১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বদৌলতে দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত-পাকিস্তান আবারো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দুই দেশের বিমানবাহিনী একে অন্যের ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালায়। আগের পর্বগুলোতে আমরা জেনেছি কীভাবে ভারত পাকিস্তানের করাচি বন্দরে মিসাইল হামলা করে। অপারেশন ট্রাইডেন্টে তিনটি পাকিস্তানি জাহাজ ডুবিয়ে ও একটি বা জেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেও ভারত শতভাগ সন্তুষ্ট ছিল না। কেননা করাচি বন্দরে নিক্ষেপ করা দুটি মিসাইলের একটি লক্ষভ্রষ্ট হয়েছিল। অপর মিসাইলটি তেলের ট্যাংকার উড়িয়ে দিয়েও বন্দরের সম্পূর্ণ অয়েল রিজার্ভ ফ্যাসিলিটি ধ্বংস হয়নি। সময়মতো ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে এনে পাকিস্তান আবারও বন্দর আংশিক চালু করতে সক্ষম হয়। ফলে ভারত আবারও করাচি বন্দরে হামলা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
আসলে অপারেশন ট্রাইডেন্ট চলাকালে ভারতীয় মিসাইল বোটগুলো পাকিস্তানের কোস্টাল ডিফেন্স গানের ট্রেসার বুলেটকে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানের মেশিনগানের আক্রমণ ভেবে ভুল করে। তাই করাচি বন্দরের সবচেয়ে নিকটে থাকা মিসাইল বোট আইএনএস নিপাত-এর একটি মিসাইল লক্ষভ্রষ্ট হলে তার মিশন অবজেক্টিভ সম্পন্ন করার জন্য অপর দুটো মিসাইল বোট আর এগিয়ে না এসে দ্রুতগতিতে সবাই মিলে পাকিস্তানের জলসীমা ত্যাগ করে। এই ভুলটি না করলে অপারেশন পাইথন-এর প্রয়োজন হতো না।
তবে যুদ্ধের উত্তেজনায় এ ধরনের ভুল করা অস্বাভাবিক নয়। শক্তিশালী পাকিস্তান এয়ারফোর্সকে ফাঁকি দিতে অপারেশন ট্রাইডেন্ট রাতে পরিচালনা করা হয়েছিল। পরদিনই পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানগুলো প্রতিশোধ নিতে ভারতের ওখা বন্দরের মিসাইল বোট স্কোয়াড্রনের ঘাঁটিতে ব্যাপক বোমা হামলা চালিয়ে জেটি, রিফুয়েলিং ফ্যাসিলিটি ও অস্ত্রাগারের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। তবে কয়েক ঘন্টা আগে নিরাপদে পাকিস্তানের জলসীমা ত্যাগ করা ভারতীয় মিসাইল বোট ও অন্যান্য যুদ্ধজাহাজগুলো সম্ভাব্য পাকিস্তানি হামলার আশঙ্কায় ওখা বন্দরে না যাওয়ায় তাদের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানি বিমান হামলা ঠেকাতে না পারায় ভারতীয় বিমানবাহিনী সমালোচনার মুখে পড়ে। এদিকে ভারতীয় নৌবাহিনী আবারও করাচি বন্দরে হামলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
নিজেদের যুদ্ধজাহাজেই পাকিস্তানের বিমান হামলা
অপারেশন ট্রাইডেন্টের পর উত্তেজনার পারদ ছিল তুঙ্গে। আরেকটি হামলার আশঙ্কায় ভারতীয় বিমানবাহিনী যৌথ টহল শুরু করে। তারা পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজগুলোর উপর গোয়েন্দা নজরদারি চালাতে একাধিক রিকনসিস মিশন পরিচালনা করে। একই কাজ করে পাকিস্তানও। তবে তারা নিজেদের বিমান, যুদ্ধজাহাজের পাশাপাশি বেসামরিক বাণিজ্যিক জাহাজকেও নজরদারি করার কাজে লাগায়। কেননা ভারত যে আরেকটি আক্রমণের পরিকল্পনা করছে তা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা টের পেয়ে গিয়েছিল। তাই তারা ছিল দ্বিগুণ সতর্ক। কিন্তু কখনো কখনো অতিরিক্ত সতর্কতা ভুল বোঝাবুঝি জনিত কারণে বিপদ ডেকে আনে।
পিএনএস জুলফিকার ছিল তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীর অন্যতম শক্তিশালী ফ্রিগেট। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ রয়্যাল নেভিতে ছিল। পরে অবিভক্ত ভারত নৌবাহিনী এবং দেশভাগের পর পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেয়। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে অপারেশন ট্রাইডেন্ট পরবর্তী নজরদারি মিশনে একটি ফকার বিমান এই বলে একটি ভুল রিপোর্ট প্রদান করে যে করাচি উপকূলের কাছে একটি ভারতীয় মিসাইল বোট প্রবেশ করেছে। মূলত সেটি ছিল আরব সাগরে টহলরত সেই পিএসএস জুলফিকার।
রিপোর্ট পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে উড়াল দেয় কয়েকটি এফ-৮৬ স্যাবর। কিন্তু মিসাইল বোটের জায়গায় ফ্রিগেট দেখতে পেয়েও তারা তথ্যটি যাচাই করার প্রয়োজনবোধ করেনি। হামলা শুরু হতেই যুদ্ধজাহাজ থেকে বিমানগুলোর সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কমান্ড সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করার পর হামলা বন্ধ হলেও এরই মধ্যে পিএনএস জুলফিকারকে হজম করতে হয় ৯০০ রাউন্ড ফিফটি ক্যালিবারের বুলেট। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাডার, কমান্ড ব্রিজ ও নেভাল গান টারেট। পরবর্তীকালে জাহাজটি মেরামত করে আবার সার্ভিসে আনা হয়। অবশেষে ১৯৮৩ একে ডিকমিশন করা হয়।
ব্যাটল ফর্মেশন
পাকিস্তানের কড়া পাহারা থাকায় গত দুদিন চেষ্টা করেও তাদের জলসীমায় ঢুকতে পারেনি শত্রুর যুদ্ধজাহাজ। এবারও রাতের বেলা হামলার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় হাইকমান্ড। তবে এবার যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা কমানো হয়। ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের গাজী সাবমেরিন ডুবে যাওয়ায় এখন আর এন্টি সাবমেরিন যুদ্ধজাহাজের দরকার নেই। সেগুলো ভারতের পূর্ব উপকূলে সম্ভাব্য অপর পাকিস্তানি সাবমেরিনকে শনাক্ত করার মিশনে নিয়োজিত। তাই অপারেশন ট্রাইডেন্টে একটিমাত্র মিসাইল বোট ‘আইএনএস বিনাশ’কে নিযুক্ত করা হয়। তাকে এসকর্ট (পাহারা) দিয়ে নিয়ে যায় ফ্রিগেট আইএনএস তলোয়ার ও আইএনএস ত্রিশূল। এর মধ্যে ত্রিশূলের রাডার ছিল অত্যাধুনিক। ৮ ডিসেম্বর রাত ১০টায় মানোরা পেনিনসুলা হয়ে করাচি বন্দরের দক্ষিণ দিক দিয়ে পাকিস্তানের জলসীমায় প্রবেশ করেন। এসময় আইএনএস ত্রিশূল একটি পাকিস্তানি পেট্রোল ভেসেল শনাক্ত করে। তারা হেডকোয়ার্টারে খবর পাঠানোর আগেই জাহাজটি ডুবিয়ে দেয় ভারতীয় ফ্রিগেট।
করাচি বন্দরে আক্রমণ
পাকিস্তান সময় রাত এগারোটায় করাচি বন্দর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে থাকতেই একাধিক জাহাজ রাডারে শনাক্ত হয়। আইএনএস বিনাশ পরপর চারটি SS-N-2B Styx মিসাইল ফায়ার করে দ্রুত বাড়ির পথ ধরে। প্রথম মিসাইলটি বন্দরের কেমারী অয়েল ফার্মের ফুয়েল ট্যাংকে আঘাত করে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। দ্বিতীয় দফায় বিস্ফোরণে একের পর এক ফুয়েল রিজার্ভ ট্যাংকে আগুন ধরতে শুরু করে। মুহূর্তেই বন্দরের একাংশ লেলিহান আগুনে দিনের ন্যায় আলোকিত হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় মিসাইল তেলবাহী জাহাজ এসএস গালফ স্টার জাহাজে আঘাত করে। কয়েক দফা বিস্ফোরণের পর জাহাজটি ডুবতে শুরু করে। তৃতীয় মিসাইলটি পাকিস্তান নৌবাহিনীর অয়েল ট্যাংকার জাহাজ ‘পিএনএস ঢাকা’তে আঘাত করে। দু-দুটো তেলবাহী জাহাজের বিস্ফোরণের শকওয়েভ পুরো বন্দরকে ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপিয়ে দেয়। চতুর্থ মিসাইল ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজ এসএস হারমাটানকে আঘাত করে ডুবিয়ে দেয়। পিএনএস ঢাকা শেষ পর্যন্ত না ডুবলেও এমন বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে সেটি আর মেরামত করা সম্ভব হয়নি বিধায় পরবর্তীতে স্ক্র্যাপ করা হয়েছিল।
অপারেশনের ফলাফল
পাকিস্তানিরা এই আক্রমণে হতচকিত হয়ে পড়ে। কেননা ঐ মুহূর্তে তাদের প্রতিটি যুদ্ধজাহাজ সাগরে অন্যান্য ভারতীয় যুদ্ধজাহাজের গতিবিধি নজরদারিতে ব্যস্ত ছিল। তাদেরকে কীভাবে ফাঁকি দিল তা বুঝে ওঠার আগেই আরেকদফা বিমান হামলা শুরু করে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স। পাকিস্তানের মতো তাদের পক্ষেও রাতে নিখুঁতভাবে হামলা করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু জ্বলন্ত করাচি বন্দরকে টার্গেট হিসেবে খুঁজে পেতে বেগ পাননি ভারতীয় পাইলটরা। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো দ্রুততার সাথে আকাশে উঠে যায়। কিন্তু ততক্ষণে বাড়ির পথ ধরেছে ভারতীয় নৌ ও বিমানবাহিনী।
এই হামলায় পাকিস্তানিদের একটি অস্ত্রগুদাম ও ওয়ার্কশপ ধ্বংস হয়। তবে সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি ছিল ব্যাপক। করাচি ফুয়েল রিজার্ভের ৫০% এর বেশি ধ্বংস হয়। প্রধান সমুদ্র বন্দরের অর্থনৈতিক ক্ষতি তৎকালে ছিল প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের ধকল ও পশ্চিমে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, সব মিলিয়ে যুদ্ধ পরবর্তী পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক দুর্বল হয়ে পড়ে। ভারতীয় নৌবাহিনী তখন ১৯৬৫ সালের লজ্জা ভুলে বিজয়োল্লাসরত। তবে এরই মাঝে বেদনাবিধুর ঘটনা ঘটে যায়। অপারেশন পাইথন-এর পরের দিন ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ আইএনএস খুকরিকে ডুবিয়ে দেয় পাকিস্তান নেভির সাবমেরিন পিএনএস হাঙর। এতে নিহত হন ১৯৪ জন নাবিক। পরবর্তী পর্বে এই ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।