শিশুশিক্ষার একেবারে সূচনাতেই যেসব প্রাথমিক জ্ঞান শেখানো হয়ে থাকে, তার মধ্যে সপ্তাহের সাতদিনের নাম একেবারে ঝাড়া মুখস্থ করার বিষয়টি থাকেই। আপনি আমি আমরা সবাইই সেই ধাপ অতিক্রম করে এসেছি। কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এই নামগুলো কোত্থেকে এসেছে, এগুলোর বিশেষত্বই বা কী? কিংবা অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই নামগুলো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে এত মিল কেন? মানে, পাশ্চাত্যে যেটা ‘সান ডে’ বা ‘সূর্য-দিন’, আমাদের এখানেও ঐ দিনটি কেন ‘রবিবার’ মানে সেই সূর্যের দিন? আচ্ছা, সব বাদ দিন তো। আগে এটাই বলুন না, সপ্তাহে কেন সপ্ত-অহ, মানে সাতদিন? কেন পাঁচ বা আট দিন নয়? আসুন আমরা আজ এই বিষয়গুলো নিয়েই একটু গবেষণা করে আসি।
সপ্তাহে কেন সাতটি দিন?
প্রশ্নটি যদি বিশুদ্ধ বাংলাতেই করা হয়ে থাকে যে, ‘সপ্তাহে কেন সাতটি দিন?’ তাহলে, জবাবে বলতে হয় যে, সপ্তাহে সাতটি দিন হবে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? কারণ, বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে, আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে- সমাসের নিয়মানুসারে, ‘সপ্তাহ’ এর ব্যাসবাক্য হচ্ছে ‘সপ্ত অহের (দিনের) সমাহার’। সে হিসেবে বলতে গেলে তো সপ্তাহে সাত দিনই থাকবে।
এবার, মাসের একেকটি সুনির্দিষ্ট বিভাজন কেন ‘সপ্তাহ’ হলো? কেন পঞ্চমাহ (পাঁচ দিনের সমাহার) বা কেন অষ্টমাহ (আট দিনের সমাহার) নয়? — এ প্রশ্ন যদি কেউ করেন, তাহলে কিন্তু আর পাশ কাটানো উত্তর দেয়া চলবে না। তো আসুন দেখি, এ প্রশ্নের কী জবাব খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রথমেই বলে রাখি, ইংরেজি ‘উইক’ (বাংলা অনুবাদে সপ্তাহই বলতে হচ্ছে) বলতেই যে, বর্তমান কালের সাত দিনের সমষ্টি বোঝায়- তা কিন্তু নয়। প্রাচীন কালে নানা দেশে নানা কালে আট দিনের সপ্তাহ, নয় দিনের সপ্তাহ এমনকি দশ দিনের সপ্তাহও প্রচলিত ছিলো। আবার ওদিকে ছয় দিনের সপ্তাহ বা পাঁচ দিনের সপ্তাহও কোথাও কোথাও প্রচলিত ছিলো।
প্রাচীন রোমে ‘আট দিনের’ সপ্তাহ চালু ছিলো। আমাদের এখনকার মতোই সাত দিন, আর অতিরিক্ত একটা দিন বরাদ্দ ছিলো বিকি-কিনি করবার জন্যে। বেচা-কেনা করবার এই দিনটি ‘হাটবার’ নামে পরিচিত ছিলো। পরে অবশ্য খ্রিস্টান অধ্যুষিত হবার পর রোমানদের ওখানে নতুন ক্যালেন্ডার চালু হয়, আর খ্রিস্ট-ধর্মের প্রভাবে হাটবার বাদ দিয়ে সাত দিনেই সপ্তাহ নির্ধারিত হয়। ৩২১ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন এই নতুন ক্যালেন্ডার চালু করে সপ্তাহের দিন সংখ্যা ৭ এ নির্দিষ্ট করেন।
ঘুরে-ফিরে দেখা যাচ্ছে, সপ্তাহের মূল ধারণাটা সাত দিনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। কী গ্রিক, কী ভারতীয় কিংবা অন্য কোনো সভ্যতা, প্রায় সব ধরনের পৌরাণিক শাস্ত্রমতে, ‘সাত’ সংখ্যাটি কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলে কিন্তু পৌরাণিক কোনো বিশ্বাসজনিত কারণে সপ্তাহে সাতটি দিন রাখা হয়েছে- এমনটি নয়। বরং, ক্যালেন্ডার তৈরি করতে গিয়ে প্রাচীন গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যে নিখুঁত হিসেব-নিকেশ করেছেন, তারই একটি অংশ হিসেবে সপ্তাহের দিন সংখ্যা ৭ এ এসে দাঁড়িয়েছে।
ইতিহাস
পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, সর্বপ্রথম ব্যাবিলনীয় সভ্যতার লোকেরা সময়ের হিসাব রাখা শুরু করে। অর্থাৎ, ক্যালেন্ডার প্রচলনের ইতিহাস ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে। তারা দিন ও মাসের হিসাব রাখতো মূলত চাঁদের গতিবিধি দেখে।
সূর্যের তুলনায় চাঁদের গতিবিধি দেখে মাসের হিসাব রাখা অনেক সহজ। কারণ, চাঁদের আকৃতি সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। কখনো এক ফালি চাঁদ, কখনো জোছনামাখা ভরাট পূর্ণিমা আবার কখনো অমাবস্যার রাতে সম্পূর্ণভাবে তিরোধান! চাঁদের এই ঘটনাগুলো আবার প্রায় ৩০ দিন পর পর পুনরাবৃত্ত হতে থাকতো। অনেক অনেক দেখে-শুনে প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রা চাঁদের গতিবিধির এই কারসাজি বুঝে গেলো এবং চাঁদের উপর ভিত্তি করে মাস গণনা শুরু করলো।
হিসাবের সুবিধার জন্য প্রতিটি চান্দ্রমাসকে আবার চন্দ্রকলার [1] ভিত্তিতে কয়েকটি সময়কালে বিভক্ত করা হলো। যেমন:
১। প্রথম দিন: চাঁদ মাত্রই উঠলো। একদম এক ফালি চাঁদ। পশ্চিমাকাশে খুব সূক্ষ্মভাবে তাকালে দেখা যায়।
২। সপ্তম দিন: চাঁদের আকার বাড়তে বাড়তে অর্ধগোলকে পরিণত হয়।
৩। চতুর্দশ দিন: চাঁদের আকার বাড়তে বাড়তে পূর্ণ গোলকে পরিণত হয়। চার দিকে ঝলমলে স্নিগ্ধ আলো ছড়ায় এই পূর্ণিমা চাঁদ। এর পর থেকেই চাঁদের আকার ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।
৪। একবিংশ দিন: চাঁদের আকার কমতে কমতে আবার অর্ধেকে এসে দাঁড়ায়।
৫। অষ্টবিংশ দিন: চাঁদের আকার ছোট হতে হতে একেবারে সূক্ষ্ম সুতার মতো হয়ে দাঁড়ায়।
৬। উনত্রিংশ দিন: আকাশে আর চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। অমাবস্যার রাত এটি। অধিদিবস (leap day)
৭। ত্রিংশ দিন: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজও চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। তবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই দিন নতুন চাঁদের উদয় হয়। চাঁদ দেখা না গেলে আমরা এ দিনটিকেও অধিদিবস (Leap Day) বিবেচনা করতে পারি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ৭ দিন পর পর চাঁদ একেকটা নতুন এবং চোখে পড়ার মতো দশায় পৌঁছুচ্ছে। তাই, এই ৭ দিন সময়কে চিহ্নিত করে সপ্তাহের উদ্ভব হলো। প্রচলিত ক্যালেন্ডারগুলোতে প্রতি ‘week’ এ সাত দিন থাকার এটাই মূল কারণ।
সাত দিনের নাম
সাত দিনের নামগুলো কী সে তো আমরা সবাই জানি- শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি এবং শুক্র। কিন্তু নামগুলো এভাবে কেন রাখা হলো, সে আলোচনা করতে গেলে পাশ্চাত্য নামগুলোর দিকে তাকাতে হবে। পাশ্চাত্যের ভাষাগুলোর মধ্যে তো কেবল ইংরেজিতেই আমরা একটু আধটু চোস্ত, আসুন ইংরেজির দ্বারস্থ হওয়া যাক।
ইংরেজিতে দিবসগুলোর নাম— Sunday, Monday, Tuesday, Wednesday, Thursday, Friday এবং Saturday.
এই নামগুলোর উৎপত্তি ঠিক কোন ভাষা হতে, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মত দেখা যায়। তবে, প্রধান মতটি হচ্ছে, ইংরেজি এই বারগুলোর নাম এসেছে স্যাক্সনদের কাছ থেকে। স্যাক্সন হলো একটি জার্মানীয় জাতি, যারা প্রাচীন জার্মানির উত্তরাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলে বসবাস করতো। পরে এরা ইংল্যান্ডের একটি বড় অংশ অধিকার করে নেয়। এই জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি থেকেই হাল আমলের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব।
এই স্যাক্সন জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন দেব-দেবীর নামে সপ্তাহের সাতটি বারের নাম রাখে। ইংরেজি ভাষার পুরোটাই প্রায় গড়ে উঠেছে এই স্যাক্সন জাতির ভাষা থেকে। ইংরেজি সাতটি দিনের নামও সেখান থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। তবে, শনিবারের যে ইংরেজি রূপ মানে Saturday, সেটি স্যাক্সন ভাষায় এই রূপটি পাওয়া যায়নি।
এবার জেনে নেয়া যাক স্যাক্সনরা এই নামগুলো কীভাবে রাখলো বা কোত্থেকে পেলো। আগেই বলেছি, স্যাক্সনরা হলো আদিতে জার্মানিক জাতিগোষ্ঠী। তো এই স্যাক্সন বা জার্মানিক জাতিগোষ্ঠী মূলত রোমকদের স্থলাভিষিক্ত, বা বলা যায় তাদের উত্তরকালের জাতি। এরা রোমকদের কাছ থেকে সপ্তাহের সাত বারের নাম জেনেছে এবং প্রত্যেকটি বারের নামের ক্ষেত্রে রোমান দেবতার নামের জায়গায় নিজ নিজ অনুরূপ দেবতার নাম বসিয়েছে। রোমক ভাষাতে সপ্তাহের সাতটি দিনের নাম রোমান দেবতাদের সাথে মিলিয়ে রাখা হয়েছে এবং এই দেবতাগুলো স্যাক্সন ভাষার দেবতাদের অনুরূপ। ফলে সাতটি বারের নামের মধ্যে এক অদ্ভুত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। আমরা যে বলছিলাম ইংরেজি ‘Saturday’ নামটির উৎসমূল স্যাক্সন ভাষায় পাওয়া যায়নি, সেটি আসলে রোমান ভাষা থেকেই নেওয়া হয়েছে।
এবার আরেকটু পিছিয়ে যাই। রোমানরা কেন এ ধরনের নাম রাখলো, সেই সূত্র খুঁজতে গেলে এবার গ্রিসে যেতে হবে। গ্রিকরা মূলত বিভিন্ন দেব-দেবীর নাম অনুসারে সপ্তাহের সাতটি দিনের নাম রেখেছে। আর এই গ্রিক পুরাণের এই দেব-দেবীরা যে যে বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেসব বিষয়ে রোমানরা আবার যেসব দেবতায় বিশ্বাসী, সেই সব দেবতার নাম প্রতিস্থাপন করে নিজেদের সাতটি দিনের নামকরণ করেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গ্রিক জাতির লোকেরা বিভিন্ন ঐশ্বরিক সত্ত্বার নামে সাত বারের নাম রেখেছিলো।
সেই গ্রিক ঐশ্বরিক সত্ত্বারা কিন্তু আবার পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান (তখন পর্যন্ত যেগুলোকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা গেছে আরকি) বিভিন্ন জ্যোতিষ্ক দ্বারা সংকেতায়িত। যেমন গ্রিক পুরাণমতে, আফ্রোদিতি হচ্ছেন সৌন্দর্যের দেবী। আর আকাশে খালি চোখে যেসব গ্রহ দেখা যায়, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে শুক্র গ্রহ। তাই, গ্রিক ভাষায় শুক্র গ্রহের নাম রাখা হয়েছে ‘আফ্রোদিতি’ ।
সপ্তাহে দিনগুলোর নামের বর্ণনা
এতক্ষণ আমরা যে আলোচনা করলাম, তার ভিত্তিতে দিনগুলোর নামের বর্ণনা করবো,
১। Sunday: সূর্যের দিন। গ্রিক পুরাণমতে, হেলিওস হচ্ছেন এক শক্তিশালী দেবতা। ইনি সূর্যদেব হিসেবেও খ্যাত। গ্রিক ‘হেলিওস’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সূর্য। রোমান ভাষায় Sol বলতে সূর্যরূপী দেবতাকেই বোঝানো হয়, যাকে স্যাক্সন ভাষায় বলা হতো Sunne, আর সেখান থেকেই ইংরেজি Sun.
পৃথিবীর আকাশ থেকে দেখতে পাওয়া জ্যোতিষ্কগুলোর মধ্যে সূর্যই সবচেয়ে উজ্জ্বল, যার আলোয় পুরো পৃথিবী আলোকিত হয়। সূর্যই অন্যসব জ্যোতিষ্ক শাসন করে বলে ল্যাটিন ভাষায় রবিবারকে dominica বলে, যা Lord’s Day নামেও পরিচিত।
২। Monday: চাঁদের দিন। এটা আসলে Moon’s day থেকে পরিবর্তিত হয়ে এই রূপে এসেছে। গ্রিক পুরাণ মতে, selenes হচ্ছেন চাঁদের দেবী। রোমান ভাষায় এই চাঁদকে বলে Moon. আরেকটি বহুল প্রচলিত নাম হচ্ছে Luna, যিনি কিনা Sol (সূর্য) দেবতার পরিপূরক এক নারী সত্ত্বা।
৩। Tuesday: গ্রিক শাস্ত্রমতে, Ares নামে এক দেবতা আছেন, যিনি যুদ্ধ আর ধ্বংসের প্রতীক। এর নামে আকাশে দৃশ্যমান মঙ্গলগ্রহের নাম রাখা হয়েছে Ares. আর এই গ্রহের নাম অনুসরণ করেই আবার গ্রিক ভাষাতে মঙ্গলবারের নাম রাখা হয়েছে ἡμέρᾱ Ἄρεως মানে ‘Ares এর দিন’। রোমান ভাষায় অনুরূপ দেবতা হচ্ছেন Mars। তবে, স্যাক্সনদের ধর্মবিশ্বাস মতে, Mars এর অনুরূপ দেবতা মানে যুদ্ধ আর ধ্বংসের দেবতা হলেন Tiu, সেখান থেকেই ইংরেজি Tuesday.
৪। Wednesday: গ্রিক পুরাণ মোতাবেক দেবতা জিউসের এক সন্তানের নাম হারমিস। এই হারমিস দেবতা বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট। Hermes দেবতার নামানুসারে গ্রিক ভাষায় সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী গ্রহের নাম রাখা হয়েছে Hermes. আর বুধবারের নামও তাই। ওদিকে রোমান মাইথোলজি বলে, ব্যবসা-বাণিজ্যের দেবতা হচ্ছেন Mercury. তবে ইংরেজি ভাষায় কিন্তু দিনটির নাম Mercury Day নয়; বরং Wednesday, যা এসেছে জার্মান প্রভাবিত বিশেষ দেবী Woden এর নাম থেকে। এই ওডেন দেবীর জন্য বরাদ্দকৃত দিনের নাম Woden’s Day বা Wednesday.
৫। Thursday: Thursday মানে Thor’s day. অ্যাংলো-স্যাক্সন বিশ্বাস মোতাবেক থর হলেন থান্ডার বা বজ্রপাতের দেবতা। তাই, তার নামে একটি দিনের নাম রাখা হলো Thursday. গ্রিক ভাষায় এই ‘বজ্রপাতের পিতা’ খ্যাত দেবতাটি হচ্ছেন জিউস। তাই তো গ্রিক ভাষায় সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহটির নাম প্রচলিত গল্পগাথার সাথে মিলিয়ে রাখা হয়েছে ‘জিউস’, আর বারের নামটিও ‘জিউসের বার’। অবশ্য এই গ্রহকে ইংরেজিতে আমরা কিন্তু ‘থর’ বা ‘জিউস’ নামে চিনি না, চিনি রোমান ‘জুপিটার’ নামে।
৬। Friday: আগেই বলেছি, গ্রিক ‘আফ্রোদিতি’ বা রোমান ‘ভেনাস’ হচ্ছেন সৌন্দর্য, প্রেম ও কামনার দেবী, তার নামেই শুক্রগ্রহের নাম। আবার এই গ্রহের নামেই দিনটির নাম ‘আফ্রোদিতির বার’ (গ্রিক) আর ‘ভেনাসের বার’ (রোমান)। অ্যাংলো-স্যাক্সনদের কাছে অবশ্য সৌন্দর্যের দেবী হলেন ফ্রিগ, সেখান থেকেই ইংরেজি ফ্রাই ডে নামের উৎপত্তি।
৭। Saturday: Saturn’s Day বা স্যাটার্নের দিন। স্যাটার্ন হলেন রোমান দেবতা যিনি খুশি হলে ভালো ফসল দেন কৃষকদেরকে। গ্রিক ভাষায় অনুরূপ দেবতা হলেন ক্রোনাস। অ্যাংলো-স্যাক্সন ভাষায় এই নামের কোনো প্রতিশব্দ পাওয়া যায়নি। ইংরেজিতে Saturday নামটি সরাসরি রোমান থেকে আত্তীকরণ করা হয়েছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভাষায়, এ দিনকে বোঝাতে যে শব্দ ব্যবহৃত হয়, তার অর্থ ‘স্নানবার’। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা সপ্তাহের শনিবারে কেবল স্নান করতো, এজন্যই হয়তো এমন নাম।
ইহুদি-খ্রিস্টান বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইউরোপের অনেক ভাষাতেই কিন্তু শনিবারকে ইহুদি প্রত্যয় ‘সাবাথ’ এর সাথে মিলিয়ে অনুরূপ কিছু একটা ডাকা হয়।
গ্রহ/দেবতাদের নাম অনুসারে গ্রিক সাতটি বারের নাম হলেও আপনি যদি খুঁজতে যান, তাহলে দেখবেন সেখানে বারগুলোর নাম সংখ্যা দিয়ে রাখা হয়েছে, অর্থাৎ অনেকটা এরকম, ‘প্রথম দিন’ (রোববার), ‘দ্বিতীয় দিন’ (সোমবার) ইত্যাদি।
ভারতবর্ষে সপ্তাহ
ভারতবর্ষেও প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষীরা দেবতাদের নামে গ্রহের নাম আর গ্রহের নাম অনুসারে সপ্তাহের প্রতিটি দিনের নাম রেখেছেন। ধারণা করা হয়, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত শাসনামলে এই নামকরণ করা হয়। সংস্কৃত ভাষায় বারের নামগুলো হলো,
শনি> আদিত্য (সূর্য বা রবি) > সোম (চাঁদ)> মঙ্গল> বুধ> বৃহস্পতি> শুক্র
শনি: হিন্দু পুরাণ মোতাবেক শনি এক উগ্র দেবতা। তার কুদৃষ্টি খারাপ ফল বয়ে নিয়ে আসে। সে মূলত সূর্য ও তার স্ত্রী ছায়ার সন্তান।
রবি: রবি মানে সূর্য, সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় আদিত্য। রবিবারকে সংস্কৃত ভাষায় বলে আদিত্যবার। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, সূর্যনারায়ণ বা সূর্যদেবতার নামের ভিত্তিতেই এই সূর্য বা রবির নামকরণ করা হয়েছে। সূর্যের মা হচ্ছেন অদিতি আর বাবা কশ্যপ।
সোম: সোম মানে চাঁদ। হিন্দু মিথ অনুযায়ী, দেবতা শিবের সাথে এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
মঙ্গল: হিন্দু মিথ অনুযায়ী, মঙ্গল হলেন যুদ্ধের দেবতা। ইনি শিবের রক্তবিন্দু থেকে জন্ম নিয়েছেন বলে কোনো কোনো উৎস থেকে জানা যায়।
বুধ: বুধ হলো এক ঐশ্বরিক সত্ত্বা। সে বৃহস্পতি ও তার স্ত্রী তারার সন্তান। অবশ্য কখনো কখনো বুধকে চাঁদের (সোম) এর সন্তান বলেও সূত্রগুলো বলে থাকে।
বৃহস্পতি: বৃহস্পতি হলো সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ। হিন্দু ধর্মমতে, একে ‘গুরু’ বলা হয়। ইনি যার পক্ষে থাকেন, তার ভাগ্য প্রসন্ন হয়।
শুক্র: শুক্র হল অসুর দেবতাকূলের প্রধান, হিন্দু মিথ অনুযায়ী তার পুরো নাম শুক্রাচার্য।
আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, গ্রিকরা যে যে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেবতাদের নাম অনুযায় গ্রহ/বারের নাম রেখেছিলেন, ভারতবর্ষেও ঠিক সেসব বিষয় সংশ্লিষ্ট দেবতাদের নামেই গ্রহ/বারের নাম রেখেছেন। এই আশ্চর্য মিলের একটি কারণ হতে পারে- হিন্দু জ্যোতিষীগণ গ্রিক জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কেননা, গ্রিকদের দর্শন ও বিশ্বাস এই সমাজে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই দেখা যায়।
সপ্তাহের দিনগুলোর নামের ধারাবাহিকতা
সপ্তাহের দিনগুলো যেই যুগে নামকরণ করা হয়েছে, সেই যুগে পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে খালি চোখে যে সব গ্রহ-নক্ষত্র দেখা যেতো সেগুলোর নাম থেকেই সাত দিনের নাম রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন আগে রোববার, তারপর সোমবার, তারপর আবার মঙ্গলবার ইত্যাদি? এর কি কোনো কারণ আছে? নাকি এমনিই?
একটা কারণ আছে বটে। তবে ঠিক ‘কারণ’ বলাটা সঙ্গত হবে না। ওরা আসলে নামকরণের সময় একটা নিয়ম মেনেছে, আর সেটা হলো- Planetary Hours.
প্রাচীনকালে পৃথিবী থেকে খালি চোখে যে সাতটি বস্তু দেখা যেতো, জ্যোতিষশাস্ত্রে সেগুলোকে ‘গ্রহ’ বলা হয়। গ্রহ সাতটি হচ্ছে- মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, সূর্য ও চন্দ্র। (খেয়াল রাখুন, আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যায় কিন্তু সূর্য ও চাঁদ গ্রহ নয়; সূর্য হলো নক্ষত্র আর চাঁদ হলো একটি উপগ্রহ; আরো খেয়াল করুন: জ্যোতিষবিদ্যা আর জ্যোতির্বিদ্যা সর্বতোভাবে অভিন্ন বিষয় নয়)।
পৃথিবীর সাপেক্ষে যে গ্রহের গতিবেগ যত বেশি, সে গ্রহ পৃথিবীর তত কাছে। বিপরীত ক্রমে, পৃথিবীর সাপেক্ষে যে গ্রহের গতিবেগ যত কম, সে গ্রহ পৃথিবী থেকে তত দূরে। দূরত্বের অধঃক্রম অনুসারে সাজালে যে অনুক্রমটি পাওয়া যায়, সেটি এরকম-
শনি > বৃহস্পতি > মঙ্গল > সূর্য (রবি) > শুক্র > বুধ > চন্দ্র (সোম)
প্রাচীনকালে বিশ্বাস করা হতো, কেবল সপ্তাহের দিনগুলোর উপর নয়, বরং একটি দিনের প্রতি সাত ঘণ্টার প্রতিটি ঘণ্টার উপরও একই অনুক্রমে গ্রহগুলোর প্রভাব রয়েছে। প্রতি সাত ঘণ্টা পর পর অনুক্রমটি পুনরাবৃত্ত হয়। তো, ২৪ ঘণ্টার একটি দিনের প্রথম ঘণ্টাটি যে গ্রহের প্রভাবাধীন থাকবে, পুরো দিনটির নাম হবে সে গ্রহের নাম অনুসারে।
ধরা যাক, চান্দ্রমাসের প্রথম দিনের প্রথম ঘণ্টার উপর শনির প্রভাব, অতএব এই দিনটি হবে শনিবার। এরপর, দ্বিতীয় ঘণ্টার উপর বৃহস্পতি, তৃতীয় ঘণ্টার উপর মঙ্গল ইত্যাদি গ্রহের প্রভাব থাকবে। এভাবে যদি হিসেব করেন, তবে দেখবেন ২৫ তম ঘণ্টাটি সূর্যের প্রভাবাধীন থাকবে। কিন্তু ২৫তম ঘণ্টা হলো গিয়ে দ্বিতীয় দিনের প্রথম ঘণ্টা। তাহলে বুঝতেই পারছেন যে, দ্বিতীয় দিনটি হবে রবিবার। এভাবে হিসাব করতে থাকলে দেখবেন, তৃতীয় দিন সোমবার, চতুর্থ দিন হবে মঙ্গলবার, পঞ্চম দিন হবে বুধবার, ষষ্ঠ দিন হবে বৃহস্পতিবার, সপ্তম দিন হবে শুক্রবার। অষ্টম দিন হবে গিয়ে আবারো শনিবার।
শনি > রবি > সোম > মঙ্গল > বুধ > বৃহস্পতি > শুক্র
প্রাচীনযুগে এই নিয়মের সপ্তাহের দিনগুলোর ক্রমধারা ঠিক করা হয়েছিলো, আজ অবধি সেই নিয়ম চালু আছে।
সপ্তাহের প্রথম দিন কোনটি?
এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। প্রাচীনকালে একেক যুগে একেক সভ্যতায় একেক দিনকে সপ্তাহের প্রথম দিন হিসেবে ধরা হয়েছে। প্রাচীনকালে অনেক জ্যোতির্বিদ হিসেব-নিকেশ করে রবিবারকে সপ্তাহের প্রথম দিন হিসবে ধার্য করেছিলেন।
আবার ইহুদি ধর্ম মোতাবেক রবিবার হচ্ছে সপ্তাহের প্রথম দিন, আর ৭ম দিন হলো শনিবার। ইহুদিরা বিশ্বাস করেন, রবিবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত টানা ছয় দিন বিশ্বজগত সৃষ্টির কাজ করতে করতে ঈশ্বর ক্লান্ত হয়ে গেছিলেন, তাই সপ্তাহের শেষ দিন তিনি বিশ্রাম যাপন করেছিলেন, এ বিশ্বাস থেকেই ইহুদিরা শনিবার দিনকে ‘সাবাথ’ তথা ‘বিশ্রামবার’ হিসেবে নাম রেখেছে।
সেমেটিক বিশ্বাসের ধর্মগুলোতে রবিবারই সপ্তাহের প্রথম দিন। যদিও খ্রিস্টান-প্রধান অনেক দেশেই বর্তমানে সোমবারকে প্রথম দিন হিসেবে ধরা হয়। ইসলাম ধর্মেও ‘হিজরি বর্ষপঞ্জি’তে রবিবারকে সপ্তাহের প্রথম দিন হিসেবে ধার্য করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান সংস্থা, ISO অবশ্য সোমবারকে সপ্তাহের প্রথম দিন হিসেবে ঠিক করে দিয়েছে।
পরিশেষ
শেষ করার আগে আমরা লেখাটির চুম্বক অংশ আবারো একটু তুলে ধরছি- প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতার লোকেরা ক্যালেন্ডার লোকেরা প্রতি চান্দ্রমাসকে চারটি সপ্তাহে ভাগ করে, যার প্রতি সপ্তাহে থাকে সাত দিন। তারা অথবা পরবর্তীতে অন্য কোনো জাতির লোকেরা পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান সাতটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের নামে সাতটি বারের নাম রাখে। ওই জ্যোতিষ্কগুলোর নাম আবার রাখা হয়েছিলো বিভিন্ন দেবতার নামে।
এরপর গ্রিক, সেখান থেকে রোমান এবং রোমান থেকে অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতির লোকেরা তা গ্রহণ করে। এই অ্যাংলো-স্যাক্সন থেকেই ইংরেজি সাত দিনের নাম উদ্ভূত। অন্যদিকে, গ্রিক পুরাণ ও জ্যোতিষবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতবর্ষের জ্যোতিষবিদরাও অনুরূপ দেবতাদের নামে গ্রহের নাম এবং গ্রহের নামানুসারে সপ্তাহের সাতটি দিনের নাম রাখে।
আজকের আলোচনা প্রমাণ করে, প্রাচীনকালের অতীব আদিম ও তথাকথিত ‘অশিক্ষিত’ মানবগোষ্ঠীর পর্যবেক্ষণের অপরিসীম ধৈর্য, নিখুঁত গবেষণার ফসল হচ্ছে আজকের এই সপ্তাহ পদ্ধতি।