উনিশ শতকের আমেরিকার কথা ভাবুন তো! আপনার মনে হতে পারে, তৎকালীন সময়ে নারীদেরকে বিজ্ঞানচর্চা থেকে দূরে রাখা হত। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে একদমই ওরকম ছিল না। বিভিন্ন কারণে আঠারো শতকের শুরুর দিকে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের কাজে নারীদের উৎসাহিত করা হত। মহাকাশ পর্যবেক্ষণের এই কাজটিকে বলা হত সুইপিং দ্য স্কাই (আকাশ লেপন)।
পটভূমি: জ্যোতির্বিজ্ঞানে মারিয়া মিশেল এবং নারীদের অংশগ্রহণ
আকাশ পর্যবেক্ষণের গুণাবলীগুলো মারিয়া মিশেল সযত্নে লালন করেছিলেন। মারিয়া ছিলেন তৎকালীন সময়ের পেশাদার নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম। তিনি যখন ছোট ছিলেন, বাবার কাছেই তার সর্বপ্রথম ‘সুইপিং দ্য স্কাই’-এর হাতেখড়ি। তিনি আকাশের নক্ষত্রগুলোর একটি নকশা বা মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। উনিশ শতকে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি পুরস্কৃত হন, যা কিনা তার নারী শিক্ষার্থীদের সামনে বিজ্ঞানের দুয়ার খুলে দেয়। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার সংগ্রাম আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সেসময়ে নারী অগ্রগতির পথ সহজ এবং সুগম ছিল না। কারণ যখনই নারীরা এগিয়ে যাচ্ছিলো, তখনই তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তখনকার সময়ের সামাজিক এবং আর্থিক প্রেক্ষাপট।
তৎকালীন সময়ে বিজ্ঞানচর্চায় নারীর অবস্থান এবং আর্থসামাজিক অবস্থা
কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, তৎকালীন সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রবেশ নারীদের জন্য তেমন কঠিন কিছু ছিল না। উপরন্তু, জ্যোতির্বিজ্ঞানকে বলা হত অনেকটা নারীসুলভ বিজ্ঞান, যেন মহাকাশ এবং নক্ষত্ররাজি এসবের হিসেব রাখতে পুরুষের চাইতে নারীরাই অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষ। ‘মারিয়া মিশেল অ্যান্ড দ্য সেক্সটিং অফ সায়েন্স’ বইটির লেখক, সাইমন্স কলেজের প্রফেসর, রিনি বার্গল্যান্ড তার বইতে উল্লেখ করেন,
“উনিশ শতকের প্রথমদিকে আমেরিকার বিজ্ঞান চর্চায় নারীদের আধিক্য ছিল বেশি, ছেলেদের না। সেই সময়ে বিজ্ঞানচর্চা কোন কাজ হিসেবে না ভেবে নারীসুলভ রেওয়াজরীতি ভাবা হত।” সূত্র: মারিয়া মিশেল অ্যান্ড দ্য সেক্সটিং অফ সায়েন্স, পৃষ্ঠা- ১৪
মিউজিয়াম অফ আমেরিকান হিস্টোরির সায়েন্স অ্যান্ড মেডিসিন বিভাগের কিউরেটর, ডেবরাহ ওয়ার্নারও স্বীকার করেন যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানে পেশাদারিত্ব প্রবেশ করার আগে, এটি নারীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল এবং নারীরাই অগ্রগণ্য ছিল।
মারিয়া যখন ছোট ছিলেন তখনকার সময়ে বিজ্ঞানীরা ‘পেশাদার বিজ্ঞানী’ হিসেবে বিজ্ঞানচর্চা করতেন না। আপনি যদি সেই সময়ে একজন নারী হতেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানে আপনার যথেষ্ট আগ্রহ থাকত এবং আপনার আশেপাশের আত্মীয়স্বজন আপনার আগ্রহকে সমাদর করতো, তাহলে আপনি সহজেই জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে পারতেন। তবে এটা কেবল তখনই সম্ভব হত, যখন আপনার পরিবার তৎকালীন এলিট শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। মিশেলের মতো সব মেয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বাবার সাহচর্যে এবং অনুপ্রেরণায় কাজ করা।
মারিয়া মিশেলের পরিবার, জন্ম এবং শৈশব
মারিয়া মিশেলের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নানটাকাটে, ১৮১৮ সালে। তার পরিবারকে বলা হত কোয়াকার (Quaker) পরিবার। এর অর্থ হচ্ছে, তারা বিশ্বাস করতো ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই শিক্ষার প্রয়োজন আছে এবং উভয়কেই স্কুলে যেতে হবে। মিশেলের বাবা ছিলেন একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং শিক্ষক। মারিয়া যখন খুব ছোট ছিলেন তখন থেকে তার বাবা তাকে আকাশ সম্পর্কে দীক্ষা দেন। যন্ত্রপাতির দিক দিয়ে তখনকার সময়ের ঘরোয়া জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তেমন একটা পিছিয়ে ছিলেন না। তার বয়স যখন ১২, তখন তিনি সর্বপ্রথম বাবার সাথে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রবেশ ও কর্ম এবং সংগ্রাম
বাবার সাহচর্য এবং নিজের আগ্রহের ফলশ্রুতিতে, জ্যোতির্বিজ্ঞানে মারিয়া মিশেলের প্রবেশ এবং বিচরণ বেশ সহজেই ত্বরান্বিত হয়েছিল। ১৮৪৭ সালে, পৃথিবী থেকে বহু দূরে অবস্থিত একটি ধূমকেতুর বিবরণ লিপিবদ্ধ করার জন্য সুইডেনের যুবরাজ মিশেলকে মেডেল প্রদান করে পুরস্কৃত করেছিল। পরবর্তীতে ধূমকেতুটি মিস মিশেল’স কমেট নামে পরিচিতি লাভ করে। এর পরের বছরই আমেরিকান একাডেমি অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সে প্রথম নারী জ্যোতির্বিদ হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর তিনি যুক্ত হন আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দ্য এডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্সের সাথে।
১৮৫৬ সালে তিনি ইতালিতে চলে যান। উদ্দেশ্য ভ্যাটিকান অবজারভেটরি থেকে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ। তবে ভ্যাটিকান অবজারভেটরি থেকে তার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, কারণ এটি মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হলেও, একটি সন্ন্যাস আশ্রম। সন্ন্যাস আশ্রমে সাধারণত নারীদের প্রবেশাধিকার দেয় না। এরপর তিনি পিটিশন দাখিল করেন। তার আত্মজৈবনিক জার্নালে তিনি বলেন,
“প্রথমদিকে এই সন্ন্যাস আশ্রমে থাকার ব্যাপারে আগ্রহ তেমন একটা না থাকলেও, এখন বলতে গেলে আমার এখানে প্রবেশ করার একটা জিদ চেপে গিয়েছে”। (সূত্র: মারিয়া মিশেল: জীবন, চিঠিপত্র এবং জার্নাল, পৃষ্ঠা ১৫৪)
এর দুই সপ্তাহ পরে, ভ্যাটিকান অবজারভেটরির কর্মকর্তারা তাকে ভেতরে প্রবেশাধিকার দেয়। এবং প্রথম নারী হিসেবে তিনি সেই আশ্রমে প্রবেশ করেন। তিনি যে ঘরে থাকার অনুমতি পেয়েছিলেন, সেটা নিয়ে তিনি খুব বেশি উচ্ছ্বসিত না হলেও, তিনি তার জার্নালে লিখেছেন,
“মার্চ ২, ১৯৫৪। গতরাতে তিনটি মেয়াদে প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত “স্কাই সুইপ” করেছিলাম। এটা খুব অসাধারণ একটি রাত ছিল- মেঘমুক্ত, পরিষ্কার এবং সুন্দর একটা আকাশ। আমার কাজ করতে বেশ ভালই লাগছিল, কিন্তু শীতল বাতাসে জিরিয়ে নেবার আগেই হঠাৎ আমার পিঠব্যথা করতে শুরু করে। কিন্তু আমি দুটি নেবুলা দেখতে পেয়েছিলাম যা আমার পিঠ ব্যথার কষ্টকে ভুলিয়ে দিয়েছিল”।(সূত্র: মারিয়া মিশেল: জীবন, চিঠিপত্র এবং জার্নাল, পৃষ্ঠা ১৫৪)
জ্যোতির্বিজ্ঞানে মারিয়া মিশেলের জ্ঞান এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে, তৎকালীন সময়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত নিউইয়র্কের ভ্যাসার কলেজ তাকে কলেজের প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রফেসর হিসেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। তিনি তার বাবাকে সাথে নিয়ে যান এবং ১৮৬৫ সালে, শরৎকালীন সেমিস্টার থেকে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে কোনো পেশাদার বিজ্ঞানী ছিলেন না। বিজ্ঞানী হিসেবে যারা কাজ করতেন তারা কেউই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াতেনও না। অর্থাৎ প্রথমদিকে মিশেলের বিজ্ঞানচর্চাও পেশাদারী বিজ্ঞানচর্চার আওতায় পড়ে না। তাই মারিয়া মিশেল ছিলেন প্রথম পেশাদার বিজ্ঞানী, প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রফেসর এবং সেসময়কার পেশাদার বিজ্ঞানীদের মধ্যে একমাত্র নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
ভ্যাসার কলেজের যেসব শিক্ষার্থীরা কলেজের পর্যবেক্ষণাগার থেকে আকাশে পর্যবেক্ষণ করতেন; পরবর্তীতে তাদের মধ্যে একজন, তার প্রিয় শিক্ষিকা মিশেলের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন,
“মিশেলের সবচাইতে প্রিয় গ্রহ ছিল শনি এবং জুপিটার।”
ভ্যাসার কলেজে মিশেলের ব্যবহৃত টেলিস্কোপটি এখন স্মিথসোনিয়ান আমেরিকান সায়েন্স মিউজিয়ামের কালেকশনে রয়েছে। মিশেলের বাসায় যে টেলিস্কোপ ছিল, সেটি অনেকটা হার্ভার্ডের টেলিস্কোপের মতোই।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে যেভাবে পিছিয়ে পড়তে থাকলো নারীরা
মিশেল সব সময়ই চেয়েছেন তার শিক্ষার্থীরা তার মতই সফল হোক এবং কাজের মাধ্যমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করুক। কিন্তু ক্রমশ পেশাদারী বিজ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটতে থাকে। ফলাফল হিসেবে নারীরা বিজ্ঞানচর্চায় নিগৃহীত হতে শুরু করে। এর পেছনে কার্যত তৎকালীন আমেরিকার পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক বাস্তবতাই প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিজ্ঞান পেশাদারীভাবে চর্চার ফলে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি তখনকার সমাজে তেমন একটা গুরুত্ব সহকারে দেখা হতো না। উপরন্তু, অর্থ উপার্জনে নারীদের চাইতে পুরুষরাই অগ্রাধিকার পেতো। মিশেলের অবসরের পর, ভ্যাসার কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে কেবলমাত্র একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে চাকরী পায়।
ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের সূত্রমতে, বর্তমানে যারা জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে তাদের মধ্যে শতকরা ২৬ ভাগ হচ্ছেন নারী; এবং আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রফেসরদের মধ্যে চার ভাগের একভাগই নারী। তবুও পুরুষদের তুলনায় নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কথা কেউই তেমন একটা স্মরণ করে না।
বিজ্ঞানচর্চায় নারী অধিকার আদায়ে মারিয়ার অবদান
১৮৭০ সালের শুরুর দিক থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে মেয়েদের সুযোগ সুবিধা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। বিজ্ঞানচর্চা যখন পেশাদারিত্বে রূপান্তর হয় তখন থেকেই বিজ্ঞানচর্চায় নারীদের পথ আরো সংকীর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। যখন বিজ্ঞানমনস্ক নারীদের বিজ্ঞানচর্চার দুয়ার বন্ধ হয়ে যেতে থাকলো, তখন মিশেল অলস বসে ছিলেন না।
১৮৭২ সালে তিনি আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দ্য এডভান্সমেন্ট অফ উইমেন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর তিনি দুই বছর প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ছিলেন এবং মৃত্যুর আগের বছর পর্যন্ত নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে যান।
১৯৩৭ সালে মারিয়া মিশেলের নামে একটি গ্রহাণুর (১৪৫৫ মিশেলা) নামকরণ করা হয়। ২০১৩ সালে গুগল মিশেলের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তার ১৯৫তম জন্মদিনে একটি ডুডল প্রকাশ করে। নান্টাকেটসের সায়েন্স সেন্টারও মারিয়া মিশেল এসোসিয়েশনের একটি অঙ্গসংস্থা।
জ্যোতির্বিজ্ঞানকে যেখানে বলা হতো নারীসুলভ বিজ্ঞান, সেই জ্যোতির্বিজ্ঞানেই যখন নারীদের অবদানের গল্প পশ্চাৎপদতার দিকে অগ্রসর হয়, অনেক ইতিহাসবিদ মারিয়া মিশেলের অবদান সম্পর্কে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। আমরা আসলে এমন গল্প পছন্দ করি না যেখানে গল্পটি পেছনের দিকে যেতে থাকে। মারিয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে যা একেবারেই কাম্য নয়।
মারিয়া মিশেলের জীবনের গল্প করুণ। বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত পেয়ে আবার সেই অবস্থান নিয়েই সংগ্রাম। যেন তার এই গল্পের গতি ভেনাস গ্রহের মতোই ক্রমেই পেছনের দিকে যাচ্ছে। মারিয়া যখন ছোট ছিলেন, তখন নারীর বিজ্ঞানচর্চা ছিল স্বাভাবিক, যতদিন না এটি পেশাদার কর্মক্ষেত্রে রূপান্তর হয়েছিল। এমনকি বর্তমান সময়েও এটা ভাবতে কষ্ট হয় যে আজ থেকে ২০০ বছর আগে নারীদের বিজ্ঞান চর্চা ছিল খুবই স্বাভাবিক, যেখানে কোনো লিঙ্গ বৈষম্য ছিল না। একদমই ছিল না!
ফিচার ইমেজ: Big Think