কিছু কিছু ছবি আছে যেগুলো পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। সেসব নাড়িয়ে দেয়া ছবিগুলো চিরকাল একরকম থাকলেও ছবির মানুষগুলো বাস্তবে একরকম থাকে না। সময়ের সাথে সাথে তাদের জীবনে পরিবর্তন আসে। এরকম কয়েকটি বিখ্যাত ছবি, ছবির ব্যক্তি ও তাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আজকের আয়োজন।
১. দ্য আফগান গার্ল
১৯৮৪ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের ফটো সাংবাদিক স্টিভ ম্যাককারি বিখ্যাত এই ছবিটি তোলেন। ছবির মেয়েটির নাম শরবত গুলা। তিনি আফগানিস্তানের নাগরিক। ১৯৮০ সালের দিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় বিমান হামলায় তার পিতামাতা নিহত হয়। এরপর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন পাকিস্তানের একটি শিবিরে। তখন আলোকচিত্রি স্টিভ এই ছবিটি ধারণ করেন। তখন শরবত গুলার বয়স ছিল আনুমানিক ১২ বছর।
ছবিতে তার ময়লা চুল, জীর্ণ পোশাক, ব্যতিক্রমী সবুজ চোখ আর হাহাকারপূর্ণ দৃঢ় চাহনির ফলে আলোড়ন পড়ে যায় সারা দুনিয়ায়। এই ছবিটি হয়ে উঠে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের প্রতিচ্ছবি। শুধু আফগানিস্তান কেন, সমস্ত পৃথিবীর যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা ও শরণার্থীর প্রতীক হয়ে উঠে এই ছবি। ১৯৮৫ সালের জুন সংখ্যায় এটি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রচ্ছদে স্থান পায়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অন্যতম সেরা ছবি হয়ে উঠে এটি। শুধু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী ছবি হিসেবে এটি পরিচিতি লাভ করে।
ছবিটি প্রকাশের পর ন্যাট-জিও কর্তৃপক্ষ হাজার হাজার চিঠি পায় যারা মেয়েটিকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে চায়। কেউ কেউ তাকে দত্তক নিয়ে লালন পালন করতে চেয়েছে। এমনকি কেউ কেউ তাকে স্ত্রী হিসেবেও গ্রহণ করতে চেয়েছে।
অনেকদিন ধরে তার নাম জানা ছিল না। ছবি তোলার সময় আলোকচিত্রি স্টিভ ম্যাককারি তার নাম জানতেও চাননি। ততদিন পর্যন্ত তিনি সারা দুনিয়ায় ‘আফগান গার্ল’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ১৭ বছর পর স্টিভ ম্যাককারি তার খোঁজে বের হন এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার সন্ধান পান। বর্তমানে তিনি তার স্বামী ও তিন সন্তানের সাথে তোরা বোরা পর্বতে বসবাস করছেন। সম্প্রতি তাকে নিয়ে মিডিয়া পাড়ায় বেশ আলোড়ন হয়েছে। তিনি পাকিস্তানে থেকে যান, কিন্তু একজন বহিরাগতকে পাকিস্তান রাখতে নারাজ। অবৈধ অবস্থানকারী হিসেবে তাকে জেলে যেতে হয়েছে এবং একসময় চার সন্তানসহ আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
২. কিম ফুক
১৯৭২ সালের ৮ই জুনের ঘটনা। তখন উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাঝে যুদ্ধ চলছে। ছবিতে কিম ফুক নামে ৯ বছরের একটি বালিকা অগ্নিদহ হয়ে দৌড়াচ্ছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামিদের বিমান হামলায় তার গায়ে আগুন লেগে গিয়েছিল। তার গায়ে কাপড় নেই কারণ আগুনে কাপড় পুড়ে গিয়েছিল। শুধু কাপড়ই নয়, পুরো গা ঝলসে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগেই বোমা হামলায় তার পিতামাতা মৃত্যুবরণ করে।
এই ছবির আলোকচিত্রি নিক উট এবং আরো কয়েকজন সাংবাদিক মিলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। অনেক কষ্টে তার প্রাণ রক্ষা হয়। এসোসিয়েটেড প্রেসের নিয়ম অনুসারে সেখানে ন্যুড ছবি প্রকাশ করা হয় না। কিন্তু এটি এমন এক ছবি যা নিয়মের শক্তির চেয়েও বেশি শক্তিশালী। নিয়ম ভঙ্গ করে এই ছবি প্রকাশ করা হয় এবং পুরো বিশ্বের বিবেক প্রকম্পিত হয়ে যায়। এই ছবি পুরো যুদ্ধের উপর প্রভাব ফেলে এবং যুদ্ধ থামাতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। এই ছবির জন্য আলোকচিত্রি নিক উট পুলিতজার পুরষ্কার লাভ করেন।
কিম ফুক বর্তমানে ভালো আছেন। বেঁচে আছেন, তবে সারা গায়ে এখনো লেগে আছে সেই আঘাতের ছাপ। ১৯৯৭ সালে তিনি ‘কিম ফুক ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন যেখানে যুদ্ধ আক্রান্ত শিশুদেরকে চিকিৎসা ও মানসিকভাবে সাহায্য করা হয়। দুই সন্তান নিয়ে বর্তমানে তিনি কানাডায় বসবাস করছেন।
৩. আমেরিকান গার্ল ইন ইতালি
১৯৫১ সালে তোলা ছবিটিতে হেঁটে যাওয়া নারীটির নাম নিনালি ক্রেইগ। আইকনিক এই ছবিটি তুলেছিলেন রুথ অর্কিন। এই ছবি সম্পর্কে ছবিটির নায়িকা নিনালি বলেন “কেউ কেউ এটিকে নারী উত্যক্তকরণের উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু আসলে এটি উত্যক্তের উদাহরণ নয়, এই ছবির মানে হচ্ছে একজন নারী স্বাধীনভাবে সুন্দর কিছু সময় কাটাচ্ছে।” ছবিটি তোলার সময় তার বয়স ছিল ২৩ বছর। এ সময়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ছয় মাস ব্যাপী সময় নিয়ে ফ্রান্স, স্পেন ও ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তখনকার সময়ে খুব কম নারীই এমনভাবে সময়কে উপভোগ করতে পেরেছে।
বর্তমানে তার বয়স ৮৯ বছর। তিনি স্বামীর সাথে কানাডার টরন্টোতে বসবাস করছেন। আর আলোকচিত্রি রুথ অর্কিন ১৯৮৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। অনেক বিখ্যাত ছবি তুলেছেন সারা জীবনে। সেসবের মাঝে আমেরিকান গার্ল ইন ইতালি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত।
৪. ওয়েইট ফর মি, ড্যাডি
১৯৪০ সালে ক্লড ডেটলফ-এর তোলা এই ছবিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম আইকনিক ছবি। ছবিতে ৫ বছর বয়সী ওয়ারেন বার্নার্ড তার মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিদায় জানাতে ছুটে যাচ্ছে তার বাবার কাছে। লাইফ ম্যাগাজিনে এই ছবিটি ফিচার হয়েছিল।
তার বাবা জ্যাক বার্নার্ড ৫ বছর পর যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছিলেন। সেই শিশুটির বয়স বর্তমানে ৮০-এরও উপরে। তিন সন্তানের বাবা এবং কয়েকজন নাতি-নাতনীর দাদাও তিনি।
৫. বিটলস-এর ভক্ত
১৯৬৪ সালের এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে পাঁচ বন্ধু মিলে স্কুল ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছে তৎকালীন গানের ক্রেজ বিটলসের পারফরমেন্স দেখতে। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রে বিটলসের প্রথম সফর। এদের একজনের নাম বব টথ। এমন কাজ করার কারণে তাকে স্কুল থেকে ৩ দিনের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ৪০ বছর পর ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মেনে নিয়ে বলেছিলেন, সেদিন স্কুল পালিয়ে বিটলসের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি আসলে ভালোই ছিল।
সেদিনের পাঁচজন কিশোর-কিশোরী আজ অনেক বড় হয়ে গেছেন। ২০১৩ সালে তারা সকলে মিলে সেই আইকনিক ছবিটি নতুন করে তোলে।
৬. নেভারমাইন্ড
এই ছবিটি ১৯৯১ সালে প্রকাশিত নেভারমাইন্ড নামক একটি এলবামের কভার। বিশ্বব্যাপী এলবামটির ৩০ মিলিয়নেরও বেশি পরিমাণ কপি বিক্রি হয়েছে। এটি বিখ্যাত হবার পাশাপাশি এর কভারের শিশুটিও বিখ্যাত হয়ে যায়। মিউজিকের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত কভার এটি। ছবির এই শিশুটির নাম স্পেনসার এলডেন। ছবিতে থাকা ডলারের নোটটি বড়শীর মাধ্যমে ফেলা হয়েছিল। এই ছবির জন্য শিশুটির পিতামাতাকে সে সময় ২০০ ডলার প্রদান করা হয়েছিল।
সেদিনের ছেলেটি আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো সবাই তাকে এলবামের নামেই ডাকে। ২৫ বছর পর ২০১৬ সালে ছবিটি আবার তোলা হয়।
ফিচার ছবি: Steve McCurry/National Geographic