গুপ্তধন শিকারি, ইতিহাসবেত্তা, প্রত্নতাত্ত্বিক থেকে শুরু করে মায়ের মুখে গল্প শুনে ঘুমোতে যাওয়া শিশু পর্যন্ত সবাইকে দুর্নিবার আকর্ষণের জালে জড়িয়ে নেয়া এক মহার্ঘ্য বস্তু ‘গুপ্তধন’। যুগে যুগে গুপ্তধনকে ঘিরে মানুষের আগ্রহকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে একের পর এক গল্প-গাঁথা। তবে শত গল্পের ভিড়েও লুকিয়ে থাকে কিছু সত্য। তেমনই এক সত্যিকারের অনাবিষ্কৃত গুপ্তধনের নাম ‘দ্য ফ্লোর দে লা মার’। ধারণা করা হয়, পর্তুগিজ এই ক্যারাক বা মালবাহী জাহাজে প্রায় ২.৬ বিলিয়ন ডলারের গুপ্তধন লুকিয়ে আছে। পর্তুগালের নৌ ইতিহাসে নির্মিত সর্ববৃহৎ এই ক্যারাকটি দিউ-এর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।
ফিরে যাওয়া যাক ১৫০২ সালের লিসবনে, পর্তুগালের স্বর্ণালী যুগের অনুসন্ধানে। সম্রাটের অর্জনের মুকুটে যুক্ত হয়েছে নতুন একটি পালক। বন্দরে তাই রীতিমতো উৎসব শুরু হয়েছে। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে উন্মুক্ত করা হচ্ছে বিশাল একটি জাহাজ, সমুদ্রের পাশে অবস্থিত এই দেশটির মানুষ এতো বড় জাহাজ এর আগে আর দেখেনি। দৈর্ঘ্যে ১১১ ফুট, প্রস্থে ১১৮ ফুট আর ৪০০ টন ভরের সেই জাহাজটি তৎকালীন সময়ের সর্ববৃহৎ জাহাজের উপাধি লাভ করে। জাহাজটির নাম রাখা হয় ‘দ্য ফ্লোর দে লা মার’, ইংরেজিতে যা ‘দ্য ফ্লাওয়ার অফ দ্য সি’ নামেই পরিচিত। আমরা একে ‘সমুদ্রের ফুল’ বলে ডাকতে পারি।
জাহাজের তক্তায় সর্বশেষ পেরেকটি ঠোকার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ক্যারাকটিকে পাঠানো হবে ভারতের উদ্দেশ্যে। ঈশ্বরের নামে নিজের দেশের গৌরব বাড়াতে ভারত বিজয় ও লুণ্ঠনের কথা মাথায় রেখে রওনা দেন নাবিকেরা। তখনকার দিনে মসলা আর স্বর্ণের দেশ ভারত, পশ্চিমা বিশ্বকে নিজের সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাই কোনো বাণিজ্য নয়, গোটা দেশ দখল করতেই বেরিয়ে পড়ে পর্তুগিজরা। অনেকে তা-ই বলেন, অপকর্মের নিয়তে বানানো জাহাজ অপঘাতেই তলিয়ে গেছে। সে যা-ই হোক, ফ্লোর দে লা মারে দেখতে কিন্তু খুব সুন্দর ছিল। তবে কথায় আছে না, চাঁদেরও কলঙ্ক আছে! সমুদ্রের ফুল তার কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। সামান্য ত্রুটি তারও ছিল, সে রহস্য শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে। ঐ ত্রুটি সত্ত্বেও ভারতগামী অন্যান্য জাহাজের মতো সেও দিব্যি সাগরের বুকে চলেফিরে বেড়িয়েছে দীর্ঘ নয় বছর যাবত। তারপরই আসে সেই দিনটি, যেদিন জাহাজটি তার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান ধনরত্ন নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিল সাগরে, পাড়ি জমিয়েছিল না ফেরার দেশে।
১৫০২ সালে সাড়ম্বরে জাহাজটির উদ্বোধন হওয়ার পর ক্যাপ্টেন এস্তেভো দা গামার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ভারতের পানে ছুটে যায় সমদ্রের ফুল। এস্তেভো ছিলেন বিখ্যাত নাবিক ভাস্কো দা গামার চাচাতো ভাই। নাবিকদল ভারতে পৌঁছে ব্যাপক লুটতরাজ চালিয়ে, লুটের মালে জাহাজ ভর্তি করে বাড়ির পথে মাস্তুল ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু ফিরে আসার পথে জাহাজটি মুখোমুখি হয় প্রথম সমস্যার। ভারতের যে নদীপথ হয়ে তারা ফেরত আসছিল, তার তুলনায় আকারে জাহাজটি বেখাপ্পা রকমের বড় ছিল। কাজেই পানির নিচের পাথরের সাথে ঘষা গেলে ফুটো হতে শুরু করে সমুদ্রের ফুল।
তাড়াহুড়া করে দক্ষ হাতে গর্তগুলো ভরাট করার চেষ্টা করে নাবিকদল। সে যাত্রায় কোনোমতে রক্ষা পেয়ে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় কয়েক মাস দেরি করে বাড়ি ফেরে তারা। কিন্তু বেঢপ আকৃতি নিয়ে যেখানে সেখানে যাত্রা করতে গিয়ে বারবার এই একই সমস্যার সম্মুখীন হয় তারা। যদিও কিংবদন্তী জাহাজটির ক্যারিয়ার তাতে খুব বেশি বিঘ্নিত হয়নি। কয়েক বছরের মধ্যেই নতুন এক নাবিকের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের উদ্দেশে পাড়ি জমায় জাহাজটি। কিন্তু ফেরার পথে আবারও সেই একই সমস্যা দেখা দেয়। এবার ফুটোগুলো এতোটাই প্রকট সমস্যার সৃষ্টি করে যে, মাঝপথেই নৌবহর থামিয়ে লুণ্ঠিত মাল নামিয়ে ইস্ট ইন্ডিজের একটি অংশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে তারা। কেউ বাধা দিতে এলে জীবনের বিনিময়ে সে ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে তাদের।
পরবর্তী চার বছর, সমুদ্রের ফুল পরিণত হয় রণতরীতে। সোকোতরা, মুস্কাত, অরমুজ, গোয়া সহ সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বেশকিছু এলাকা দখল করে নেয় পর্তুগিজরা। জাহাজটি তখন আলফোনসো দ্য আলবুকার্ক নামক এক অভিজাত সেনাপতির নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছিল। আলবুকার্ক পরে ভারতে পর্তুগালের দ্বিতীয় ভাইসরয়ের পদ অর্জন করেন।
১৫১১ সালে মালয়েশিয়ার মালাক্কায় তার পরবর্তী অভিযানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আলবুকার্ক। সে সময় মালাক্কা ছিল স্থানীয় বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু, ক্রমেই তা আন্তর্জাতিক হাবে পরিণত হচ্ছিল। যে কারণে বিচক্ষণ আলবুকার্ক এমন সুবর্ণ সুযোগ ছাড়তে চাননি। টানা বার দিনের সহিংস ও হত্যার কাহিনী সম্বলিত যাত্রার পর তারা যখন মালাক্কা পৌঁছান, তখন আক্ষরিক অর্থেই তাদের বিরোধিতা করার মতো সাহস কারো ছিল না। মালাক্কার সুলতানের প্রাসাদে ঢুকে দু’হাতে ধনসম্পদ নিয়ে রণতরী বোঝাই করে ফেলেন তারা। পর্তুগালের রাজা সিয়ামের জন্য নিয়ে যাওয়া সে সম্পদ ছিল পর্তুগালের ইতিহাসে সবচেয়ে মূল্যবান সংযোজন। এতো বিপুল পরিমাণ রত্ন নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কিনা সে ব্যাপারে আলবুকার্ক জানান, জাহাজটি ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য একদম ঠিকঠাক অবস্থায় আছে।
প্রায় ছয় বছর পর উপচে পড়া ধনরত্নের ভান্ডার সাথে নিয়ে পর্তুগালে ফিরে যাচ্ছে সমুদ্রের ফুল। গুপ্তধন শিকারি রবার্ট এফ. মার্ক্স এবং তার স্ত্রী জেনিফার মার্ক্স ‘ট্রেজার লস্ট অ্যাট সি’ নামক একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেন আলবুকার্করা প্রায় ৬০ টন ওজনের সোনার তৈরি পশু-পাখি, কয়েন আর আসবাবপত্র নিয়ে আসেন মালাক্কার সুলতানের প্রাসাদ থেকে। এতেই এত বেশি জায়গা লাগছিল যে আরও ২০০টি হীরা, রুবি, মণি, মুক্তা, জহর ভরা বাক্স রাখার আর কোনো জায়গা ছিল না, নাবিকদের থাকার জায়গার সংকটের কথা তো বলাই বাহুল্য। বর্তমান সময়ের হিসাব অনুযায়ী প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ে ফিরতি পথে পাড়ি জমায় ফ্লোর দে লা মারে।
১৫১১ সালের ডিসেম্বর মাসে আরো চারটি জাহাজের সাথে ফ্লোর ডে লা মার রওনা হয়েছিল। কিন্তু রওনা দেয়ার দুদিন পরেই মালাক্কা জলপ্রণালীর কাছাকাছি আসার পর একটি ভয়ঙ্কর ঝড়ের মুখোমুখি হয় সমুদ্রের ফুল। ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে কয়েক ঘণ্টা টিকে থাকে এটি। সুমাত্রার কাছে এসে উপকূলের প্রবালপ্রাচীরের সাথে ধাক্কা লেগে এটি ডুবে যায়। জাহাজটি দু’টুকরো হয়ে যায়, কিন্তু নাবিক আলফোনসো বেঁচে যায়। বিপুল ধনরত্ন পেছনে ফেলে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসেন তিনি। জাহাজে থাকা প্রায় ৪০০ নাবিকের মধ্যে মাত্র কয়েকজন এক পোশাকে জাহাজ থেকে নেমে তীরে উঠে প্রাণ বাঁচান। বাকিদের খবর পাওয়া যায়নি আর কখনো। সমুদ্রের অতলে হারিয়ে যাওয়া ফ্লোর দে লা মারের গুপ্তধন উদ্ধার করা কখনো সম্ভব হয় নি, সম্ভব হয়নি হারানো নাবিকদের কোনো খোঁজ পাওয়া।
এরপর বেশ অনেকবার অনেকভাবে অন্তত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় ঘুমিয়ে আছে সমুদ্রের ফুল, কেউ তা ঠিক করে বলতে পারেনি। ১৯৮৯ সালে সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান ইন্দোনেশিয়ার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে জাহাজটি খুঁজে বের করতে একটি অভিযান চালায়। তারা অনুসন্ধান করে যে প্রবালপ্রাচীরের আঘাতে ফ্লোর দে লা মার ডুবে যায় সেটিও খুঁজে বের করে। দলটি পরবর্তী ধাপে পৌঁছানোর আগেই মালয়েশিয়া, পর্তুগাল এবং ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে বড় একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হয় অনুসন্ধানকারী দলটিকে। ফলে গুপ্তধনের রহস্য আজীবন রহস্যই রয়ে যায়।