খালিস্তান আন্দোলন: শিখরা কেন আলাদা রাষ্ট্র চায়?

সম্প্রতি ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে শিখদের সংঘাত শুরু হয়েছে। সেই সাথে আবারও একটি পুরনো বিষয় সামনে এসেছে, যে বিষয়ের সাথে জড়িয়ে আছে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের এক বড় অংশ। পাঞ্জাব প্রদেশের শিখদের ‘খালিস্তান আন্দোলন’ একসময় কেন্দ্রীয় সরকার ও পাঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মাঝে চরম সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি বদলাতে পাঞ্জাবের শিখদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী সেসময় দুটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল, যেগুলোর দগদগে ক্ষত এখনও পাঞ্জাবি শিখদের বুকে প্রোথিত আছে। বিভিন্ন সময়ে এই আন্দোলনকে নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে চলতে থাকা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মধ্যে খালিস্তান আন্দোলন একটি আগ্রহোদ্দীপক ‘কেস স্টাডি’।

খালিস্তান আন্দোলনকে সহজ ভাষার বোঝার চেষ্টা করা যাক। শিখরা তাদের ধর্মের উপর ভিত্তি করে ভারত রাষ্ট্র থেকে বের হয়ে গিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র চায়, যে রাষ্ট্রের নাম তারা ঠিক করেছে ‘খালিস্তান’। এই নতুন প্রদেশের সীমারেখা নিয়ে তাদের মাঝে মতবিভেদ রয়েছে। একদল মনে করে তারা পাঞ্জাবের ভারতীয় অংশ নিয়েই খালিস্তান প্রতিষ্ঠা করবে। আরেক দল মনে করে ভারত ভাগ হওয়ার পূর্বে যে বৃহৎ পাঞ্জাব প্রদেশ রয়েছে, সেই প্রদেশ ঘিরেই প্রতিষ্ঠা করা হবে খালিস্তান। দ্বিতীয় দলের মত অনুযায়ী, তাদের খালিস্তান গড়ার জন্য পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ ও ভারতের হিমাচল, চন্ডীগড় এবং হরিয়ানাকেও প্রস্তাবিত খালিস্তানের সীমানাভুক্ত করা হবে। সেই সাথে বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরকে বানানো হবে খালিস্তানের রাজধানী। বলে রাখা ভালো, ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার আগে পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী ছিল লাহোর। প্রস্তাবিত এই স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র হবে সার্বভৌম।

Image source: Adda247

ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশরা এমনভাবে সেনাবাহিনীর নিয়োগের নিয়ম ঠিক করেছিল যে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় অংশের বেশিরভাগ সামরিক কর্মকর্তা ও সেনা ছিল পাঞ্জাবি শিখ। এটি ছিল উপমহাদেশে ব্রিটিশদের বহুল চর্চিত ‘ভাগ কর, শাসন কর’ (Divide and Rule) নীতির বহিঃপ্রকাশ। ব্রিটিশ শাসনামলে পাঞ্জাবে দুটো আন্দোলন গড়ে উঠিছিল। একটি হচ্ছে  সিং সভা আন্দোলন, যার লক্ষ্য ছিল শিখদের মাঝে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো। এর পাশাপাশি এই আন্দোলনের আরেকটি বড় লক্ষ্য ছিল শিখদেরকে ধর্মান্তরিত হওয়া থেকে ফিরিয়ে আনা। এরপর ‘আকালি আন্দোলন’ বা ‘গুরুদুয়ারা সংস্কার আন্দোলন’ নামে আরেকটি আন্দোলন শুরু হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল শিখদের উপাসনালয় গুরুদুয়ারাগুলোকে দুর্নীতিবাজ অসৎ উদাসি মোহন্তদের হাত থেকে রক্ষা করা। এই দুই আন্দোলনের ফলে শিখদের মাঝে জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটে, তারা পুরো ভারত থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র ভাবতে শুরু করে। 

ভারতবর্ষ ভাগের পর শিখদের স্মৃতিবিজড়িত পাঞ্জাব প্রদেশ দুই ভাগ হয়ে যায়। এক অংশ ছিল ভারতে, আরেক অংশ পাকিস্তানে। পাকিস্তানে যে অংশটি ছিল, সেখান থেকে অসংখ্য শিখ ভারতের পাঞ্জাব অংশে চলে আসে, অপরদিকে পাকিস্তানে অবস্থানরত শিখরা সেদেশের পাঞ্জাব প্রদেশে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। এছাড়াও ঐতিহাসিক পাঞ্জাব রাজ্যের লাহোর ও শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের জন্মস্থানও পাকিস্তানের সীমারেখায় রেখে দেয়া হয়।

এই ভাগকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। শিখরা এই ভাগের ফলে নিজেদের প্রতারিত ভাবতে শুরু করে। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই শুরু হয় ‘পাঞ্জাবি সুবাহ্ আন্দোলন’। এই আন্দোলনের দাবি ছিল পাঞ্জাবি ভাষার উপর ভিত্তি করে একটি আলাদা প্রদেশ তৈরি করতে হবে। প্রথমদিকে এই দাবিকে গুরুত্ব দেয়া হলেও অব্যাহত প্রতিবাদের পর ১৯৬৬ সালে ভারতের ‘স্টেটস রিকগনাইজেশন কমিশন’ এই দাবি গ্রহণ করে। তবে এই দাবি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমাচল ও হরিয়ানা নামে দুটো হিন্দিভাষী প্রদেশ তৈরি করা হয়েছিল।

Photographer: Noah Berger/AFP/Getty Images

‘পাঞ্জাবি সুবাহ্ আন্দোলন’ সফল হওয়ার পর প্রদেশটির রাজনৈতিক আকালি দলের জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়তে থাকে। এরপর তারা আরও বেশি জনসমর্থন গড়ে তোলার করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়। ১৯৭৩ সালে খালসা মতাদর্শের জন্মস্থান আনন্দপুর সাহিবে দলের নেতারা একত্রিত হন এবং ‘আনন্দপুর সাহিব প্রস্তাবনা’র ঘোষণা দেন। এই প্রস্তাবে কিছু দিক ছিল খালিস্তান প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ। যেমন- অন্যান্য প্রদেশের বেশ কিছু অংশ নিয়ে গঠিত একটি প্রদেশ গঠন এবং সেই প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে তারা। এছাড়া তারা নতুন প্রদেশের স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থার জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানায় সেই প্রস্তাবে।

এরপরই প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব ঘটে জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে নামের এক ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের। তিনি আকালি দলের স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন শিখদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে । অল্প সময়ের মধ্যেই তার বিশাল সমর্থন গড়ে ওঠে। পাঞ্জাবের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মাঝে তার বিপুল জনপ্রিয়তা তৈরি হয়।

১৯৮২ সালের গ্রীষ্মে আকালি দলের নেতৃত্বের সমর্থনে জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে একটি আইন অমান্য আন্দোলন গড়ে তোলেন পাঞ্জাবে। তিনি নিজে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকেই পুলিশের সাথে তার অনুসারীদের সংঘাত ও দাবি আদায়ের মিছিলের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। আনন্দপুর সাহিব প্রস্তাবনায় যেসব প্রস্তাবের উল্লেখ করা হয়েছিল, সেগুলো মেনে নেয়ার দাবি জানানো হয় তার পক্ষ থেকে। সেই সাথে পাঞ্জাবের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। তার অনুসারীরা অন্যান্য ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। জারনেইল শিং ভিন্দ্রানওয়ালে হিন্দু ধর্মের বিপক্ষে অনেক স্পর্শকাতর মন্তব্য প্রচার করেন। ভারতের তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী সরকার এই আন্দোলনকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে ঘোষণা দেয়।

১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি আরও বাজে দিকে মোড় নেয়। জারনেইল সিং আন্দোলনরত শিখদের অস্ত্র হাতে নেয়ার আহ্বান জানান। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্র রূপ ধারণ করে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবার আর কোনো উপায় না পেয়ে সেনাবাহিনীকে শিখ উগ্রপন্থীদের হাত থেকে স্বর্ণমন্দির মুক্ত করা এবং জারনেইল সিংকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন।

Image Source: The India Today Group/Getty Images

সেনাবাহিনী ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ হাত নেয়। শিখদের প্রতিরোধ এত বেশি ছিল যে, একপর্যায়ে সেনাবাহিনী ট্যাংক ও বিমান থেকে গোলাবর্ষণের সহায়তা নেয়। এই সামরিক অভিযানে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। সরকারি হিসেবে বলা হয়েছিল, ৮৩ জন সেনাসদস্য নিহত এবং ২৪৯ জন সেনাসদস্য আহত হয় এই অভিযানে। শিখ উগ্রপন্থী এবং বেসামরিক মানুষের সংখ্যা দেখানো হয় ৪৯৩। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসেবে দু’পক্ষ মিলিয়ে হতাহতের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।

সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে শিখদের নেতা জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে নিহত হন। সে বছরেরই ৩১ অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দুজন শিখ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হলে শিখদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয়, যাতে প্রায় আট হাজার শিখ নিহত হন। এর পরের বছর কানাডাপ্রবাসী শিখরা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বোমা বিস্ফোরণে বিমানে অবস্থানরত ৩২৯ জনের সবাই মৃত্যুবরণ করে। এই বিস্ফোরণের পেছনে যারা দায়ী ছিল, তারা তাদের নেতা জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে এই বিমান হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাবে খালিস্তান আন্দোলনকেন্দ্রিক সহিংসতা চলমান ছিল।

খালিস্তান আন্দোলন শিখদের আলাদা রাষ্ট্রের দাবি হলেও ক্রমাগত সহিংসতা ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি তাদের ঘৃণাসুলভ মনোভাব এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিশাল জনমত গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। খোদ পাঞ্জাবেই এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে আলোচনা শুরু হয়েছিল।

Language: Bangla
Topic: Khalistan movement
References:
1. Land of the Pure: The Khalistan Movement in India - HAF
2. How India’s Hunt for a Separatist Preacher Cut Off the Internet for 27 Million People - Bloomberg
3. Khalistan Movement: An Exploration of Its Origins - Adda247
Feature Image: Stringer/Reuters

Related Articles

Exit mobile version