যেভাবে পতন হলো মির্জা কামরানের

নভেম্বর, ১৫৪৪ সাল। হিন্দুস্তানের সম্রাট শের শাহ সুরি রাজপুতদের বিরুদ্ধে কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ করে বসে আছেন। দ্রুত দুর্গটির দখল বুঝে নিতে তার আর্টিলারি বাহিনী মুহুর্মুহু কামান দাগাচ্ছে। তিনি নিজে ঘুরে ঘুরে আর্টিলারি ইউনিটের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছিলেন আর উৎসাহ দিচ্ছিলেন। তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দুর্গটি এখনও বহাল তবিয়তেই দাঁড়িয়ে আছে।

রাজপুতদের প্রতিরোধ তেমন শক্ত না, তবে দুর্গের দেয়াল বেশ শক্ত। দেয়ালে কোনোভাবেই ফাটল ধরানো যাচ্ছে না। ফাটল ধরাতে না পারলে সেনাবাহিনীও ভেতরে ঢুকতে পারবে না। এদিকে দেয়ালে ফাটল ধরানোর চেষ্টায় আরো কয়েক মাস চলে গেল। বিরক্ত শের শাহ মাইন বসিয়ে দুর্গের দেয়াল উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।

হিন্দুস্তানের সুরি বংশের প্রথম সম্রাট শের শাহ সুরি; Image Source: thefamouspeople.com

২১ মে, ১৫৪৫ সাল। দুর্গের দেয়ালের নিচে মাইন বসানো হয়েছে। শের শাহ নিজে তার বাহিনীর কার্যক্রম পরিদর্শন করছেন। মাইন ফাটানো হলো। হঠাৎ ঘটে গেল একটি অঘটন। মাইনের বিস্ফোরণে একটি গোলাবারুদের স্তুপে আগুন ধরে গেল। শের শাহ তখন সেদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন। আগুন ধরা মাত্রই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মাটি কেঁপে উঠলো। যে যেভাবে পারলো ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গেল। কিন্তু পালাতে পারলেন না স্বয়ং শের শাহ।

কালিঞ্জর দুর্গের তৈলচিত্র; Image Source: Wikimedia Commons

অগ্নিদগ্ধ শের শাহকে দ্রুত উদ্ধার করে তাবুতে নিয়ে আসা হলো। চিকিৎসকদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। আঘাতটি বেশ মারাত্মক ছিল। সম্ভবত শের শাহ বুঝতে পেরেছিলেন, পৃথিবীতে তার সময় শেষ হয়ে আসছে। তাই মৃত্যুর আগেই তিনি কালিঞ্জর দুর্গটি দখল করে যেতে চাইলেন। মুমূর্ষু শের শাহ তার সেনাবাহিনীকে একযোগে দুর্গে আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিলেন। শের শাহের সেনাবাহিনী পাগলের মতো দুর্গের উপর আছড়ে পড়লো।

এদিকে ইতোমধ্যেই শের শাহের আমিররা তার চারপাশে ভিড় জমাতে শুরু করেছেন। চিন্তায় তাদের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। এই অসময়ে মৃত্যুর জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিল না। তার পরে কে হিন্দুস্তানের হাল ধরবে? 

আসরের আজানের সময়ই দুর্গ দখলের সংবাদ পাওয়া গেলো। সংবাদটি শুনে মুমূর্ষু শের শাহ তৃপ্তির হাসি দিলেন।

কালিঞ্জর দুর্গের ভেতরের একাংশ; Image Source: columbia.edu

পরের দিনই অর্থাৎ, ১৫৪৫ সালের ২২ মে মারা গেলেন হিন্দুস্তানের নতুন এই বাঘ শের শাহ সুরি। বিহারের সাসারামে তাকে সমাহিত করা হলো। শের শাহ সুরির মৃত্যুর পর তার বড় পুত্র জালাল খান ইসলাম শাহ সুরি উপাধী নিয়ে হিন্দুস্তানের মসনদে বসলেন।

বিহারের সাসারাম, এখানেই শুয়ে আছেন হিন্দুস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি শের শাহ সুরি; Image Source: Wikimedia Commons

এদিকে মির্জা হিন্দালের করুণ মৃত্যু আর এই মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে সম্রাট হুমায়ুন আফগানদের উপর প্রবল আক্রমণ চালিয়ে তাদের কোমড় ভেঙে দিলেন। বাধ্য হয়ে আফগানরা মির্জা কামরানকে সাহায্য-সহযোগীতা বন্ধ করে দিলো। মরিয়া হয়ে কামরান মির্জা ছুটলেন হিন্দুস্তানে। তার লক্ষ্য এবার ইসলাম শাহ সুরির দরবার।

হিন্দাল মির্জা; Image Source: Wikimedia Commons

ইসলাম শাহ সম্ভবত তার আসল শত্রুকে চিনতে পারলেন না। যদি তিনি জানতেন আর কয়েক বছরের মাঝেই সম্রাট হুমায়ুন পুনরায় হিন্দুস্তানের মসনদ অধিকার করতে সক্ষম হবেন, তাহলে হয়তো তিনি মির্জা কামরানকে সাহায্য করে সম্রাট হুমায়ুনকে ব্যস্ত রাখতেন। একমাত্র এভাবেই সম্রাট হুমায়ুনকে কাবুল আর কান্দাহারের গোলকধাঁধায় আটকে রাখা সম্ভব হতো। শের শাহ মসনদে থাকলে এ সিদ্ধান্তই নিতেন।

কিন্তু, ইসলাম শাহ কামরান মির্জাকে সামরিক সহায়তা প্রদান করা তো দূরের কথা, তাকে রাজকীয় সম্মানটুকু পর্যন্ত দিলেন না। আক্ষরিক অর্থে কাবুল আর কান্দাহারের রাজনীতি নিয়ে তার তেমন আগ্রহও ছিল না। তাছাড়া ইসলাম শাহ মির্জা কামরানকে ভাই হত্যাকারী আর ভাইয়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কিছুটা ঘৃণাও করতেন। কিন্তু রাজনীতি ব্যক্তিগত ভালো লাগা বা না লাগার উপর নির্ভর করে না। এই কথাটা যদি ইসলাম শাহ অনুধাবন করতে পারতেন, তাহলে তা সুরি সাম্রাজ্যের জন্যই ভালো হতো। কারণ আর কয়েকদিন পরেই সম্রাট হুমায়ুন সুরি সাম্রাজ্যের মূলোৎপাটন করবেন।

যতদিন কামরান মির্জা ইসলাম শাহের দরবারে ছিলেন, ততদিনই তাকে নিয়ে উপহাস করা হতো। তিনি দরবার কক্ষে প্রবেশ করলে ইসলাম শাহের সভাসদরা উচ্চস্বরে হাসাহাসি করতো আর রসিকতা করতো এই বলে, “ময়ূর এসেছে, ময়ূর এসেছে।”

অতিষ্ঠ মির্জা কামরান দাঁতে দাঁত চেপে এসব উপহাস সহ্য করতেন। একদিন তিনি জানতে চাইলেন, এই ‘ময়ূর এসেছে’ কথাটার মানে কি? মির্জা কামরানকে উত্তর দেওয়া হলো, শুধুমাত্র বিশেষ ব্যক্তিদের জন্যই এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়। মির্জা কামরান তখন অকপটে বলে বসলেন, “তাহলে তো ইসলাম শাহ প্রথম শ্রেণীর ময়ুর আর শের শাহ তার চেয়েও বড় ময়ূর।”

মুহূর্তেই দরবারে সভাসদদের হাসি থেমে গেল। মির্জা কামরানকে নিয়ে যেন দরবারে আর কোনো রসিকতা করা না হয়, এই মর্মে একটি ফরমান জারি করলেন ইসলাম শাহ। অঘটন এরপরেও থামলো না। প্রায়ই ইসলাম শাহ সুরি আর মির্জা কামরানের মাঝে কবিতার মাধ্যমে কথোপকথন হতো। এমনই এক কথোপকথনে মির্জা কামরান একটি কবিতা পাঠ করলেন, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়,

কপালের লিখন এমনই যে সে শ্রেষ্ঠজনকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়, আর অযোগ্যদের বসিয়ে দেয় যোগ্যদের মাথার উপর।

মির্জা কামরান কী বলতে চাইছেন, সেটা অনুধাবন করতে বেগ পেতে হয়নি। ইসলাম শাহ সুরি প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হয়ে কামরান মির্জাকে বন্দী করলেন। সামরিক সহায়তা নিতে এসে বন্দী হলেন সম্রাট বাবরের উচ্চাভিলাষী এই পুত্র।

মির্জা কামরান প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। রাজা বকখু নামের স্থানীয় এক ভূস্বামীর সহায়তায় তিনি পালিয়ে সুলতানপুরে গাক্কারদের কাছে চলে গেলেন। গাক্কার গোত্রের দলপতি সুলতান আদম সম্রাটের হুমায়ুনের আনুগত ছিলেন।

এই তথ্যটি কামরান মির্জাও জানতেন। তাই তিনি সুলতান আদমকে অনুরোধ করলেন তার ব্যপারে সম্রাটকে না জানাতে। কিন্তু সুলতান আদম যদি কামরানের ব্যপারে সম্রাটকে না জানান, তাহলে তিনি আবার বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন। কাজেই বুদ্ধি করে কামরান মির্জার জীবনের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে সম্রাটকে মির্জা কামরানের অবস্থানের ব্যাপারে খবর দিলেন। এসব ১৫৫২ সালের ঘটনা।

কামরান মির্জার খবর পেয়ে সম্রাট হুমায়ুন সেনাবাহিনী নিয়ে সিন্ধু পাড়ি দিয়ে গাক্কারদের এলাকায় এলেন। তার সামনে পেশ করা হলো বন্দী কামরান মির্জাকে।

সম্রাট হুমায়ুন; Artist: Kailash Raj

সম্রাট কামরান মির্জার সাথে ভালো আচরণই করলেন, যেমনটা তিনি সারাজীবন করে এসেছিলেন। তিনি আকবরকে তার বামপাশে বসিয়ে মির্জা কামরানকে বসালেন তার ডানপাশে। সম্রাট এ সময় উপস্থিত সবাইকে নিয়ে তরমুজও খেলেন। 

সুলতান আদম খানকে তার কৃতকাজের উপহার স্বরূপ নিজস্ব পতাকা ও নাকাড়া দেয়া হলো। সাথে দেয়া হলো প্রচুর ধনসম্পদ।

এদিকে, মির্জা কামরানের ব্যপারে এবার বেশ সতর্কতা অবলম্বন করা হলো। তাকে তাবুতে বন্দী করে রাখা হলো। তার সব সেবক আর অনুগতদের থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা হলো। জওহর আবতাবচির উপর দায়িত্ব পড়লো কামরান মির্জাকে চোখে চোখে রাখার।

তিন দিন পর সম্রাট তার আমিরদের সাথে বসলেন কামরানকে কী করা হবে, সে ব্যপারে আলোচনা করতে। অধিকাংশ আমিরই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যপারে মত প্রকাশ করলেন। এমনকি বিচারকরাও মৃত্যুদণ্ডে ছিলেন। সম্রাট হুমায়ুনের দলের সবাই জীবনের কোনো না কোনো অংশে মির্জা কামরানের জন্য প্রচণ্ড কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। এদের মাঝে অনেকেই মির্জা কামরানের চাপিয়ে দেয়া অনর্থক যুদ্ধের জন্য অনেক আত্মীয়-স্বজনও হারিয়েছেন। কাজেই মির্জা কামরানের উপর তাদের ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।

তবে নিজের ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দিতে সম্রাট হুমায়ুন তখনো প্রস্তুত ছিলেন না। সম্রাটের মনোভাব বুঝতে পেরে সভাসদরা বললেন,

আপনি যদি ভাইয়ের দৃষ্টিতে কামরানকে দেখতে চান, তাহলে আপনার মসনদ ত্যাগ করা উচিত। বাদশাহের ভূমিকায় থাকতে হলে ভাইয়ের পরিচয়টি বিবেচনায় রাখা যাবে না। কিপচাকে এই মির্জা কামরানই আপনার মাথায় আঘাত করার নির্দেশ দিয়েছিল। তার ষড়যন্ত্রের কারণেই আফগানরা মির্জা হিন্দালকে হত্যা করেছে। কামরানের কারণেই অনেক চুগতাই নিহত হয়েছে। অনেক মহিলা আর শিশু লাঞ্ছিত হয়েছে। এ ঘাতক ভবিষ্যতে আমাদের স্ত্রী সন্তানকে আঘাত করুক, আমরা কেউই তা চাই না। আমরা আমাদের স্ত্রী-সন্তান আর সম্পদ সবকিছুই আপনার জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তবে কামরান মির্জার শাস্তি আপনাকে দিতে হবে।

সম্রাট তার সভাসদদের মনোভাব বুঝলেন। কামরান মির্জাকে এখন ক্ষমা করে দিলে বিদ্রোহ অবশ্যম্ভাবী। অনেক কষ্টে আমির আর অন্যান্যদের শান্ত করলেন। এরপর মির্জা কামরানকে অন্ধ করে দেয়ার পক্ষে নিজের মত প্রকাশ করলেন। এতে অন্তত ভাইয়ের জীবন তো রক্ষা পাবে!

ভাইদের ব্যাপারে আমিররা সম্রাটের মনোভাব ভালোভাবেই জানতেন। কাজেই তারা আর বেশি প্রতিবাদ করে পরিস্থিতি ঘোলাটে না করে সম্রাটের রায় মেনে নিলেন। কামরান মির্জাকে অন্ধ করে দিলেও হবে। একজন অন্ধ মানুষের পক্ষে বিদ্রোহ করার সুযোগ খুবই কম।

এদিকে বন্দী মির্জা কামরানও বেশ চিন্তিত অবস্থায় সময় অতিবাহিত করছিলেন। তিনি মোটামুটি নিশ্চিতই যে এবার তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তবে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি জওহরকে প্রশ্ন করলেন, আমাকে কি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে?

জওহর মির্জা কামরানকে শান্ত করার জন্য বেশ কৌশলী উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, মহামান্য বাদশাহ রাজকীয় চরিত্রের অধিকারি। নিজের বিচার বুদ্ধিমতো আমি শুধু এ কথাই বলতে পারি যে, কোনো লোকই স্বেচ্ছায় নিজের হাত ভেঙে দিতে পারে না। আর বাদশাহ হুমায়ুন তো বিশেষ সুবিবেচক ব্যাক্তি।

কামরান মির্জাকে অন্ধ করার দায়িত্ব পড়লো আলী দোস্ত আয়শেক আকার উপর। আলী দোস্তকে এই আদেশটি দিয়েছিলেন গোলাম আলী। এই আদেশ শোনা মাত্র আলী দোস্ত সরাসরি তা মানতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি গোলাম আলীকে বললেন,

আপনি বাদশাহর হুকুম ছাড়া কাউকে এক শাহরুখিও পরিশোধ করতে পারেন না। তাহলে আমি বাদশাহর নির্দেশ ছাড়া এ কাজ করতে যাবো কেনো? আগামীকাল যদি বাদশাহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি আমার ভাইয়ের চোখ তুলে নিয়েছ কেন, তখন আমি বাদশাহকে কী জবাব দেবো?

অবস্থা বেগতিক দেখে জওহর আবতাবচি নিজে আলী দোস্তকে নিয়ে সম্রাটের নিকট থেকে এই ব্যাপারে আদেশ গ্রহণ করলেন।

আলী দোস্তকে দেখে মির্জা কামরান বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন তাকে হত্যা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তবে আলী দোস্ত কামরান মির্জাকে বিনীত গলায় আশ্বস্ত করে বললেন,

মির্জা ধৈর্য্য ধারণ করুন। হত্যার আদেশ নেই। তবে এর আগে যেহেতু আপনি অনেক নিরপরাধ লোককে অন্ধ করে দিয়েছিলেন, কাজেই আপনাকেও অন্ধ করে দেবার আদেশ হয়েছে।’

এ কথা শুনে মির্জা কামরান বললেন, আমাকে এভাবে অন্ধ করার চেয়ে বরং আমাকে হত্যাই করে ফেলো। আলী দোস্ত বললেন, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ আপনাকে হত্যা করতে পারবে না।

মির্জা কামরান এরপর আর তেমন বাঁধা দেননি। তিনি মাটিতে শুয়ে পড়লেন। খেজুর কাটা দিয়ে তার দুই চোখে পঞ্চাশবারের মতো খোঁচা দেওয়া হলো। মির্জা কামরান এ সময় একটি শব্দ পর্যন্ত করেননি। তবে তার পা মাটিতে চাপ দিয়ে ধরে রাখা একজনকে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, আমার হাঁটুর উপরে উঠে বসে আছো কেন তুমি?

মির্জা কামরানের পোট্রেট; Image Source: rct.uk

নষ্ট চোখে লেবুর রস আর লবণ দিয়ে দেয়া হলো। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মির্জা কামরান বলে উঠলেন, হে আল্লাহ, পৃথিবীতে যত অন্যায় আমি করেছি, তার সাজা আমি পেয়ে গেলাম। আখেরাতে আমি তোমার ক্ষমা চাই।

মির্জা কামরানকে অন্ধ করার পুরো প্রক্রিয়াটি পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলেন সম্রাট হুমায়ুনের ব্যক্তিগত সহকারী ও পানিবাহক জওহর আবতাবচি। তবে এ পর্যায়ে মির্জা কামরানের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি তার তাবুতে চলে গেলেন।

অন্ধ করার পর কাবুলে পাঠাতে চাইলে মির্জা কামরান তাতে রাজী হলেন না। যে জায়গায় একসময় বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন, সেই জায়গাতেই অন্ধ হয়ে অন্যের দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। মির্জা কামরান সম্রাটের কাছে হজ্ব করতে মক্কা যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। ভগ্ন হৃদয়ে সম্রাট হুমায়ুন তার ভাইকে হজ্বে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

কামরান মির্জার বিদায়ের মুহূর্তটি হৃদয়বিদারক এক পরিবেশের সৃষ্টি করলো। মির্জা কামরানের চোখের ক্ষত তখনো শুকায়নি। তাই চোখে রুমাল বেঁধে তিনি সম্রাটের সামনে উপস্থিত হলেন।

ভাইয়ের এই করুণ আর অসহায় অবস্থা দেখে সম্রাট হুমায়ুন অঝোরে অশ্রু ঝরাতে লাগলেন। তবে মির্জা কামরান যেন শক্ত হয়ে গিয়েছেন। তিনি নিজেকে সামলালেন। যে ভাইকে একসময় হত্যা করার উদ্দেশ্য কাবুল আর কান্দাহারের এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তরে ছুটে বেড়িয়েছিলেন, অসহায় অবস্থায় আজ তিনি তার সেই ভাইকেই জড়িয়ে ধরলেন।

ভাইকে জড়িয়ে ধরে মির্জা কামরান শুধু একথাটাই বললেন যে, যা কিছু ঘটে গেছে, তার জন্য স্বয়ং তিনি নিজেই সত্যিকার দায়ী ছিলেন। সম্রাট হুমায়ুনও চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, হ্যাঁ ঠিক বলেছ, যা কিছু ঘটেছে তার জন্য আমি লজ্জিত। তবে এ সবের দায়ভার আমি কখনোই একা নেবো না।

আরো কিছু কথার পর দুই ভাই একসাথে কিছুক্ষণ পবিত্র কোরআন পাঠ করলেন। এরপর এলো বিদায়ের পালা। বিদায়ের পূর্বে মির্জা কামরান তার পরিবারের ও আশ্রিত লোকজনের দেখভালের দায়িত্ব সম্রাটকে দিয়ে গেলেন।

সিন্ধু নদের তীরে দুই ভাই একে অপরের থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন। দুজনই হয়তো জানতেন এ দেখাই তাদের শেষ দেখা। সম্রাট হুমায়ুনকে বিদায় জানিয়ে কিছুদূর এগোনোর পর দেখা গেলো মির্জা কামরান কাঁদছেন। শিশুদের মতো তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। সিন্ধুর তীরে আরেকজনও শিশুদের মতো ফুঁপিয়ে কান্না করছিলেন। তিনি হিন্দুস্তানের মসনদ হারানো দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন।

কামরান মির্জার মক্কা যাত্রায় তার সঙ্গী হয়েছিলেন তার সেবক চিলমা কোকা। তার স্ত্রী চোচক বেগমও স্বামীর সঙ্গে যাত্রা করলেন। চোচক বেগমের পিতা শাহ হুসেন আরগুন তাকে অন্ধ কামরান মির্জার সাথে মক্কা না যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। চোচক বেগম বলেছিলেন,

মির্জার হাতে যখন আপনি আমাকে তুলে দিয়েছিলেন, তখন তিনি অন্ধ ছিলেন না। ভাগ্যবিড়ম্বনায় আজ তিনি অন্ধ। এখন আমি যদি তাকে ত্যাগ করি, তাহলে সারা পৃথিবী বলবে শাহের কন্যা তার স্বামীর দুর্দিনে তাকে ত্যাগ করেছিল। এত বড় কলঙ্কের ভার আমি বইতে পারব না।

কামরান মির্জা স্ত্রীসহ হজ্ব করতে চলে গেলেন। তবে তিনি আর পিতার রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যে ফিরতে পারলেন না। মক্কাতেই ১৫৫৭ সালের ৫ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৯ বছর।

মুঘল বংশের রাজপুরুষদের মাঝে কামরান মির্জা একেবারেই ভিন্ন ধাঁচের ছিলেন। তার মাঝে যেমন বিরল কিছু গুণের সন্নিবেশ ঘটেছিল, আবার একইসাথে অতি নিচ কিছু দোষও তার মাঝে ছিল।

অন্যান্য মুঘল রাজপুরুষদের মতোই মির্জা কামরান চিলেন প্রচণ্ড সাহসী আর বীর যোদ্ধা। সম্রাট বাবরের সমকালীন সময় থেকেই তার যোদ্ধা জীবনের শুরু। সম্রাট বাবরের পক্ষে তিনি বেশ কয়েকবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

মির্জা কামরান একজন দক্ষ প্রশাসকও ছিলেন। হিন্দুস্তানে অভিযান চালানোর সময় সম্রাট তার হাতেই কাবুল আর কান্দাহার শাসনের গুরুদায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন। যতটুকু সময় সম্রাট বাবর পেরেছিলেন, নিজ হাতে মির্জা কামরানকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন।

মির্জা কামরান বিভিন্ন জাতির বিরুদ্ধে তার জীবনের বিভিন্ন সময়ে লড়াই করেছিলেন। এদের মাঝে যেমন আফগানরা আছে, তেমনই আছে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন গোত্র। তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য সম্ভবত ১৫৩৫ সালে। এই সময়ে তিনি পরাক্রমশালী পারস্য বাহিনীকে নাকানিচুবানি খাইয়ে কচুকাটা করেছিলেন। কাজেই তিনি যে তার সময়ের একজন যোগ্য জেনারেল ছিলেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।

মির্জা কামরানের আরেকটি সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি যে কাউকে সহজেই নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারতেন। তার ভেতরে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণাবলী ছিল। যে কারণে তিনি যেখানেই যান না কেন বা যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, সহজেই মিত্র আর অনুগত যোদ্ধা জুটিয়ে ফেলতে পারতেন।

তবে মির্জা কামরানের সবচেয়ে বড় মহানুভবতা ধরা হয় আকবরের সাথে তার আচরণকে। সম্রাট হুমায়ুনের সাথে যুদ্ধের রেষ ধরে বেশ কয়েক বছর শাহজাদা আকবরকে মির্জা কামরানের কাছে থাকতে হয়েছিল। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি সম্রাট হুমায়ুনের উপর প্রতিশোধ নিতে চাইলে আকবরকে হত্যা করতে পারতেন। তবে তিনি তা করেননি। এই যুদ্ধের ডামাডোলে তিনি তার ভাইপোকে রক্ষা করে গিয়েছিলেন। এছাড়াও মির্জা কামরান বেশ সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তিনি নিজেও একজন কবি ছিলেন।

তবে এতসব ভালো গুণের পাশাপাশি কামরান মির্জার অনেক দোষও ছিল। চরিত্রগত দিক থেকেই তিনি অত্যন্ত স্বার্থপর ব্যক্তি ছিলেন। তার এই দোষটি এতটাই প্রকট ছিল যে, স্বার্থের জন্য তিনি যেকোনো হীন কাজ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না।

তাছাড়া, উচ্চাকাঙ্ক্ষার নেশায় বেশ কয়েকবার হিতাহিত জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। দ্বিতীয়বার সম্রাট হুমায়ুনের নিকট থেকে কাবুল উদ্ধারের পর তিনি কাবুলবাসীকে যে পরিমাণ অত্যাচার করেছিলেন, তা কাবুলবাসী দীর্ঘদিন মনে রেখেছিল।

মির্জা কামরানের আরেকটা ভয়াবহ দোষ হলো তার প্রতারণাপূর্ণ আচরণ। প্রায় সময়ই তিনি তার প্রতিপক্ষকে মিথ্যা কথা আর ধোঁকার মাধ্যমে প্রতারণা করতেন, যা যেকোনো রাজপুরুষের জন্যই বেমানান।

সম্রাট হুমায়ুনের দীর্ঘদিনের ভাগ্যবিরম্বনার কারণ কিন্তু একমাত্র শের শাহই ছিলেন না। বরং বলা যায় শের শাহের চেয়েও সম্রাটের বেশি ক্ষতি করেছে তারই ভাই মির্জা কামরান। শের শাহের আঘাত সম্রাট সহজেই সামলে নিতে পারতেন, যদি বিপদের দিনে তিনি তার ভাইদের সাহায্য ও সমর্থন পেতেন। এতে যেমন সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা বজায় থাকতো, ঠিক তেমনই সম্রাটের ভাইরাও যার যার ভূখণ্ডে শান্তিতে রাজ্য শাসন করতে পারতেন।

কিন্তু প্রচণ্ড উচ্চাভিলাষী মির্জা কামরান সম্রাটের জন্য যত রকম সমস্যা তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল, সবই তৈরি করেছিলেন। মির্জা আসকারি সম্রাটের প্রতি তেমন বিদ্বেষপরায়ণ ছিলেন না। কিন্তু ভাই মির্জা কামরানের উস্কানিতে তিনিও সম্রাটের জন্য প্রতি পদে পদে বাঁধা তৈরি করেছিলেন। এক্ষেত্রে হিন্দাল মির্জা সম্রাটের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন। কিন্তু সম্রাটের প্রয়োজনের দিনে তাকেও কামরান মির্জার কারণে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।

ইতোমধ্যেই (১৫৫১ সালে) আসকারি মির্জার উপদ্রব থেকে সম্রাট মুক্ত হয়েছেন। তিনিও হজ্ব করতে মক্কা চলে গিয়েছেন। মির্জা কামরানও মক্কায় গিয়ে এবার সম্রাটকে একটা স্থায়ী সমাধান দিয়ে গিয়েছেন। সম্রাটের জন্য এখনই উপযুক্ত সময় নিজের হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা। এবং সব পিছুটান পেছনে ফেলে সম্রাট এবার সেই প্রস্তুতিই নিতে শুরু করবেন। লক্ষ্য এবার হিন্দুস্তান।

[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]

This article is in Bangla language. It's about the fall of Mirza Kamran.

References:

1. মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫

2. তাজকিরাতুল ওয়াকিয়াত, মূল: জওহর আবতাবচি, অনুবাদ: চৌধুরী শামসুর রহমান, দিব্য প্রকাশ, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ (চতুর্থ মুদ্রণ)

3. হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০১৬

4. মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩

Featured Image: joyfimg.pw

Related Articles

Exit mobile version