বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি স্ট্যান্ডার্ড সামরিক বাহিনীরই নিজস্ব স্পেশাল ফোর্স রয়েছে। স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের সাধারণভাবে ‘কমান্ডো’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কমান্ডোরা অপ্রচলিত যুদ্ধের (unconventional warfare) বিভিন্ন শাখায় পারদর্শী হয়ে থাকে, এবং এরকমই একটি শাখা হচ্ছে জিম্মি উদ্ধার (hostage rescue)। নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধার বা দাবি আদায়ের জন্য বেসামরিক জনসাধারণকে জিম্মি করা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের একটি অতি প্রচলিত কৌশল, এবং এরকম পরিস্থিতিতে জিম্মিদের উদ্ধারের জন্য কমান্ডোদের ব্যবহার করা হয়। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফবিআই’–এর ‘হোস্টেজ রেস্কিউ টিম’, ব্রিটিশ ‘স্পেশাল এয়ার সার্ভিস’, সোভিয়েত/রুশ ‘আলফা গ্রুপ/ভিমপেল’, ইসরায়েলি ‘সায়েরেৎ মাৎকাল’ – সকলেরই জিম্মি উদ্ধারের জন্য সফল কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করার নজির রয়েছে।
কিন্তু জিম্মি উদ্ধারের জন্য কমান্ডো অভিযান ব্যর্থ হওয়ারও অনেক নজির রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮০ সালে ইরানের তেহরানে জিম্মি মার্কিন কূটনীতিকদের উদ্ধারের জন্য মার্কিন কমান্ডোদের অভিযান এবং ১৯৯৫ সালে রাশিয়ার বুদিয়োন্নভস্কের একটি হাসপাতালে জিম্মি বেসামরিক রুশদের উদ্ধারের জন্য রুশ কমান্ডোদের অভিযান শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। কিন্তু কোনো কমান্ডো বাহিনী জিম্মি উদ্ধারের জন্য অপর কোনো রাষ্ট্রে অনুপ্রবেশ করেছে এবং এরপর জিম্মি উদ্ধারের চেষ্টা না করে ঐ রাষ্ট্রের সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করে পর্যুদস্ত হয়েছে, এরকম ঘটনা ইতিহাসে বিরল। কিন্তু ঠিক এই ঘটনাটিই ১৯৭৮ সালে ঘটেছিল মিসর আর সাইপ্রাসের মধ্যে।
১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোশিয়ায় একটি এশীয়–আফ্রিকান সম্মেলন চলছিল, এবং এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন। তাদের অনেকেই নিকোশিয়ার হিলটন হোটেলে অবস্থান করছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন মিসরীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী এবং আধা–সরকারি ‘আল–আব্রাম’ পত্রিকার সম্পাদক ইউসুফ এল সিবাই। ১৮ ফেব্রুয়ারি জায়িদ আল–আলী এবং রিয়াদ সামির আল–আহাদ নামক দুজন ব্যক্তি তাদের পাসপোর্ট দেখিয়ে হিলটন হোটেলে প্রবেশ করে। তারা নিজেদেরকে যথাক্রমে কুয়েতি ও ইরাকি নাগরিক হিসেবে দাবি করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রদত্ত পরিচয় ছিল মিথ্যা।
তারা হোটেলের লবিতে ইউসুফ এল সিবাইকে গুলি করে হত্যা করে, এবং এরপর এশীয়–আফ্রিকান সম্মেলনে যোগ দিতে আসা প্রতিনিধিদের জিম্মি করে। জিম্মিকারীরা নিজেদেরকে ফিলিস্তিনি হিসেবে দাবি করে, এবং তাদের দাবি মেনে নেওয়া না হলে জিম্মিদেরকে খুন করে ফেলা হবে বলে সাইপ্রিয়ট সরকারকে হুমকি প্রদান করে। তাদের দাবি ছিল, তাদেরকে জিম্মিসহ সাইপ্রাসের লারনাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে এবং সেখানে পৌঁছানোর পর তাদেরকে একটি যাত্রীবাহী বিমান সরবরাহ করতে হবে। জিম্মিকারীদের সঙ্গে প্রলম্বিত আলোচনার পর উপায়ান্তর না দেখে সাইপ্রিয়ট সরকার তাদের দাবি মেনে নিতে সম্মত হয়। এরপর জিম্মিকারীরা কিছুসংখ্যক জিম্মিকে মুক্তি প্রদান করে।
মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মিরা জানায় যে, জিম্মিকারীরা তাদেরকে বলেছে, সিবাই ইসরায়েলের সম্পর্কে ইতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছেন এবং ফিলিস্তিনিবিরোধী ছিলেন, তাই তাকে খুন করা হয়েছে। তারা আরো মন্তব্য করে যে, মিসরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত এবং অন্য যারা ইসরায়েলের পক্ষ অবলম্বন করেছে, তাদের সকলকেই একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মিসরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ করেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যেটিকে ফিলিস্তিনিরা তাদের সঙ্গে মিসরের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে বিবেচনা করত।
যাই হোক, জিম্মিকারীরা অবশিষ্ট জিম্মিদেরকে নিয়ে লারনাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর তাদেরকে সাইপ্রাস এয়ারওয়েজের একটি ৪ ইঞ্জিনবিশিষ্ট ‘ডগলাস ডিসি–৮’ যাত্রীবাহী বিমান সরবরাহ করা হয়, এবং সেটিতে চড়ে ১১ জন জিম্মি ও ৪ জন বিমানের ক্রুসহ জিম্মিকারীরা সাইপ্রাস ত্যাগ করে। এই ১১ জন জিম্মির মধ্যে ছিল ৪ জন মিসরীয়, ৩ জন ফিলিস্তিনি, ২ জন সিরীয়, ১ জন সোমালি এবং ১ জন মরোক্কান নাগরিক।
কিন্তু জিম্মিকারীদের বিমানটি কোনো দেশে অবতরণ করতে ব্যর্থ হয়। সিরিয়া ও সৌদি আরবসহ অন্তত ৬টি রাষ্ট্র বিমানটিকে তাদের দেশে অবতরণের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বিমানটির জ্বালানি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, এজন্য পূর্ব আফ্রিকান রাষ্ট্র জিবুতি বিমানটিকে অবতরণ করার অনুমতি প্রদান করে। কিন্তু অবতরণের পর জিবুতি কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে বিমানটিকে জ্বালানি প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়। সেখানকার রানওয়েতে ১২০° ফারেনহাইট তাপমাত্রায় ১১ ঘণ্টা বসে থাকার পরই কেবল জিবুতি সরকার তাদেরকে রিফুয়েলিংয়ের অনুমতি প্রদান করে, কিন্তু শর্ত জুড়ে দেয় যে, তাদেরকে সাইপ্রাসে ফিরে যেতে হবে।
জিবুতি বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে জিম্মিকারীদের জানানো হয় যে, দক্ষিণ ইয়েমেন, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার বিমানবন্দরগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে, অর্থাৎ জিম্মিকারীরা সেখানে যেতে পারবে না। লিবিয়া, কুয়েত আর গ্রিস আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, তারা এই বিমানটিকে তাদের দেশে নামার অনুমতি দেবে না। অর্থাৎ, সাইপ্রাসে ফিরে যাওয়া ব্যতীত জিম্মিকারীদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। সাইপ্রিয়ট সরকার জিবুতির সরকারের মাধ্যমে জিম্মিকারীদের আশ্বস্ত করে যে, সাইপ্রাসে ফিরে জিম্মিকারীরা যদি আত্মসমর্পণ করে, সেক্ষেত্রে তাদের প্রতি ‘ন্যায়সঙ্গত’ আচরণ করা হবে।
এই পরিস্থিতিতে জিম্মিকারীরা বিমানটিকে সাইপ্রাসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়, এবং লারনাকা বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। সাইপ্রিয়ট কর্মকর্তারা পুনরায় জিম্মিকারীদের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হয়। কিন্তু এর মধ্যে একটি ভিন্ন ঘটনার অবতারণা হচ্ছিল, যেটির জন্য সাইপ্রিয়টরা মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
জিম্মিকারীদের হাতে নিহত ইউসুফ এল সিবাই ছিলেন মিসরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এজন্য তার খুনের ঘটনায় সাদাত যারপরনাই ক্ষিপ্ত হন। তিনি সাইপ্রিয়ট রাষ্ট্রপতি স্পাইরোস কিপ্রিয়ানুকে জিম্মিদের উদ্ধার করা এবং জিম্মিকারী ‘সন্ত্রাসবাদী’দের মিসরের নিকট সমর্পণ করার অনুরোধ জানান। কিপ্রিয়ানু সাদাতকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি নিজে জিম্মিকারীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন এবং জিম্মিদের মুক্ত করবেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জিম্মিকারীদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য তিনি লারনাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হন।
সাদাত কিপ্রিয়ানুকে জানান যে, জিম্মি উদ্ধারের আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি একটি বিমানে করে মিসরীয় মন্ত্রীদের প্রেরণ করছেন। কিন্তু ১৯ ফেব্রুয়ার মন্ত্রীদের পরিবর্তে বিমানে করে তিনি ‘টাস্ক ফোর্স ৭৭৭’/’ইউনিট ৭৭৭’ নামক একটি মিসরীয় এলিট সন্ত্রাসবাদবিরোধী ইউনিটকে সাইপ্রাসে প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য, এই ঘটনার দুই বছর আগে ১৯৭৬ সালে ইসরায়েলি কমান্ডোরা উগান্ডার এন্টেব্বে বিমানবন্দরে অভিযান চালিয়ে ১০২ জন জিম্মিকে উদ্ধার করেছিল এবং উগান্ডান বিমানবাহিনীর এক–চতুর্থাংশ ধ্বংস করে দিয়েছিল। ধারণা করা হয় যে, সাদাত সাইপ্রাসে অনুরূপ একটি কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করতে আগ্রহী ছিলেন।
এদিকে সাইপ্রিয়টরা মিসরীয়দের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানত না, এজন্য তারা মিসরীয় কমান্ডোদের বহনকারী ‘সি–১৩০এইচ হারকিউলিস’ পরিবহন বিমানটিকে লারনাকা বিমানবন্দরে অবতরণের অনুমতি প্রদান করে। কিন্তু বিমানটি অবতরণের পরপরই লেগে যায় বড় ধরনের গণ্ডগোল।
বিমান থেকে নামার পরপরই মিসরীয় কমান্ডোরা পুরোদমে আক্রমণ শুরু করে। মিসরীয় বাহিনীটিতে ৭৪ জন ‘শক ট্রুপ’ ছিল বলে সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়, কিন্তু এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মূল বাহিনীটির অগ্রভাগে ছিল একটি জিপ, যেটিতে ৩ জন কমান্ডো ছিল। বাকি কমান্ডোরা হেঁটে জিপের পিছন পিছন আসছিল। এদিকে জিম্মিকারীদের কব্জায় থাকা ‘ডিসি–৮’ বিমানটিকে সাইপ্রিয়ট ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা ঘিরে রেখেছিল। মিসরীয় কমান্ডোদের ক্ষিপ্রগতিতে সেদিকে আসতে দেখে সাইপ্রিয়টরা তাদেরকে আর অগ্রসর না হওয়ার জন্য সতর্ক করে। কিন্তু মিসরীয় কমান্ডোরা তাদের সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে এবং গোলাগুলি শুরু করে। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে যায়।
সাইপ্রিয়ট সৈন্যদের নিক্ষিপ্ত রকেট প্রোপেল্ড গ্রেনেডের আঘাতে মিসরী জিপটি বিধ্বস্ত হয় এবং তাতে আরোহণকারী তিন মিসরীয় কমান্ডো নিহত হয়। জিপটি ধ্বংস হওয়ার পর মিসরীয় ও সাইপ্রিয়ট সৈন্যদের মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র ৩০০ মিটার, এবং মিসরীয় সৈন্যদের সামনে কোনো ধরনের কাভার ছিল না। এ অবস্থায় উভয় পক্ষ তুমুল গোলাগুলি চালাতে থাকে। একপর্যায়ে সাইপ্রিয়ট সৈন্যদের নিক্ষিপ্ত ১০৬ মি.মি. ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মিসরীয় ‘সি–১৩০’ পরিবহন বিমানটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং বিমানটির তিনজন ক্রু নিহত হয়। ফলে মিসরীয় কমান্ডোদের কোনোভাবে অভিযানটি বাতিল করে ফিরে যাওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে যায়।
যখন মিসরীয় ও সাইপ্রিয়ট সৈন্যদের মধ্যে গোলাগুলি চলছিল, তখন সাইপ্রিয়ট রাষ্ট্রপতি কিপ্রিয়ানু বিমানবন্দরের টাওয়ারে অবস্থান করছিলেন এবং সেখানকার জানালা থেকে মিসরীয় কমান্ডোদের কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন। মিসরীয় কমান্ডোরা এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ছিল, এবং বেশ কয়েকটি গুলি টাওয়ারে এসে লাগে। এরপর তিনি জানালার কাছ থেকে সরে পড়েন এবং জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইমকে ফোন করে মিসরের কার্যকলাপ নিয়ে অভিযোগ করেন।
ঘণ্টাখানেক এরকম গোলাগুলি চলার পর মিসরীয় কমান্ডোরা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। জীবিত কমান্ডোদের কেউ কেউ আশেপাশে থাকা অন্য যাত্রীবাহী বিমানগুলোর ভেতর আত্মগোপন করে। সব মিলিয়ে ১৭ জন কমান্ডো এবং ৩ জন বিমানের ক্রু (মোট ২০ জন মিসরীয়) এই সংঘর্ষে নিহত হয়। ১৫ জন মিসরীয় কমান্ডো গোলাগুলিতে আহত হয়, এবং পরবর্তীতে সাইপ্রিয়ট ন্যাশনাল গার্ড ও পুলিসের সদস্যরা লুকিয়ে থাকা ৩৮ জন মিসরীয় কমান্ডোকে গ্রেপ্তার করে। সাইপ্রিয়ট সরকার ঘোষণা করে যে, তারা গ্রেপ্তারকৃতদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে বিবেচনা করবে। এই সংঘর্ষে কোনো সাইপ্রিয়ট সৈন্য নিহত হয়নি, তবে ৭ জন সামান্য আহত হয়।
পরবর্তীতে সাইপ্রাস নিহত মিসরীয় সৈন্যদের মৃতদেহ এবং মিসরীয় যুদ্ধবন্দিদের মিসরের নিকট হস্তান্তর করে। আত্মসমর্পণকারী দুই জিম্মিকারীকেও মিসরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মিসরীয় সরকার এই দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে, কিন্তু পরবর্তীতে তাদের শাস্তি হ্রাস করে তাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
লারনাকা বিমানবন্দরে ব্যর্থ মিসরীয় কমান্ডো অভিযান মিসর ও সাইপ্রাসের মধ্যেকার সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি করে। মিসরীয় রাষ্ট্রপতি সাদাত দাবি করেন যে, জিম্মিদের প্রাণ রক্ষায় মিসরীয় কমান্ডোরা অবদান রেখেছে এবং জিম্মিকারীদের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হওয়ার জন্য সাইপ্রিয়ট সরকারকে ‘সন্ত্রাসবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ হিসেবে আখ্যা দেন। সাইপ্রিয়ট রাষ্ট্রপতি কিপ্রিয়ানুকে তিনি ‘রাজনৈতিক বামন’ হিসেবে অভিহিত করেন। বস্তুত এই ব্যর্থ, নিষ্প্রয়োজনীয় ও রক্তাক্ত অভিযানটি মিসরীয় জনসাধারণের মনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারত, এবং সেটি যাতে না ঘটে, সেজন্য মিসরীয় সরকার নানা ধরনের প্রচারণা চালাতে শুরু করে। তারা সাইপ্রাসকে মিসরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য আহ্বান জানায়।
অন্যদিকে, সাইপ্রাস এই তিক্ত ঘটনাটি ভুলে গিয়ে মিসরের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার ইচ্ছা ব্যক্ত করে, কিন্তু তাদের বক্তব্য ছিল, সাইপ্রিয়ট সরকারের অনুমতি ব্যতিরেকে সাইপ্রাসের অভ্যন্তরে কমান্ডো হামলা চালিয়ে মিসর সাইপ্রাসের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে, তাই সাইপ্রাস এই ঘটনার জন্য মিসরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না। মিসরের প্রতিদ্বন্দ্বী আরব রাষ্ট্র সিরিয়া ও লিবিয়া সাইপ্রাসের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে, এবং মিসরীয় কার্যকলাপের নিন্দা জানায়। এই পরিস্থিতিতে মিসর সাইপ্রাসের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে, এবং ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাত নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত মিসরীয়–সাইপ্রিয়ট সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে দুজন ব্যক্তি এই জিম্মি সঙ্কটের সৃষ্টি করেছিল, তারা নিজেদেরকে ফিলিস্তিনি হিসেবে দাবি করে এবং ফিলিস্তিনের স্বার্থে কাজ করছে বলে জানায়। এর ফলে মিসরীয় সরকার এই জিম্মি সঙ্কটের জন্য ‘ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা’কে (Palestine Liberation Organization, ‘PLO’) দায়ী করে। কিন্তু পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত এই অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং এই ঘটনাটির নিন্দা জানান। মার্কিন পত্রিকা ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’–এর মতে, পিএলও নিজেই এই জিম্মিদের উদ্ধার করার জন্য সাইপ্রাসে একটি কমান্ডো দল প্রেরণ করতে চেয়েছিল এবং এজন্য তারা সাইপ্রিয়ট সরকারের অনুমতি প্রার্থনাও করে। কিন্তু সাইপ্রিয়ট সরকার তাদেরকে এর অনুমতি দেয়নি, ফলে তারা এই অভিযান পরিচালনা থেকে বিরত ছিল। অন্যথায় তাদেরকে ঘিরেও অনুরূপ একটি দুর্ঘটনার অবতারণা হতে পারত।