সম্প্রতি একটি খবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাবিকদেরকে বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখা গেছে। খবরটি হলো, ব্রেড অ্যান্ড ওয়াটার শাস্তি রদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউএস নেভি। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আর কোনো নাবিকের উপরই এই শাস্তি প্রয়োগ করতে পারবেন না জাহাজের কাপ্তানেরা।
কী এই ব্রেড অ্যান্ড ওয়াটার শাস্তি?
যদি জাহাজের কোনো নাবিক অপরাধ করে বা নিয়ম লঙ্ঘন করেন, তবে জাহাজের সর্বেসর্বা হিসেবে কাপ্তানের রয়েছে তাকে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা। নাবিককে প্রদত্ত শাস্তিসমূহের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি উপায় ছিল ব্রেড অ্যান্ড ওয়াটার শাস্তি। এর অর্থ হলো অপরাধী নাবিককে জাহাজের বন্দিশালায় আটক করে রাখা হবে এবং খুবই সীমিত পরিমাণে রুটি ও পানি ছাড়া আর কিছুই তাকে খেতে দেয়া হবে না। আধুনিক সময়ে এই শাস্তির মেয়াদ মাত্র তিনদিন হলেও, একসময় নাবিকদেরকে এমনকি ছোটখাট অনেক অপরাধের শাস্তি হিসেবেও টানা এক মাস এই শাস্তি ভোগ করতে হতো। সেই সময় নাবিকদেরকে কেবল বন্দিশালায় বন্দি করেই রাখা হতো না, পরিয়ে রাখা হতো শেকলও।
ইতিহাস
১৭ শতকের দিকে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভিতে এই শাস্তি পদ্ধতির প্রচলন ঘটে। পদ্ধতিটি এতই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, ইউএস নেভিও তাদের অনুকরণে এই শাস্তি পদ্ধতি প্রয়োগ করতে থাকে। তবে শাস্তিটি অমানবিক হওয়ায়, সেই ১৮৯১ সালেই রয়্যাল নেভি এটি বাতিল করে দেয়। কিন্তু সে পথ মাড়ায়নি ইউএস নেভি। তারা এই শাস্তি অব্যাহত রাখে। কেবল ১৯০৯ সালে শাস্তির মেয়াদ ৩০ দিন থেকে সাত দিনে নামিয়ে আনা হয়, এবং শেকল পরানোর রীতিটি মুছে ফেলা হয়। ১৯৮০ সাল নাগাদ নতুন একটি নিয়ম চালু হয়: কোনো নাবিককে এই শাস্তি প্রদানের আগে তার শরীরের মেডিকেল টেস্ট করে নেয়া হবে।
যে কারণে বাতিল হলো
অতীতে এই শাস্তি পদ্ধতিটি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, যখন ২০১৫-১৬ সময়কালের মধ্যে অ্যাডাম এম অ্যায়কক নামের একজন কাপ্তান তার জাহাজ ইউএসএস শিলোহের বেশ কয়েকজন নাবিকের উপর খুবই সামান্য সব কারণে উপর্যুপরি এই শাস্তির প্রয়োগ করতে থাকেন। ঘটনাটি এতটাই উত্তাপ ছড়িয়েছিল যে, পরবর্তীকালে ঐ জাহাজটিকে সবাই ডাকতে শুরু করে ইউএসএস ব্রেড অ্যান্ড ওয়াটার নামে।
শাস্তিটি খুবই অমানবিক হওয়ায় তখন থেকেই সর্বমহলে এটি পুরোপুরি রদের দাবি জোরালো হতে থাকে। ২০১৬ সালের শেষ দিকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিফর্ম কোড অব মিলিটারি জাস্টিস’-এ বেশ কিছু বড়সড় পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখা হয়, যাতে স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সেখানে উত্থাপিত প্রস্তাবসমূহের অন্যতম ছিল ব্রেড অ্যান্ড ওয়াটার শাস্তি বাতিল করা। ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবনাগুলোকে আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর নির্দেশ দেন। তারই সূত্র ধরে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হতে চলেছে ব্রেড অ্যান্ড ওয়াটার শাস্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত।
আরও কিছু ভয়াবহ শাস্তি
আজকের দিনে অনেকের কাছেই ব্রেড অ্যান্ড ওয়াটার শাস্তিটিকে খুবই বর্বর ও অমানবিক মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু জেনে অবাক হবেন যে ১৭ ও ১৮ শতকের দিকে এই শাস্তিটিই ছিল সবচেয়ে কম ভয়াবহ। এর চেয়েও অনেক বড় বড় শাস্তি দেয়া হতো নাবিকদেরকে, যার ফলস্বরূপ অনেক নাবিককে অকালে প্রাণও হারাতে হতো। এখন আপনাদেরকে জানানো হবে সেরকমই কিছু শাস্তির ব্যাপারে।
মাস্ট-হেডিং
খুবই সাধারণ একটি শাস্তি ছিল এটি। এই শাস্তি প্রদানও করা হতো একেবারেই ছোটখাট অপরাধে। এক্ষেত্রে নাবিককে জাহাজের মাস্তুল বেয়ে উপরে উঠে যেতে হতো এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়ার মাঝেই অবস্থান করতে হতো। এদিকে মাস্তুলের মাথায় বসে থাকা অস্বস্তিকর তো ছিলই, তার উপর আবার বাতাস- সব মিলিয়ে দোষী নাবিকের কষ্টের কোনো সীমা থাকত না। এ যেন ছিল অনেকটা লঘু পাপে গুরু দন্ডের সামিল। তবে স্বাভাবিকভাবে প্রাথমিক স্তরের এই শাস্তিকে সবাই হালকা চালের, শিক্ষণীয় একটি শাস্তি বলেই জ্ঞান করতেন, যার মাধ্যমে নাবিকেরা উপলব্ধি করতে পারতেন এর চেয়ে বড় কোনো অপরাধ করলে তার শাস্তি আরও কতটা ভয়াবহ হতে পারে!
কেনিং
মাস্ট-হেডিংয়ের পরবর্তী ধাপের শাস্তি ছিল কেনিং, অর্থাৎ বেত্রাঘাত। এক্ষেত্রে শক্ত বেত দিয়ে দোষী অভিযুক্ত নাবিকের পশ্চাদ্দেশে প্রবল বাড়ি মারতে থাকা হতো। মূলত ঊর্ধ্বতনদের সাথে অসদাচরণের দায়ে নাবিকদেরকে এ ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হতো। এছাড়া জাহাজের কম বয়সীদের শিক্ষা দেয়ারও একটি মোক্ষম উপায় ছিল এই শাস্তি।
উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে ১২ বছরের বালকরাও ব্রিটিশ রয়্যাল নেভিতে যোগ দিতে পারতো। তাদের উচিত সাজা দিতে বেত্রাঘাতের মতো ভালো উপায় আর দ্বিতীয়টি ছিল না। মোটা, সাড়ে ৩ ফুট লম্বা বেত দিয়ে একেকজন অভিযুক্তকে ছয় থেকে বারোটি আঘাত করা হতো। অনেক ক্ষেত্রেই শাস্তি প্রদানের সময়ে অভিযুক্তের পেছনের কাপড় খুলে ফেলা হতো। মাঝে মাঝে নিরালায় নিয়ে গিয়ে শাস্তি দেয়া হলেও, বেশিরভাগ সময়ে সবার সামনেই এই শাস্তি কার্যকর করা হতো।
বার্চিং
খুব সামান্য সামান্য কারণেও একজন বালক নাবিককে বেত্রাঘাত করা হতো। যেমন সে যদি কোনোদিন সকালে রোলকলের সময় উপস্থিত না থাকতো। কিন্তু এরচেয়ে গুরুতর অপরাধের দায়ে তাকে বার্চিংয়ের শিকার হতে হতো। এক্ষেত্রে ১২ থেকে ২৪টি তক্তা একসাথে বেঁধে, তা দিয়ে মারা হতো অপরাধীকে। মারলে যাতে ব্যথা বেশি লাগে, সে উদ্দেশ্যে শাস্তি প্রদানের পূর্বে তক্তাগুলোকে ভিনেগার বা লবণ পানিতে ভালো করে ভিজিয়ে নিয়ে তারপর একসাথে বাঁধা হতো।
ফ্লগিং
এতক্ষণ তো কেনিং ও বার্চিংয়ের কথা জেনেছেন, কিন্তু ভয়াবহতার মাত্রায় ফ্লগিংয়ের কাছে তারা নেহাতই শিশু। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছোটখাট থেকে বড়সড় অপরাধ, সকল ক্ষেত্রেই প্রাপ্তবয়স্ক নাবিকদের শাস্তি দিতে এই পন্থা অবলম্বন করা হতো। এক্ষেত্রে অভিযুক্তের দুই হাত উপরে তুলে জাহাজের মাস্তুলের সাথে বেঁধে নিয়ে, ক্যাট ও’ নাইন টেইল (একাধিক পুচ্ছবিশিষ্ট বিশেষ চাবুক, যা শাস্তি প্রদানের উদ্দেশেই তৈরী করা) দিয়ে তাকে মারা হতো। এই চাবুকের আঘাত যেখানে লাগতো, শরীরের সেই জায়গার মাংসে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হতো এবং প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হতো।
অনেকে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে বা রক্তক্ষরণের ফলে মারাও যেত। আর যারা ব্যথা সহ্য করে টিকে থাকত, তাদেরও ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকত। ইনফেকশন যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে শাস্তিপ্রদানকারী ক্ষতস্থানে লবণ ঘষে দিত, যার ফলে ব্যথা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যেত। ১৮৬২ সালে মার্কিন কংগ্রেস এই শাস্তিটি বাতিল করে।
কিলহলিং
সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই শাস্তির প্রচলন ছিল, যদিও এটির প্রয়োগ ছিল খুবই বিরল। এক্ষেত্রে শুরুতে একজন নাবিককে জাহাজের ডেকে নগ্নভাবে শুইয়ে দিয়ে তাকে দুইটি দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হতো। এরপর জাহাজের একদিক থেকে তাকে পানিতে ফেলে দিয়ে, অপরদিকের দড়ি ধরে টানা হতো, যাতে সে জাহাজের নিচ থেকে অপরপাশ প্রদক্ষিণ করে উঠে আসে। ফ্লগিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ ছিল এই শাস্তি, যাতে মৃত্যুর সম্ভাবনাও বেড়ে যেত কয়েকগুণ।
ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে এই শাস্তির প্রচলন করেনি এবং ১৭২০ সালে এটিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি এই শাস্তির প্রয়োগ। দীর্ঘকাল সব নিয়ম অগ্রাহ্য করে, অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ কষ্ট দিয়ে মারতে ব্যবহার করা হয়েছে এই পদ্ধতি।
হ্যাঙ্গিং
ফ্লগিং ও কিলহলিংয়েও অপরাধীর মৃত্যুর বেশ ভালোরকম সম্ভাবনা থাকত বটে, কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়ার সুযোগও ছিল। কিন্তু অপরাধী যেন কোনোভাবেই বেঁচে না যায়, তা শতভাগ নিশ্চিত করতে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হতো। জাহাজের অন্য সব নাবিকরা মিলে অভিযুক্তের হাত-পা ভালো করে বাঁধতো এবং তার গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে দিত। ফাঁসের সাথে আরেকটি দড়ি বেঁধে সেটি মাস্তুলের উপর দিয়ে নিয়ে আসা হতো। তারপর সেটি ধরে টানতে থাকতো। অভিযুক্ত ব্যক্তি শূন্যে ভাসমান অবস্থায় গলায় পুরোপুরি ফাঁস আটকে যখন প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করতো, তখন তাকে ছেড়ে দেয়া হতো এবং একপর্যায়ে সে নিঃশ্বাস আটকে মারা যেত।
ওয়াকিং দ্য প্ল্যাংক
এটিই সম্ভবত জলদস্যুদের নিয়ে নির্মিত ছবিগুলোতে এবং একই ধারার উপন্যাসগুলোতে মৃত্যুদন্ডের সবচেয়ে পরিচিত পদ্ধতি। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত নাবিকের চোখ বেঁধে দেয়া হতো, দুই হাতও পেছনে এনে বেঁধে ফেলা হতো। এরপর তাকে একটি তক্তার উপর দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করা হতো, যার শেষ মাথা জাহাজের বাইরে পানির দিকে। ঐ তক্তার উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অভিযুক্ত নাবিক পানিতে পড়ে যেতো। আর হাত বাঁধা থাকায় সাঁতরাতে না পেরে ডুবে মারা যেতো। তবে ছবি ও বইতে নাটকীয়তা সৃষ্টির জন্য এই ধরনের মৃত্যুদন্ডের উল্লেখ থাকলেও, বাস্তবে কখনও কাউকে এমন মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে বলে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/