সমাজের অগ্রগতির সাথে অপরাধপ্রবণতাও যুগে যুগে ধরন পাল্টেছে। অপরাধ দমনের জন্য রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন সময় উল্লেখযোগ্য ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে চেষ্টা করেছে- তবে ব্যর্থতা পিছু ছাড়ার মতো নয়। কারণ কর্তৃত্ব না মানা ও আইন অমান্য করতে চাওয়ার প্রবণতা মানুষের মজ্জাগত। আবার কখনও কখনও এমন অপরাধও ঘটে যায়, যা সোজাসুজি কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মতো হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সমাজ ও আইনের ভিত নড়েচড়ে বসে। অপরাধ- সে ছোট হোক আর বড়- খুব সহজে মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের কাছে দমে যাওয়ার পাত্র নয়।
১৯৬৬ সালের ১২ আগস্ট লন্ডনে ছোট অথচ ভয়াবহ এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। হ্যারি রবার্টস নামে একজন খুনী লন্ডনের উপকণ্ঠে ব্রেব্রুক স্ট্রিটে তিন পুলিশ সদস্যকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনা ‘শেফার্ড’স বুশ’ মার্ডার নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। এই ঘটনা সমগ্র ইংল্যান্ডকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো।
দিনটি অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক ছিলো।
পশ্চিম লন্ডনের ‘ইস্ট অ্যাকটন’ এলাকায় মেট্রোপলিটন পুলিশ সদস্যরা তাদের রুটিনমাফিক কাজ চালাচ্ছিলেন। ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ক্রিস্টোফার টিপেড হিড ও ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডেভিড বারট্রাম উম্বওয়েল মেট্রোপলিটন পুলিশের দুই টগবগে যুবক। দুজনই শেফার্ড’স বুশ অঞ্চলের সিআইডি বিভাগে কর্মরত ছিলেন। কনস্টেবল জিওফ্রে রজার ফক্স নামের ৪১ বছরের অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মচারী তাদের গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তারা মূলত নিয়মমাফিক টহলদারি করছিলেন। আলোচ্য এলাকার প্রতিটি জায়গা তাদের একরকম নখদর্পণে।
বিকেল ৩টা ১৫’র দিকে একটি গাড়িকে ব্রেব্রুক স্ট্রিটে প্রবেশ করতে দেখা গেলো। কর্মরত পুলিশ সদস্যরা দেখতে পেলেন- একটি স্ট্যান্ডার্ড ভ্যানগার্ড স্টেশন ওয়াগন আসছে, যার ভেতরে তিনজন লোক বসা। তারা সচকিত হয়ে উঠলেন। অনেক সময় জেলখানা এলাকার কাছাকাছি গাড়ি নিয়ে এসে আসামীদের নিয়ে পালিয়ে যাবার ঘটনা শোনা যায়। তাছাড়া, কনস্টেবল রজার ফক্সের কাছে গাড়ির ড্রাইভারকে কিছুটা পরিচিত মনে হচ্ছিলো। সুতরাং পুলিশ কর্মকর্তারা গাড়িতে বসা লোকগুলোকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ক্রিস্টোফার ও ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডেভিড গারির দিকে এগিয়ে গেলেন। আগত গাড়ির ড্রাইভার উইটনির হাবভাব কিছুটা সন্দেহজনক দেখাছিলো। গাড়ির ট্যাক্স ডিস্ক, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ইন্সুরেন্সের ব্যাপারে সে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিতে পারছিলো না। ফলে সার্জেন্ট হিড গাড়ি তল্লাশি করতে চললেন। ড্রাইভার হুইটনির এটা পছন্দ হলো না। এমন সময় গাড়ির সামনের সিটে বসা হ্যারি রবার্টসের হাতে ল্যুগার পিস্তল দেখা গেলো। হ্যারি ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডেভিডের দিকে গুলি ছুঁড়লো। বাম চোখে গুলি লাগার কারণে হ্যারি সাথে সাথে মারা গেলেন। সার্জেন্ট হিড পুলিশের গাড়ির দিকে এগোনোর চেষ্টা করলেন। হ্যারি এগিয়ে এসে তাকে লক্ষ্য করেও গুলি চালালো। প্রথম গুলিটি ব্যর্থ হলেও পরের গুলি ঠিক মাথায় আঘাত করলো। ডেভিডের মতো হিডও রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
হ্যারির গাড়ি থেকে জন ডাডি নামে আরেকজন বেরিয়ে এলেন। তার হাতেও রিভলভার ছিলো। জন ডাডি পুলিশের গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে জিওফ্রে রজারকে তিনটি গুলি করলো। মৃত রজারের পা গাড়ির এক্সিলারেটরে পড়ার কারণে এটি চলন্ত অবস্থায় সার্জেন্ট হিডের দেহের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে।
আচমকা ঘটে যাওয়া এই হত্যাকাণ্ডের পর খুনীর দল ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত সরে পড়লো। সন্দেহজনক গতিতে গাড়ি চালাতে দেখে জনৈক পথিক রেজিস্ট্রেশন প্লেটে লিখে রাখলেন। ঘটনা ঘটার ৬ ঘন্টা পর গারির ড্রাইভার হুইটনি গ্রেফতার হলো। পরের দিন সেই গাড়িটি কাছের এক গ্যারেজ থেকে উদ্ধার করা হয়। এতে গাড়ি চুরির করার সরঞ্জাম ছাড়াও বেশ কিছু অস্ত্রের অংশবিশেষও পাওয়া গিয়েছিলো। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথমদিকে হুইটনি খুনের ঘটনা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলো। কিন্তু ১৪ আগস্ট নিরুপায় হয়ে স্বীকারোক্তি দিলো। খুনীদের পরিচয়ও দিতে বাধ্য হলো। ১৭ আগস্ট জন ডাডি লন্ডনের বাইরে গ্লাসগো থেকে গ্রেফতার হলো।
হ্যারি রবার্টস আগে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ছিলো, তাই তাকে ধরতে ধকল পোহাতে হলো। তিনমাস ধরে গ্রেফতার এড়িয়ে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলো। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশ ১০০০ পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেছিলো। ১৫ নভেম্বর হার্টফোর্ডশায়ার অঞ্চলের থর্লি গ্রামের এক খামারবাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
১৪ নভেম্বরে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো। হ্যারি রবার্টস ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ও ডিটেকটিভ কনস্টেবলের হত্যার কথা নিজেই স্বীকার করেছিলো। জন ডাডি ও হুইটনি সব রকম অপরাধ অপরাধের কথা অস্বীকার করলো। হুইটনি তার নিজের জবানবন্দীতে জানালো, সে এবং জন ডাডি হ্যারির আকস্মিক আক্রমণে একেবারে থমকে গিয়েছিলো। নয়তো কাউকে হত্যা করা তাদের উদ্দেশ্যই ছিলো না।
১৯৬৬ সালের ১২ ডিসেম্বর এই নির্মমতার বিচারের রায় দেওয়া হলো। হ্যারি, ডাডি ও হুইটনিকে খুন ও অবৈধ অস্ত্র বহনের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। রায়ে প্যারোলে মুক্তি পাবার শর্ত হিসেবে কমপক্ষে ৩০ বছর দণ্ড ভোগ করার কথা বলা হলো। বিচারক গ্লিন জোন্স এই ঘটনাকে ‘দেশটিতে হওয়া সবচেয়ে ভয়ানক হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করলেন।
জন ডাডি ১৯৮১ সালে জেলে থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করে। হুইটনি কোনো অজ্ঞাত কারণে ৩০ বছর পূর্ণ হবার আগেই ছাড়া পায়। ১৯৯৯ সালে সে নিজের রুমমেটের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়। হ্যারি রবার্টস নির্ধারিত মেয়াদের চেয়ে অনেক বেশি জেল খেটেছিলো। বেশ কয়েকবার তার প্যারোলের আবেদন নাকচ করা হয়েছিলো। জনমনে নির্মম সেই খুনের স্মৃতি কর্তৃপক্ষকে প্যারোলের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দ্বিধায় ফেলেছিলো। শেষে অনেক নিবেদনের পর ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর হ্যারিকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়।
এই ঘটনা ইংল্যান্ডকে বেশ বড় আকারে নাড়া দিয়েছিলো। অপরাধচক্রের সীমানায় পড়লে অপরাধ দমনের দায়িত্ব পাওয়া পুলিশ সদস্যও নির্মমভাবে খুন হতে পারে- এই কঠোর সত্য নিরীহ মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্তাদের পর্যন্ত সচকিত করে দিয়েছিলো। ইংল্যান্ডের পুলিশ অফিসারদের সেসময় সার্ভিস উইপন হিসেবে ফায়ারআর্ম দেওয়া হতো না। এই হত্যাকাণ্ডে সবার চোখ খুলে গেলো। পুলিশ অফিসারদের সার্ভিস রিভলভার দেওয়ার বিধান চালু করা হলো। এসময়ই লন্ডনে ‘মেট্রোপলিটন পুলিশ ফায়ারআর্মস উইং’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
নিহত পুলিশ সদস্যদের সমাহিত করার সময় প্রায় ৬০০ মেট্রোপলিটন পুলিশ সদস্য অংশ নিয়েছিলো। ঘটনার স্মরণসভায় অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন, বিরোধীদলের নেতা অ্যাডওয়ার্ড হিথ ও আরো অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠিত শোকসভায় হাজারেরও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিলো। পুলিশ সদস্যদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য গঠিত হলো ‘পুলিশ ডিপেন্ডেন্টস ট্রাস্ট’। ইংল্যান্ডের বিত্তবান ব্যক্তিরা এতে বড় অংকের অর্থ দান করেছিলেন। এছাড়া অপরাধ তদন্তে চলাকালীন অন্যান্য নিরাপত্তার ব্যবস্থাও জোরদার করার ব্যবস্থা করা হলো। এতেই বোঝা যায়- একসাথে তিনজন পুলিশ সদস্যের ডিউটিরত অবস্থায় এমন করুণ মৃত্যু ইংল্যান্ডকে কী পরিমাণে নাড়িয়ে দিয়েছিলো!
১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেবার বিধান ছিলো। সেবছর থেকে শাস্তি হিসেবে প্রাণদণ্ড বন্ধ করা হয়। শুধুমাত্র রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো অপরাধের জন্য প্রাণদণ্ড দেবার বিধান ছিলো, যা ১৯৯৮ সালে স্থগিত হয়েছিলো। ১৯৬৬ সালে ঘটে যাওয়া এই নির্মমতার ফলে অনেকে অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে প্রাণদণ্ড ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। আবার অনেক মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রাণদণ্ড রহিত করা হলেও পুলিশ সদস্যদের হত্যার ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হোক। তবে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান পুনরায় চালু করা হয়নি।
‘শেফার্ড বুশ হত্যাকাণ্ড’ ইংল্যান্ডের অপরাধের ইতিহাসে বেশ আলোচিত এক ঘটনা। সেসময়ের বিচারে এমন ঘটনা বেশ অভাবনীয় ছিলো। জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত যারা, অপরাধীরা অন্তত তাদের কিছুটা হলেও ভয় পাবে- এই বিশ্বাস জনমনে এমনিই থাকে। সে হিসেবে এ ঘটনা বিশ্বাসভঙ্গের এক নিদর্শন। অন্যদিকে কর্তব্য পালনের জন্য কঠোর হওয়া ও প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ারও অন্যতম উদাহরণ বিশ শতকের মাঝামাঝি ইংল্যান্ডে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা। ইংল্যান্ডের মানুষ এখনও এই ঘটনাকে শোকবিহ্বল হয়ে স্মরণ করে থাকে।