শাহান-ই-মোগল, শাহান-ই-গুরখানি, দৌলত-ই-মোগলিয়া, সালতানাত-ই-মোগলিয়া অথবা, মুঘল সাম্রাজ্য- যে নামেই ডাকা হোক না কেন, মুঘল সাম্রাজ্য এখন শুধুমাত্র অতীত গৌরবের ধ্বংসস্তুপের ছাই হলেও এই সাম্রাজ্যের প্রভাব এখনও আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনুভব করি। সেটা হোক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রায় ৪০ লাখ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই সাম্রাজ্যটি ছিলো সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী আর শক্তিশালী একটি সাম্রাজ্য। তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষের উপর মুঘল শাসন বজায় ছিলো। সেই সময় ১৫০ মিলিয়ন মানুষ মানে পুরো পৃথিবীর চার ভাগের একভাগ মানুষ!
সম্পদ কিংবা বিলাসিতা, আভিজাত্যের কিংবা চাকচিক্য- সবদিক থেকেই ৩ মহাদেশ শাসন করা উসমানী খিলাফতকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো হিন্দুস্তান শাসন করা দুর্দান্ত এই মুঘল সাম্রাজ্য। তবে সম্পদ আর আভিজাত্যই মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিলো না। বরং মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত হয়ে থাকা হিন্দুস্তানের ভূখন্ডগুলোকে এক পতাকার নিচে নিয়ে আসা; মুঘল পতাকা। হিন্দুস্তানের প্রতি মুঘলদের আরেকটি অবদান হচ্ছে, হিন্দুস্তানের মানুষকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার শিক্ষাদান করা। যার ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্য একটি পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো। ঠিক ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তি হিন্দুস্তানে তাদের “ডিভাইড এন্ড রুল” পদ্ধতির সফল প্রয়োগ না করলো।
এখানে উল্ল্যেখ্য, মুঘলদের পূর্বপুরুষরাও ব্রিটিশদের মতোই হিন্দুস্তানের বাইরে থেকেই এসেছিলেন, এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্রিটিশদের মতো হিন্দুস্তানে লুটপাট আর শোষণের রাজত্ব তাঁরা কায়েম করেন নি। বরং মুঘল শাসকরা হিন্দুস্তানের মাটিকে আপন করে নিয়েছিলেন। তাছাড়া, প্রথম দুজন মুঘল সম্রাট ছাড়া বাকী সব মুঘল শাসকই বিশুদ্ধ হিন্দুস্তানীয় ছিলেন। কাজেই সাম্রাজ্যবাদী আর অত্যাচারী ব্রিটিশদের সাথে মুঘলদের গুলিয়ে ফেললে হবে না।
ইসলামের আগমনী বার্তা কিংবা মুসলিম শাসন যে মুঘলরাই সর্বপ্রথম হিন্দুস্তানে নিয়ে এসেছিলেন, এমনটা কিন্তু না। বরং মুঘলদের বহু পূর্ব থেকেই, একেবারে ইসলামের পুনরাবির্ভাবের সময়কাল থেকেই ইসলামের ছোঁয়া হিন্দুস্তানবাসী পেয়েছিলো। রাসূল (স)- এর জন্মের অনেক আগে থেকেই আরব ভূমির সাথে হিন্দুস্তানের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিলো। আরব ব্যবসায়ীরা তাদের বাণিজ্যিক জাহাজগুলো নিয়ে হিন্দুস্তানের পশ্চিম ভূ-খন্ডের বিভিন্ন বন্দরগুলোতে ভীড়তেন। ব্যবসায়ের মূল পণ্য ছিলো স্বর্ণ সহ মূল্যবান বিভিন্ন পাথর আর মশলা। এছাড়া আফ্রিকান বিভিন্ন পণ্যও বেচাকেনা হতো এ বন্দরসমূহে। রাসূল মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে ইসলামের মহান দাওয়াত যখন আরব ভূমিতে আবার ছড়াতে শুরু করলো, তখন এই বণিকরাও ইসলামের বানী নিজেদের ভেতরে ধারণ করে নিলেন।
বর্তমান ভারতের মাদ্রাজ তামিলনাড়ু প্রদেশের একটি জেলার নাম মালাবর বা মলাবার। আরবি “মাবার” শব্দ থেকে “মালাবর” নামটির উৎপত্তি। “মাবার” শব্দটির বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, অতিক্রম করে যাওয়ার স্থান। মালাবরের প্রাচীন নাম ছিলো “চেরর” বা “কেরল”। এই মাবার বা মালাবর জায়গাটি আরব বণিকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাটি ছিলো। এ পথ দিয়েই তাঁরা ব্যবসায়িক কাজে চীনের উদ্যেশ্যে যাত্রা করতেন। ইসলাম গ্রহণের পর এ ব্যবসায়ীরা আর শুধুমাত্র পণ্যই নিয়ে আসতেন না, সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন এক নতুন জীবনাদর্শকে। এসব এলাকায় বসবাসকারী মানুষগণ খুব সহজেই এই জীবন দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কারণ, তারা সনাতন ধর্মের বর্ণবাদের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছিলেন। সেই তুলনায় ইসলাম তাদের কাছে অনেক সম্মানজনক আর মর্যাদাপূর্ণ বিকল্প জীবনাদর্শ মনে হয়েছিলো। দলে দলে এসব এলাকার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলেন।
যা-ই হোক, এই চেরর বা মালাবরের শেষ রাজা চেরুমাল পেরুমাল বা পেরুমল ভাস্কর রবি বার্মা নিজ ইচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে করেন এবং সিংহাসন ত্যাগ করে ইসলামের প্রবাদপুরুষের সাথে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি মক্কায় রাসূল (স) এর সাথে দেখা করতে পেরেছিলেন কি না তা স্পষ্ট নয়। তবে “তোহফাতুল মুজাহিদীন” নামক গ্রন্থ থেকে ভারতের একজন রাজার বর্ণনা পাওয়া যায়, যিনি নিজ রাজ্য ত্যাগ করে মক্কায় গিয়ে রাসূল (স) এর সাথে দেখা করেছিলেন। এই ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, গ্রন্থের উল্ল্যেখিত ব্যাক্তিটি চেরর রাজ্যের রাজাই ছিলেন। রাসূল (স) এর জীবদ্দশাতেই পেরুমল ভাস্কর রবি বার্মা প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দুস্তানের প্রথম মসজিদ- চেরামান জুম’আ মসজিদ।
অর্থাৎ, ইসলামের পুনরাবির্ভাবের একেবারে শুরুতেই ইসলাম হিন্দুস্তানে পৌছে গিয়েছিলো।
মুসলিমদের দ্বারা হিন্দুস্তান অভিযানের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যার নাম উঠে আসেন, তিনি আর কেউ নন, ১৭ বছর বয়সী সিন্ধুবিজয়ী বীর মুহাম্মদ বিন কাশিম। তবে তার মাধ্যমেই যে ইসলাম ব্যাপকহারে হিন্দুস্তানে প্রচার পেয়েছে বা এটাই যে হিন্দুস্তানের প্রথম সামরিক অভিযান ছিলো- তা না। এর পূর্বেও হিন্দুস্তানের সীমান্তে বিভিন্ন অভিযান প্রেরণ করা হয়েছিলো, যা বিভিন্ন ছোটখাট সংঘর্ষ হিসেবেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এসব অভিযানের তেমন ব্যাপকতাও ছিলো না।
হিন্দুস্তান মুসলিমদের জন্য এক বিশেষ আবেগের নাম। স্বয়ং রাসূল (স) মুসলিমদের দ্বারা হিন্দুস্তান বিজয়ের কথা বলেছিলেন। তিনি হিন্দুস্তানকে “আল-হিন্দ” নামে উল্লেখ করেছেন। হিন্দুস্তান নামটি আদি ফার্সি ভাষার “হিন্দু” শব্দটি থেকে এসেছে, যা দ্বারা সিন্ধু নদটিকে বোঝানো হয়। “হিন্দু” শব্দটি দ্বারা সিন্ধু নদের অববাহিকায় বসবাসকারী মানুষদেরও বোঝাতো। আর হিন্দুস্তান শব্দটির মানে দাঁড়ায় যেখানে হিন্দুরা বসবাস করে। অন্যদিকে, প্রাচীন গ্রিকরা হিন্দুস্তানীয়দের বলত ইন্দোই (Ινδοί), বা ‘ইন্দাস’, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় সিন্ধু নদী অববাহিকার অধিবাসী। আর এই গ্রীক ‘ইন্দাস’ নাম থেকেই ‘ইন্ডিয়া’ নামটির উৎপত্তি। অন্যদিকে ধারণা করা হয়, হিন্দু পৌরাণিক রাজা ভারতের নাম থেকে “ভারতবর্ষ” বা “ভারত” নামটি এসেছে। আমরা “ভারতবর্ষ” হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলটিকে হিন্দুস্তান নামেই অভিহিত করবো।
রাসূল (স) এর হিন্দুস্তানের প্রতি আগ্রহের কারণে পরবর্তী মুসলিম শাসকেরাও হিন্দুস্তানের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। যেমন: দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (র) এর সময় বাহরাইন ও আম্মানের গভর্নর ওসমান আম্মান থেকে হিন্দুস্তান সীমান্তে একটি অভিযান চালান। এই অভিযানের সফল সমাপ্তির পর তিনি তার ভাই মুগীরাকে দেবল বা করাচীর দিকে পাঠান। করাচীতে তিনি প্রবল বাঁধার মুখে পড়েন, যার কারণে অভিযানে তেমন অগ্রগতি আর হয় নি। তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা) হিন্দুস্তান অভিযানের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি গোয়েন্দা মিশন পরিচালনা করেন। সেই রিপোর্টে জানানো হয়, এই মুহূর্তে হিন্দুস্তানের দিকে অভিযান না পাঠানোই ভালো। কারণ এই অভিযান পরিচালনা করা হলে সেনাবাহিনীকে তীব্র খাদ্য ও পানীয়ের সংকটে পড়তে হবে। এই রিপোর্টের ফলে হিন্দুস্তান অভিযান পিছিয়ে যায়। এমনকি চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা) এর সময়েও হিন্দুস্তানে অভিযান প্রেরণ করা হয়। প্রথমদিকে সফলতা আসলেও পরবর্তীতে অভিযানের তেমন আর অগ্রগতি হয় নি।
হিজরী ৪৪ সালে আমীর মুয়াবিয়া (রা) মোহালাব ও তারপর আবদুল্লাহ ইবনে সওয়ারের নেতৃত্বে হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু প্রাথমিক কিছু সফলতার পরও মুসলিমরা চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হতে পারেন নি।
৬৬১ সালে মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান এর মাধ্যমে শুরু হয় উমাইয়া শাসনামল। পঞ্চম উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ৬৯৪ সালে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ নামের এক ব্যক্তিকে ইরাকের গভর্নর করে পাঠালেন। ইরাকের শাসনকর্তা হওয়ার পর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ পারস্যের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এ যুদ্ধ কোনভাবেই হিন্দুস্তানের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলো না। কিন্তু, হিন্দুস্তানবাসীদের দুর্ভাগ্য! এ যুদ্ধে হিন্দুস্তান থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পারস্য সেনাবাহিনীকে সহায়তা প্রেরণ করা হয়। এছাড়া পারস্যের কিছু বিদ্রোহীদের তৎকালীন ব্রাক্ষ্মণ রাজা দাহির আশ্রয় প্রদান করলেন। এসব কারণে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের চোখ হিন্দুস্তানের উপরে পড়লো। তাছাড়া, সমসাময়িক সময়েই আরবের কিছু জাহাজ যাত্রীসহ সিন্ধুর নিকটবর্তী এলাকা থেকে জলদস্যুদের কবলে পড়ে। পুরুষদের হত্যা করা হয়, আর নারীদের করা হয় লাঞ্চিত। এমন একজন লাঞ্চিতা নারী নিজেদের সম্মান রক্ষার দাবী নিয়ে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের কাছে গোপনে একটি পত্র পাঠান। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ রাজা দাহিরের কাছে দস্যুদের দমন করে জিম্মিদের উদ্ধার ও তাদের ক্ষতিপূরণের দাবী করেন। কিন্তু রাজা দাহির সাফ জানিয়ে দেন, ক্ষতিপূরণ দেয়া কিংবা দস্যুদের শাস্তিদানে তিনি বাধ্য নন। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ক্রোধের বশবর্তী হয়ে একটি সেনাবাহিনী পাঠান। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ধর্মপ্রচার ছিলো না, ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ছিলো মাত্র। প্রাথমিকভাবে মুসলিম সেনাবাহিনী সফলতা পেলেও শেষ পর্যন্ত এই অভিযান চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ হয়। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ এই পরাজয়ে তীব্র অপমানিত বোধ করলেন।
এই অপমানের শোধ নিতে ও হিন্দুস্তানে ইসলামের বাণী পৌছে দিতে হাজ্জাজ তাঁর জামাতা ও ভাতিজা মুহাম্মদ ইবনে কাশিমকে সেনাপতি করে আরেকটি অভিযান পাঠালেন। মুহাম্মদ বিন কাশিম তাঁর হিন্দুস্তান অভিযানে স্থলপথ ও জলপথ উভয়ই ব্যাহার করে ৭১২ সালে দেবল পর্যন্ত পৌছে যান। মুহাম্মদকে বাধা দান করতে দেবলের দিকে এগিয়ে যান রাজা দাহির। সিন্ধুর দেবল বন্দরের প্রচন্ড যুদ্ধে রাজা দাহির পরাজিত ও নিহত হলেন। মুসলিম সেনাবাহিনী এরপর রিওয়ার আর ব্রাক্ষ্মণাবাদে প্রচন্ড বাঁধার মুখোমুখি হন। তবে এসব যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীই বিজয়ী হন। এরপর মুসলিম সেনাবাহিনী বীরদর্পে হিন্দুস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে লাগল। কিন্তু অভিযান চলাকালেই মাত্র ২০ বছর বয়সে ৭১৫ সালের ১৮ জুলাই তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তাঁর অভিযান সম্পূর্ণ করতে পারলে হয়তো হিন্দুস্তানের ইতিহাস ভিন্নভাবে লিখতে হতো।
মুহাম্মদ ইবনে কাশিমের নেতৃত্বে মুসলিমরা হিন্দুস্তানের উপর চূড়ান্ত রকমের সাফল্য পেলেও ইসলামের সামরিক বিজয়াভিযানে এই অভিযানের তেমন আলাদা কোনো গুরুত্ব ছিলো না। কেননা সময়টা ছিলো ইসলামের বিজয়ের। চারদিক থেকে একে একে মুসলিমদের বিজয়ের সংবাদই পাওয়া যাচ্ছিলো।
হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে এরপর বড় ধরনের হামলা পরিচালনা করেন গজনীর সুলতান মাহমুদ। তিনি বার বার হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রতিবারই হিন্দুস্তানের রাজারা জোটবদ্ধ হয়ে সুলতান মাহমুদকে বাধা দিতে এগিয়ে যেতেন এবং প্রতিবারই পরাজিত হতেন। ১০০১ সাল থেকে ১০২৬ সাল পর্যন্ত মোট ১৭ বার হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রতিটি অভিযানেই সুলতান মাহমুদ সফলতা অর্জন করলেও হিন্দুস্তানে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই যুদ্ধগুলো দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি।
তবে শুরু থেকে মোটামুটি তিন শতাব্দীব্যাপী এই যুদ্ধ উত্তর হিন্দুস্তানের কয়েকটি জায়গায় সুলতানী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সহযোগীতা করে। অন্যদিকে বণিকদের মাধ্যমে হিন্দুস্তানের উপকূল এলাকাগুলোতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ফলে ধীরে ধীরে দক্ষিণ হিন্দুস্তানে প্রতিষ্ঠা পায় বাহমানী সালতানাত আর দাক্ষিণাত্য সালতানাত। সেই সাথে ধীরে ধীরে হিন্দুস্তানে মুসলিম আধিপত্যের একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
সমসাময়িক সময়ে মুসলিম বিশ্বে অপর প্রান্তের দিকে নজর দেয়া যাক। খলিফা আবদুল মালিকের মৃত্যুর পর ৭০৫ সালে তাঁর পুত্র আল ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক খিলাফতের দায়িত্ব পান। তাঁর সময়ে একে একে অনেকগুলো সফল অভিযান মুসলিমরা পরিচালনা করেন। খলিফা আল ওয়ালিদেরই বিশ্বস্ত সেনাপতি মুসার নেতৃত্বে আফ্রিকার ভূখন্ডগুলো ধীরে ধীরে ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মুসার একসময়কার কৃতদাস তারিক ইবনে যিয়াদ নেতৃত্ব দেন মুসলিমদের স্পেন বিজয়াভিযানে। ৭১১ সালের ২৯ এপ্রিল মাত্র ৭,০০০ মুসলিম নিয়ে গঠিত একটি সেনাবাহিনী নিয়ে তারিক জিব্রাল্টার প্রণালীর তীরে অবতরণ করেন। এই মাত্র ৭,০০০ সেনা নিয়েই তিনি দখল করে ফেললেন শক্তিশালী স্পেনকে!
গজনীর সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর (১০৩০ সালের ৩০ এপ্রিল) গজনভী সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার অর্জন করে ঘোরী সাম্রাজ্য। এই ঘোরী সাম্রাজ্যের হাত ধরেই হিন্দুস্তানে প্রতিষ্ঠা পায় দিল্লী সালতানাত। দিল্লী সালতানাত বলতে একক কোনো বংশের রাজত্ব কিংবা একক কোনো সাম্রাজ্য বোঝায় না। বরং ১২০৬ থেকে ১৫২৬ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি রাজবংশের শাসনের সমষ্টিকে বোঝায়। আর দিল্লী সালতানাতের শেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদীকে পানিপথের প্রান্তরে ১৫২৬ সালে পরাজিত করেন প্রথম মুঘল সম্রাট জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবর। আর এর মাধ্যমেই হিন্দুস্তান শাসন করার অধিকার অর্জন করেন মুঘল সুলতানরা। ইতিহাসে কোনো সাম্রাজ্যই চিরস্থায়ী হয় নি। একটি সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের উপর বিজয় পতাকা উড়িয়েছে অন্য আরেকটি সাম্রাজ্যের অন্য কোনো শাসক। ঠিক যেভাবে দিল্লী সালতানাতের ধ্বংসস্তুপের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো ইতিহাসের প্রবল শক্তিশালী মুঘল সাম্রাজের পতাকা!
তথ্যসূত্র:
১। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান
২। ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমেদ মোর্তজা
৩। ভারতবর্ষের ইতিহাস- কোকা আন্তোনোভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি
৪। বিশ্বসভ্যতা- এ. কে. এম. শাহনাওয়াজ
ফিচার ইমেজ- shutterstock.com