ক্লাসরুমের শেষ বেঞ্চে বসে নোট তুলতে গিয়ে বোর্ডের লেখাগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। অক্ষরগুলো যেন ডুবন্ত জাহাজের মতোই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু পাশের মানুষগুলো তখনো ঠিকঠাক নোট তুলে যাচ্ছে। হটাৎই যেন মনে হলো চোখ ঠিকঠাক কাজ করছে না। সমস্যা ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে। আবার অন্যদিকে ঘটছে আরেক রকম ঘটনা। একই ক্লাসে কেউ দূরের বোর্ডের লেখা ঠিকঠাক দেখতে পেলেও নিজের খাতাটা দেখতে পাচ্ছে না।
চোখের এই ত্রুটি সমাধানে আজকের দিনে চোখের সামনে চশমাই যেন অবিকল্প। কত মানুষের ত্রাতা যে হয়েছে এই চশমা তা গুনে শেষ করা যাবে না। তবে দীর্ঘদিন ধরে এই চশমা ছিল শুধুই অভিজাত শ্রেণীর ব্যবহারের জন্য। সাধারণের কাছে পৌঁছাতে অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে হয়েছে একে।
শত শত বছর আগে রোমান সম্রাটরা দূর থেকে গ্ল্যাডিয়েটরদের আকর্ষণীয় লড়াই দেখার জন্য চশমাসদৃশ বস্তু ব্যবহার করতেন। রোমান সম্রাট নিরোর আমলে ফ্রেমে আবদ্ধ কাচের লেন্সের চশমা না থাকলেও, দূরের জিনিস দেখার অভিনব ব্যবস্থা ছিল। সম্রাট নিরো তার সাথে বহন করতেন সুন্দর করে পালিশ করা এমেরাল্ডের টুকরো। তার ভেতর দিয়ে তাকালে অনায়াসে দূরের জিনিস দেখা যেত।
এই ব্যাপারটি অবশ্য নিরো নিজেই আবিষ্কার করেছিলেন এমনটা বলা যাবে না। নিরোর উপদেষ্টা এবং বিখ্যাত দার্শনিক সেনেকা নিরোকে গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই দেখার সময় রোদ থেকে চোখ বাঁচাতে এবং দূরের জিনিস দেখতে মসৃণ এমেরাল্ডের টুকরো ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়, সরু ছিদ্রের মধ্য দিয়ে তাকালে দূরের বস্তু একটু ভালোভাবে দেখা যায়, এমন তথ্যের ভিত্তিতে প্রাচীনকালে মেরুবাসী ইনুইট বা এস্কিমোরা হাতির দাঁতে ছিদ্র করে সেটিকে চশমা হিসেবে ব্যবহার করতো। এতে দূরের জিনিস ভালো করে দেখার পাশাপাশি চোখও থাকতো রোদ থেকে সুরক্ষিত।
চোখের সমস্যা দূরীকরণের জন্য চশমার সত্যিকার ব্যবহার প্রথম শুরু হয়েছিল ইতালিতে। ১২৬৮ থেকে ১৩০০ সালের দিকে ইতালিতে আতশকাঁচ নির্মাতাদের মধ্যে কেউ একজন দুটি আতশকাঁচের মধ্যে কব্জা লাগিয়ে নাকের উপর ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেন। ফলে চোখে পরবার উপযোগী চশমা তৈরি হয়ে যায়। এই কাজটি কে করেছিলেন সে ব্যপারে ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত নন। তবে জিওর্দানো দা পিসা নামক এক ব্যক্তি এ ধরনের চশমাকে জনপ্রিয় করেন বলে জানা যায়।
প্রাচীন চিত্রকলার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেও চশমার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। ১৪০০ সালের দিকে অঙ্কিত কিছু চিত্রকর্ম পাওয়া গেছে যেখানে যাজকেরা চোখে চশমাসদৃশ বস্তু পরেই বই পড়ছেন এবং লিখছেন। তাই ১৪০০ সালের দিকেই ইউরোপের ধর্মযাজকদের মধ্যে চশমার প্রচলন হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা।
ষষ্ঠদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হ্রস্বদৃষ্টির প্রতিকার হিসেবে অবতল লেন্সের ব্যবহার শুরু হয়। মূলত পোপ দশম লিওর চোখের সমস্যা দূরীকরণে প্রথমে এ ধরনের অবতল লেন্সের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে তার বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়। তবে এ ধরনের চশমা তৈরি করা হতো অল্প সময় ব্যবহার করার জন্য। সবসময় চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখার চশমা তখনো তৈরি হয়নি।
স্প্যানিশ লেন্স প্রস্তুতকারকদের একটি দল ব্যবহার উপযোগী চশমা তৈরির লক্ষ্যে লেন্সে ছিদ্র করে তাতে ফিতা লাগায়। এই ফিতার মাধ্যমে চশমাটিকে কানের সাথে আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এ ধরনের চশমার ব্যবহার ইতালিয়ান আর স্প্যানিশ মিশনারিদের হাত ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। মিশনারিদের মাধ্যমে চীনেও এই চশমা পৌঁছে যায়। তবে চীনের মানুষ চশমাকে কানের সাথে আটকে রাখার বদলে চশমার ফিতার প্রান্তে ছোট ওজন ঝুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।
ব্রিটিশ চক্ষুবিদ এডওয়ার্ড স্কারলেট ১৭৩০ সালে চশমার ডিজাইনে কিছু পরিবর্তন আনেন। ফ্রেমের মধ্যে লেন্সকে আবদ্ধ করে কানের উপর স্থির রাখার জন্য চশমার ফ্রেমের শেষাংশ বাঁকা করে দেওয়ার ডিজাইন তারই করা। তবে তখনো সেই চশমার ডিজাইনে বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছিল। যেমন, বর্তমান সময়ের চশমার মতো কব্জা না থাকায় এই চশমা ভাঁজ করে রাখা যেত না। দীর্ঘদিন পরে এই সমস্যা সমাধানের জন্য চশমার ফ্রেমে কব্জা যুক্ত হয়। ফলে ব্যবহার না করা অবস্থায় চশমা ভাজ করে ব্যাগে কিংবা পকেটে গুঁজে রাখার সুবিধাটি চালু হয়।
১৭৮০ সালের দিকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিজের প্রেসবায়োপিয়া (Presbyopia) সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তৈরি করেন বিশেষ ধরনের চশমা। বাইফোকাল চশমা নামে পরিচিত এই চশমার উপরের অংশ ব্যবহৃত হয় দূরের জিনিস দেখার জন্য আর নীচের অংশ ব্যবহৃত হয় কাছের জিনিস কিংবা ছোট আকারের লেখা পড়ার জন্য। এই চশমা উদ্ভাবনের অনুভূতি নিয়ে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ১৭৮৪ সালে তার বন্ধু জর্জ হোয়াটলিকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন,
“দ্বি-দর্শন চশমা উদ্ভাবন করতে পেরে আমি খুবই উচ্ছসিত। এর মাধ্যমে দূরের বস্তু যেমন দেখা যায় তেমনই কাছের বস্তুও স্পষ্টতরভাবে দেখা যায়। এর মাধ্যমে আমার চোখ এতই কার্যকরী হয়েছে যে এরকম কার্যকরী আগে কখনোই ছিল না।”
চশমার বিবর্তনের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল বিষমদৃষ্টি (Astigmatism)-এর প্রতিকার আবিষ্কার। বিশ্বজুড়েই বিষমদৃষ্টিজনিত সমস্যা বেশ প্রকট। ১৮২৫ সালে ইংরেজ জ্যোর্তিবিদ জর্জ এইরি তৈরি করেন সিলিন্ডারাকৃতির অবতল লেন্স। এর ফলে বিষমদৃষ্টি সমস্যার সমাধান হয়।
১৮৮০ থেকে ১৯০০ সালের দিকে Pince-nez নামে নাকের উপর ঝুলে থাকা এক বিশেষ ধরনের চশমা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের এ চশমা বিশেষ পছন্দ ছিল। রুজভেল্ট থেকে শুরু করে হলিউডের অভিনেতা অভিনেত্রীদের অনেকেরই নাকে ঝুলে থাকা এই চশমা বেশ ভাল লাগতো।
১৮৭৩ সালে জন ওয়েসলি যখন সেলুলয়েডের পেটেন্ট করাচ্ছিলেন তখন হয়তো তিনি জানতেনও না এই সেলুলয়েড চশমা শিল্পে কী ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। কয়েক বছরের মধ্যেই সেলুলয়েডের তৈরি ফ্রেমে আঁটা চশমা বাজারে আসতে থাকে। সেলুলয়েডকে নানা অদ্ভুত আকার আকৃতি দেওয়া যায় বলে চশমার ফ্রেমেও বাড়তে থাকে বৈচিত্র্য। ১৯৩০ সালের দিকে আমেরিকায় সেলুলয়েডে নির্মিত সানগ্লাস জনপ্রিয় হতে থাকে। হলিউডের তারকা থেকে শুরু করে সাধারণ তরুণ ও মধ্যবয়স্কদের মধ্যে সানগ্লাস ব্যবহারের প্রবণতা বাড়তে থেকে ত্রিশের দশক থেকেই। সানগ্লাস যেন আসলেই চোখকে রোদ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে সেজন্য এতেও যুক্ত হয় বেশ কিছু ফিল্টার। এই ফিল্টার সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মিকে আটকে রেখে চোখকে সুরক্ষা দান করে।
চশমার ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করলে একটি কথা অবধারিতভাবেই সামনে চলে আসে যে, দীর্ঘ সময় ধরে চশমা ছিল শুধুই অভিজাতদের বস্তু। সাধারণ মানুষ চোখের সমস্যা সংশোধনের জন্য চশমা পরবে ব্যাপারটি অনেকটাই অবাস্তব শোনাতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চোখের সমস্যার সমাধান হিসেবে চশমার ব্যাপক প্রচলন শুরু হতে থাকে। তবে তখনো প্লাস্টিক সুলভ হয়নি বলে চশমা উৎপাদনে খরচের পরিমাণ একটু বেশিই হতো।
গত শতাব্দীর চল্লিশ আর পঞ্চাশের দশকেও ফ্রেমে আঁটা চশমা ছিল সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ষাটের দশকে প্ল্যাস্টিকের সহজলভ্যতার কারণে কাঁচামালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। পাশাপাশি চশমার চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে চশমা তৈরির কারখানাগুলোতে দ্রুত আধুনিকায়ন হতে থাকে। ২০১৬ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে চশমাশিল্পের পঁচানব্বই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার তৈরি হয়েছে। চশমাশিল্পকে বাণিজ্যিকীকরণের দিক থেকে অন্য কোনো দেশের চেয়ে ইতালি এগিয়ে আছে অনেকগুণ। ইতালির চশমা শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত ভেনেটো অঞ্চল এখনো ৭০০ বছরের ইতিহাস নিয়ে টিকে আছে পৃথিবীর বুকে।
মানুষের চোখের ত্রুটি সংশোধনে বর্তমানে চশমার অনেক কার্যকরী বিকল্প চলে এসেছে। তবে চশমা তার জায়গা ধরে আছে ঠিকই। পাশাপাশি লক্ষ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানও টিকে আছে এই শিল্পকে কেন্দ্র করে। কত মানুষ ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টি থেকে স্বাভাবিক দৃষ্টি পাচ্ছে সামান্য এই চশমার গুনে তা অগণিত। নিঃসন্দেহে চশমা এই আধুনিক সভ্যতার অন্যতম মাইলফলক।
ফিচার ইমেজ: lenspick.com