“Oh Lord! Won’t you buy me a Mercedes-Benz ?”
সত্তরের দশকের শুরুর দিকে গায়িকা জেনিস জ্যাপ্লিনের একটি গান তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। যদিও গানটি রেকর্ডের তিনদিন পরেই গায়িকার মৃত্যু হয়। উপরের বাক্যটি সেই গানেরই প্রথম লাইন এবং গানটির নাম ছিল ‘মার্সিডিজ বেঞ্জ’। বস্তুবাদের প্রতি আমাদের তীব্র আকর্ষণ এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো পাবার প্রতি আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা, তার প্রতি কটাক্ষ করে লেখা হয়েছিল গানটি। তবে বিদ্রূপাত্মক হলেও মার্সিডেজ বেঞ্জের গাড়িগুলো যে পৃথিবীর অন্যতম সেরা এবং বিলাসিতা ও উৎকর্ষতার অপর নাম তা এই গানের মাধ্যমে প্রকারান্তে গায়িকা স্বীকার করে নিয়েছেন। বর্তমানে পৃথিবীর অনেকের কাছেই মার্সিডিজ বেঞ্জ হলো আভিজাত্য, পদমর্যাদা এবং সর্বোচ্চ সফলতার প্রতীক।
মার্সিডিজ বেঞ্জ বিশ্বখ্যাত জার্মান গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তারা বিলাসবহুল সব গাড়ি, বাস, ট্রাক, লড়ি ইত্যাদি মোটরগাড়ি তৈরির জন্য বিখ্যাত। জার্মানির ব্যাডেন-ওর্টেনবার্গের স্টুটগার্টে তাদের হেডকোয়ার্টার অবস্থিত। তবে শুরুতে মার্সিডিজ এবং বেঞ্জ দুটি আলাদা কোম্পানি ছিল। তাদের উভয়ের জন্ম জার্মানিতে এবং নতুন কিছু করার তাগিদ থেকেই যাত্রা শুরু কোম্পানি দুটির।
যাত্রা শুরুর পর থেকে দুটি কোম্পানির লক্ষ্য ছিল একই। শুরু থেকেই তারা ক্রমবিকাশমান যান্ত্রিক ইঞ্জিন নিয়ে কাজ শুরু করে। কীভাবে বাজারে চলমান ইঞ্জিনগুলোকে আরও উন্নত করা যায় এবং এসব ইঞ্জিন তৎকালীন ত্রিচক্রযানগুলোর সাথে জুড়ে দিয়ে কীভাবে সেগুলোকে আরও শাণিত করা যায়, তা নিয়ে পৃথকভাবে গবেষণা করতে থাকেন কার্ল বেঞ্জ এবং গটলিব ডাইমলার। গবেষণার ফল হিসেবে ১৮৮৫ সালে বেঞ্জ পৃথিবীর সর্বপ্রথম গ্যাসোলিনচালিত ত্রিচক্রযান তৈরি করেন এবং অন্যদিকে ডাইমলার দুই চাকা একটি কাঠের কাঠামোর সাথে ইঞ্জিন জুড়ে দিয়ে তৈরি করে ফেলেন পৃথিবীর সর্বপ্রথম মোটর সাইকেল। নিজেদের সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে বেঞ্জ চার চাকার মোটরগাড়ি নিয়ে কাজ শুরুর করেন এবং ১৮৮৯ সাল থেকে ডাইমলার মোটরসাইকেল বাদ দিয়ে গাড়ি তৈরির দিকে মনোনিবেশ করেন।
১৯০০ সালটি মার্সিডিজ বেঞ্জের ইতিহাসে একটি মাইলফলক অর্জনের বছর। এ বছর ডাইমলার তাদের কোম্পানি থেকে বাজারে নিয়ে আসেন মার্সিডিজ নামের একটি গাড়ি। এই নামকরণটি করা হয় বেঞ্জের কোম্পানির একজন গ্রাহক এবং অংশীদার এমিল জেলিনিকের মেয়ে মার্সিডিজ জেলিনিকের নামানুসারে। তবে ঐ পর্যন্তই। এরপর জার্মানিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। ফলে অধিকাংশ জ্বালানী যুদ্ধ সরঞ্জামেই খরচ হওয়ায় দেশজুড়ে গাড়ি চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানী পাওয়া যাচ্ছিলো না। একইসাথে মোটরগাড়ি তৈরির ওপর বসানো হয় উচ্চ কর। ফলে জার্মানিতে মোটরগাড়ি তৈরি একেবারেই কমে যায়। এর প্রভাব পড়ে গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলোর ওপর, যার মধ্যে বেঞ্জ এবং ডাইমলারের কোম্পানিও ছিল।
যুদ্ধের পর বিশাল মুদ্রাস্ফীতির ফলে এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে গাড়ি বিক্রি একেবারে কমে যায়। ফলে এককভাবে কোম্পানী টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই কার্ল বেঞ্জ অনেক বছরের প্রতিদ্বন্দ্বী ডাইমলারের ডিএমজি কোম্পানির সাথে যৌথভাবে কাজ করার জন্য তাদের কাছে প্রস্তাব পাঠান। শুরুতে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে দুই কোম্পানির পরিস্থিতিই ধীরে ধীরে খারাপের দিকে গেলে একসময় ডাইমলারের প্রতিষ্ঠান বেঞ্জের প্রস্তাবে সাড়া দেয়। ফলে ১৯২৬ সালে দুই কোম্পানি একীভূত হয় এবং যাত্রা শুরু করে ডাইমলার-বেঞ্জ কোম্পানি। এর এক বছর পর প্রথমবারের মতো মার্সিডিজ-বেঞ্জ নামে একটি গাড়ি বাজারে আসে।
১৯৩১ সালে মার্সিডিজ-বেঞ্জ “Mercedes-Benz W-15” নামে একটি গাড়ি বাজারে ছাড়ে। গাড়িটির তুমুল জনপ্রিয়তা কোম্পানিকে ওই মডেলের উন্নত সংস্করণ তৈরিতে উৎসাহিত করে। ১৯৩২ সালে তারা নতুন সংস্করণ বাজারে ছাড়ে এবং তা যথারীতি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর দুই বছর পর বাজারে আসে তাদের W-23 মডেলের নতুন একটি গাড়ি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে যাতে ভ্রমণ করা যায় সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গাড়িটি তৈরি করা হয়। দুই দরজার এই গাড়িটি লিমুজিন এবং সেডান এই দুই সংস্করণে পাওয়া যেত। W-23 তুমুল জনপ্রিয় হয় এবং চারদিকে সাড়া ফেলে দেয়। ফলে ১৯৩৬ সালের মধ্যে মার্সিডিজ-বেঞ্জ জার্মানির বাইরেও বিশাল পরিচিতি লাভ করে এবং W-136 মডেলের নতুন একটি গাড়ির উদ্বোধন করে।
ত্রিশের দশকে মার্সিডিজ বেঞ্জ আরও বেশ কয়েকটি অসাধারণ গাড়ি উপহার দেয়। এর মধ্যে ছিল W-136 Sphon Roadstar এবং W-138 Limousine। তাদের তৈরি 260D মডেলের গাড়িটি ছিল বিশ্বের প্রথম ডিজেলচালিত গাড়ি। তবে চল্লিশের দশকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কোম্পানি গাড়ি উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু হারিয়ে যায়নি মার্সিডিজ বেঞ্জ। তাদের তো তখনো অনেক পথ চলার বাকি! যুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে আবার গাড়ি তৈরি শুরু করে তারা এবং 170V মডেলের একটি গাড়ি বাজারে আনে।
পঞ্চাশের দশকে মার্সিডিজ-বেঞ্জ জার্মানির প্রধান গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। গাড়ি বিক্রির দিক দিয়ে তারা শীর্ষস্থান দখল করে নেয়। এই সময়ের মধ্যেই তারা বাজারে আনে 190 এবং 300sL মডেলের দুটি অসাধারণ গাড়ি। 190 মডেলের গাড়িটি ছিল ডিজেল চালিত এবং গতিদানব। এই গাড়িটি ছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগতির গাড়ি।
ষাটের দশক ছিল গাড়িশিল্পের জন্য এক বৈপ্লবিক বছর। এই দশক থেকেই গাড়ির ডিজাইন নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। ফলে পূর্বের মডেলের গাড়িগুলো সেকেলে হয়ে পড়ে। এসময় অন্যান্য গাড়ি নির্মাতাদের মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল মার্সিডিজ-বেঞ্জকেও। কারণ তাদের পূর্বের মডেলের অনেক জনপ্রিয় গাড়িরও বিক্রি কমে যায় এবং ফলে ওসব গাড়ির উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়। সমস্যা মোকাবেলায় মার্সিডিজ-বেঞ্জ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন নকশার অসাধারণ সব গাড়ি তৈরি করতে থাকে। এই দশকেই তারা W110 মডেলের একটি বিলাসবহুল গাড়ির সাথে বিশ্ববাসীর পরিচয় করিয়ে দেয়, যেটি চার দরজার সেডান এবং স্টেশন ওয়াগন এই দুই সংস্করণে পাওয়া যেত। এই গাড়িটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং কোম্পানিকে ষাটের দশকে গাড়ি শিল্পে পরিবর্তনের হাওয়া লেগে সৃষ্ট ক্রান্তিকাল সাফল্যের সাথে পার করিয়ে দেয়।
সত্তরের দশকে মার্সিডিজ-বেঞ্জ তাদের SL এবং SLC 107 মডেলের দুটি গাড়ি বাজারে নিয়ে আসে। অসাধারণ ডিজাইনের দুই দরজার এই গাড়ি দুটি সবাই খুব পছন্দ করে এবং তাদেরকে কোম্পানির ইতিহাসের অন্যতম সেরা উদ্বোধন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আশির দশক থেকে বিশ্ববাসীর মাঝে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। গাড়ি থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড যে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে তা ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে শুরু করে। ফলে পরিবেশবান্ধব গাড়ি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। গাড়ি নির্মাতারাও সবাই পরিবেশবান্ধব গাড়ি তৈরির ব্যাপারে একমত হন। এক্ষেত্রেও মার্সিডিজ বেঞ্জ ছিল অন্যতম অগ্রপথিক।
১৯৮১ সালে মার্সিডিজ-বেঞ্জ অন্যতম প্রথম কোম্পানী হিসেবে বাজারে নিয়ে আসে তৎকালীন গাড়িগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বায়ু দূষণকারী একটি গাড়ি। এই গাড়িতে ছিলে একটি ক্যাটালাইটিক কনভার্টার যেটি গাড়ির ইঞ্জিন যেসব দূষিত গ্যাস উৎপন্ন করতো তা পরিশোধনের কাজে ব্যবহৃত হতো। এছাড়াও এই দশকে মার্সিডিজ বেঞ্জ তাদের গাড়িগুলোতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে। অয়েল ফিল্টার এবং এয়ার ফিল্টার যোগকরণ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পরিবেশোপযোগী এসব নতুন সংযোজন কোম্পানির সাফল্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৮৭ সালে মার্সিডিজ বেঞ্জ তাদের বিখ্যাত “100 D 631” সিরিজের গাড়ি বাজারে ছাড়ে, যা তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
নব্বইয়ের দশকে মার্সিডিজ বেঞ্জ বাজারে আনে “G-class wagon” এবং “G-class SUV” মডেলের গাড়ি। শক্তপোক্ত এই গাড়িগুলো গাড়িপ্রেমী সবার মন জিতে নেয়। ২০০০ সালের পর থেকে মার্সিডিজ-বেঞ্জ তাদের গাড়িগুলোতে আরও বিভিন্ন ধরনের মেকানিক্যাল পরিবর্তন আনতে থাকে এবং নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে সমন্বয় ঘটাতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে তারা তাদের গাড়িগুলোতে “ব্লুটেক্ সিস্টেমের” ব্যবহার শুরু করে, যার মাধ্যমে মার্সিডিজ বেঞ্জের গাড়িগুলো থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমন অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। পরবর্তী বছরগুলো থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মার্সিডিজ বেঞ্জ প্রতিনিয়ত তাদের গাড়িগুলোকে আরও সমৃদ্ধ করে চলেছে এবং আমাদের সামনে হাজির করছে একের পর এক চোখধাঁধানো বিলাসবহুল সব গাড়ি।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে মার্সিডিজ বেঞ্জ পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় এবং প্রধান গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মডেলের বিলাসবহুল গাড়ি, ট্রাক, কোচ, বাস সহ বিভিন্ন ধরনের মোটরগাড়ি নির্মাণ করে যাচ্ছে। এছাড়াও তাদের আছে একটি অসাধারণ ফর্মুলা ওয়ান টিম, যারা পঞ্চাশের দশকের পর থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্যবার এই প্রতিযোগিতার ট্রফি জিতে চলেছে।
আগামী পর্বে গাড়ি দুনিয়ার আরেক জায়ান্ট ফেরারি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।