ রায়কে চিনি তাদের গড়ে তোলার মূলে যে উপেন্দ্রকিশোর রায়ের সরাসরি প্রভাব ছিল সেটা কয়জন জানি? আজকের লেখায় আমরা অন্যরকম উপেন্দ্রকিশোর রায়ের সাথে পরিচিত হবো যিনি কি না নিজের গুণে এবং জ্ঞানে নিজেই উজ্জ্বল ছিলেন।
১৮৬৩ সালে জন্ম উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর (তিনি ‘চৌধুরী’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাইতেন না। এই শব্দের ভিতরে নাকি জমিদার জমিদার ভাব লুকিয়ে আছে। তিনি নিজে ইউ. রায় হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন)। সত্যজিৎ রায় তার দাদুকে অন্য সবার থেকে আলাদা বলে অভিহিত করেছেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়ই প্রথম যিনি তার পরিবারে পড়ালেখা, গবেষণা, বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদির উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন।
তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য ছিলেন। তখনকার পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়ার সময় তিনি এই সংগঠনের সদস্য হয়েছিলেন। তার আর ভাইবোনদের মধ্যে তিনিই ছিলেন আধুনিকমনা। পড়াশোনার বাইরে ছোটবেলা থেকেই গান এবং আঁকাআঁকির প্রতি তার অন্যরকম আকর্ষণ ছিল, আঁকতেনও ভালো। ময়মনসিংহে থাকাকালীন বাংলার তৎকালীন গভর্নর একবার সেই স্কুল পরিদর্শনে আসেন। সেখানে গিয়ে একটি ছেলের দিকে তার নজর যায় যে কি না একমনে কী যেন আঁকছিল। তিনি সেই ছেলের কাছে গেলেন এবং দেখতে পেলেন তার নিজের ছবি আঁকা হয়েছে। স্কুলের অন্য সবাই ব্যাপারটিতে ভয় পেলেও গভর্নর মোটেও এতে ক্ষুব্ধ হননি, বরং তিনি সেই ছেলেটিকে বলেছিলেন সে যেন তার এই গুণকে হারিয়ে যেতে না দেয়। ছেলেটি তার কথা শুনেছে, সে সারাজীবন তার এই গুণটি ধরে রেখেছিল। সেই ছোট্ট ছেলেটি ছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়।
পরবর্তীতে কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য বৃত্তি পান তিনি। সেখানে গিয়ে বিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করেন। সেখানে তার সহপাঠী ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তার মূল ঝোঁক ছিল সাহিত্যের প্রতি। সেখানে তিনি ছবি আঁকার প্রতি, গান করার প্রতি বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন। বড় বড় ওস্তাদের সংস্পর্শে এসে তিনি গান শিখেছিলেন, বেহালা বাজানো শিখেছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে গান গাইতে হতো। তার বাড়িতে গানবাজনার সকল সরঞ্জাম ছিল। সুকুমারসহ তার অন্যান্য ভাইবোনেরা নাকি রাতে বাবার বেহালার সুর শুনে ঘুমিয়ে পড়তেন। বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন থেকেই দেখে আসছেন যে কলকাতায় রায় বাড়ির সামনে লোকজন ভিড় করতো শুধুমাত্র উপেন্দ্রকিশোর রায়ের বেহালা বাজানো শোনার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেই তার ঝোঁক বসে লেখালেখির উপর। তখন থেকেই মূলত ছোটদের জন্য তিনি লেখা শুরু করেন। তবে তখন প্রিন্টিং এর অবস্থা কলকাতায় তেমন ভালো ছিল না। তাই তখন তার নজর পরে প্রিন্টিং এর উপর। পরে গিয়ে প্রিন্টিং প্রযুক্তির উপর নেশা চলে আসে তার। সেজন্যই সুকুমার রায়কেও ইংল্যান্ডে প্রিন্টিং প্রযুক্তির উপর পড়াশোনা করতে পাঠান তিনি। উপেন্দ্রকিশোর রায় প্রথমে বইপত্র পড়ে বিদেশ থেকে প্রিন্টিং এর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে আনার ব্যবস্থা করলেন। নিয়ে আসার পর সেগুলো আরও বেশি উন্নত কীভাবে করা যায় সেটার কাজে লেগে গেলেন।
হাফটন বলে একটি প্রযুক্তি প্রিন্টিংয়ে ব্যবহার করা হতো যেটা যেকোনো ছবিকে ছোট ছোট ফোঁটায় বিভক্ত করে ফেলে এবং বিভিন্ন উপায়ে সেগুলোকে ফুলটোন ছবিতে পরিণত করে। পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে যেকোনো কিছু প্রিন্টিং করতে এই প্রযুক্তির দরকার পড়ে। তিনি নিজের বৈজ্ঞানিক পড়াশোনা কাজে লাগিয়ে এই প্রযুক্তিগুলোকে আরও উন্নত করেন এবং বিংশ শতক শুরুর প্রায় সাথে সাথেই U. Ray and Sons নামের ছাপাখানা এবং ব্লক তৈরি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। পুরো ভারতবর্ষে এরকম আধুনিক ছাপাখানা আর একটিও ছিল না। তখন ব্রিটিশ রাজত্ব চলছিল। তাদের কাছ থেকে কোনোপ্রকার সাহায্য না নিয়ে একলা হাতে তিনি এই কাজ করতে পেরেছিলেন, যেটা অবশ্যই সাহসিকতার পরিচয়।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর প্রিন্টিং এর প্রতি যখন নেশা শুরু হল তখন তিনি এ নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা করেছিলেন। তখনকার বিখ্যাত প্রিন্টিং জার্নাল Penrose Annual এ তার প্রবন্ধ প্রকাশ পায়। তার প্রবন্ধগুলোর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে Focusing the Screen (1897), The Theory of Half-tone Dot (1899), Automatic Adjustment of the Half-tone Screen (1901), Diffraction of Half-tone (1903), The 60 degree cross-line screen (1905) ইত্যাদি।
প্রত্যেকটি প্রবন্ধ প্রিন্টিং নিয়ে এবং তার নিজের গবেষণা থেকে লেখা। ব্যবহারিক পর্যায়ে প্রত্যেকটি প্রবন্ধের আলাদা আলাদা প্রভাব আছে। আলো নিয়ে খেলতে ভালবাসতেন, তাই তো হাফটোন প্রযুক্তির শুরুর দিকে তিনি ভারত থেকে প্রায় একলা হাতেই এই প্রযুক্তির উন্নতিতে কাজ করে গেছেন এবং সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগও করেছেন। এই ছাপাখানা থেকেই প্রথম প্রকাশ পায় ছোটদের “সন্দেশ” পত্রিকা। এই পত্রিকাতে তিনি এবং সুকুমার রায় বিভিন্ন রম্য লেখা দিতেন, ইলাস্ট্রেশন তৈরি করতেন, গল্প থেকে ছবি তৈরি করে প্রকাশ করতেন- অর্থাৎ ছোটদের জন্য আদর্শ পত্রিকা যাকে বলে সেরকম একটি কাজ ছিল এই সন্দেশ।
১৯১৫ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি এই পত্রিকাতে কাজ করে গেছেন। নানারকম রম্য গল্প তো বটেই, এর সাথে কিশোরদের জন্য রম্যচিত্র আঁকা, তাদের জন্য পল্লী সমাজের চিত্রায়ন এবং লোকগীতি রচনা, পুরাণ এবং রামায়ণকে যুগোপযোগী করে পুনরায় তৈরি করা ইত্যাদি কাজ করেছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়।
একজন বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন তিনি। একদিক দিয়ে সাহিত্যচর্চা করেছেন, অন্যদিকে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন। একদিকে তিনি সংগীত, অংকন ইত্যাদি চর্চা করেছেন এবং পরিবারের সবাইকে সাহিত্য চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন, অন্যদিকে প্রিন্টিং ব্যবসার কাজেও তাদেরকে কাজে লাগিয়েছেন এবং নিজেও কাজ করেছেন। তিনি একাই শিক্ষিত এবং বড় হননি, বরং তার ছেলেমেয়েদের মধ্যেও সেই শিক্ষা সঞ্চার করেছেন। তাই তো তার তৈরি করা শিক্ষার পরিবেশ থেকে উঠে এসেছেন সুকুমার রায় এবং সত্যজিৎ রায়ের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা।
ফিচার ইমেজ সোর্স: techtunes.com.bd