গণিতের সঠিক প্রয়োগ আপনাকে দিতে পারে ভাগ্যের গ্যারান্টি।
কথাটি বলেছেন স্টেফান ম্যান্ডেল। অখ্যাত স্টেফান মেন্ডেলের নামের মতো উক্তিটিও কেমন যেন লাগে শুনতে। কিন্তু এই উক্তিটিকেই সত্য বানিয়ে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন স্টেফান ম্যান্ডেল। পাঠক হয়তো ভাবছেন, স্টেফান ম্যান্ডেল কোনো এক গণিতবিদ। আদতে তা নয়, তিনি ছিলেন কোনোমতে পাশ করা একজন হিসাবরক্ষক। কিন্তু কীভাবে গণিতের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছেন কোটিপতি সেই গল্পই আজ শোনানো হবে আপনাদের।
ম্যান্ডেলের জন্ম রোমানিয়ায়। বেড়ে ওঠাও সেখানে। কিন্তু তখন রোমানিয়া স্বাধীন কোনো রাষ্ট্র ছিলো না। সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকা রোমানিয়ায় তখন মানুষজন জীবিকার জন্য করতো কঠিন সংগ্রাম। ঠিক অন্যান্যদের মতোই ম্যান্ডেলের জীবনেও শুরু হয় সংগ্রাম। মাসে সব মিলিয়ে মাত্র ৮৮ ডলার আয় করা ম্যান্ডেলকে স্ত্রী ও দুই বাচ্চার পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিলো। দুটি পথ খোলা ছিলো তার সামনে। অনৈতিক উপায়ে টাকা উপার্জন অথবা পরিবার নিয়ে পালিয়ে গিয়ে পশ্চিমে তাঁবু গাড়া। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন তৃতীয় পথ; একটি অ্যালগরিদমের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন।
ম্যান্ডেল চেয়েছিলেন অ্যালগরিদমের মাধ্যমে লটারি জিততে। তার হিসেব অনুযায়ী, জ্যাকপট যখন মোট কম্বিনেশনের চেয়ে তিনগুণ হবে, তখনই লটারি কিনতে হবে। সেজন্য পাঠকদের অবশ্য জ্যাকপট ও কম্বিনেশন কী জিনিস সেটি বুঝতে হবে। জ্যাকপট বলতে বোঝানো হয় লটারির জন্য জমানো সব টাকা। অন্যদিকে কম্বিনেশন হচ্ছে লটারির জন্য প্রযোজ্য নাম্বার সংখ্যা সবগুলোকে ওলটপালট করে যতগুলো সম্ভাব্য সংখ্যক লটারি তৈরি করা যায়।
যে কাউকে লটারির নাম্বার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৪০ পর্যন্ত যেকোনো ছয়টি নাম্বার বেছে নিতে হয়। এক্ষেত্রে লটারির মোট কম্বিনেশন হবে ৩,৮৩৮,৩৮০টি। আর এর তিনগুণ অর্থাৎ প্রায় ১১.৫ মিলিয়ন ডলার সমমানের জ্যাকপট হলেই ম্যান্ডেল টিকেট কিনতেন। এর কারণ ছিলো একেবারেই সহজ। যদি একটি টিকেটের মূল্য এক ডলার করে হয় (সেই সময় টিকেটের মূল্য এক ডলার করে ছিলো), তাহলে সব ধরনের কম্বিনেশনের টিকেট কিনে লটারি জিতে যাওয়া সম্ভব। আর তাতে করে টিকেটের দাম ছাড়াও দ্বিগুণ লাভ করা সম্ভব। কিন্তু টিকেটের পেছনে এত টাকা খরচ করা সম্ভব ছিলো না ম্যান্ডেলের পক্ষে।
তাই ম্যান্ডেল অন্য উপায় খুঁজে বের করলেন। কয়েকজনকে নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করলেন। সবাই সেখানে হাজার ডলারের মতো বিনিয়োগ করতো। সেই বিনিয়োগের টাকা দিয়ে সব ধরনের কম্বিনেশনের টিকেট ছাপাতেন ম্যান্ডেল (যা কি না সেই সময়কার আমলে করা যেতো)। তারপর অনুমোদিত ডিলারদের মাধ্যমে লটারির নাম্বারগুলো কেনাতেন। আর যখন লটারি জিতে যেতেন, তখন পুরো অর্থ বিনোয়োগকারীদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হতো। প্রথমে স্থানীয় রোমানিয়ান বন্ধুদের সাথে নিয়ে গ্রুপ তৈরি করেছিলেন তিনি। এভাবে ম্যান্ডেল ১৯.৩ হাজার ডলার আয় করেন, যা সরকারের লোকদের ঘুষ দিয়ে পশ্চিমে চলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সেই সুযোগ নিয়ে তিনি পাড়ি জমান পশ্চিমে।
কিন্তু লটারি হ্যাকিংয়ের নেশা ততদিনে মাথায় ঢুকে গেছে ম্যান্ডেলের। তাই শুধু পশ্চিমে গিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। ১৯৭০ ও ৮০’ এর দশকে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যে আবারও একই কাজ শুরু করেন তিনি।
কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও সমস্যা ছিলো অনেক। প্রথমত, সবগুলো কম্বিনেশনের নাম্বার নিজ হাতে লিখতেন ম্যান্ডেল, যাতে করে ভুল করার সম্ভাবনাও ছিলো অনেক। অন্যদিকে রোমানিয়ায় জ্যাকপটের মূল্যও ছিলো অনেক কম। বিনিয়োগকারী ও কর পরিশোধের পর টাকার বড় একটা অংশই হাওয়া হয়ে যেতো। উদাহরণস্বরুপ, একবার ১.৩ মিলিয়ন ডলারের জ্যাকপট জেতা সত্ত্বেও সবকিছু শেষে তার কাছে অবশিষ্ট ছিলো ৯৭,০০০ হাজার ডলার। তবে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে নিজের পন্থা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হন তিনি।
৮০’র দশকে কম্পিউটারের উত্থানে ম্যান্ডেলের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। এখন হাতে লেখার পরিবর্তে মেশিন দিয়েই নাম্বারগুলো লিখা শুরু করেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে নতুন এক বিনিয়োগকারী গ্রুপ খোলেন তিনি। আর সবাইকে নিয়ে যুতসই জ্যাকপট খুঁজে বেড়ান। অবশেষে অস্ট্রেলিয়ার ‘লোটো সিন্ডিকেট’ এ ১২টি জ্যাকপট জিতে তাক লাগিয়ে দেন। অন্য বিজয়ীদের তুলনায় ৪ লাখ ডলার বেশি জেতেন তিনি। তার এই জয়ে নড়েচড়ে বসে সবাই। সেই জের ধরে অস্ট্রেলিয়ায় পুরো লটারি ও জ্যাকপট সিস্টেমে বেশ পরিবর্তন আনা হয়, যাতে করে ভবিষ্যতে ম্যান্ডেলের মতো কেউ পুরো সিস্টেমকে প্রভাবিত করতে না পারে। কিন্তু তখনও ম্যান্ডেল ছিলেন নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় হ্যাকের অপেক্ষায়।
আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সহযোগীতা পেয়ে ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যান্ডেল ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের লটারিতে নিজের সিস্টেম প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন, যেটির জ্যাকপট ততদিনে পৌঁছে গেছে ২৭ মিলিয়ন ডলারে। ম্যান্ডেলের পক্ষে তখন কাজ করছেন অনেকেই।
ম্যান্ডেল হিসাব করে দেখলেন, ভার্জিনিয়া লটারির জন্য প্রায় সাত মিলিয়ন টিকেট কিংবা নাম্বার লিখতে হবে তাদের। যে-ই ভাবা সে-ই কাজ। ম্যান্ডেল ও তার কর্মীরা কম্পিউটারে ৭ মিলিয়ন নাম্বার লিখে ফেলেন। তারপর তারা সবাই মিলে ৭ মিলিয়ন টিকিট ছেপে ভার্জিনিয়ার বিভিন্ন গ্যাস স্টেশন ও মুদি দোকানে বিলি করতে শুরু করেন। যদিও অনেক মানুষই ব্যাপারটি উপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু ম্যান্ডেল ও তার অনুচারীরা দমে যাননি। একজন এক হাজারের উপর টিকেট কিনলেও কিছু যায় আসে না। সেই সময় কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যক টিকেট কেনার উপর কোনো বিধিনিষেধ ছিলো না। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ম্যান্ডেল পুরো ভার্জিনিয়া চষে সাত মিলিয়ন টিকেট বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অবশেষে ম্যান্ডেলের কৌশল কাজে লাগে ১৬ই ফেব্রুয়ারি। ভার্জিনিয়ার লটারি জিতে নেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই এত বড় অঙ্কের অর্থ জিতে যাওয়ায় তদন্তে নামে সবাই। তবে সব তদন্ত শেষে ম্যান্ডেল নির্দোষ প্রমাণিত হন। সামান্য অঙ্কের সাথে কিছুটা ভাগ্য আর অসামান্য পরিশ্রমের ফলে তিনি বনে যান কোটিপতি। পুরো জীবনে তিনি চৌদ্দবার লটারি হ্যাক করতে সক্ষম হন। আর এই চৌদ্দবারে টিকেট ছাপাতে ও বিনিয়োগকারীদের পেছনে তার ব্যয় হয়েছিলো ৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাগিয়ে নিয়েছিলেন ১৫ মিলিয়ন ডলার।
তবে ভার্জিনিয়া লটারি জেতার কিছুদিনের মধ্যেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিনিয়োগকারীদের সব অর্থ না দেওয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। ধীরে ধীরে এসব কারণে দেউলিয়া হয়ে যান তিনি। পাশাপাশি জেলও খাটেন ২০ মাসের জন্য। বর্তমানে স্টেফান ম্যান্ডেল বাস করছেন অস্ট্রেলিয়ার একটি দ্বীপে।
একনজরে ম্যান্ডেলের লটারি হ্যাকিংয়ের ছয়টি পদক্ষেপ দেখে নেওয়া যাক।
১. প্রথমেই ১ থেকে ৪০ নাম্বার থেকে ছয়টি সংখ্যা নিয়ে মোট কম্বিনেশন বের করা। (মোট কম্বিনেশন ৩,৮৩৮,৩৮০)
২. এমন লটারি খুঁজে বের করা যা জ্যাকপট কম্বিনেশন থেকে তিনগুণ বা তারও বেশি।
৩. প্রতিটি কম্বিনেশনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে টাকা সংগ্রহ করা (ম্যান্ডেলের অধীনে প্রায় ২,৫২৪ জন বিনিয়োগকারী ছিলেন)।
৪. সকল কম্বিনেশনের টিকেট ছাপানো (সেই সময় যা বৈধ ছিলো, কিন্তু এখন আমাদের সরাসরি টিকেট কিনতে হয়)।
৫. অনুমোদিত ডিলারের মাধ্যমে টিকেট গুলো ছাড়া।
৬. ক্যাশ জিতে বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য অর্থ বুঝিয়ে দেওয়া।