১৯৪০ এর মাঝামাঝি সময়। চারদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। জার্মান বাহিনীর হাতে রীতিমতো নাস্তানাবুদ হচ্ছে ইংরেজ বাহিনী। বিভিন্ন জায়গায় ক্রমশ শক্তি হারাচ্ছে তারা। ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর এটিই সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস আগে থেকেই ইংরেজ সরকারকে সমর্থন দিয়ে রেখেছে।
কংগ্রেসের মতের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁঁড়িয়ে আছেন শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। তিনি বিশ্বাস করেন, সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত ব্রিটিশরাজকে ভারতের মাটি থেকে বিতাড়ন করা সম্ভব নয়। তার এই বিশ্বাসে তার দল ফরোয়ার্ড ব্লক, বাংলার বৈপ্লবিক সংস্থা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (বি. ভি.), অনুশীলন সমিতি, বিপ্লবী পূর্ণ দাসের দলের মতো বাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সহমত পোষণ করেন।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে লড়াইয়ের জন্য চাই অস্ত্রে সজ্জিত সুগঠিত সেনাবাহিনী। তা না হলে কিছুতেই বিজয় সম্ভব নয়। তাই চাই প্রচুর অস্ত্র। কিন্তু এই অস্ত্র জোগাড় হবে কীভাবে? তার জন্য অন্য দেশের সাহায্য প্রয়োজন। ইংরেজদের বিপক্ষে যেসব দেশ রয়েছে, তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। সুভাষ ঠিক করলেন, তাকে ভারতবর্ষের বাইরে যেতে হবে। দেশগুলোর কাছ থেকে অস্ত্র পাওয়া গেলে তিনি একটি শক্তিশালী বিপ্লবী সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে পারবেন।
এজন্য তাকে কলকাতা থেকে পালাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? সর্বক্ষণ তার পেছনে গোয়েন্দা লেগে আছে। তাদের নজর এড়াবেন কীভাবে? সুভাষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ফরোয়ার্ড ব্লকের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সর্দার নিরঞ্জন সিং তালিবের সাথে গোপনে পরামর্শ করে ঠিক করলেন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে দুর্গম উপজাতি এলাকা পেরিয়ে তিনি আফগানিস্তান প্রবেশ করবেন। এ পথ দিয়ে ভারতবর্ষের বাইরে যাওয়া কঠিন হলেও গোয়েন্দাদের নজর এড়ানো অনেক সহজ হবে। কিন্তু এ পথটি তাদের কারো চেনা নয়। তার জন্য চাই এমন এক বিশ্বস্ত কর্মী, যে পথটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল এবং এ পথ দিয়ে সুভাষকে নিরাপদে আফগানিস্তান পৌঁছে দিতে পারবেন।
এমন লোকের সন্ধানে পাঞ্জাবের কীর্তি কিষাণ পার্টির বিশ্বস্ত কর্মী কমরেড অচ্ছর সিংয়ের কাছে খবর পাঠানো হলো। কমরেড অচ্ছর সিং তার দলের বিশ্বস্ত এক সহকর্মীর সাথে আলোচনা করে ঠিক করলেন, এই কাজের জন্য ভগৎরামই যোগ্য ব্যক্তি।
ভগৎরাম কীর্তি কিষাণ পার্টির শুধু একজন সভ্যই নন, ফরোয়ার্ড ব্লকেরও একজন অতি উৎসাহী কর্মী। যে পথ দিয়ে সুভাষ দেশের বাইরে যেতে চাচ্ছেন, সেই রাস্তাটি তার নখদর্পণে। ঐ এলাকার আফ্রিদি, পশতুন প্রভৃতি উপজাতীয়দের সাথে তার যথেষ্ট সখ্যতা রয়েছে। একমাত্র তিনিই সুভাষকে নিরাপদে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দিতে পারেন। ভগৎরাম সুভাষকে আফগানিস্তান পৌঁছে দিতে সানন্দে রাজি হলেন।
সব প্রস্তুতি যখন প্রায় সম্পন্ন তখনই ঘটলো বিপত্তি। ১৯৪০ এর ৩ জুলাই হলওয়েল মনুমেন্ট আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন সুভাষ। তার আগের দিনেই তাকে গ্রেপ্তার করে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হলো। ফলে ভারতবর্ষ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সব পরিকল্পনায় ভেস্তে গেল। জেলের মধ্যে সুভাষের সাথে অনেক পরিচিত বিপ্লবীর দেখা মিললো। তিনি তাদের সাথে নানা রাজনৈতিক আলোচনায় মেতে উঠলেন। এসব আলাপ আলোচনায় দেশের স্বাধীনতার আনার ব্যাপারে আরো বেশি উৎসাহিত হয়ে উঠলেন সুভাষ। সবাই একমত, দুর্বার আন্দোলন ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না। দেশ থেকে পালানোর চিন্তাটা সুভাষের আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। যেভাবেই হোক তাকে জেল থেকে বের হতে হবে।
এদিকে ২৮ অক্টোবর জেল থেকেই সুভাষ কেন্দ্রীয় আইনসভায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন। আইনজীবীদের পরামর্শে সুভাষ অনশন শুরু করলেন। আমৃত্যু অনশন। অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লো দেশের আনাচে-কানাচে। সুভাষকে বিনা বিচারে আটকে রাখা যাবে না। অবিলম্বে তার মুক্তি চাই। এই আন্দোলন যখন জোরদার হচ্ছে, তখন ইংরেজ সরকার ৫ ডিসেম্বর গৃহবন্দি থাকার শর্তে সুভাষকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
শুরু হলো সুভাষের সংগ্রামী জীবনের এক নতুন অধ্যায়। এলগিন রোডের বাসায় ফিরে এসে সুভাষ একদম নিশ্চুপ। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথা বলেন না। কারো সাথে দেখা করেন না। এমনকী অন্তরঙ্গ সহচরদের সাথেও নয়। আসন্ন কোনো সংগ্রামের জন্য যেন তিনি নিজেকে প্রস্তুত করছেন। ঘরে বসেই ভারতবর্ষ থেকে পালানোর পরিকল্পনা আবার নতুন করে শুরু করলেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা মিঞা আকবর শাহের সহায়তায় ভগৎরামের সাথে নতুন করে যোগাযোগ স্থাপন করলেন। কীর্তি কিষাণ পার্টির বিশ্বস্ত কর্মীরা নতুন করে পরিকল্পনা সাজাতে লাগলেন। কে, কবে, কোথায় সুভাষকে পেশোয়ারের ক্যান্টেনমেন্ট স্টেশন থেকে নিয়ে আসবে, তার থাকার ব্যবস্থা করবে এবং কাবুল সীমান্ত পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছে দেবে তা-ও স্থির হয়ে গেল।
নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে উপস্থিত হলো সেই দিন। ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। প্রস্তুত সুভাষ, প্রস্তুত ভগৎরাম আর তার সাথে প্রস্তুত ফরোয়ার্ড ব্লক ও কীর্তি কিষাণ পার্টির সেসব বিশ্বস্ত কর্মীরা যাদের হাতে সুভাষের যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন করার সকল দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল।
রাত তখন বেশ গভীর। গোটা এলগিন রোড নিস্তব্ধ। কোনো কোলাহল নেই। সেদিন রাস্তায় জ্বলছিল না কোনো আলো। ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য পাঠান যুবকের ছদ্মবেশ নিলেন সুভাষ। বাড়ির একটি গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়িতে মাত্র দুজন আরোহী। গাড়ির চালক আর সুভাষ। একটি সুটকেস, বিছানা আর একটি অ্যাটাচি কেস গাড়িতে রাখা হলো। গাড়ির চালক আর কেউ নন, সুভাষের প্রিয় ভাইপো শিশির বোস। শক্ত হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসে আছেন শিশির। মাথার ওপর তার গুরুদায়িত্ব। পুলিশের নজর এড়িয়ে নেতাজিকে তার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিতে হবে। রাত ১টা ২৫ মিনিটে যাত্রা শুরু হলো।
কলকাতা শহর ছাড়িয়ে গ্র্যান্ড ট্যাঙ্ক রোড ধরে গাড়ি এগিয়ে চলতে লাগলো। চুঁচুড়া, ব্যাণ্ডেল, শক্তিগড়, বর্ধমান, আসানসোল …। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি বরাকর ব্রিজ পার হয়ে গেল। নিস্তব্ধ রাস্তায় যেন তুফান মেল ছুটছে। ধীরে ধীরে পূব আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। রাতের অন্ধকার মুছে গিয়ে ভোরের হালকা মিষ্টি আলো দেখা দিচ্ছে। গাড়ির স্পিড আরও বাড়িয়ে দিলেন শিশির। সকাল হওয়ার আগেই তাকে যেকোনো উপায়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে হবে। ব্রিটিশদের চররা চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। কখন কার চোখে পড়ে যায়!
অবশেষে গাড়ি পৌঁছলো ধানবাদের এক বাংলোর সামনে। এই বাংলোতে থাকেন শিশিরের দাদা অশোক বোস ও তার স্ত্রী মীরা। সেদিনের মতো যাত্রা বিরতি। বাংলোর কেউ যাতে সন্দেহ না করে সেজন্য সুভাষকে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির একজন এজেন্ট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। খাঁটি পাঠানের পরিচয় ধরে রাখতে সুভাষ প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে তেমন কোনো কথাই বললেন না। যা বললেন তা-ও আবার ইংরেজিতে। বাংলোয় নানা রকম মানুষের আনাগোনা। তাই সাবধান থাকা খুব প্রয়োজন।
সেদিন রাতেই আবার যাত্রা শুরু হলো। এবার গাড়ি বদল করা হলো। এ যাত্রায় সুভাষের সাথে অশোক ও মীরা যুক্ত হলেন। আর গাড়ির স্টিয়ারিং যথারীতি শিশিরের হাতে। অনেক রাতে গাড়ি এসে পৌঁছলো গোমো জংশনে। একপাশে উঁচু পাহাড়ের সারি আর নীচ দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলে যাওয়া রেলপথ। এই গোমো জংশনেই থামবে হাওড়া থেকে আসা দিল্লি-কালকা মেল।
জংশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে অন্ধকারে গাড়িটিকে দাঁড় করানো হলো। আশেপাশে কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। ট্রেন আসতে তখনও বেশ দেরি। আরও ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর ট্রেনের ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেলো। ইঞ্জিনের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো গোটা রেল স্টেশন। এবার শিশির গাড়িটাকে ধীরগতিতে স্টেশনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। স্টেশনের মুখেই রাখা হলো গাড়ি। এবার সুভাষকে বিদায় জানাতে হবে।
এদিক-ওদিক ভাল করে দেখে নিয়ে সুভাষ গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেলেন দৃঢ় পদক্ষেপে। রেলের কামরায় ওঠার আগে একবার শুধু ফিরে তাকালেন তার প্রিয়জনদের দিকে। বিদায় …!
কত শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত, কত হাসি-কান্না গাঁথা দিন, সব পেছনে ফেলে সুভাষ চলে যাচ্ছেন ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে। পিছে পড়ে রইলো তার প্রিয়জন, তার দল, তার বিপ্লবী বন্ধুরা। হয়তো আবার দেখা হবে স্বাধীন দেশের মাটিতে।
রাত্রির অন্ধকার ফুঁড়ে সুভাষের এই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো অসাড়, নিস্পন্দ তিনটি প্রাণ- শিশির, অশোক আর মীরা। তাদের চোখে আজ আর পানি নেই। সেখানে শুধু তার যাত্রাপথ শুভ হওয়ার মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা। নিজের ব্রত সাঙ্গ করে ফিরে এসো বিজয়ের বেশে, এই ভারতবর্ষে।
পরবর্তী পর্ব: ইংল্যান্ডের চোখে ধুলো দিয়ে নেতাজির ঐতিহাসিক কাবুল যাত্রা- শেষ পর্ব