১৯৪৭–৪৯ সালের কাশ্মির যুদ্ধের ফলে ‘জম্মু ও কাশ্মির’ দেশীয় রাজ্যটি থেকে ‘আজাদ জম্মু ও কাশ্মির’ অঞ্চলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ১৯৪৭–পরবর্তী সময়ে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাজনৈতিক ইতিহাসকে তিনটি সময়সীমায় বিভক্ত করা যায়।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি মূলত নিখিল জম্মু ও কাশ্মির মুসলিম কনফারেন্সের (সংক্ষেপে ‘মুসলিম কনফারেন্স’) নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার অঞ্চলটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং অঞ্চলটির স্বায়ত্তশাসনের কার্যত অবসান ঘটে। ১৯৭০ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অঞ্চলটি আংশিক স্বায়ত্তশাসন লাভ করেছে, যদিও অঞ্চলটির মূল নিয়ন্ত্রণ এখনো ইসলামাবাদের হাতে।
১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাশ্মির সমস্যায় পাকিস্তান ও ভারতের পাশাপাশি আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরও একটি বিবদমান পক্ষ হিসেবে আলোচনায় জড়িত ছিল, কিন্তু ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝিতে এর অবসান ঘটে, কারণ কোনো রাষ্ট্রই (এমনকি পাকিস্তানও) আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি এবং ভারত একে পাকিস্তানের পুতুল সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করছিল। এরপর থেকে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে এবং আজাদ কাশ্মিরিরা কাশ্মির সমস্যা সম্পর্কে স্বতন্ত্র ভূমিকা পালনের সুযোগ হারায়।
১৯৪৮ সালের শেষদিকে ৩৫,০০০ সৈন্যবিশিষ্ট আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সেনাবাহিনীকে, যেটিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘আজাদ হিন্দ ফৌজে’র নামানুসারে ‘আজাদ ফৌজ’ নামকরণ করা হয়েছিল, বিলুপ্ত করা হয়। এই সৈন্যদের একাংশকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয় এবং বাকিরা সামরিক জীবন থেকে অবসর নিয়ে তাদের নিজ নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তন করে। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের নিজস্ব সেনাবাহিনী বিলুপ্ত হওয়ার ফলে পাকিস্তানের পক্ষে অঞ্চলটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজতর হয়ে ওঠে।
১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ‘কাশ্মির ও উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়’ স্থাপন করে, যেটি রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত। বাহাওয়ালপুর রাজ্যের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মুশতাক আহমেদ গুরমানি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৪৯ সালের ২৮ এপ্রিল পাকিস্তান এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের মধ্যে করাচি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গুরমানি, আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি সর্দার মুহাম্মদ ইব্রাহিম খান এবং মুসলিম কনফারেন্সের সভাপতি চৌধুরী গুলাম আব্বাস এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। করাচি চুক্তি অনুযায়ী আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের প্রশাসন ও অর্থব্যবস্থা কীভাবে পরিচালিত হবে সেটি নির্ধারণ করা হয় এবং অঞ্চলটির প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। তদুপরি, আজাদ জম্মু ও কাশ্মির সরকার ‘উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা’টিকে (বর্তমান গিলগিট–বালতিস্তান’) পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট হস্তান্তর করে। এর মধ্য দিয়ে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের ওপর পাকিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
আজাদ জম্মু ও কাশ্মির এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করার ফলে তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং গিলগিট–বালতিস্তান অঞ্চলটি হারিয়ে ফেলে। চুক্তিটি আপাতদৃষ্টিতে মুজাফফরাবাদের জন্য অলাভজনক মনে হলেও এই চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল।
প্রথমত, আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণের অধিকাংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যোগদান করতে আগ্রহী ছিল। এজন্য অঞ্চলটির ওপর পাকিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের নীতিগত কোনো আপত্তি ছিল না।
দ্বিতীয়ত, আজাদ জম্মু ও কাশ্মির ছিল একটি অত্যন্ত দরিদ্র কৃষিপ্রধান অঞ্চল এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ভিত্তি, দক্ষ জনবল বা আন্তর্জাতিক সমর্থন কোনোটিই তাদের ছিল না।
তৃতীয়ত, আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের প্রয়োজনীয় সামরিক লোকবল ছিল, কিন্তু সেনাবাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করার মতো অর্থ তাদের ছিল না। এমতাবস্থায় ভারতের বিপক্ষে একাকী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল এবং এজন্য পাকিস্তানের সঙ্গে যোগদান তাদের নিরাপত্তার জন্য আবশ্যক ছিল।
চতুর্থত, আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সরকার গিলগিট–বালতিস্তানকে তাদের অংশ হিসেবে দাবি করলেও সেসময় অঞ্চলটির ওপর তাদের প্রকৃত কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মির আর গিলগিট–বালতিস্তানের মধ্যবর্তী সীমান্ত দুরতিক্রম্য হওয়ায় মুজাফফরাবাদ থেকে ঐ অঞ্চলের শাসন কার্য পরিচালনার পরিবর্তে রাওয়ালপিন্ডি বা পেশোয়ার থেকে অঞ্চলটি শাসন করা প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকতর যুক্তিযুক্ত ছিল।
সর্বোপরি, ১৯৪৭ সাল থেকেই আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে পাকিস্তানি সৈন্য উপস্থিত ছিল এবং এর ফলে পাকিস্তানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করার মতো সামর্থ্য মুজাফফরাবাদের ছিল না (অবশ্য তাদের এরকম কোনো ইচ্ছেও ছিল না)। এসব কারণ বিবেচনায় রেখে মুজাফফরাবাদ করাচি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।
করাচি চুক্তি–পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান অঞ্চলটির ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে পাকিস্তানের ‘কাশ্মির বিষয়ক’ মন্ত্রণালয় অঞ্চলটির রাজনীতিবিদদের মধ্যে দ্বন্দ্বকে কাজে লাগায় এবং ফলে অঞ্চলটিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
এসময় আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে মুসলিম কনফারেন্স ছিল একমাত্র প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল। দলটির বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল এবং দলটির সদস্যদের মধ্যে আদর্শগত কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে মোট ৫ জন ব্যক্তি মোট ৭ মেয়াদে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন এবং তাদের প্রত্যেককেই মুসলিম কনফারেন্সের কার্যকরী কমিটি মনোনীত করেছিল। অর্থাৎ আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে মুসলিম কনফারেন্সের রাজনৈতিক আধিপত্য ছিল একচ্ছত্র।
কিন্তু দলটির নেতাদের মধ্যে, বিশেষত দলপ্রধান গুলাম আব্বাস ও আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের প্রথম রাষ্ট্রপতি সর্দার ইব্রাহিমের মধ্যে, তীব্র ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং এর ফলশ্রুতিতে ১৯৫০–১৯৫১ এবং ১৯৫৫ সালে পুন্চ অঞ্চলে বিদ্রোহও দেখা দেয়, যেগুলো পাকিস্তানি সৈন্যরা কঠোর হাতে দমন করে। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার ও আমলাতন্ত্র কাজে লাগায় এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবহার করে।
উল্লেখ, এসময়, বিশেষ করে ১৯৫১ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের হত্যাকাণ্ডের পরে, পুরো পাকিস্তান জুড়েই রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ধর্মীয় সংঘাত (বিশেষত আহমদিয়া সম্প্রদায় সংক্রান্ত), প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতাবাদ (বালুচিস্তানে বিদ্রোহ, পূর্ববঙ্গের নির্বাচনে মুসলিম লিগের পরাজয়, ‘এক ইউনিট’ ব্যবস্থার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র প্রদেশগুলোর অনীহা) এবং বৈদেশিক সমস্যা (মার্কিন সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্তি এবং ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্ব) পাকিস্তানকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এজন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরকে পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগ্রহী ছিল। পাকিস্তানি কাশ্মির বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করে এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯৪৭–পরবর্তী সময়ে সমগ্র জম্মু ও কাশ্মিরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও সেটির সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসতে থাকে। ১৯৫১ সালে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, মুসলিম কনফারেন্সের নেতা গুলাম আব্বাস এবং ভারত–নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের নেতা শেখ আব্দুল্লাহ গোপনে সমঝোতায় এসে দুই কাশ্মিরকে একত্রিত করার চেষ্টা করছেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এরকম গুজব শোনা যেতে থাকে, কিন্তু এগুলো কখনোই সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। ১৯৫৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত–নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের গণপরিষদ ১৯৪৭ সালে রাজা হরি সিং–এর ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ‘অন্তর্ভুক্তি চুক্তি’কে বৈধতা দান করে এবং ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর থেকেই কার্যত সমগ্র কাশ্মিরে গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার পর রুদ্ধ হয়ে যায়।
১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা দখল করে নেন এবং সমগ্র পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চাপিয়ে দেন। এসময় আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরেও ঘন ঘন সরকারের পরিবর্তন বন্ধ হয়। ১৯৫৯ সালের ১ মে আইয়ুব খান খুরশিদ হাসান খুরশিদকে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন। খুরশিদ ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। আইয়ুব খান এবং ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে আইয়ুবের প্রতিদ্বন্দ্বী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ উভয়ের সঙ্গেই খুরশিদের সুসম্পর্ক ছিল, ফলে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে তার ক্ষমতার নিজস্ব ভিত্তি ছিল।
১৯৬১ সালে আইয়ুবের প্রবর্তিত ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যবস্থা অনুযায়ী আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং খুরশিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি স্বাধীনচেতা ছিলেন এবং কাশ্মির বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আমলাদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতার এই দ্বন্দ্বে খুরশিদ পরাজিত হন এবং ১৯৬৪ সালের ৫ আগস্ট তাকে অপসারণ করে খান আব্দুল হামিদ খানকে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করা হয়।
এই পর্যায়ে পাকিস্তানি আমলারা আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন পুরোপুরি কেড়ে নেয় এবং ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালের ‘আজাদ জম্মু ও কাশ্মির সরকার আইন’দ্বয়ের মাধ্যমে অঞ্চলটির সরকারকে প্রায় ক্ষমতাহীন করে ফেলে। এসময় আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সরকার প্রকৃতপক্ষে একটি ‘পৌরসভা কমিটি’তে পরিণত হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদরা বিবেচনা করেন।
এদিকে ১৯৬৪ সালের মে মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ভারত–নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের নেতা শেখ আব্দুল্লাহকে কাশ্মির সমস্যা সমাধান সম্পর্কে আলোচনার জন্য পাকিস্তানে প্রেরণ করেন। আব্দুল্লাহ পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি মীরওয়াইজ ইউসুফ শাহ ও মুসলিম কনফারেন্সের নেতা গুলাম আব্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু ২৭ মে নেহরু মৃত্যুবরণ করেন এবং আব্দুল্লাহ তার সফর বাতিল করে ফিরে যেতে বাধ্য হন। ফলে আলোচনা ভেঙে যায়।
১৯৬২ সালের চীন–ভারত যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয় ও ১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যু–পরবর্তী ভারতীয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে পাকিস্তান ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির দখল করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯৬৫ সালের আগস্টে পাকিস্তানি সৈন্যরা কাশ্মিরি বিদ্রোহীদের ছদ্মবেশে ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে অনুপ্রবেশ করে। কাশ্মিরকে ‘মুক্ত’ করার জন্য পাকিস্তান এই যুদ্ধ শুরু করলেও আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সরকারকে যুদ্ধ শুরুর আগে এ ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় সৈন্যরা আজাদ জম্মু ও কাশ্মির আক্রমণ করে এবং ৬৪০ বর্গ কি.মি. অঞ্চল দখল করে নেয়। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয় এবং ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারির ‘তাসখন্দ ঘোষণা’ অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের ভূমি থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পাকিস্তান জুড়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। স্বভাবতই আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরেও এর প্রভাব পড়ে। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল – ‘মুসলিম কনফারেন্স’, ‘জম্মু ও কাশ্মির স্বাধীনতা লীগ’ এবং ‘আজাদ জম্মু ও কাশ্মির মুসলিম কনফারেন্স’ (সংক্ষেপে ‘আজাদ মুসলিম কনফারেন্স’)– ১৯৬৮ সালে প্রণীত অজনপ্রিয় ‘আজাদ জম্মু ও কাশ্মির সরকার আইন’ বাতিল এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে প্রকৃত গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬৮ সালে গুলাম আব্বাসের মৃত্যুর পর খান মুহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম খান মুসলিম কনফারেন্সের নেতা নিযুক্ত হন। অন্যদিকে, সর্দার ইব্রাহিম ছিলেন আজাদ মুসলিম কনফারেন্সের নেতা।
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং বেআইনিভাবে জেনারেল আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, যদিও ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী তিনি জাতীয় পরিষদের স্পিকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য ছিলেন। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে গণতন্ত্রায়নের প্রতিশ্রুতি দেন এবং ১৯৬৯ সালের ৭ অক্টোবর আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ খান পদত্যাগ করেন। তার স্থলে আব্দুল রহমান খানকে নিযুক্ত করা হয়।
১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান ‘আজাদ জম্মু ও কাশ্মির সরকার আইন ১৯৭০’ প্রণয়ন করেন এবং এটি অঞ্চলটির প্রথম সংবিধান হিসেবে কাজ করে। এই সংবিধান অনুযায়ী আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা চালু হয় এবং একটি আইনসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রা ব্যতীত অন্য সকল বিষয়ে আজাদ জম্মু ও কাশ্মির সরকার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। এর ফলে পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের কাশ্মির বিষয়ক মন্ত্রণালয় এতদিন আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে যে স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব চালিয়ে আসছিল তার অবসান ঘটে।
১৯৭০ সালের অক্টোবরে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে প্রথম বারের মতো সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ৩১ অক্টোবর আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম কনফারেন্সের নেতা সর্দার কাইয়ুম আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৫ সালের ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। সর্দার কাইয়ুম ১৯৭০–এর সংবিধানের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরকে পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি অঙ্গীভূত করে নেয়া উচিত ছিল বলে মত প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, এটি ছিল আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে অনুষ্ঠিত একমাত্র রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, যেটিতে সরাসরি জনগণের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিল।
এদিকে ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানে পশ্চিমাংশ ও পূর্বাংশের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে এবং পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা চালালে সেখানে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ভূরাজনৈতিক কারণে ভারত ‘বাংলাদেশ’কে সহায়তা করতে থাকে। নভেম্বর–ডিসেম্বরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয় এবং পাকিস্তান শোচনীয়ভাবে এই যুদ্ধে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক–তৃতীয়াংশ, নৌবাহিনীর অর্ধেক এবং বিমানবাহিনীর এক–চতুর্থাংশ ধ্বংস হয়ে যায় এবং পাকিস্তান তার পূর্বাংশ হারায়। যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় সৈন্যরা আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের কয়েক হাজার বর্গ কি.মি. ভূমি দখল করে নিয়েছিল, কিন্তু ১৯৭২ সালের ২ জুলাই স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি অনুযায়ী ভারত অঞ্চলটি পাকিস্তানকে ফিরিয়ে দেয়।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের ফলে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের জন্য নতুন কিছু বাস্তবতা দেখা দেয়।
প্রথমত, যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে পাকিস্তানে সামরিক সরকারের পতন ঘটে এবং তদস্থলে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে সরকারি আমলা ও সামরিক কর্মকর্তাদের আধিপত্য লোপ পায় এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাধান্য লাভ করে।
দ্বিতীয়ত, ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন যে, সিমলা চুক্তিতে ভুট্টো ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কাশ্মির সমস্যার ‘প্রাদেশিকীকরণ’ ও ‘দ্বিপাক্ষিকীকরণ’ সম্পর্কে একটি অলিখিত সমঝোতায় পৌঁছান। এর ফলে পাকিস্তান আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরকে ধীরে ধীরে পাকিস্তানের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে।
তৃতীয়ত, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের ফলে পাকিস্তান এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মির অনুধাবনের করতে পারে যে, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতার ক্রমবিন্যাসে ভারত শীর্ষে এবং এজন্য সামরিকভাবে ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরকে দখল করে নেয়া পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। এর ফলে আজাদ কাশ্মিরিরাও পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি অঙ্গীভূত হয়ে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
১৯৭১ সালে যুদ্ধের পর পাকিস্তানে সামরিক সরকারের পতন ঘটে এবং তদস্থলে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ভুট্টো ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং ১৯৭৩ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, ১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি এবং ১৯৭৩ সালে বালুচিস্তানে বিদ্রোহ আরম্ভ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ইসলামাবাদ আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের ওপর কার্যকরী ও আইনগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করে, যদিও তখন আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের জনসাধারণের প্রায় সম্পূর্ণ অংশই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল।
১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। এই সংবিধান অনুযায়ী, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বালুচিস্তান, কেন্দ্রশাসিত উপজাতীয় অঞ্চল ও ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং ‘যেসব রাষ্ট্র বা ভূমি অন্তর্ভুক্তি বা অন্য কোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বা হতে পারে’– এদেরকে নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত। শেষোক্ত শব্দগুচ্ছটির দ্বারা আজাদ জম্মু ও কাশ্মির এবং গিলগিট–বালতিস্তানকে নির্দেশ করা হয়। সংবিধানে এই ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে পাকিস্তান আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরকে আইনগতভাবে (যদিও পরোক্ষ কায়দায়) পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে।
এতদিন পর্যন্ত আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাজনীতিতে কেবল স্থানীয় দলগুলোই অংশ নিতে পারত। পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে সক্রিয় দলগুলো এই অঞ্চলের রাজনীতিতে অংশ নিতো না। ভুট্টো এই প্রথা ভেঙে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে পাকিস্তানের জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন এবং অঞ্চলটিতে তার নিজ দলের একটি শাখা ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি – আজাদ কাশ্মির’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার আরেকটি প্রচেষ্টা।
১৯৭৪ সালে ইসলামাবাদ ‘আজাদ জম্মু ও কাশ্মির অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান আইন ১৯৭৪’ প্রণয়ন করে। এসময় আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি ছিলেন সর্দার কাইয়ুম এবং তার সঙ্গে ভুট্টোর সম্পর্ক ভালো ছিল না, ফলে এই আইনটি নিয়ে ইসলামাবাদ ও মুজাফফরাবাদের মধ্যে প্রলম্বিত আলোচনা হয়। অবশেষে ১৯৭৪ সালের ২৪ আগস্ট আজাদ জম্মু ও কাশ্মির আইনসভা এটিকে অনুমোদন দান করে। এর ফলে এটি আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সংবিধানে পরিণত হয়। এই সংবিধান অনুযায়ী অঞ্চলটিতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রধানমন্ত্রী পদটির সৃষ্টি করা হয়। আজাদ জম্মু ও কাশ্মির আইনসভা অঞ্চলটির সংসদের নিম্নকক্ষ হিসেবে গণ্য হয় এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মির পরিষদ (Azad Jammu and Kashmir Council) উচ্চকক্ষ হিসেবে গণ্য হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী এই পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৭৪ সালের সংবিধান আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের শাসনব্যবস্থাকে স্থিতিশীলতা দান করে এবং পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের কাশ্মির বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করে। কিন্তু একই সঙ্গে এই সংবিধানের ৫৩ ও ৫৬ নং ধারা অনুযায়ী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছেমতো আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করার অধিকার লাভ করে এবং অঞ্চলটিতে সক্রিয় সকল রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের প্রতি আনুষ্ঠানিক আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়।
এই আনুষ্ঠানিকতা প্রবর্তনের কারণ ছিল স্বাধীনচেতা কাশ্মিরি দলগুলোর প্রতি ইসলামাবাদের অবিশ্বাস। যেমন: কাশ্মির ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, যে দলটি ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে একটি ভারতীয় যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করেছিল, এই দলটির ওপর ইসলামাবাদের তেমন কোনো প্রভাব ছিল না। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেন এরকম স্বাধীনচেতা মনোভাব না দেখা দেয় সেজন্যই ইসলামাবাদ এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
১৯৭৫ সালের ৫ জুন আজাদ মুসলিম কনফারেন্সের নেতা সর্দার ইব্রাহিম আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। তার সঙ্গে ভুট্টোর ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু পাকিস্তানে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হক একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন এবং ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
জিয়াউল হক ক্ষমতা দখলের পরপরই আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান এবং ১৯৭৭ সালের ২৭ জুলাই আজাদ কাশ্মিরি নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে মুসলিম কনফারেন্সের নেতা সর্দার কাইয়ুম, আজাদ মুসলিম কনফারেন্সের নেতা চৌধুরী নূর হুসেইন এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি – আজাদ কাশ্মিরের নেতা পীর আলী জান শাহ অংশ নেন এবং জিয়ার চাপের মুখে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এই চুক্তি অনুযায়ী আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সংবিধানে পরিবর্তন এনে জিয়াকে আজাদ জম্মু ও কাশ্মির পরিষদের সভাপতি নিযুক্ত করা হয় এবং ৬ আগস্ট জিয়ার নির্দেশে সর্দার ইব্রাহিম অঞ্চলটিতে সামরিক আইন জারি করেন। একইসঙ্গে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী পদটি ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত খালি রাখা হয়।
শীঘ্রই জিয়া সর্দার ইব্রাহিম ছাড়া আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সরকারের সকল সদস্যকে পদচ্যুত করেন এবং তাদের স্থানে সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করেন। ১৯৭৮ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি সর্দার ইব্রাহিমকেও বরখাস্ত করেন এবং তার স্থলে মেজর জেনারেল মুহাম্মদ হায়াত খানকে নিযুক্ত করা হয়। সর্দার ইব্রাহিম তার পদচ্যুতিকে বেআইনি দাবি করে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের হাইকোর্টে আবেদন করেন, কিন্তু জিয়া বেঁচে থাকতে এই মামলার রায় প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯০ সালে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সুপ্রিম কোর্ট ইব্রাহিমের পদচ্যুতিকে বেআইনি হিসেবে ঘোষণা করে।
এদিকে হায়াত খান আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন না। আজাদ কাশ্মিরিরা তার নিযুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং অবশেষে আন্দোলনের মুখে ১৯৮৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হায়াত খানকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং তার স্থলে মেজর জেনারেল আব্দুল রহমান খানকে নিযুক্ত করা হয়, যিনি ইতোপূর্বে একবার অঞ্চলটির রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৫০–এর দশকে পুন্চ অঞ্চলে গোলযোগের পর এটিই ছিল আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের একমাত্র রাজনৈতিক গোলযোগ।
১৯৭৭ সালের আগস্টে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে সামরিক আইন জারির পর রাষ্ট্রপতি জিয়া একই বছরের অক্টোবরে অঞ্চলটিতে নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি এবং প্রায় ৮ বছর পর ১৯৮৫ সালের জুনে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জিয়ার সমর্থক মুসলিম কনফারেন্স জয়লাভ করে। সর্দার কাইয়ুম আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি এবং সর্দার সিকান্দার হায়াত খান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট এক বিমান দুর্ঘটনায় জিয়াউল হক নিহত হন এবং এরপর আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। জিয়া আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সংবিধানে যে পরিবর্তন এনেছিলেন সেটিকে রদ করা হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে গণতন্ত্র বজায় ছিল, যদিও এই সময়টি ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতায় পরিপূর্ণ এবং এই সময়ে পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
এই সময়ে ইসলামাবাদ একটিমাত্র ব্যতিক্রম (১৯৯১ সালের ৫ জুলাই আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী মমতাজ হুসেইন রাঠোরকে বরখাস্ত করা) ছাড়া আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে এবং এর পরিবর্তে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে অঞ্চলটির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। এসময় পাকিস্তান মুসলিম লিগও অঞ্চলটিতে একটি শাখা প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৯৯ সালে ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের কারগিল অঞ্চলে পাকিস্তানি সৈন্য অনুপ্রবেশের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কারগিল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের পরপরই ১২ অক্টোবর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন। কিন্তু জিয়াউল হকের মতো তিনি আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেননি। ফলে অঞ্চলটির রাজনীতিতে প্রচলিত ধারার পরিবর্তন ঘটেনি।
২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে ৭.৬ মাত্রার ভয়াবহ একটি ভূমিকম্প হয়। এর ফলে অঞ্চলটিতে প্রায় ১,০০,০০০ মানুষ নিহত ও প্রায় ১,৩৮,০০০ মানুষ আহত হয়, এবং প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এসময় পাকিস্তানের প্রতি সহায়তার হাত প্রসারিত করে এবং পাকিস্তান বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে প্রায় ৫৪০ কোটি মার্কিন ডলার (বা ৪০,০০০ কোটি পাকিস্তানি রুপি) সহায়তা লাভ করে। উল্লেখ্য, এসময় ভারতও আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে মানবিক সহায়তা প্রদান করে এবং ভারতীয় সহায়তা পৌঁছানোর জন্য নিয়ন্ত্রণ রেখার (Line of Control) ৫টি ক্রসিং পয়েন্ট খুলে দেয়া হয়েছিল।
২০১৬ সাল থেকে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। অঞ্চলটির বর্তমান রাষ্ট্রপতি মাসুদ খান এবং প্রধানমন্ত্রী রাজা ফারুক হায়দার খান। অবশ্য আগামী বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অঞ্চলটির রাজনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটতে পারে সেটি অনিশ্চিত।
বস্তুত, ১৯৭৪ সালের পর থেকে আজাদ জম্মু ও কাশ্মির ‘অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানে’র মাধ্যমে শাসিত হয়ে আসছে এবং প্রায় এক যুগ ধরে সামরিক শাসনাধীনে থাকার পর ১৯৯০–এর দশক থেকে অঞ্চলটিতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা মোটামুটিভাবে বজায় রয়েছে। কিন্তু অঞ্চলটির অর্থনীতির এখনো আধুনিকায়ন ঘটেনি এবং অঞ্চলটি সম্পর্কে বহির্বিশ্বের মানুষ এখন পর্যন্ত খুব কমই জানে। ফলে আজাদ জম্মু ও কাশ্মির খুব কমই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর শীর্ষ খবর হিসেবে আবির্ভূত হয়।