দুইশত বছরের দীর্ঘ নিদ্রা শেষে ফের জেগে উঠতে হলো নুয়েস্ত্রা সেনোরা দে লা মার্সেদিসকে। ১৮০৪ সালের অক্টোবর মাসে যখন ২০০ জন নাবিক নিয়ে আটলান্টিকের বুকে ডুবে গিয়েছিল এই ধনরত্নবাহী জাহাজ, তখন কেউ ভাবেনি তারা আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসবে। কিন্তু সবার ধারণা এবং কল্পনার বাইরে তাকে ফিরে আসতে বাধ্য করা হলো, ঠিক যেভাবে তাকে ডুবে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল একসময়। তবে সেদিনের পৃথিবী আজ অনেকটাই ভিন্ন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ঊনবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী আজ একদম অচেনা। এই নতুন জগতে জেগে উঠেও মার্সেদিসের দুদণ্ড বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অবসরটুকুও মিলল না তার। আন্তর্জাতিক কলহের বলিদান হওয়া মার্সেদিস জেগে উঠল নতুন কলহের সূত্রপাত ঘটিয়ে। আর এই বিতর্কিত কলহের মূল কারণ ছিল শতবর্ষী জাহাজের বুকে উদ্ধার হওয়া কয়েক কোটি ডলারের ধন-রত্ন।
নুয়েস্ত্রা সেনোরা দে লা মার্সেদিস
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পেরু থেকে প্রায় ১৭ টন ওজনের সমতুল্য রূপা এবং সোনার মুদ্রা, দারুচিনি এবং কিনোয়া বোঝাই করে স্পেনের দিকে যাত্রা শুরু করে মালবাহী জাহাজ নুয়েস্ত্রা সেনরা দে লা মার্সেদিস বা সংক্ষেপে মার্সেদিস। যাত্রাকালে জাহাজটি উরুগুয়েতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি শেষে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইউরোপ অভিমুখে রওনা হয়। কিন্তু ইউরোপে প্রবেশের ঠিক আগে চারটি ব্রিটিশ রণতরীর সামনে পড়ে যায় এই জাহাজ। ভিনদেশী সম্পদ বোঝাই জাহাজের দেখা পেয়ে তৎকালীন দখলবাজ ব্রিটিশরা মার্সেদিসকে আক্রমণ করে বসে। মালবাহী জাহাজের পক্ষে বিশ্বের সেরা নৌবাহিনীর সাথে পেরে ওঠা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। কিছুক্ষণের মধ্যে গোলার আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে সলিল সমাধিস্থ হয় মার্সেদিস। আর সেই সাথে সাগরজলে হারিয়ে যায় জাহাজ বোঝাই অমূল্য রত্নসামগ্রী।
এই ঘটনার পর স্পেন সান্তা মারিয়া অন্তরীপে নেপোলিওনিক যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়। যুদ্ধের তালে স্পেন জেগে উঠলেও ঘুমিয়ে পড়েছিল মার্সেদিস, আটলান্টিকের তলানিতে। প্রায় ২০০ বছর পর এই মার্সেদিসকে পুনরায় জাগিয়ে তুলেছে ‘ওডিসি’ নামক এক প্রতিষ্ঠান। আর সেই সাথে তারা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ উদ্ধারের তালিকায় নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছে।
ব্ল্যাক সোয়ান প্রকল্প
ব্ল্যাক সোয়ান প্রকল্প মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার সমুদ্র অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান ওডিসি মেরিন এক্সপ্লোরেশন কর্তৃক পরিচালিত একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ওডিসি আটলান্টিকের তলায় নিমজ্জিত জাহাজ থেকে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের সমতুল্য ধন-সম্পদ উদ্ধার করে, যা এখন পর্যন্ত সমুদ্রে পরিচালিত সবচেয়ে মূল্যবান উদ্ধারকর্মের রেকর্ড হিসেবে গণ্য হয়। উদ্ধারকৃত মালামালের মধ্যে সোনা, রূপার গয়না, মুদ্রা, শিল্পকর্ম, ভাস্কর্যসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত ছিল। পুরো প্রকল্প সম্পন্ন করতে ওডিসির খরচ হয়েছিল প্রায় ২৬ লাখ ডলার। উদ্ধারকার্য শেষ হওয়ার পর তারা সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করে দেয়।
এই প্রকল্পের কথা সাধারণের নিকট উন্মুক্ত হয় ২০০৭ সালের মে মাসের দিকে, কারণ এপ্রিলের দিকে ওডিসি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এই উদ্ধারকৃত সম্পদের বৈধ মালিকানার জন্য আবেদন করে বসে। কিন্তু এই প্রকল্প নিয়ে বহির্বিশ্বের জ্ঞান ছিল এতটুকুই। কারণ, ওডিসি একদম শুরু থেকে তাদের প্রকল্পের সকল তথ্য গোপন করে রেখেছিল। সীমিত আকারে যে তথ্য উন্মুক্ত করেছিল, সেটাও ছিল অস্পষ্ট। তথ্য ঘাটতির ফলে শুরুর দিকে ধারণা করা হতো, নিমজ্জিত জাহাজটি সম্ভবত ১৭ শতাব্দীর মার্চেন্ট রয়্যাল নামক একটি জাহাজ ছিল। কিন্তু আরও অনুসন্ধান শেষে বেরিয়ে আসে, এটি ছিল স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত মার্সেদিস।
বিতর্কের শুরু
জেগে উঠেই নতুন যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাল মার্সেদিস। এবার যুদ্ধ বেঁধেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওডিসি এবং স্পেন সরকারের মাঝে। তবে পার্থক্য একটাই- যুদ্ধের ময়দান এবার আদালত। ওডিসি যখন তাদের প্রকল্পের তথ্য নিয়ে লুকোচুরি শুরু করল, তখন থেকে সন্দিহান হয়ে পড়ে স্পেন সরকার। তারাও পাল্টা এই সম্পদের দাবিদার হিসেবে প্রতিবাদ করে বসে। চাপের মুখে পড়ে ওডিসি জানায় তারা আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে এই সম্পদ উদ্ধার করেছে। কিন্তু এই মন্তব্য স্পেনকে থামিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী, যদি কোনো বাণিজ্যিক নৌযান সাগর পথে যাত্রাকালে অবাণিজ্যিক কোনো ইস্যু বা মিশনে জড়িয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে এই নৌযানের মালিকানা তাদের থাকবে, যাদের নির্দেশে সেই নৌযান যাত্রাপথে প্রেরিত হয়েছিল। ১৮০৪ সালে নিমজ্জিত হওয়ার সময় মার্সেদিস জাহাজের মালিক ছিল স্পেন সাম্রাজ্য। তাই আইনত এই জাহাজের সম্পদের মালিক স্পেন, এমনটাই দাবি তুলল স্পেন সরকার।
কিন্তু ওডিসি পাল্টা যুক্তি দেখাল, এই জাহাজের আসল পরিচয় জানার কোনো শক্ত নথি নেই। তারা আরও দাবি করল, এই জাহাজের অধিকাংশ সম্পদের মালিকানা ব্যক্তি পর্যায়ের ছিল, যেখানে স্পেন সাম্রাজ্যের কোনো অধিকার নেই। কিছুদিন পর মালিকানার যুদ্ধে সামিল হলো দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু। যেহেতু জাহাজটি পেরু থেকে মাল বোঝাই করে ইউরোপ রওয়ানা হয়েছিল, তাই তাদের দাবি, জাহাজে উদ্ধারকৃত মালামালের অধিকাংশই পেরুভিয়ান সংস্কৃতির নিদর্শন। তাছাড়া স্বর্ণমুদ্রাগুলো পেরুর রাজধানী লিমার টাকশালে নির্মিত। তাই তারা এই সম্পদের বৈধ মালিক।
মামলার নিষ্পত্তি
১৭ টন সম্পদের অধিকার নিয়ে দায়েরকৃত মামলার নিষ্পত্তি হতে আইনি লড়াই চলল মার্কিন মুলুকের আদালতে। প্রায় ৫ বছর ধরে চলা মামলা শেষে আদালত রায় দিল স্পেনের পক্ষে। স্পেন সরকার উপযুক্ত নথি প্রদর্শন করে প্রমাণ করতে সক্ষম হয় জাহাজটি মূলত স্পেনের মালিকানাধীন নুয়েস্ত্রা সেনোরা দে লা মার্সেদিস। তাছাড়া জাহাজ ডুবে যাওয়ার সময় পেরু স্পেন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কলোনি থাকায় তাদের দাবি খারিজ করে দেয়া হয়। রায় অনুযায়ী, এই সম্পদের উপর স্পেন ব্যতীত যুক্তরাষ্ট্র এবং পেরু সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই। মামলার রায় শেষে স্প্যানিশ বিমান বাহিনীর দুটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানে বহন করে উদ্ধারকৃত সম্পদ স্পেনে ফেরত পাঠানো হয়। সম্পদ ফেরত পাঠানো ছাড়াও ওডিসিকে প্রায় ১০ লাখ ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছিল তথ্য গোপন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য।
প্রায় ১৭ টন সম্পদ ফেরত পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত বলেছেন,
“আজ এমন একটি যাত্রা শেষ হচ্ছে, যার সূচনা হয়েছিল ২০০ বছর আগে। আমরা আজকে ইতিহাসকে উদ্ধার করেছি। এটি স্প্যানিশ ঐতিহ্য, একে অর্থ-কড়ি বা মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।”
১৮০৪ সালে ৭ মাস সমুদ্রে ভেসে আটলান্টিকের গর্ভে সলিল সমাধিস্থ মার্সেদিসের যাত্রা শেষ হতে লেগে গেল দুইশত বছর। যাত্রা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই জাহাজ সাক্ষী হয়ে থাকল ইতিহাসের এবং বিবর্তিত পৃথিবীর। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোলাবারুদের যুদ্ধ থেকে আদালতের মঞ্চে আইনি যুদ্ধ- এ যেন শতাব্দী ঘুরে সভ্যতার পরিবর্তনের সাক্ষী। আর এই নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছে ব্ল্যাক সোয়ান প্রকল্প। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মূল্যবান উদ্ধার প্রকল্পের রেকর্ড দখল করে আছে। আর স্পেন ফেরত সম্পদের ভাণ্ডারের ঠাঁই হলো দেশের বিখ্যাত সব জাদুঘর এবং সংগ্রহশালায়। ২০১৪ সালে সর্বপ্রথম সেগুলো জনসাধারণের প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এভাবে জাদুঘরে ছড়িয়ে থাকবে মার্সেদিসের রহস্য, সেখানে অদৃশ্য হয়ে থাকবে দুইশত বছরের যুদ্ধের গল্পগাঁথা।