১৮৭১ সালের গ্রীষ্মকাল। মিশরের ভূ-খণ্ডে তখন কাঠফাটা গরম। ওইসময় দেইর-এল-বাহরি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটি সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল সমাধি ডাকাত আহমেদ আব্দ এল রাসুল, তার ভাই মোহাম্মদ এবং তাদের এক বন্ধু। এই দেইর-এল-বাহরিতে প্রাচীনকালে ফেরাউন মন্তুহোতেপ এবং রানি হাতশেপসুতের মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে সেখানে শুধু রানি হাতশেপসুতের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষই বিদ্যমান। হাঁটতে হাঁটতে আহমেদের চোখ গিয়ে পড়ল বড় এক পাথরে। সে এই পাথরের পেছনে অন্ধকার একটি এলাকা দেখতে পেল। পেশায় সমাধিডাকাত সে, সমাধি লুট করাই তার নেশা। লোলুপ দৃষ্টিতে সে এগিয়ে গেল। জায়গাটিতে একটি ছোট গর্ত দেখতে পেয়ে তার মনে সন্দেহ জাগনা দিল। ওই গর্তে পাথর ছুড়ে মারার কিছুক্ষণ পর পাথরটি নিচে শক্ত কিছুতে থেমে যাওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। মূলত এই শব্দটিই শুনতে চেয়েছিল আহমেদ ও তার সঙ্গীরা।
দেরি না করে দ্রুত খাদের ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেলেও ভেতর থেকে আহমেদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল বাইরে অপেক্ষারত দুজন। হঠাৎ গর্ত থেকে বেরিয়ে আসলো গগনবিদারী চিৎকার, দড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি উপরে উঠে আসলো সে। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ভেতরে সে জ্বিন দেখেছে। অশুভ সংকেত পেয়ে সবাই দ্রুত এ স্থান ত্যাগ করল, এবং কারও কাছে এই ব্যাপারে মুখ খুলল না।
এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েকবছর। হঠাৎ কায়রোর প্রত্নতাত্ত্বিক বাজার, নিলামঘর, এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে আনাগোনা বাড়তে লাগল চমৎকার কিছু প্রাচীন শিল্পকর্মের। অনেকে ধারণা করতে লাগল, কেউ নিশ্চয় সোনাদানা ভর্তি কোনো রাজকীয় সমাধির হদিস পেয়েছে। এ নিয়ে ছোটখাট এক গুজবও রটে গেল। যখন পুরাতত্ত্ব বাজারে একবিংশ রাজবংশের ফারাও পিনেদজেমের উশাবতি এবং একটি প্যাপিরাসের সন্ধান মিলল, এই গুজবের আগুনে তা যেন আরও এক ছটাক ঘি ঢেলে দিল। প্যাপিরাসটি ছিল অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল বর্ণের, যা দেখে মনে হয় মাত্র কয়েক বছর আগে তাতে লেখা হয়েছে।
মিশরের পুরাতত্ত্ব বিভাগের (Egyptian Dept. of Antiquities) প্রধান তখন অগাস্টে মারিয়েটে। ব্যাপারটি তাঁর টনক নড়ালে তিনি খানিকটা অনুসন্ধানের চেষ্টা চালান। কিন্তু অনুসন্ধানে সন্দেহজনক তেমন কিছুই খুঁজে পাননি তিনি। অগাস্টের পর স্যার গ্যাস্টন মাসপেরো পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান হয়ে আসলে, তিনিও ঠিক একই পথে হাঁটেন। তবে, অনুসন্ধানে তিনি একটি সূত্র পেয়ে যান। ওই সূত্রের মারফতে তিনি জানতে পারেন, আহমদ ও তাঁর ভাইয়েরা এক রাজকীয় সমাধির সন্ধান পেয়েছে। তৎকালীন স্থানীয় গভর্নর দাউদ পাশা তিনজনকে হাতকড়া পরিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালালেও, তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেননি।
কিন্তু হুট করে এই পরিস্থিতি নাটকীয়তায় মোড় নিতে থাকে। আহমেদ আব্দ এল রাসুল যে গ্রামে বসবাস করতেন, ওই গ্রামের সকলেই ছিল ডাকাত। অর্থাৎ বছরের পর বছর সমাধি লুটতরাজ তাদের বংশপরম্পরায় চলে এসেছে। আহমেদের ভাই মোহাম্মদের একদিন মনে হলো, তাদের গ্রামেরই কেউ পুলিশের কাছে তাদের তথ্য ফাঁস করে দিতে পারে। তাই সে নিজে থানায় গিয়ে অকপটে সকল কিছু স্বীকার করে নিল। মোহাম্মদ জানিয়েছিল, সে আর তার ভাই সমাধি খুঁজে পাওয়ার পর একটি গাধা হত্যা করে সমাধির গর্তে ফেলে এসেছিল, যাতে মৃত গাধার দুর্গন্ধে কেউ ওই গর্তের কাছাকাছি ঘেঁষতে না পারে। আর লোকজনের চোখ এড়াতে তারা মাঝেমধ্যে ওই গর্তে হানা দিয়ে মূল্যবান সামগ্রী প্রত্নতত্ত্ব বাজারে বিক্রি করত। এতে কারও মনে কোনো সন্দেহ জন্মাত না।
মাসপেরো তখন ছুটি কাটাচ্ছেন। মোহাম্মদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য পেয়ে এমিল ব্রুগস নামে পুরাতত্ত্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা দেইর-এল-বাহরিতে ছুটে যান। সমাধিতে নামার পর ব্রুগসের চক্ষু ছানাবড়া। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রচুর ধনসম্পদ। রাসুল ভ্রাতৃদ্বয়ের লুটপাটের পরেও এখানে বহু পরিমাণ সম্পদ রয়ে গেছে। তিনি আরও হতবিহবল হলেন এই দেখে, রাজকীয় নর-নারীদের বহু মমি মেঝেতে শুইয়ে এবং দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা আছে। মমিগুলোর নাম দেখতে গিয়ে কপালে চোখ উঠে গেলো তার। মমিগুলো ছিল ফেরাউন প্রথম আহমোসে, প্রথম সেটি, দ্বিতীয় রামেসিস, তৃতীয় রামেসিস, প্রথম তুথমোস, দ্বিতীয় তুথমোসেসহ ১৮ ও ১৯ তম রাজবংশের প্রায় পঞ্চাশজন খ্যাতনামা ফেরাউন এবং রাজকীয় সদস্যের।
তবে শঙ্কা অন্তরাত্মা গ্রাস করে নিল এমিল ব্রুগসের। এই অঢেল সম্পদের কথা ডাকাত গ্রামবাসী জানতে পারলে তাকে জান নিয়ে ফিরতে দেবে না। তাই ৩০০ লোক খাটিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সবকিছু জাহাজে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। চেম্বার থেকে প্রাপ্ত মমি খুব সতর্কতার সাথে মুড়িয়ে কফিনে রাখা হয়েছিল। তাড়াহুড়ো আর ভয়ে কোনোকিছু অর্থবইয়ে টুকে নিতে পারলেন না তিনি। কোন মমি কোন অবস্থায় ছিল, সেগুলোর বর্ণনাও লেখা সম্ভব হলো না। এই কাহিনির উপর ভিত্তি করে ১৯৬৯ সালে মিশরে ‘The night of the counting of years’ নামে এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। চলচ্চিত্রের এক দৃশ্যে দেখা যায়, মূল্যবান সকল সম্পদ এবং রাজকীয় মমিসমূহ গাধার পিঠে করে নীল নদের জাহাজে তোলা হচ্ছে। জাহাজটি মমিসহ যখন নীল নদ হয়ে কায়রোর দিকে যাচ্ছিল, ততক্ষণে সবাই জেনে গেছে এই জাহাজে করে কী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নদীতীরের দুই প্রান্ত কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠল। দলে দলে তারা জাহাজকে প্রণামের মাধ্যমে শ্রদ্ধা-ভক্তি উজাড় করে দিতে লাগল। কারণ, জাহাজে করে যাচ্ছে এই ভূমির কিংবদন্তি, শাসক, সূর্য সন্তান, সম্রাট, ও দেবতাগণ।
ছুটি থেকে ফিরে এসে মাসপেরো একমুহূর্ত দেরি না করে ফিরে যান ঘটনাস্থলে। সমাধিস্থল ঘুরে দেখার পরই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এখানে দুটি আলাদা শ্রেণীর মমি রাখা হয়েছিল। একশ্রেণীর মমি ছিল পূর্ববর্তী ফারাওদের, আরেকশ্রেণীর মমি ছিল আমুনের প্রধান পুরোহিত পরিবারের সদস্যদের মমি। মনে প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে, এতসব বিখ্যাত ফেরাউনের মমি দেইর-এল-বাহরিতে একত্রিত হলো কীভাবে?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে ডাকাত কর্তৃক সমাধি লুটপাটের সঙ্গে। রাজকীয় সমাধিতে ডাকাতির বিষয়টা প্রাচীন মিশরে ছিল অতি সাধারণ এক ঘটনা। একেকটি রাজকীয় সমাধি চোর-ডাকাতদের নিকট ছিল স্বর্ণখনির সমতুল্য। শুধুমাত্র একটি রাজকীয় সমাধির সন্ধান পেলেই তারা পায়ের উপর পা তুলে বাকি জীবনটা রাজার হালে কাটিয়ে দিতে পারত। তাই, এ পর্যন্ত যত রাজকীয় সমাধির সন্ধান পাওয়া গেছে, এর সবগুলোতেই একবার না একবার চোর-ডাকাতের পা পড়েছে।
মিশরতত্ত্ববিদেরা বিংশতম রাজবংশের কিছু প্যাপিরাস থেকে সমাধি ডাকাতদের কথা এবং তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তির কথা জানতে পেরেছেন। কোন সমাধিতে ডাকাতি হয়েছিল, ডাকাতদের স্বীকারোক্তি, সমাধিতে আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পরিদর্শনের কাহিনিসমূহ সেই প্যাপিরাসে লিপিবদ্ধ করা আছে। ঐসময় আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রচুর অবনতি ঘটায় সমাধিডাকাতদের দৌরাত্ম্য বহুলাংশে বেড়ে গিয়েছিল। Mayer B নামে একটি প্যাপিরাসে ষষ্ঠ রামেসিসের সমাধি লুটের কথা বর্ণনা করা আছে। এই সময়ে ফেরাউনদের সমাধিতে ডাকাতদের উৎপাত এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সমাহিত গুপ্তধনের কানাকড়িও অবশিষ্ট রাখত না ডাকাতেরা। লুটতরাজ তো চালাতই, সেই সাথে মমিরও অনেক ক্ষতিসাধন করত তারা। দেখা গেছে, শিশুদের মমি কবরের ভেতরে মশাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তখন রাজবংশীয়দের কাছে ধনসম্পদ রক্ষার চেয়ে মমি রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। কারণ, তাদের বিশ্বাসে- মমি রক্ষা করা না গেলে তাদের বিদেহী আত্মা পরকালে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাবে না।
মমিগুলো রক্ষা করতে একবিংশ রাজবংশের ফেরাউন ‘ফেরাউনদের উপত্যকা’ থেকে প্রতিটি রাজকীয় মমি একত্রিত করে দেইর-এল-বাহরিতে পুনরায় সমাহিত করেন। এই কাজটি তাকে করতে হয়েছিল খুবই গোপনীয়তার সাথে। মাসপেরো মমির ব্যান্ডেজ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মর্মার্থ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে সক্ষম হন যে, বেশ কিছু মমি কয়েকবার ব্যান্ডেজ করার পাশাপাশি, সত্তর বছর ধরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় লুকানো হয়েছে। এই সত্তর বছরে মমিগুলোকে রাখা হয়েছিল প্রথম সেটির সমাধিতে, সেখান থেকে আবার রানি ইনহাপির সমাধিতে। রানি ইনহাপির নাম অনেকবার ঘুরে-ফিরে আসায়, শুরুতে মনে করা হতো, সম্ভবত ইনহাপির সমাধিতেই সকল মমিগুলো একত্র করে রাখা হয়েছে। কিন্তু নিখুঁত বিশ্লেষণের পর গবেষকরা দেখতে পান, এই সমাধিটি মূলত আমুনের প্রধান পুরোহিত দ্বিতীয় পিনেদজেমের। ইনহাপির সমাধি আরও দূরে অবস্থিত। দ্বিতীয় পিনেদজেমের সদস্যদেরকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল শেষদিকের কক্ষগুলোতে। আর রাজকীয় অন্যসকল মমি তাড়াহুড়ো করে রাখা হয়েছিল প্রথমদিকে কক্ষগুলোতে।
সমাধি ডাকাতের স্বীকারোক্তির বিষয়টি ছিল চরম নির্যাতনের সাথে সম্পৃক্ত। পুরুষ বা মহিলা যার কাছ থেকেই স্বীকারোক্তি আদায় করা হোক না কেন, তার উপর প্রবল অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানো হতো। মুতেম্বিয়া নামক নারীকে একবার এই স্বীকারোক্তির মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছিল। তার স্বামী পায়েরো ডাকাতিতে জড়িত থাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল, সমাধির মূল্যবান সামগ্রী তার স্বামী কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। প্রথমে সে এই ডাকাতির কথা সরাসরি অস্বীকার করলেও পাশবিক নির্যাতন চালানো হলে মুতেম্বিয়া সেসব লুকানোর স্থান জানিয়ে দেন। ধরা পড়লে শাস্তি হিসেবে সমাধি ডাকাতদের নাক, কানসহ বিভিন্ন অঙ্গহানি করার রীতি ছিল। আর অপরাধের পরিমাণ বেশি হলে শূলে পর্যন্ত চড়ানো হতো।
তবে ডাকাতি যে শুধু ফারাওদের সমাধিতেই চলত বিষয়টা এমন নয়। পুরোহিত বা সাধারণ মানুষের সমাধিতেও ডাকাতদের কালো থাবা পড়েছে। সমাধি লুটের পর তাদের মৃতদেহ মরুর বালিতে ফেলে রাখা হতো। আরও ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, রাজাদের উপত্যকায় সমাধি ডাকাতিতে দেইর-এল-মদিনার লোকজনও জড়িত ছিল।
এখন ফিরে আসা যাক সমাধিডাকাত আহমেদের ভাই মোহাম্মদের কাছে। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের পর কী হয়েছিল তার? সে ভেবেছিল- তাকে হয়ত গুরুতর কোনো শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু এর পরিবর্তে তাকে করা হলো পুরস্কৃত। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ফোরম্যানের হিসেবে নিযুক্ত করা হলো তাকে। কিন্তু কপালে সেই সুখ বেশিদিন সইলো না। কয়েক বছর পর এক প্রত্নতাত্ত্বিক দলকে কারনাকের আমুন রে মন্দিরের ১৫০ জন পুরোহিতের সমাধি খুঁজে বের করে দিলে কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে ছাটাই করে দেয়। কারণ, তাদের বিশ্বাস ছিল, মোহাম্মদ আগে থেকেই এই সমাধির খবর জানত, এবং সে এই সমাধি থেকে ধীরে ধীরে মূল্যবান সমাধি সামগ্রী সরিয়ে ফেলেছে।