বিগত শতাব্দীতে চীনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাসমূহের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব অন্যতম। কমিউনিস্ট নেতা মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে ১৯৬৬-৭৬ সাল পর্যন্ত চলা এই অভিযান চীনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বদলে দেয় অনেক কিছু, চ্যালেঞ্জ করে প্রচলিত অনেক কিছুই। কিন্তু কী ছিল সেই বিপ্লব? কারা ছিলেন সেই বিপ্লবের কুশীলব? কেন পরবর্তী চীনা নেতৃত্ব এই বিপ্লবকে ‘বিপর্যয়’ বলে আখ্যা দিয়েছিল? বর্তমান চীনা নেতৃত্বই বা সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে কতটুকু স্বকীয় বলে মনে করে? এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে এই লেখায়।
পটভূমি
১৯৫৯ সালের কথা। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের গৃহীত ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ কর্মসূচি ততদিনে শেষ হয়েছে। এই কর্মসূচি চীনে ডেকে আনে এক ভয়াবহ পরিণতি, দুর্ভিক্ষে মারা যায় প্রায় ৪ কোটি মানুষ। এই ভয়াবহতার ফলে চেয়ারম্যান মাও রাজনৈতিকভাবে অনেকটাই ব্যাক-ফুটে চলে যান, তাকে গণচীনের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়। পার্টিতেও তার অবস্থান একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে। পরবর্তী কয়েক বছর তিনি শুধুমাত্র নামেই কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ছিলেন। এ সময় পার্টির মূল নেতৃত্ব চলে যায় লিউ শাওকি এবং দেং জিয়াও-পিংয়ের মতো নেতাদের হাতে। লিউ শাওকি হন গণচীনের নতুন রাষ্ট্রপ্রধান।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে মাও সে তুং পার্টিতে প্রতিপক্ষদের সরিয়ে তার অবস্থান পুনরায় সুসংহত করার উদ্দেশ্যে এক নতুন কৌশলের আশ্রয় নেন, ঘোষণা করেন এক নতুন কর্মসূচি। ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে মাও ঘোষণা করেন, পার্টির বর্তমান নেতৃত্ব পুঁজিবাদী প্রভাবে প্রভাবান্বিত এবং এরা দেশকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন। তাই, দেশকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য, বুর্জোয়া এবং পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণার নেতাদের সরিয়ে সমাজ এবং দল শুদ্ধ করার জন্য বিপ্লবী চেতনার পুনর্জীবন প্রয়োজন। এরই অংশ হিসেবে তিনি চারটি পুরনো জিনিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন- পুরনো অভ্যাস, ধ্যান-ধারণা, ঐতিহ্য, এবং সংস্কৃতি। মাও এই অভিযানের নাম দেন Great Proletarian Cultural Revolution। এটিই ইতিহাসে সাংস্কৃতিক বিপ্লব নামে পরিচিত।
শুরু হলো অভিযান
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য মাও মূলত বেছে নেন তরুণদের। তিনি তরুণদেরকে এই মহান কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে দল এবং সমাজে বিপ্লবী চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহবান জানান। তার এই আহবানে সাড়া দেয় লক্ষ লক্ষ চীনা তরুণ, যাদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র-ছাত্রী এবং শ্রমিক। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় লাল রঙের ছোট পুস্তিকা, যা ছিল মূলত মাওয়ের বাণীর সংকলন। রাতারাতি এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা, এমনকি স্কুলের বাচ্চারাও হাতে লাল রঙের ব্যান্ড পরতে শুরু করে তাদের আনুগত্য প্রকাশের চিহ্ন হিসেবে। এই তরুণদের নিয়ে গঠিত হয় রেড গার্ড, যা ছিল মূলত একটি প্যারা মিলিটারি বাহিনী।
রেড গার্ডের কার্যকলাপ
রেড গার্ডের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় পুরনো সকল কিছু। বিপ্লব-পূর্ববর্তী সকল কিছুকে পুরনো আখ্যা দিয়ে ধ্বংস করা হয়। প্যাগোডা, গির্জা, মসজিদ প্রভৃতি মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। ধর্মীয় গ্রন্থ এবং কনফুসিয়াসের মতাদর্শী বই, ম্যাগাজিনসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক বই পুড়িয়ে ফেলা হয়। এ সময় জাদুঘর এবং সাধারণ মানুষের বাড়িঘর থেকে সব ধরনের পুরাকীর্তি এবং ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম ছিনিয়ে নেওয়া হতো, এবং এগুলোকে ‘পুরনো চিন্তা-ভাবনার’ প্রতীক আখ্যায়িত করে ধ্বংস করা হতো। এ সময় বহু বাড়িঘরও ধ্বংস করে দেওয়া হয়। সারা দেশে রেড গার্ড এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা লোকেদের বাড়িঘরে ঢুকে পুরনো আসবাবপত্র পর্যন্ত ভেঙে দিতে শুরু করে। কারো চুল বেশি লম্বা মনে হলে তাকে ধরে চুল কেটে দেয়া হতো।
রেড গার্ডের নির্মমতার সবচেয়ে বেশি শিকার হন শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মকর্তা, এবং ভূস্বামীরা। তাদেরকে ‘প্রতিবিপ্লবী’ এবং ‘বুর্জোয়া’ আখ্যা দিয়ে তাদের উপর অত্যাচার চালানো হয়। তাদের প্রকাশ্যে রাস্তায় অপমান করা হতো, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হত, অনেককে হত্যাও করা হতো।
এই অভিযানের ফলে তিব্বতীয় বৌদ্ধ, হুই এবং মঙ্গোলীয়সহ চীনে বসবাসরত সকল জাতি, ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পরিবারও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সরাসরি ভুক্তভোগী। শি জিনপিংকে খামারে কাজ করতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তার বাবা শি ঝংজুন ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির বড় একজন নেতা। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাবন্দী করা হয় এবং পরবর্তীতে ট্রাক্টর নির্মাণ কারখানায় কাজ করতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
যে সমস্ত আর্মি জেনারেল রেড গার্ডের বাড়াবাড়ির বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন, তাদেরও লক্ষবস্তুতে পরিণত করা হয়। মাওয়ের স্ত্রী জিয়াং কিং সেনাবাহিনী থেকে অস্ত্র লুট করতে, এমনকি প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীর স্থলে নিজেদের প্রতিস্থাপন করতে রেড গার্ডের সদস্যদের
উৎসাহিত করেন।
লাগামহীন ঘোড়া
এভাবে চলতে চলতে একটা সময় গিয়ে দেখা যায়, রেড গার্ডকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তথাকথিত প্রতিবিপ্লবী এবং বুর্জোয়া নিধনের পাশাপাশি রেড গার্ডের বিভিন্ন অংশ পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত হতে শুরু করে। মাও এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ খুঁজতে থাকেন। শেষমেশ সমাধান হিসেবে রেড গার্ডের বহু সদস্যকে শহর থেকে সরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয় কৃষিকাজের জন্য। মূলত, মাও এর মাধ্যমে সারা দেশে রেড গার্ডদের ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যাতে করে তারা আর সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে।
ক্ষমতা পুনরুদ্ধার
আগেই বলা হয়েছে, মাও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনাই করেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে তার শক্তিশালী অবস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য। সেসময় মাওয়ের প্রতিপক্ষ ছিলেন মূলত লিউ শাওকি এবং দেং জিয়াও-পিংয়ের মতো নেতারা। লিউ শাওকি তখন চীনের রাষ্ট্রপ্রধান এবং দেং জিয়াও-পিং ছিলেন পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য। বছরখানেকের মধ্যেই দুজনকে দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। লিউ শাওকিকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়, এবং জিয়াও-পিংকে পাঠিয়ে দেয়া হয় নির্বাসনে। পরের বছর লিউ শাওকি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। যদিও তার মৃত্যুসংবাদ বহুদিন পর্যন্ত গোপন রাখা হয়। এভাবেই মাও সে তুং তার হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন।
কুশীলবদের মধ্যে বিবাদ
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শুরু থেকেই এর অন্যতম কুশীলব এবং মাওয়ের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান লিন বিয়াও। ক্ষমতায় আরোহণের পর মাও লিনকে সাংবিধানিকভাবে তার উত্তরসূরি হিসেবেও মনোনীত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে দুজনের মাঝে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এ সময় মাও এবং লিন একে অপরের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালাতে থাকেন। ১৯৭১ সালে হঠাৎ একদিন লিন বিয়াও নিখোঁজ হয়ে যান এবং সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় “তিনি একজন ষড়যন্ত্রকারী এবং বিশ্বাসঘাতক যিনি পরিবারসহ সোভিয়েত ইউনিয়নে পালিয়ে যাওয়ার সময় এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন।” গুলি করে তার বিমানকে ভূপাতিত করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
দৃশ্যপটে নতুন চরিত্রেরা
লিন বিয়াওয়ের মৃত্যুর পর দৃশ্যপটে চৌ এনলাইয়ের আবির্ভাব ঘটে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে দ্বিতীয় শীর্ষ নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে চৌ এবং মাও উভয়েরই স্বাস্থ্যের অবনতি হলে চৌ এনলাই দেং জিয়াও-পিংকে আবার দলের শীর্ষ নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। ইতোমধ্যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে মূল ক্ষমতা চলে যায় মাওয়ের স্ত্রী জিয়াং কিং এবং তার তিন সহযোগী ঝাং শানকিশাও, ওয়াং হঙ-ওয়েন এবং ইয়াও ওয়েনউয়ানের হাতে। ইতিহাসে তারা Gang of four নামে পরিচিত। নেপথ্যে তারাই রাষ্ট্র এবং পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। তারা চৌ এবং দেংয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
বিপ্লবের সমাপ্তি
১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মাও সে তুং বেইজিংয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এবং বাকি তিন সহযোগীকে (Gang of four) গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের বিচার শুরু হয়। এর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে এক দশকব্যাপী চলা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের।
ফলাফল
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলে সারা দেশে সব মিলিয়ে কত মানুষ মারা গিয়েছিল তার সঠিক হিসেব পাওয়া যায় না। তবে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন, মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ। গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের ফলে চীনের অর্থনীতি এমনিতেই ধুঁকছিল। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে অর্থনীতির অবস্থা আরো বেহাল হয়ে পড়ে। শিল্পোৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায়।
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পুরো দশকজুড়ে চীনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ফলে, চীনা তরুণরা এসময় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থেকে যায়। শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী, যাদেরকে হত্যা করা হয়নি, তাদের কারাগারে কিংবা পুনঃশিক্ষালাভের (Re-education) নামে লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়ার ফলে শিক্ষা এবং গবেষণাক্ষেত্রে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
এভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চীনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
বর্তমান চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে কীভাবে দেখা হয়?
১৯৮১ সালে দেং জিয়াও-পিংয়ের সরকার সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে ‘বিশৃঙ্খলার দশ বছর’ এবং ‘দল এবং জনগণের জন্য একটি বড় বিপর্যয়’ বলে ঘোষণা করলেও চীনের বর্তমান নেতৃত্বকে সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে ইতিবাচক/নেতিবাচক কোনো কথাই বলতে দেখা যায় না। ২০১৬ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে কোনো নিবন্ধও ছাপা হয়নি। এ থেকে উপলব্ধি করা যায়, বর্তমান নেতৃত্ব সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে ‘বিপর্যয়’ বলেই মনে করে। কিন্তু এর সাথে যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টি এবং মাও সে তুংয়ের ভাবমূর্তি জড়িত, তাই এই বিষয়কে সামনে না আনাকেই নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে।
শেষকথা
সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল চীনের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিপর্যয়কর অধ্যায়, এবং অর্থনীতির জন্য এক গভীর ক্ষত। কিন্তু চীনের পরবর্তী নেতৃত্ব যেভাবে বলিষ্ঠ এবং সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে সেই বিপর্যয়কে কাটিয়ে চীনকে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে- তা সত্যিই বিস্ময়কর।