ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইমেইলের নাম জানেন আর মিম কী সেটা জানেন না, এমন মানুষ খুব বেশি নেই পৃথিবীতে। মানুষ নিজের চেহারার যতগুলো অনুভূতি প্রকাশ পায় তার প্রায় সবগুলোকেই বিভিন্ন মিমের মাধ্যমে আটকে রাখতে চেয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে নিজেদের আবেগ প্রকাশ করতে। আরো অনেকের মতো আপনিও হয়তো ব্যবহার করেন মিম। এখনো হয়ত করছেন। আসলেই, কাঠখোট্টা আন্তর্জালিক সম্পর্কে আর একটু সহজ ভাব প্রকাশের জন্য মিমের চাইতে ভালো কিছু হতেই পারে না। কিন্তু মিম ব্যবহারের সময় কখনো কি আপনার মনে হয়েছে যে, এরা কোথা থেকে এল? এদের কে প্রথম তৈরি করেছে? মিমের অতীত সম্পর্কে একটুও কি জানেন আপনি? চলুন, এবার নাহয় জেনেই আসি!
প্রথম মিম
ইন্টারনেটে প্রথম কোন মিমটি আসে সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেক আগের ঘটনা হওয়ায় এবং সঠিক কোনো তথ্য না থাকায় এই ব্যাপারে মানুষের বিভিন্ন মন্তব্য আছে। তবে অনেকের মতে, ইন্টারনেটে আসা একেবারে প্রথম কিংবা শুরুর দিকের মিমটি ছিল ‘এট মাই বলস’। ছবি এবং তার সাথে কিছু কথা একত্র করে ইন্টারনেটে ব্যবহার করা হয় এই মিম। তবে সেসময় এর মান খুব বেশি ভালো ছিল না। নেহাল পাটেল নামক একজন ছাত্র প্রথম ১৯৯৬ সালে ‘মিস্টার টি. এট মাই বলস’ ওয়েবসাইটের জন্য এই মিমটি তৈরি করেন। তবে নেহাল পাটেলের আগে, এমনকি ইন্টারনেটেরও আগে মিম তৈরি করেছিল কেউ একজন। মিমটি তৈরি হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। পুরোটি ছিল ১৯৮৬ সালে রোনাল্ড রিগান ও ফার্স্ট লেডির ‘জাস্ট সে নো’ ভাষণটির মতো। পার্থক্য কেবল এটুকুই ছিল যে, মূল ভিডিওতে তারা কথা বলেছিলেন মাদকদ্রব্য থেকে সবাইকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে। এবং পরের ভিডিওতে, যেটা কিনা মিম হিসেবে প্রকাশ করা হয়, তাদের চেহারা, বাচনভঙ্গী এবং শব্দও বদলে দিয়ে খুব চমৎকারভাবে মূল ভাষণের সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলান হয়। মাদকদ্রব্যের পক্ষে অবশ্যই রাষ্ট্রপতি কথা বলেননি। তবে এই ভিডিওতে সেটাই করে দেখানো হয়। সেসময় ইউটিউব ছাড়াই সবার কাছে মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল নতুন এক মিম।
কে তৈরি করেছিলেন এই মিমটি? তিনি আর কেউ নন, নিউ ইয়র্ক সিটির ক্লিফ রথ। কেন এমনকিছু করলেন রথ? কোথা থেকে তার মাথায় এমন চিন্তা জন্ম নিল? রথ ছিলেন ভিডিও ও অডিও সম্পাদনা করার ওস্তাদ। খুব ভালোবাসতেন তিনি নিজের কাজকে। ১৯৮৬ সালে নিউ ইয়র্কের মিলেনিয়াম ফিল্ম ওয়ার্কশপে অডিও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপরে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন রথ। সেসময় শিক্ষার্থীদের আরো ভালো করে সবকিছু শেখানোর জন্য একেবারে অন্যরকম একটি কাজ দেন তিনি। আর সেটি হল প্রেসিডেন্ট রেগানের দেওয়া ভাষণকে বদলে ফেলে সেটাকে অন্যরকম কিছু করে পরিবেশন করা। শিক্ষার্থীরা ব্যাপারটিকে লুফে নেয় এবং রেগানের ভাষণের মজার কিছু রূপ দেয়। এর মাধ্যমে কেবল মানুষকে হাসাতে কিংবা বিনোদন দিতে চাননি রথ। তিনি চেয়েছিলেন, এরকম কিছু যে করা সম্ভব, আমরা যেটা দেখছি সেটা যে সবসময় সত্যি নয় তা মানুষকে জানানো। আর সেটা করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তবে রথের তৈরি এই মিমটিই নয়। ইন্টারনেট শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই বেশ কিছু মিম বিখ্যাত আর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল মানুষের কাছে। এমন ৭টি মিমের নাম নীচে দেওয়া হল।
কিলরয় ওয়াজ হিয়্যার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়। হুট করেই যেন ‘কিলরয় ওয়াজ হিয়্যার’ নামক একটি মিম খুব বেশি পরিচিতি পেয়ে যায়। কোথা থেকে এটি এল কিংবা এর অর্থ কী তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে সবার মাঝে। তবে মনে করা হয়, এই মিমে মোট দুটো ব্যাপারের মিশ্রণ ঘটেছে। আর সেগুলো হল- ব্রিটিশ ডুডল ‘মিস্টার চাঁদ’ এবং আমেরিকান ওয়েল্ডিং ইনস্পেক্টর জেমস জে. কিলরয়। মিমে আঁকা কার্টুনটি অনেকটা মিস্টার চাঁদের মতো। আর কিলরয়? অন্য ইন্সপেক্টরেরা যখন কেবল একটা চকের দাগ দিয়েই নিজেদের কাজ সারতেন তখন কিলরয় লিখে রাখতে ভালোবাসতেন ‘কিলরয় ওয়াজ হিয়্যার’। আর সেখান থেকেই এমন লেখনী জন্ম নিয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। পরবর্তীতে ব্যাপারটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে যায় যে, হিটলারের বাংকার থেকে শুরু করে যুদ্ধকালীন সব স্থানে কিলরয় ওয়াজ হিয়্যার লিখে রাখতে শুরু করে সৈনিকেরা। আর কেবল সৈনিক কেন, পরবর্তীতে এটি মানুষের কাছেও পায় প্রচন্ড জনপ্রিয়তা। মানুষ যত্ন করে পাহাড় থেকে শুরু করে আইফেল টাওয়ার এবং সম্ভাব্য সবখানে ছড়িয়ে দিতে থাকে কিলরয়কে।
ফ্রোডো লিভস
‘লর্ড অব দ্য রিংস’ মুভিটি তখনো মুক্তি পায়নি। এর প্রায় কয়েক যুগ আগে, ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ বইটি প্রকাশ পাওয়ার কিছুদিন পর মানুষ হঠাৎ করে আবিষ্কার করে বিভিন্ন দেয়ালে লেখা ‘ফ্রোডো লিভস’। এই সময়ে লর্ড অব দ্য রিংস প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। বইটির নায়ক ফ্রোডো ব্যাগিন্স হয়ে পড়ে সবার পছন্দের। বিশেষ করে হিপ্পিরা ফ্রোডোর সাথে নিজেদের মিল খুঁজে পেয়ে মিমটিকে আরো বেশি বাড়িয়ে তোলে। ৬০ এবং ৭০ এর দশকে সবাই একরকম পাগলামি শুরু করে ফ্রোডোকে নিয়ে। আর এরপর? এরপর গাড়ি, দালান, দেয়াল- সবখানে দেখা যেতে থাকে ফ্রোডো লিভস কথাটা। যারা এসব লিখছিল তারা সবাই কি লর্ড অব দ্য রিংস পড়েছিল? উঁহু, তখন তো এটা মিম হয়ে গিয়েছে। আর মিম লেখার জন্য বই পড়ার দরকার পড়ে না!
অ্যান্দ্রেস দ্য জায়ান্ট হ্যাস অ্যা পোসি
নিজের ছবিটা সবখানে ছড়িয়ে থাকতে দেখতে নিশ্চয় খারাপ লাগবে না আপনার? অ্যান্দ্রেসেরও লাগেনি হয়তো। তাই এই মিমের শুরুটা কে করেছিল তা জানা না গেলেও পরবর্তীতে এটা নিয়ে কোনো কথা বলেনি অ্যান্দ্রেস। অ্যান্দ্রেস নামের এই ব্যাক্তিটি ছিলেন ডব্লিউডব্লিউএফ আশির দশকের একজন কুস্তিগীর। একদিন সকালে রাস্তার ধারে দেখতে পাওয়া যায় তার ছবি, আর সাথে ‘অ্যান্দ্রেস দ্য জায়ান্ট হ্যাস অ্যা পোসি’ লেখাটি। ব্যস! এরপর থেকে সবখানে ছড়িয়ে পড়ে এই মিম। কোম্পানিগুলো স্টিকার তৈরি করা শুরু করে এটি ব্যবহার করে। পরবর্তীতে অবশ্য এ নিয়ে মামলা হয় আর স্টিকার তৈরি করা বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানিগুলোর।
দ্য থ্রি হেয়ারস
ঠিক ধরেছেন, এটা আজকালের কোনো ব্যাপার নয়। বরং অনেক অনেক আগেকার একটি মিম। তিনটি খরগোশের এই মিম প্রথম তৈরি করা হয় চীনের সুই রাজত্বকালে। সেখান থেকে মধ্যযুগের ইউরোপে এবং সবশেষে ব্রিটেনে এসে পৌঁছায় এই মিম। মিমগুলোর মধ্যে সবচাইতে প্রাচীন একটি মিম হিসেবে ধরা হয় এই মিমটিকে। তবে এটা কিন্তু পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন মিম নয়!
দ্য স্যাতোর স্কোয়্যার
পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন মিম হিসেবে পিরিচিত স্যাতোর স্কোয়্যারের শুরুটা হয় রোমান শাসনামলে। সেসময় কোনো একজন রোমান নাগরিক নিজের ইচ্ছেমতো একটি ছক কাটেন আর তার সেই ছকটিকেই বুঝে কিংবা না বুঝে সবাই নকল করে যায়। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি- বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে আছে প্রায় ২,০০০ বছর বয়সী স্যাতোর স্কোয়্যার।
ফিচার ইমেজ: Reaganite Republican