[৩য় পর্ব পড়ুন]
সত্যের সন্ধানে
আগেই বলে রাখা ভালো- বর্তমান তথ্যের ভিত্তিতে এলিজাবেথ বাথোরিকে নিয়ে স্থির কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন। ঐতিহাসিকদের মধ্যেই এই নিয়ে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। স্লোভাক আর চেক ইতিহাসবিদেরা এলিজাবেথের দোষের ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতে রাজি নন, তাকে তারা নৃশংস এক সিরিয়াল কিলারই মনে করেন। তাদের দলে আরো লোক আছেন, আবার বিপক্ষদলের জনসংখ্যাও কিন্তু কম নয়।
বিংশ শতাব্দীতে হাঙ্গেরিয়ান ইতিহাসবেত্তা লাসজলো নেগি দুটি বইয়ে এলিজাবেথ বাথোরির ব্যাপারে নিরপেক্ষ একটি চিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। আরেক গবেষক ইরমা কারদোসার লেখাতেও এলিজাবেথের জীবনের অজানা নানা অধ্যায় জানা যায়, যা কিনা তার দোষ খণ্ডন না করলেও সন্দেহের ছায়াতিপাত করে।
লেখক পাভেল ভোরাক আর ক্যারল ক্যালি অবশ্য দাবি করেন- বাথোরিকে আসলে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে ফাঁসানো হয়েছে। ২০০৯ সালে প্রকাশিত কিম্বার্লি ক্র্যাফটের বইতেও (Infamous Lady: The True Story of Countess Erzsébet Báthory) এই মনোভাবের প্রতিফলন ছিল।
দোষী হোন বা নির্দোষ, অন্তত একটি বিষয়ে সবাই একমত যে এলিজাবেথকে নিয়ে যেসব গালগপ্পো চালু তার একটা বড় অংশই অতিরঞ্জিত। সবচেয়ে বড় অতিরঞ্জন নিহতের সংখ্যায়, এলিজাবেথ হয়তো ৫০-১০০ মেয়েকে হত্যা করেছেন, ৬৫০ কিছুতেই নয়। এত বড় সংখ্যার একমাত্র উৎস মামলার এক সাক্ষী, যার বক্তব্যের কোনো প্রমাণ নেই, এবং সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও রয়েছে বহু প্রশ্ন।
রক্ত দিয়ে গোসলের ব্যাপারটিও পুরোটাই উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত। ১৮১৭ সালে কাউন্টেসের মামলার নথি যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন দেখা যায় এই ব্যাপারটি বিচার চলাকালে কখনোই উঠে আসেনি। লাসজলো টুরোকজিই প্রথম তার বইতে এই ঘটনার উল্লেখ করেন, যা কিনা এলিজাবথের মৃত্যুরও বহু বছর পর।
অনেক গল্পে বলা হয়- এলিজাবেথ নাকি কালোজাদুর চর্চা করতেন। অথচ এত বড় একটি অভিযোগ আদালতেই তোলা হয়নি! সমসাময়িক অনেক মহিলার মতো কাউন্টেসও ভেষজ ঔষধ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন এবং এর সাহায্যে চিকিৎসার প্র্যাকটিস করতেন। এজন্য শেকড়বাকড় আর নানা উদ্ভিদ নিয়ে প্রায়শই পরীক্ষানিরীক্ষা চলত তার দুর্গে। এখান থেকেই সম্ভবত এই কিংবদন্তীর উৎপত্তি।
জনপ্রিয় আরেকটি কেচ্ছা হলো- এলিজাবেথের বাবা-মা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন, এ কারণে তাদের মেয়ের মধ্যে সমস্যা তৈরি হয় যা প্রকাশ পায় খুনি মানসিকতার মাধ্যমে। অথচ একই বংশের হলেও জর্জ বাথোরি আর অ্যানা সম্লোর মধ্যে ছিলো সাত প্রজন্ম বা ততোধিক দূরত্ব। এত দূরের আত্মীয়দের বিয়েতে এমন কিছু হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ছোটবেলায় চোখের সামনে এক জিপসির মৃত্যুদণ্ডের ঘটনার ট্রমা থেকে এলিজাবেথের মানসিকতার পরিবর্তন হয়ে যায়- এই মতবাদও ধোপে টেকেনি, কারণ এমন কোনো ঘটনা আসলে ঘটেইনি।
এটা সত্যি যে সেসময়ের প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় চাকরবাকরদের পেটানোর অনেক ঘটনাই এলিজাবেথ চাক্ষুষ করেছেন, স্বামী ফ্রান্সিসও এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না। তবে মনে রাখতে হবে- তেমন কোনো ঘটনা হত্যাকান্ডে গড়ায়নি। তাছাড়া, এলিজাবেথ যখন তার নারী কর্মচারীদের হত্যা করছিলেন বলা হয়, সেসময় কাজের লোকের অত্যন্ত অভাব ছিল। সেক্ষেত্রে সেধে কেন এলিজাবেথ এই অভাব আরো প্রকট করতে যাবেন? এতে তো তারই অসুবিধা!
বিয়ের আগে কৃষকপুত্রের সাথে প্রেম থেকে অবৈধ সন্তানের জন্ম হয়েছিলো এই গল্পই রূপকথা বলে উড়িয়ে দেন গবেষকেরা। এমন কিছু হলে সোজা তাকে সন্ন্যাসাশ্রমে পাঠিয়ে দিতো দুই পরিবার। স্বামীকে বিষ দিয়ে হত্যায় তার হাত ছিল এই অভিযোগও অসত্য। ফ্রান্সিসের শরীরে মার্কারি পাওয়া গিয়েছিল বটে, তবে তা তখন ব্যবহার হতো অসুস্থতা নিরাময়ে, বিষ হিসেবে নয়।
সব বিবেচনায় নেয়ার পর এলিজাবেথের ব্যাপারে একাংশের মতামত, তিনি শ’খানেক মানুষ হত্যা করেছেন, সম্ভবত মানসিক বৈকল্য থেকে। এখানে ষড়যন্ত্রের কোনো ঘটনা নেই। তাদের বিরোধিতা করে অন্য দলের মতামত, বাথোরি পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তিকে খাটো করতে তাদের শত্রুরা এলিজাবেথকে বেছে নেয়, যাদের প্রতিনিধি ছিলেন থুরজো। দুর্গে বাস করা একাকী মহিলাকে পাগল প্রমাণ করে বাথোরি বংশের উপর কলঙ্ক লেপন করে দেন তিনি।
কেউ কেউ আবার এমন বলে থাকেন- আসলে বাইরের শত্রু নয়, ভেতরের শত্রুরাই এলিজাবেথের সর্বনাশ করেছে। তার ছেলে ও জামাইরা সম্পত্তির ভোগদখল করতে চাইছিল, ফলে পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে এলিজাবেথের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ আনে তারা। থুরজো তাদের পক্ষে কাজ করছিলেন মাত্র।
এই দলের ঐতিহাসিকেরা এলিজাবেথ বাথোরির ব্যাপারে বেশ নমনীয় মনোভাব পোষণ করেন। তাদের কথা, এলিজাবেথ আসলে খুনি নন, বরং চিকিৎসাবিদ্যায় আগ্রহী ছিলেন। এজন্য দুর্গে নানা গবেষণা আর অসুস্থ রোগীদের অনুমতিতে তাদের উপর শল্যচিকিৎসা প্রয়োগ করতেন তিনি। অশিক্ষিত গ্রামবাসীরা একেই জাদুবিদ্যা মনে করত। তার এলিজাবেথের অন্যতম বান্ধবী অ্যানার কথা টেনে আনেন, যাকে স্থানীয়রা ডাইনি আখ্যা দিয়েছিল। আদতে অ্যানা ভিয়েনার নামকরা এক ধাত্রী। চিকিৎসাবিদ্যায়ও তার দখল ছিল বেশ, বিশেষ করে সার্জারি, দূষিত রক্ত বের করা, টিউমার অপসারণ ইত্যাদিতে পারদর্শী ছিলেন তিনি।
থুরজো অভিযোগপত্রে লিখেছিলেন, এলিজাবেথের দুর্গ থেকে নির্যাতিত মেয়েদের উদ্ধার করেছিলেন তিনি। এদের একজন মারাই গিয়েছিলেন। কারো কারো ধারণা, এই মেয়েরা আসলে চিকিৎসা নিতে এসেছিল, থুরজো তাদের ভিক্টিম বলে চালিয়ে দেন। নিজের ইচ্ছেমতো সাক্ষী উপস্থাপন করে পুরো ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। ফলে একজন ভিক্টিম এলিজাবেথের পক্ষে সাক্ষী দিতে চাইলেও তাকে আদালতেই আনেননি তিনি।
তবে এলিজাবেথের নির্দোষিতার ব্যাপারে সবচেয়ে চমকপ্রদ তত্ত্ব এই যে, তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। এখানে পক্ষভেদে দুটো দোষী পক্ষ চিহ্নিত করা হয়। একটি অস্ট্রিয়ার হাবসবুর্গ পরিবার, অন্যজন হাঙ্গেরির রাজা ম্যাথিয়াস।
কিন্তু হাবসবুর্গদের সাথে এলিজাবেথের শত্রুতা থাকবে কেন? মূলত, বাথোরি পরিবারের হওয়াতে তাকে এই তাদের কোপানলে পড়তে হয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এলিজাবেথের সময় হাঙ্গেরি তিনভাগে বিভক্ত ছিল। রয়্যাল হাঙ্গেরি হাবসবুর্গদের, মধ্যাঞ্চল অটোমান আর ট্রান্সিলভানিয়া বাথোরিদের একটি উপধারার অধীন।
১৬০২ সালে সিগিসমুণ্ড বাথোরিকে সরিয়ে হাবসবুর্গরা ট্রান্সিলভানিয়া কব্জা করে। কিন্তু দু’বছর পরই স্টিফেন বোকস্কে নামে এক লোকের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা তাদের পরাজিত করে, রয়্যাল হাঙ্গেরিতেও তাদের ক্ষমতা কমে যায়। ১৬০৬ সালে শান্তিচুক্তি করে হাবসবুর্গরা বোকস্কেকে ট্রান্সিলভানিয়ার নতুন শাসক হিসেবে মেনে নেয়।
১৬০৮ সালে বোকস্কের উত্তরাধিকার নির্বাচিত হন পোল্যান্ডের রাজা অ্যান্ড্রু বাথোরির নাতি গ্যাব্রিয়েল। হাঙ্গেরির একত্রীকরণের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন তিনি। এজন্য টাকাপয়সা ধার চান এলিজাবেথের কাছে।
হাবসবুর্গরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কাউন্টেস বাথোরির অর্থ সাহায্য পেলে গ্যাব্রিয়েল যেকোনো কিছু করে বসতে পারেন। তাছাড়া, জেস্থে দুর্গ কৌশলগতভাবে পূর্ব হাঙ্গেরি আর পোল্যান্ডে যাতায়াতের রাস্তার উপর অবস্থিত, এলিজাবেথ জ্ঞাতি ভাইকে যদি দুর্গ ব্যবহারের অনুমতি দেন তাহলে তারা বেকায়দায় পড়ে যাবেন। সাত-পাঁচ ভেবে হাবসবুর্গরাই নাকি থুরজোকে দিয়ে কাউন্টেসকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়।
ম্যাথিয়াসের ব্যাপারটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এলিজাবেথের কাছ থেকে প্রচুর টাকা ধার করেছিলেন তিনি। সত্যি বলতে কি, এই টাকা পরিশোধের ক্ষমতা ছিল না তার, উপরন্তু বার বার তাকে তাগাদা দিচ্ছিলেন কাউন্টেস। দেনা থেকে রেহাই পেতে থুরজোকে ব্যবহার করে এলিজাবেথকে ফাঁসিয়ে দেন রাজা। দণ্ডিত কাউন্টেসের পক্ষে টাকা ফেরত চাওয়া সম্ভব ছিল না।
রাজা নাকি এলিজাবেথের উত্তরাধিকারীদেরও দলে টেনে নিয়েছিলেন। দণ্ডিত আসামীর সম্পত্তি রাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করতে পারত। ম্যাথিয়াস কথা দিয়েছিলেন- এরপর এই সম্পদ ভাগবাটোয়ারা করে নেবেন সবাই। তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ হিসেবে ১৬১০ সালের ৭ জুন প্রধান বিচারপতির সাথে গোপন এক সভার উল্লেখ করেন একদল ঐতিহাসিক, যদিও অকাট্য প্রমাণ কিন্তু নেই।
আধুনিক বিচার ব্যবস্থায় কিন্তু এলিজাবেথের খালাস পাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। তাকে দণ্ডিত করা হয়েছিল পারিপার্শ্বিক প্রমাণ এবং লোকমুখে শোনা বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে। সরকারপক্ষের সাক্ষীরাই পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তাদের অনেককে জোর করে ধরে আনার প্রমাণ পাওয়া যায়, স্বীকারোক্তি আদায় তো করাই হয়েছিল নির্যাতনের মাধ্যমে।
কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, থুরজো আসলে এলিজাবেথকে বাঁচিয়েছিলেন। তিনি এলিজাবেথকে খুনী মনে করলেও বন্ধু ফ্রান্সিসের বিধবা স্ত্রী হিসেবে তার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিলেন। ফলে রাজা বার বার কাউন্টেসকে আদালতে তুলে মৃত্যুদণ্ড দিতে বললেও সুকৌশলে এড়িয়ে যান তিনি। বরং এলিজাবেথের আত্মীয়স্বজনদের সাথে পরামর্শ করে তাকে গৃহবন্দি করে রাখেন।
এলিজাবথে যদি দোষীও হয়ে থাকেন, তারপরেও এটা সত্য যে তার ব্যাপারে প্রচলিত কাহিনীর একটা বড় অংশই অতিরঞ্জিত। তিনি কি সিরিয়াল কিলার, নাকি চক্রান্তের শিকার নিরীহ এক নারী? এই প্রশ্নের উত্তর তার সাথেই কবরে চলে গেছে।