১৯৯২ সালের বার্সেলোনা অলিম্পিক। অলিম্পিক শুরু হতে বাকি রয়েছে আর মাত্র দেড়মাস। অলিম্পিয়ান পুরনো স্টেডিয়াম থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে ঐতিহ্যময় মশালযাত্রা। দেড়মাসের মধ্যে এই মশাল পৌঁছে যাবে এথেন্স হয়ে বার্সেলোনা। এথেন্স থেকে বার্সেলোনা যাওয়ার পথে হাতবদল হলো অলিম্পিক মশাল, আবার শুরু হলো যাত্রা।
কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে এক বিস্ময়কর ঘটনা। চুরি হয়ে গিয়েছে অলিম্পিক মশাল। স্টেডিয়াম থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে, রাস্তাতেই উধাও হয়ে গেল সেই মশাল। কে চুরি করলো? আজো তার কোনো হদিশ দিতে পারেনি গ্রিক পুলিশ।
অভিনেত্রী মারিয়া পামবৌকির হাত থেকে তরুণ হ্যামার থ্রোয়ার সাওয়াস সার্দদ সোগলেভিতর স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শকের সামনে তুলে নেন মশালটি এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি তা পরের জনকে তুলে দিয়েছেন বলে জানান। কিন্তু সাওয়াসের পরেই সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির হাত থেকে কিছুক্ষণ পরে ওই মশাল নেন বছর চল্লিশের এক অ্যাথলেট। মশালটি নিয়েই ভিড়ের মধ্যে উধাও হয়ে যান তিনি। সাথে সাথে মশালটিও।
সেবারের মতো দ্বিতীয় মশাল দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হয় অলিম্পিক সংস্থাকে, আর ব্যর্থ হতে হয় গ্রিক পুলিশবাহিনীকে। কেউ কল্পনাও করতে পারেনি চুরি যেতে পারে এই অলিম্পিক মশাল।
পৃথিবী জুড়ে এরকম কত চুরির ঘটনাই না ঘটছে। ব্যাঙ্ক ডাকাতি, ট্রেন ডাকাতি কিংবা গৃহস্থের ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে চুরির কথা তো প্রায়সময় শোনা যায়। রত্ন চুরি, দুষ্প্রাপ্য মূর্তি চুরি এবং আরো নানা ধরনের চুরির খবরও সংবাদপত্রে বেরোয়। কিন্তু এমন সব চুরির কথা আজ জানাবো, যা নিয়ে একসময় সারা পৃথিবীতে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। আর এসব ঘটনাও যেন এখন ইতিহাস।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাংক ডাকাতি
২৪ মার্চ, ১৯৭২ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত ইউনাইটেড ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাংকে ঘটে এক বিস্ময়কর ব্যাংক ডাকাতি। ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে চুরি করা হয় প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার (বর্তমান সময়ে তার মূল্য প্রায় ১৭২.৪ মিলিয়ন ডলার)। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, এই ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল এমিলো ডিনসিলো নামের এক তুখোড় ব্যক্তি। এই এমিলো ডিনসিলোর অধীনে কাজ করতো একটি দল।
যেই গ্রুপে ছিলো এমিলোর ভাই জেমস ডেনসিলো, দুই ভাইপো হ্যারি এবং রোনাল্ড বারবার, বোনের স্বামী চার্লস মুলিগ্যান এবং তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু ফিল ক্রিস্টোফার ও চার্লস ব্রোকেল। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন একেক বিষয়ে অভিজ্ঞ। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ছিলেন জেমস। বিভিন্ন বিস্ফোরণ সম্পর্কিত বিষয়ে তার দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। কী ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করে ভল্ট ভাঙা হবে, তার পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন জেমস। মুলিগ্যান ছিলেন একজন বিশ্বস্ত ড্রাইভার। ফিল ক্রিস্টোফার ও চার্লস ব্রোকেল ছিলেন অ্যালার্ম বিশেষজ্ঞ। ব্যাংকের কোথায় অ্যালার্ম রয়েছে, তার অনুসন্ধান করা এবং সেই অ্যালার্ম নিষ্ক্রিয় করার জন্য পুরোপুরি নির্ভর করতে হতো এই দুই অ্যালার্ম বিশেষজ্ঞের ওপর। আর সম্পূর্ণ চুরির মাস্টার প্ল্যান করতেন এমিলো। আর তার পরিকল্পনা তৈরিতে সহায়তা করতো তার দুই ভাইপো।
ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যাংক ডাকাতির কয়েক মাস আগেই ওহিও শহরেও পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে একই ধরনের ডাকাতি করতে সফল হয় এমিলো ও তার টিম। তাই এই বড় রকমের ডাকাতির পর তারা সকলেই ছিল বেশ নির্ভার। কিন্তু এই ব্যাংক ডাকাতির পর পুলিশ মরিয়া হয়ে ওঠে অপরাধীদের ধরার জন্য। অনুসন্ধান করতে গিয়ে পুলিশের কাছে তথ্য আসে যে, ওহিওতে ঘটে যাওয়া ডাকাতির সাথে ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যাংক ডাকাতির সংযোগ রয়েছে। দুটো ডাকাতিই একইভাবে সংঘটিত হওয়ায় পুলিশ নিশ্চিত হয় যে এই দুই অপরাধের সাথে একটি সংঘবদ্ধ দলযুক্ত।
পুলিশ ওহাইয়ো ও ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন পরিবহণ রেকর্ড পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখে যে একটি দল তাদের নিজেদের নাম ব্যবহার করে বিমানে করে ওহিয়ো থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় পৌঁছায়। ক্যালিফোর্নিয়া শহরে তারা একটি ঘর ভাড়া নেয়, যেটিকে তারা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আসে। পুলিশ পরবর্তীতে সেই ঘর অনুসন্ধান করে রহস্য সমাধানের তেমন কোনো তথ্যই খুঁজে পায়নি।
তবে গোয়েন্দা পুলিশের দল নাছোড়বান্দা। তারা আবার বাসাটিতে যায় এবং তন্ন তন্ন করে প্রত্যেকটি ঘরের আনাচে-কানাচে অনুসন্ধান করতে থাকে। গোয়েন্দা দল খুঁজতে খুঁজতে চলে এলো রান্নাঘরে। কোনো সূত্র খুঁজে দলটির প্রায় হতোদ্যম দশা।
কিছুক্ষণ রান্নাঘরে ইতস্ততভাবে খুঁজতে খুজতে তাদের চোখে পড়ে ফেলে দেয়া পরিত্যক্ত কয়েকটি থালাবাটি। আর এতেই কেল্লা ফতে! এখান থেকেই খুঁজে পাওয়া গেলো অপরাধীদের আঙুলের ছাপ। আর সে সূত্র ধরেই পুলিশ সকল অপরাধীদের হদিস পায়। ধরা পড়ে একে একে সব অপরাধী। ডাকাতি হওয়া অধিকাংশ টাকাই উদ্ধার করা হয়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত সকল অপরাধীদের জেল জরিমানা হয়। পরবর্তীতে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এমিলো ডিনসিলোে একটি বই লেখেন, যার নাম ছিল ‘ইনসাইড দ্য ভল্ট উইথ দ্য হেল্প অফ হিজ ডটার’।
অস্কার মনোনীত ছবির রিল চুরি
অস্কারের জন্য মনোনীত শ্রেষ্ঠ যুগোস্লাভ ছবি ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার ১৯৪৯’-এর দুটো রিল চুরি হয়েছিল নিউইয়র্কে। সময়টা ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাস। রিল দুটি চুরি যায় নিউইয়র্ক সিটির এক হোটেলের সামনে পার্ক করে রাখা একটি গাড়ি থেকে। সাথে সাথে খবর দেয়া হলো পুলিশকে।
পুলিশ শহর থেকে বেরোবার সব পথ বন্ধ করে দিল। ম্যানহাটান ও ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে চিরুনি তল্লাশি শুরু হল। শেষপর্যন্ত দুই পুলিশ অফিসার চুরি যাওয়া রিল দুটো খুঁজে পান সেই হোটেল থেকে দুটো ব্লক দূরে ফুটপাতের ওপর। চোরদের হদিস অবশ্য পাওয়া গেলো না।
এদিকে ওই দুই পুলিশ অফিসারকে যুগোস্লাভিয়ার পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হলো। তাদের যুগোস্লাভিয়ায় ডেকে পাঠানো হল ম্যাসিডোনিয়ার লেক ওরিড পর্যটন কেন্দ্রে সাতদিনের ছুটি কাটানোর জন্য। যুগোস্লাভ চলচ্চিত্র দপ্তর তো খুব খুশি। হারানো রিল ফেরত পাওয়া গেছে বলে নয়, ছবিটার দারুণ একটা ‘পাবলিসিটি’ হলো বলে।
বেলজিয়ামের এন্টওয়ার্প ডায়মন্ড সেন্টার থেকে ডায়মন্ড চুরি
২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, বেলজিয়ামের এন্টওয়ার্প শহরে অবস্থিত এন্টওয়ারপ ডায়মন্ড সেন্টারের ভল্ট থেকে খোয়া যায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের সামগ্রী। সেন্টারের ১২৩টি ডিপোজিটের ভল্ট ভেঙে এই পরিমাণ সামগ্রী চুরি করা হয় বলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়। লিওনার্দো নোবার্টটোলো নামের এক ব্যক্তি এই চুরির সাথে জড়িত বলে নানা তথ্য-প্রমাণে উঠে আসে। তিনি পাঁচজনের একটি গ্রুপ নিয়ে এই ধরনের চুরি সংঘটিত করতেন বলে পুলিশ পরবর্তীতে জানতে পারে। ৩০ বছর ধরে এই ধরনের চুরির সাথে তার জড়িত থাকার প্রমাণ উঠে আসে। কিন্তু এন্টওয়ার্প ডায়মন্ড সেন্টারের এত সুরক্ষিত স্থান থেকে কীভাবে এতগুলো ভল্ট ভাঙা হলো আর এতো বিপুল পরিমাণ অর্থের সামগ্রী চুরি গেলো, তা নিয়ে পুলিশের ধন্দ আজো কাটেনি।
তবে পুলিশের গোয়েন্দাদের তরফ থেকে যে তথ্যটি উঠে আসে, সেখানে দেখা যায়, চুরির দু বছর আগে সেই সেন্টারে উপর তলায় লিওনার্দো নিজেকে একজন ইতালীয় ব্যবসায়ী হিসেবে একটা অফিস স্পেস ভাড়া নেন। ফলে ঐ অফিসে ২৪ ঘণ্টা যাতায়াতের জন্য সেন্টার থেকে একটি পরিচয় পত্র সংগ্রহ করেন এবং সেন্টারে একটি সিকিউরিটি ডিপোজিট বক্স ভাড়া নেন। অনুমান করা হয়, ২০০৩ সালের ১৫ বা ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তার গ্রুপের সদস্যদের নিয়ে সুরক্ষিত ডিপোজিট বক্স ভেঙে বিভিন্ন কাস্টমারদের মূল্যবান ডায়মন্ড, সোনা এবং জুয়েলারি আত্মসাৎ করেন।
পরে পুলিশ তদন্তে এসে ডিপোজিট বক্সের আশেপাশে অপরাধীদের ফেলে দেয়া স্যান্ডুইচের টুকরোর সন্ধান পায়। স্যান্ডুইচের সাথে লেগে থাকা লালায় লিওনার্দোর ডিএনএ-র অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই সূত্র ধরেই পুলিশ লিওনার্দোকে খুঁজে পায়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হন লিওনার্দো ও তার দল। বিচারে লিওনার্দোর ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু সেই চুরি হওয়া সামগ্রীর সন্ধান পুলিশ এখনো পায়নি।
ফিচার ইমেজ- collider.com