যোধপুরে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন: রাও মালদেব কি সম্রাটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন?

১৫৪১ সালের শুরুর দিকে সম্রাট হুমায়ুন যখন লাহোর থেকে পালিয়ে সিন্ধুতে গিয়েছিলেন, তখনই তিনি যোধপুরের রাজা রাও মালদেবের পক্ষ থেকে যোধপুর যাওয়ার নিমন্ত্রণ পান। সেই নিমন্ত্রণপত্রে তাকে শের শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করা হবে, এমন আভাসও দেওয়া হয়েছিলো। তবে তখনই সম্রাটের পক্ষে মালদেবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কারণ সম্রাট নিজেই হয় সিন্ধু থেকে সাহায্য নিয়ে কিংবা সিন্ধু বিজয় করে দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধারের চিন্তা করছিলেন তখন।

দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন; Image Source: Wikimedia Commons

কিন্তু বেশ কয়েকমাস সিন্ধুতে অবস্থান করেও কোনোভাবেই যখন সিন্ধুকে বাগে আনতে পারলেন না, তখন বাধ্য হয়ে সম্রাট যোধপুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

যোধপুরের উদ্দেশ্যে সম্রাট হুমায়ুন ১৫৪২ সালের মে মাসে ভক্কড় ত্যাগ করে উছ-এ আসলেন। তার বাহিনীতে তো খাদ্য আর পানীয় সংকট আগেই ছিলো। উছ-এ আসার পর তা আরো তীব্র আকার ধারণ করলো। সম্রাট পুনরায় বংশু লংগার কাছে রসদ সহায়তা চাইলেন। কিন্তু বংশু লংগার সম্রাটকে এবার খালি হাতে ফিরিয়ে দিলো। সম্রাট চরম অপমানিত হলেন।

সম্রাট আর কথা না বাড়িয়ে যাত্রা শুরু করে উছ থেকে দিলাওয়ারা, দিলাওয়ারা থেকে ওয়াসিলপুর হয়ে বিকানির থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে এসে ঘাটি গাড়লেন।

সম্রাট হুমায়ুন মালদেবের আমন্ত্রণে যোধপুর তো এলেন, কিন্তু তিনি মালদেবকে ঠিক বিশ্বাসও করতে পারছিলেন না। কারণ সম্রাটের দূত মীর সমন্দরকে বিকানিরে এসে মালদেবের দরবারে প্রেরণ করেছিলেন। মীর সমন্দর এসে সম্রাটকে জানালেন, মালদেব মৌখিক বন্ধুত্বের কথা বলছেন, কিন্তু তার মনোভাব মোটেও ভালো নয়।

এ সময় আলী বেগ পরামর্শ দিলেন দিলাওয়ার দুর্গ দখল করে নিতে। কিন্তু রাও মালদেব ব্যাপারটি ভালো নজরে দেখবেন না ভেবে তিনি আর এ ব্যাপারে অগ্রসর হলেন না।

এদিকে সম্রাটের শিবিরে খাদ্য সংকট ক্রমেই আশঙ্কাজনকভাবে তীব্রতর হচ্ছিলো। শেষপর্যন্ত সম্রাটকে খাদ্যের খোঁজে আশেপাশের এলাকায় সৈন্যদের পাঠাতে হলো। ফলৌদিতে এসে সৈন্যরা প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হলো।

এদিকে প্রায় একই সময় মালদেবের পক্ষ থেকেও সম্রাটের জন্য উট বোঝাই করা রসদ সামগ্রী আর প্রয়োজনীয় সম্পদ এসে পৌঁছালো। মালদেব সাথে একটি পত্রও সম্রাটকে দিলেন। পত্রে তিনি সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, আমি আপনাকে বিকানির দিয়ে দিচ্ছি!

১১৭০ থেকে ১১৯৪ সাল পর্যন্ত রাজপুতানার শাসক ছিলেন রাজা জয়চন্দ্র। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় রাজপুতরা হিন্দুস্তানের মাটিতে বেশ শক্ত অবস্থানে ছিলো। তবে ১১৯১ সালে পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে পরাজয়ের পরের বছরই শিহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়ে তারই বিশ্বস্ত সেনাপতি কুতুবুদ্দীন মুহাম্মদ আইবেককে দিল্লি দখলের নির্দেশ দিয়ে নিজের রাজধানীতে ফিরে যান।

সুলতান মুইজউদ্দীন মুহাম্মদ শিহাবুদ্দীন ঘুরি; Image Source: historydiscussion.net

এদিকে মুসলিমরা স্থায়ীভাবে হিন্দুস্তানে সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা চালালে রাজা জয়চন্দ্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসেন। শিহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরিকে আরেকবার হিন্দুস্তানে আসতে হলো। রাজা জয়চন্দ্র পরাজিত হলেন। রাজপুতানার রাঠোর রাজপরিবার চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। পরবর্তীতে এ রাজবংশের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যোধপুরে এসে রাজত্ব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। রাও মালদেব এই রাঠোর বংশেরই শাসক ছিলেন।

মালদেবের পিতা রাও গাঙ্গা ১৫১৫ সাল থেকে শুরু করে ১৫৩২ সাল পর্যন্ত যোধপুর বা মারওয়ার রাজ্যটি শাসন করেছিলেন। তিনি নিতান্তই ভদ্র ও নিরীহ একজন শাসক ছিলেন। ফলে তার শাসনামলে রাজ্যের বিস্তার ঘটেনি। কিন্তু এর বিপরীতে মালদেব ছিলেন বেশ উচ্চাকাঙ্খী এবং উগ্র। রাজ্যবিস্তার নীতি নিয়ে পিতার সাথে মতবিরোধের জের ধরেই রাও গাঙ্গা নির্মমভাবে মালদেবের হাতে খুন হলেন। এরপর যোধপুরের সিংহাসনে বসলেন রাও মালদেব। যোধপুর রাজ্য বলতে তখন শুধুমাত্র যোধপুর আর সুজাতই ছিলো। কিন্তু মালদেব শীঘ্রই রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করলেন।

গুজরাটে যখন বাহাদুর শাহের মৃত্যু ঘটলো, তখন গুজরাটের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগে তিনি বেশ কিছু ভূখন্ড দখল করে নিলেন। শের শাহের সাথে সম্রাট হুমায়ুন যখন কনৌজের যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, মালদেবের রাজ্য তখন যোধপুর, বিকানির, নাগৌর, মেরতা, জয়সলমীরসহ জয়পুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিলো।

ধীরে ধীরে মালদেবের রাজ্য দিল্লির আশপাশ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো। ঐ সময় মূলত মুঘল সাম্রাজ্য (হুমায়ুনের পতনের পর শের শাহের) আর মালদেবের সীমানা এক জায়গাতেই এসে ঠেকেছিলো। এ সময় মালদেবের অধীনে ছিলো প্রায় ৫০,০০০ অশ্বারোহী যোদ্ধার এক দুর্দান্ত সেনাবাহিনী, যা দিল্লি শাসনকারী যেকোনো শাসকেরই পিলে চমকে দিতে সক্ষম ছিলো।

বিকানির চরম দুর্দশাগ্রস্থ সম্রাট হুমায়ুনকে দিয়ে দেওয়াটা মালদেবের মহত্ত্ব মনে হতে পারে। তবে ব্যাপারটি রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখলে তেমন মনে হয় না।

মালদেব বিকানির দখল করেছিলেন জাইতসিরের নিকট থেকে। বিকানির হারানোর পর জাইতসি শের শাহের নিকট সাহায্য চাইলে শের শাহও সাহায্যের অঙ্গীকার করলেন। মালদেব পড়লেন উভয় সংকটে। শের শাহের আক্রমণের মুখে তিনি না পারবেন বিকানির দখলে রাখতে, আবার বিকানির হারানোর ইচ্ছাও তার নেই। এ সংকট থেকে বেঁচে থাকতে তিনি বেছে নিলেন নির্বাসিত সম্রাট হুমায়ুনকে। এ কারণে যোধপুরে পা দেয়া মাত্রই মালদেব হুমায়ুনকে বিকানির দিয়ে দিলেন। এখন থেকে বিকানির রক্ষার দায়িত্ব সম্রাট হুমায়ুনের!

রাজনীতিতে নিঃস্বার্থভাবে কেউ কিছু করে না। রাজনীতির খেলার প্রতিটি চালের পেছনেই থাকে অনেক সূক্ষ্ম অনেক হিসাব-নিকাশ। মালদেবও এমন সূক্ষ্ম কিছু হিসাব করেই সম্রাট হুমায়ুনকে যোধপুরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

যদিও নির্বাসিত সম্রাট হুমায়ুনকে নিজের এলাকায় ডেকে আনা মালদেবের জন্য বেশ বিপজ্জনক একটি সিদ্ধান্ত ছিলো। কারণ এতে শের শাহ অবশ্যই রুষ্ট হবেন। কিন্তু রাজনীতির মাঠের হিসাব নিকাশে এই ঝুঁকি নেয়াটা মালদেবের জন্য একইসাথে লাভজনক আবার বিপজ্জনক হিসেবে দেখা দিলো।

যোধপুরের রাও মালদেব; Image Source: Wikimedia Commons

মালদেব যে শুধু বিকানির রক্ষার স্বার্থেই হুমায়ুনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তা কিন্তু মোটেই সত্য না। বরং তিনি চাইছিলেন নির্বাসিত এই সম্রাটকে তার সিংহাসনে বসিয়ে উত্তর ভারতে নিজের প্রভাব বাড়াতে। তবে এতে বিপদটাও কিন্তু নিছক কম ছিলো না। এই পরিকল্পনায় ব্যর্থ হলে মালদেবের নিজেরই সিংহাসন হারানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিলো। তারপরেও তিনি এই ঝুঁকিটুকু নিলেন।

কারণ যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় রাজনীতির পালের বাতাস মালদেবের পক্ষেই বইতে শুরু করেছিলো।

কনৌজের যুদ্ধের পরে হিন্দুস্তানের নতুন অধিপতি হয়ে দিল্লির মসনদে তো শের শাহ বসলেন। তবে প্রশাসন গুছিয়ে নেয়ার জন্য তার কিছুটা সময় প্রয়োজন ছিলো।

১৫৪১ সালের শুরুর দিকটায় শের শাহ গাক্কারদের বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। একই সময় বাংলা থেকেও বিদ্রোহের সংবাদ পেলেন শের শাহ। এই বিদ্রোহ দমন করতে সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বাংলার সীমান্তে মোতায়েন করা হলো। শের শাহ স্বয়ং বাংলা সীমান্তের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। গাক্কারদের বিরুদ্ধে অভিযানে পেছনে রেখে এলেন প্রায় ৫০,০০০ অশ্বারোহী যোদ্ধা। অন্যদিকে শের শাহের সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ গোয়ালিয়র আর মালব অঞ্চলে ব্যস্ত ছিলো।

মালদেব শের শাহের এই চরম ব্যস্ততাকেই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মালদেবের পরিকল্পনা ছিলো, সম্রাট হুমায়ুনকে যোধপুরে ডেকে এনে সামরিক সহায়তা দিয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসানো। অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি সম্রাট হুমায়ুনকে পত্র প্রেরণ করলেন যোধপুরে আসার জন্য। সম্রাট হুমায়ুন আসলেন, তবে কয়েকমাস দেরি করে।

সম্রাট হুমায়ুন যখন মাত্র যোধপুরে পা দিয়েছেন, শের শাহ আসলেই তখন ব্যাপক ব্যস্ত ছিলেন। গাক্কার বিদ্রোহ দমন করে বাংলার দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন তিনি। বাংলা থেকে আগ্রা ফিরে এসেই আবার মালব অঞ্চলের অভিযানে নেতৃত্ব দিতে হয়েছিলো তাকে।

মালব অভিযান শেষ করে ১৫৪২ সালের শেষের দিকে শের শাহ আগ্রা এসে পৌঁছান। এসেই তিনি সম্রাট হুমায়ুনের যোধপুরে অবস্থানের ব্যাপারে জানতে পারেন। শের শাহ বুঝে গেলেন, সম্রাট সামান্য সুযোগ পেলেই দিল্লির মসনদ আবারও অধিকার করে নেবেন।

তিনি কোনো কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ধার কাছ দিয়ে না গিয়ে সরাসরি বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে যোধপুর থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরের নাগৌড়ে গিয়ে রাও মালদেবকে বার্তা পাঠালেন। বার্তার ভাষা পরিষ্কার। হয় হুমায়ুনকে বিতাড়িত করুন, নয়তো আফগানদের ঢুকে বিতাড়িত করতে দিন।

হিন্দুস্তানের নতুন সম্রাট শের শাহ; Image Source: thefamouspeople.com

রাও মালদেব উভয় সংকটে পড়ে প্রমাদ গুণতে লাগলেন। তিনি এই বিপদের আশংকাটুকু জানতেন। তবে ধারণাও করতে পারেননি যে শের শাহ এত দ্রুত সামরিক তৎপরতা দেখাবেন। এদিকে তিনিও শের শাহের দানবীয় বাহিনীর সাথে তাৎক্ষণিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, অন্যদিকে মুঘলরাও যে সাহায্য করবে, এমন অবস্থাও ছিলো না।

এদিকে শের শাহের বার্তাবাহক যখন এই বার্তা নিয়ে মালদেবের দরবারে অবস্থান করছিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময়ই মালদেবের দরবারে প্রবেশ করলেন সম্রাট হুমায়ুনের বিশ্বস্ত আমির শামসুদ্দিন মুহাম্মদ আতাগা খান। মালদেব গেলেন আরো ফেঁসে। তিনি না শের শাহের দূতকে কোনোভাবে আশ্বস্ত করতে পারছেন, আর না মুঘল সম্রাটকে সতর্ক করতে। উপরন্তু আতাগা খানের সামনে সম্রাট সম্পর্কে বিরূপ কোনো মন্তব্যও করতে পারছিলেন না। কারণ তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। অবশ্য মালদেব পরিস্থিতি বেশ বিচক্ষণতার সামনে সামাল দিলেন।

তিনি প্রথমেই আতাগা খানকে বন্দী করলেন। এরপর আতাগা খানের সামনেই কিছু সৈন্যকে মুঘল শিবিরের দিকে প্রেরণ করলেন, যাতে শের শাহের দূত আশ্বস্ত হয়। কিছুক্ষণ পরই আতাগা খানকে পালানোর সুযোগ করে দেয়া হয়, যেন তিনি নিজ চোখে যা দেখেছেন তা সম্রাটকে বর্ণনা করতে পারেন।

এদিকে আতাগা খানের পৌঁছানোর আগেই সম্রাট হুমায়ুন তার পুরনো এক কর্মচারী মোল্লা সুরখের নিকট থেকে একটি পত্র পেলেন। সম্রাট হুমায়ুনের এই কর্মচারী একসময় সম্রাটের গ্রন্থাগারিক ছিলেন। কনৌজের যুদ্ধে সম্রাটের পরাজয়ের পর তিনি যোধপুরে মালদেবের অধীনে চাকরি নিয়েছিলেন। মোল্লা সুরখের পাঠানো পত্রে লেখা ছিলো,

‘আপনার অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে আমি সাবধান করে দিচ্ছি। যেখানে আছেন, সেখান থেকে আর অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা না করে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করুন। মালদেব আপনাকে বন্দী করার পরিকল্পনা করেছেন। তার কথাও আপনি মোটেও বিশ্বাস করবেন না। শের শাহের পক্ষ থেকে একটি অগ্রবর্তী দল মালদেবের কাছে পৌঁছেছে। দূতদের হাতে পাঠানো চিঠিতে শের শাহ মালদেবকে জানিয়েছেন, যেকোনো উপায়েই হোক, বাদশাহকে বন্দী করুন। এ কাজে সফল হলে আপনাকে নাগৌর, আলোয়ারসহ আপনার পছন্দের যেকোনো অঞ্চল আপনাকে দিয়ে দেয়া হবে।’

এদিকে আতাগা খান পৌঁছেই সম্রাটকে একই ঘটনা শোনালেন।

মুহুর্তেই মুঘল শিবিরে হৈ চৈ পড়ে গেলো। যে যার মতো করে যা যা পারলো তা-ই নিয়ে পালাতে লাগলো। মুঘল শিবিরের দুরবস্থার কথা তো আগেই অনেক জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। যোধপুর থেকে পলায়নের সময় মুঘল শিবিরের দৈন্যতা আরেকবার ধরা পড়লো। পালানোর সময় সম্রাটের স্ত্রী হামিদা বানুর চড়ার জন্য কোনো ঘোড়া পাওয়া গেলো না। এ সময় তিনি ছিলেন সন্তানসম্ভাবা।

সম্রাট তরদী বেগকে নির্দেশ দিলেন তার ঘোড়াটি দেয়ার জন্য। তরদী বেগ সম্রাটের নির্দেশের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করলেন না। বাধ্য হয়ে সম্রাট তার স্ত্রীকে নিজের ঘোড়াটি দিয়ে জওহরের সাথে উটের পিঠে চড়তে গেলে মাহাম আগার স্বামী নাদিম আগা তার ঘোড়াটি হামিদা বানুকে দিলেন এবং নিজেই উটের পিঠে চড়লেন।

এই ঘটনাটি থেকে সম্রাট হুমায়ুন তার বিপদের দিনে তার বেশ কিছু আমিরের থেকে কেমন আচরণ পেয়েছিলেন তা বোঝা যায়। একজন সম্রাট হিসেবে নিজের দুর্দিনে হুমায়ুন এসব কীভাবে সহ্য করেছিলেন কে জানে!

মালদেব সম্রাট হুমায়ুনের সাথে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন কি না, এ প্রশ্ন আসলে সমসাময়িক মুঘল ঐতিহাসিকেরা সরাসরি কিছু বলেননি।

যেমন, সম্রাটের ব্যক্তিগত পানিবাহক জওহর লিখেছেন,

‘মালদেবের উদ্দেশ্য ছিলো সম্রাটকে কষ্ট দেয়া।’

আব্দুল কাদির বদায়ূনী লিখেছেন,

‘শের শাহের সতর্কবার্তা পাওয়ার পর মালদেব এক বিশাল বাহিনীকে বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে বাদশাহ হুমায়ুনকে স্বাগত জানানোর বাহানায় তাঁকে বন্দী করার জন্য পাঠালেন।’

ফিরিশতা লিখেছেন,

‘মালদেব হুমায়ুনের সৈন্যদের অব্যবস্থাপনা আর দুর্দশা দেখে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনুতাপ করতে লাগলেন। শেষমেষ সম্রাটকে বন্দী করে শের শাহের নিকট পাঠিয়ে শেরশাহের আনুগত্য প্রমাণের চেষ্টা চালালেন।’

নিজামউদ্দিন আহমদ লিখেছেন,

‘রাও মালদেব হুমায়ুনের পৌঁছানোর খবর পেয়ে এবং তার কাছে সামান্য সংখ্যক সৈন্য থাকার কথা জানতে পেরে খুবই চিন্তিত হয়ে গেলেন। কারণ তিনি শের শাহকে মুকাবিলা করার মতো শক্তি পাচ্ছিলেন না।’

অন্যদিকে আকবরের সভাসদ আবুল ফজল পূর্ববর্তীদের সূত্র ধরে বলেছেন,

‘কিছু লোক এ কথাও বলতেন যে, প্রথম দিকে হুমায়ুনের প্রতি মালদেবের মনোভাব পবিত্র ছিলো এবং তিনি তাঁকে সহযোগীতাও করতে চাচ্ছিলেন। পরে, হয় হুমায়ুনের সৈন্যদের দুর্দশা এবং কম সংখ্যা দেখে, নতুবা শের শাহের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও ক্রমবর্ধমান শক্তির কারণে মালদেবের মনোভাব বদলে গিয়েছিলো। সম্ভবত এর কারণ ছিলো শের শাহের প্রতি ভয়।’

এসব থেকে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, মুঘল ঐতিহাসিকেরাও আসলে একবাক্যে একথা বলছেন না যে মালদেব বিশ্বাসঘাতক ছিলেন।

তবে এটা নিশ্চিত যে, মালদেব সম্রাটকে যোধপুরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র দিয়েছিলেন। তিনি শের শাহের বাংলা ও গাক্কার বিরোধী অভিযানের প্রেক্ষাপট থেকে সম্রাটকে সাহায্যও করতে চাইছিলেন, আবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইছিলেন। এবং তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটা মোটেও দোষের কিছু ছিলো না।

কিন্তু সমস্যা হলো সম্রাট হুমায়ুন মালদেবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে একটু বেশিই সময় নিয়ে ফেলেছিলেন। ততদিনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিলো। গাক্কার বিদ্রোহ অনেকটাই দমন করে ফেলা হয়েছিলো। বাংলার বিদ্রোহ মাথাচাড়া দেয়ার আগেই দমন করা হয়। এমনকি শের শাহ সমগ্র মালব অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে সবেমাত্র ধীরে সুস্থে আগ্রা ফিরে গিয়েছিলেন। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই হুমায়ুন যোধপুরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন।

শের শাহ যখন যোধপুরে হুমায়ুনের উপস্থিতির কথা জানলেন, তখন তিনি এতটাই দ্রুত সামরিক পদক্ষেপ নিলেন যা সম্ভবত মালদেবের হিসাবেও ছিলো না। শের শাহ যোধপুরের কাছাকাছি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে এসে যখন মালদেবকে বার্তাযোগে ভয়ভীতি দেখাতে লাগলেন, তখন মালদেবের আসলে করার মতো কিছুই ছিলো না।

কারণ তিনি এত দ্রুত শের শাহের মুকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। উপরন্তু তিনি মুঘল সেনাবাহিনীর এমন চরম দুরাবস্থার কথাও জানতেন না। তিনি আশা করেছিলেন শের শাহের সাথে সংঘর্ষ যদি বেঁধেই যায়, তাহলে অবশ্যই মুঘলরা সাহায্য করবে। কিন্তু নতুন বাস্তবতায় তিনি অনুধাবন করলেন, মুঘলরা কাউকে সাহায্য করার মতো অবস্থায় আর নেই।

মালদেব যে বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না, তার আরেকটি প্রমাণ তিনি চাইলেই শের শাহের পত্রের প্রেক্ষিতে সম্রাটকে বন্দী করে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি এর কোনো চেষ্টাও করেননি। যদিও তিনি একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন হুমায়ুনকে বন্দী করার জন্য, কিন্তু আসলে সেটি শের শাহকে দেখানো ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। কারণ আকারে মুঘল সেনাবাহিনী থেকে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও মালদেবের বাহিনী বড় কোনো সংঘর্ষে না জড়িয়ে হুমায়ুনকে শুধুমাত্র তাড়া করছিলো।

মালদেব আসলে চাইছিলেন যেকোনোভাবেই হোক সম্রাটকে যোধপুর থেকে দূরে সরিয়ে দিতে। কারণ পরিবর্তিত বাস্তবতায় শের শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেয়ে শের শাহকে সন্তুষ্ট করাতেই মালদেব নিজের মঙ্গল দেখেছিলেন। তা না হলে সম্রাট হুমায়ুন তো ধরা পড়তেনই, সেই সাথে মালদেবও নিজের সিংহাসন হারাতেন।

কাজেই মালদেব যে বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না, তা একেবারে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

এদিকে বিকানির থেকে পালিয়ে সম্রাটের বহর প্রথমে ফলৌদিতে পৌঁছায়। এখান থেকে মালদেবের পাঠানো রাজপুত যোদ্ধারা মুঘল বহরের পিছু ধাওয়া করতে লাগলো। ছোটখাট কিছু সংঘর্ষ হতে লাগলো বটে, তবে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো তাদের উদ্দেশ্য সম্রাটকে বন্দী করা ছিলো না। বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিলো শের শাহকে বুঝ দেয়া।

মুঘল বহর ধীরে ধীরে ফলৌদি থেকে সাতলমীর হয়ে ১৫৪২ সালের ১৩ আগস্ট জয়সলমীরে পৌঁছালো।

সম্রাটের এই যাত্রাটি বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো। যাত্রাপথ দুর্গম ছিলো। শিবিরে যথেষ্ট খাদ্য ও পানীয় ছিলো না। আর আবহাওয়াও ছিলো চরম। চারদিকে গরম বাতাস বইছিলো। এই বাতাসে টিকে থাকাই দায় ছিলো। উটকো ঝামেলা হিসেবে দেখা দিলো মরুভূমির নরম বালি। নরম বালিতে ঘোড়া, উটসহ অন্যান্য প্রাণীর পা বালিতে বারবার দেবে যাচ্ছিলো। পানি স্বল্পতায় মানুষের পাশাপাশি পশুগুলোও কষ্ট করছিলো। ফলে যাত্রার গতি কমে যাচ্ছিলো। বাধ্য হয়ে সবাইকে পায়ে হেঁটে মরুর উত্তপ্ত বালির উপর দিয়ে চলতে হলো।

গরমের থেকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছিলো পানি। যাত্রাপথের একপর্যায়ে সংরক্ষিত সব পানি শেষ হয়ে গেলে কষ্ট আরো তীব্র হলো। একবার প্রায় ৩ দিন কোনো পানি ছাড়াই পথ চলতে হলো। অনেক মানুষ আর পশু সেই ধাক্কায় মারা গেলো। এভাবেই ধুকতে ধুকতে মুঘল বহর এগোতে লাগলো।

জয়সলমীরের সীমান্তে পৌঁছে সম্রাট হুমায়ুন পড়লেন নতুন ঝামেলায়। জয়সলমীরে গরু জবাই করা নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু সম্রাট হুমায়ুনের কিছু সৈন্য গরু জবাই করে তার মাংস দিয়ে ক্ষুধা মেটালে জয়সলমীরের রাজা রাও লোনকরণ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে দূত প্রেরণ করলেন। সম্রাট সেই দূতকে বন্দী করলেন।

এই ঝামেলার ফলশ্রুতিতে সম্রাটের পথের আশেপাশে থাকা সমস্ত পানির উৎসগুলো নষ্ট করে ফেলা হলো। সম্রাটের ক্ষমতা থাকলে তিনি অবশ্যই এর শোধ তুলে ছাড়তেন। কিন্তু সমস্যা হলো তিনি এখন ক্ষমতাহীন হয়ে নিজ সাম্রাজ্য থেকেই বিতাড়িত। ফলে সম্রাট বাধ্য হলেন নতুন কোনো আশ্রয়স্থল খুঁজতে। তখনই সম্রাটের মাথায় এলো অমরকোটের নাম।

শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু। এই নীতিতে সম্রাট অমরকোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঘটনা হলো, অমরকোটের রাণা পারসাদের পিতাকে সিন্ধুর শাহ হুসেন আরগুন হত্যা করেছিলেন। এই হিসাবে শাহ হুসেন আরগুণ ছিলেন রাণা পারসাদের শত্রু। আবার শাহ হুসেন আরগুণের শত্রু হচ্ছেন সম্রাট হুমায়ুন। কাজেই শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু, এই নীতিতে সম্রাট হুমায়ুন অমরকোটের রাণাকে নিজের বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করলেন। পারসাদের সহায়তায় তিনি প্রথমে সিন্ধু বিজয় করতে চাইছিলেন।

সম্রাট হুমায়ুনের নির্বাসনকালীন জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত স্থান। এই লেখায় সম্রাট হুমায়ুনের ‘4’ নাম্বার চিহ্নিত স্থানে অবস্থানের ঘটনাগুলো আলোচনা করা হয়েছে। যোধপুর থেকে বিতাড়িত হয়ে সম্রাট হুমায়ুন অমরকোটের দিকে অগ্রসর হন। ম্যাপে অমরকোট ‘5’ নাম্বার দ্বারা চিহ্নিত করা আছে; Image Source: farbound.net

১৫৪২ সালের ২২ আগস্ট মাত্র ৭ জন অশ্বারোহী নিয়ে সম্রাট অমরকোট পৌঁছান। অমরকোটের পক্ষ থেকে সম্রাটকে উষ্ণ সম্মাননা জানানো হলো। পারসাদের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা পেয়ে বাকিদের অমরকোটে ডেকে আনা হলো। পারসাদ মুঘলদের জন্য যা যা প্রয়োজনীয় তার সবই ব্যবস্থা করে দিলেন।

সম্রাট হুমায়ুন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। আপাতত কিছু সময়ের জন্য হলেও মুঘলরা একটি নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছেন। হয়তো এখান থেকে ভবিষ্যতে যুদ্ধ করার মতো সাহায্যও পাওয়া যাবে। দীর্ঘদিন পর নির্বাসিত মুঘল সম্রাট হুমায়ুন আবারও আশার আলো দেখতে লাগলেন।

মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে পূর্বে প্রকাশিত সবগুলো পর্ব একসাথে পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

 

 

This article is in Bangla Language. The article is about Mughal emperor Humayun when he was in Jodhpur.

 

তথ্যসূত্র

১. মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০০৫

২. হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৬

৩. তারিখ-ই-শের শাহ; মূল: আব্বাস সারওয়ানী, অনুবাদ গ্রন্থের নাম: শের শাহ, অনুবাদক: সাদিয়া আফরোজ, সমতট প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৫

Featured Image: Wikimedia Commons

Related Articles

Exit mobile version