২০১৪ সালে ইতিহাসের অধ্যাপক কিম ওয়াগনার তার লন্ডনের একটি অফিসে বসে ইমেইল চেক করছিলেন। হঠাৎ একটি ইমেইলে তার চোখ আটকে যায়। ইমেইলটি পাঠিয়েছেন এক ব্রিটিশ দম্পতি। ইমেইলটিতে তারা অধ্যাপককে জানান, তাদের কাছে একটি মানব করোটি আছে। করোটিটি সিপাহি বিদ্রোহ আমলের কোনো এক ভারতীয়র হতে পারে বলে তাদের ধারণা।
এ ধরনের করোটি বাড়িতে রাখতে তারা খুব একটা স্বস্তি বোধ করছেন না। আবার ফেলেও দিতে পারছেন না। অধ্যাপক নিজে একবার এসে যদি করোটিটি দেখে যেতেন তাহলে খুব ভাল হয়। ইমেইলে এই দম্পতি ওয়াগনারকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান।
কিম ওয়াগনার লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়ান। ইমেইলটি পড়ে স্বভাবতই তিনি রোমাঞ্চিত বোধ করলেন। সিপাহি বিদ্রোহ? ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের ওই সময়টা নিয়ে তখন তিনি গবেষণা করছিলেন। কাজেই ইমেইলটা পেয়েই আর দেরি করলে না। নভেম্বরের এক সকালে সেই বয়স্ক দম্পতির এসেক্সের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
চমকের পর চমক যেন অধ্যাপকের জন্য অপেক্ষা করছিল। শুধু করোটিই নয়, এর মধ্যে রয়েছে ইংরেজিতে লেখা একটি চিরকুটও। এটি কার করোটি তাতে বিস্তারিতভাবে লেখা রয়েছে। চিরকুট থেকে জানা যায়, করোটিটি ৪৬তম রেজিমেন্টের বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রির হাবিলদার আলম ভেগের। ১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহি বিদ্রোহে এই সিপাহি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন।
সেই বিদ্রোহে যে ক’জন সিপাহি নেতৃ্ত্ব দিয়েছিলেন এই আলম ভেগ ছিল তাদের একজন। ৩২ বছর বয়সী, ৫ ফুট সাড়ে ৭ ইঞ্চি উচ্চতার এই সিপাহি নাকি অত্যন্ত উগ্র মেজাজের ছিলেন। বিদ্রোহের দাবানল যখন স্ফূলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিভিন্ন জায়গার ব্যারাকে, তখন আলম ভেগের নেতৃত্বে ভারতীয় সিপাহিদের একটি দল রেজিমেন্টের দুর্গের দিকে যাওয়ার রাস্তাটি দখল করে নেয়।
ইউরোপীয় নাগরিকরা সুরক্ষার আশায় তখন ব্রিটিশ সৈন্যদের আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন। সে সময় ভেগের নেতৃত্বে সিপাহিদের দলটি প্রথমে ইউরোপীয় ডাক্তার গ্রাহামকে গুলি করে। তারপর জনাব হান্টার, তার স্ত্রী ও মেয়েদের খুন করে। কিন্তু কী কারণে এসব ইউরোপীয় সিভিলিয়ানদের ভেগ খুন করেছিলেন সেই সম্পর্কে চিরকুটে কোনো তথ্য নেই।
আলম ভেগের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল তা-ও চিরকুট থেকে জানা যায়। ১৮৫৮ সালে তৎকালীন পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে আলম ভেগের প্রাণদন্ড দেয়া হয়। কামানের সাথে বেঁধে তার পুরো শরীরটি উড়িয়ে দেয়া হয়। তখন ডিউটিতে থাকা ব্রিটিশ সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন এ আর কাস্টেলো ‘যুদ্ধজয়ের স্মারক’ হিসেবে আলম ভেগের দেহ থেকে মাথা কেটে নেন। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর কাস্টেলো ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন আলম ভেগের করোটিটি।
করোটিটি যে বহু বছরের পুরনো তা হাতে নিয়েই ওয়াগনার বুঝতে পেরেছিলেন। হালকা লালচে খয়েরি রঙের করোটির চোয়ালের নীচের হারটি আর অবশিষ্ট নেই। চোয়ালের ওপরের পাটির যে কয়েকটি দাঁত তখনও অবশিষ্ট আছে সেগুলোও বেশ নড়বড়ে অবস্থায়। কামানের আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল বলে করোটিতে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।
চিরকুটের লেখা পড়ে করোটিটি দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো বলে চিহ্নিত করা গেলেও তার ফরেন্সিক প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত ওয়াগনারের পক্ষে তা মেনে নেয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না। এসেক্সের বৃদ্ধ দম্পতির অনুমতি নিয়ে ওয়াগনার করোটিটি পরীক্ষার জন্য ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম’-এ নিয়ে আসেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওয়াগনার নিশ্চিত হলেন যে করোটিটি সত্যিই উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের এবং তা কোনো এশীয় বংশোদ্ভূত পুরুষের। বয়স ত্রিশের আশেপাশে।
করোটিতে যেটুকু আঘাতের চিহ্ন রয়েছে তা থেকে বোঝা যায় মৃত্যুর পর কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে দেহ থেকে মাথাটিকে আলাদা করা হয়েছে। চিরকুটে দেয়া তথ্যের সাথে পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য মিলে যাওয়ায় ওয়াগনার নিশ্চিন্ত হলেন, এই করোটি সিপাহি বিদ্রোহে মারা যাওয়া সেই ভারতীয় সিপাহির।
চিরকুটের লেখার উপর ভিত্তি করে অধ্যাপক ওয়াগনার এ নিয়ে আরও নানা তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করতে লাগলেন। এর মধ্যেই ঘটে যায় আর একটি ঘটনা। ২০১৪ সালে ভেগের পরিবারের সদস্যরা আলম ভেগের কাটা মাথাটি ফেরত নিতে ইংল্যান্ডে যান। বিভিন্ন সংবাদ থেকে তারা জানতে পারেন, করোটিটি তখন কিম ওয়াগনারের কাছে আছে। এ নিয়ে তারা ওয়াগনারের সাথেও যোগাযোগ করেন। ফলে ওয়াগনার তার গবেষণাকে আরও ফলপ্রসু করতে উঠে-পড়ে লাগেন। তিন বছর ধরে গবেষণা করে তিনি সেই সিপাহি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য উদঘাটন করেন এবং পরবর্তীকালে সেই গবেষণার উপর ভিত্তি করে একটি বইও লেখে ফেলেন। বইয়ের নাম দেন- ‘The Skull of Alum Bheg: The Life and Death of a Rebel of 1857’।
বইটিতে লেখক উনিশ শতকের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার এই আলম ভেগের জীবন ও তার মৃত্যুর সব ঘটনাই তুলে ধরেছেন। ওয়াগনার তার বইতে উল্লেখ করেন চিরকুটে উল্লেখ করা ব্যক্তিটির আসল নাম ‘আলিম ভেগ’। তিনি উত্তর ভারতের অধিবাসী ছিলেন। বিদ্রোহের সময়ে তিনি আজকের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কৌনপোরে (বর্তমানে কানপুর) বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহী ছিলেন।
রেজিমেন্টে হিন্দু সিপাহিদের সংখ্যা বেশি থাকলেও ২০ শতাংশের মতো মুসলিম সিপাহিও সেখানে কর্মরত ছিলেন। এ সিপাহি মূলত রেজিমেন্টে পাহারা দেয়ার কাজ করতেন। সাথে চিঠিপত্র বিলি করা এবং রেজিমেন্টের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের পিয়ন হিসাবেও কাজ করতেন। সিপাহি বিদ্রোহের সময় তিনি ত্রিম্মু ঘাট লড়াইয়ে অংশ নেন এবং সিপাহিদের একটি গ্রুপকে নেতৃত্ব দেন। সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ১৮৫৭ সালের জুলাইয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় এক বছর তিনি কারা অন্তরীন ছিলেন। ১৮৫৮ সালে সেনা বিদ্রোহের অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
১৯৬৩ সালে আলিম ভেগের করোটি কেন্টের ‘দ্য লর্ড ক্লাইড’ পানশালায় পাওয়া যায়। কিন্তু কীভাবে তা সেখানে পৌঁছেছিল তা জানা যায়নি। পানশালাটি একসময় হাতবদল হয়ে যায়। এসেক্সের সেই দম্পতির এক আত্মীয় পানশালাটি কিনে নেন। পরবর্তীকালে উত্তরাধিকারসূত্রে এ দম্পতি পানশালার মালিকানা পান। তবে করোটির প্রকৃত মালিক ইংরেজ সেনাবাহিনীর ওই ক্যাপ্টেনের সাথে পানশালা মালিকের কী সম্পর্ক ছিল, তা আজও অজানা।
ডক্টর ওয়াগনার তার বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন, বইয়ে তিনি মানবতা পুনরুদ্ধারের কিছুটা চেষ্টা করেছেন। আলম ভেগের জীবনের গল্প বলার মধ্য দিয়ে বিস্মৃত হওয়া মানুষটির সংগ্রামকে মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বইতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৬০ বছর পর হলেও আলমে ভেগের আত্মাকে কিছুটা শান্তি দেয়ার চেষ্টা করেছেন বলে লেখক জানান।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসমিন খান কিম ওয়াগনারের বইটি সম্পর্কে লেখেন, বইটি পড়তে পড়তে তার মনে হয়েছিল তিনি যেন কোনো ডিটেকটিভ নোভেল পড়ছেন। বইটিতে সে সময়ের ব্রিটিশ শাসন এবং কলোনিয়াল সমাজ ব্যবস্থায় ঘটে যাওয়া নানা সহিংসতার একটি বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে বলে তিনি মনে করেন।
১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারতবর্ষ নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। ১৮৫৭ সাল। ইংরেজদের ভারতবর্ষ শাসনের ১০০ বছর হতে চললো। এর মধ্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি বিক্ষিপ্ত আন্দোলন সংঘটিত হলেও ইংরেজদের ভয় ধরিয়ে দেয়ার মতো তেমন কোনো সুগঠিত সংগ্রামই গড়ে উঠতে পারেনি। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভিত কিছুটা হলেও নাড়িয়ে দিয়েছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। তাই এ সংগ্রামের সাথে জড়িত সকল সিপাহীরই বীরের মর্যাদা প্রাপ্য।
ওয়াগনার চান সিপাহি বিদ্রোহের সাথে জড়িত এই সংগ্রামী নেতা যেন তার দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত হন। তিনি জন্মেছিলেন ভারতে আর তার মৃত্যু হয়েছিল পাকিস্তানে। তাই ডা. ওয়াগনারের ইচ্ছা ভেগকে যেন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের মাঝে কোনো এক জায়গায় সমাহিত করা হয়।
সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) সিপাহি বিদ্রোহ এবং একটি ঐতিহাসিক অবিচার