‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না’ – এই প্রবচনের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। প্রবচনটি যে কেবল আলঙ্কারিক অর্থে ব্যবহৃত হতো সেরকম নয়। বাস্তবিকই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভৌগোলিকভাবে এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, সাম্রাজ্যের এক অংশে সূর্যাস্ত হয়ে গেলেও আরেক অংশের আকাশে সূর্য ঠিকই অবস্থান করত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল মানব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য, এবং পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশ জুড়ে এই সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ১৯১৩ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৩% ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ছিল, এবং ১৯২০ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মোট আয়তন ছিল প্রায় ৩ কোটি ৫৫ লক্ষ বর্গ কি.মি., অর্থাৎ পৃথিবীর মোট ভূখণ্ডের প্রায় ২৪%! এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেন ছিল বিশ্বের প্রধান সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি।
স্বাভাবিকভাবেই, এই বিরাট সাম্রাজ্য গঠন করার জন্য ব্রিটিশদের বহুসংখ্যক যুদ্ধ করতে হয়েছে, এবং এর অংশ হিসেবে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে আক্রমণ চালাতে হয়েছে। উল্লেখ্য, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নাম ও শাসনব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে এবং তাদের ভূখণ্ড সম্প্রসারিত বা সঙ্কুচিত হয়েছে। বেশকিছু রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এবং সেগুলো হয় অন্য কোনো রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত হয়ে গেছে, নয়ত সেগুলো ভেঙে একাধিক নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য এক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোর বর্তমান সীমানা বিবেচনা করা হয়েছে এবং সেই সীমানার মধ্যে ব্রিটিশরা কখনো আক্রমণ পরিচালনা করেছিল কিনা সেটি বিবেচনা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯১৮–১৯২০ সালে ব্রিটিশ সৈন্যরা তদানীন্তন রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত কাজাখ স্তেপের কাস্পিয়ান সাগর উপকূলে আক্রমণ চালায়। মূলত এটি ছিল বলশেভিক রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত আক্রমণ, কিন্তু কাজাখস্তান যেহেতু বর্তমানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, সেহেতু এই আক্রমণকে কাজাখস্তানের ওপর ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ব্রিটেনের জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের রাষ্ট্রের অতীত সাম্রাজ্যবাদী কার্যক্রমের বিস্তৃতি সম্পর্কে কেবল আংশিকভাবে অবগত। ব্রিটিশ জনসাধারণ এটা জানে যে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের উপনিবেশ ছিল। তারা এটাও জানে যে, পশ্চিম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের বিস্তৃত সাম্রাজ্য ছিল। কিন্তু ব্রিটেন যে তাদের ইতিহাসের এক পর্যায়ে ভারতীয় হস্তীবহর সমেত ইথিওপিয়ায় আক্রমণ চালিয়েছিল, কিংবা তুর্কমেনিস্তানের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ সৈন্যরা যে কেবল আক্রমণই নয়, একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড (massacre) চালিয়েছিল, এই সম্পর্কে খুব কম সংখ্যক ব্রিটিশ নাগরিকই অবগত।
অবশ্য ব্রিটিশদের আক্রমণের ভুক্তভোগী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে কেবল ক্ষুদ্র মালদ্বীপ বা দুর্বল মৌরিতানিয়া রয়েছে, এমনটা কিন্তু নয়। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে বর্তমান বিশ্বের সবগুলো বৃহৎ শক্তি, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন। ব্রিটিশরা বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আক্রমণ চালিয়ে ও সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের ভূমি দখল করে সেখানে ১৩টি উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এই উপনিবেশগুলোই পরবর্তীতে একত্রিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। পরবর্তীতে ১৮১২–১৮১৫ সালের মার্কিন–ব্রিটিশ যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সৈন্যরা মার্কিন ভূখণ্ডে আক্রমণ চালায়। শুধু তা-ই নয়, সেসময় তারা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনও পুড়িয়ে দিয়েছিল!
অনুরূপভাবে, ব্রিটেন বেশ কয়েকবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং এর অংশ হিসেবে রুশ ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করেছে। যেমন: ১৮৫৩–৫৬ সালের পূর্বাঞ্চলীয়/ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ও ফরাসি সৈন্যরা রাশিয়ার ক্রিমিয়া উপদ্বীপ, তাগানরোগ বন্দর ও কামচাৎকা উপদ্বীপে আক্রমণ চালায়। ১৯১৮–২০ সালে রাশিয়ায় মিত্রশক্তির আক্রমণ চলাকালে ব্রিটিশরা মিত্রশক্তির অংশ হিসেবে বর্তমান উত্তর ও পূর্ব রাশিয়ায় আক্রমণ চালায় এবং সাইবেরিয়ার অভ্যন্তরে বহুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। অবশ্য উভয় আক্রমণই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, কিন্তু সুবিশাল রাশিয়া যে ব্রিটিশ আক্রমণের শিকার হয়েছে, এ থেকে বুঝতে পারা যায় যে, ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি কতটা সর্বব্যাপী ছিল।
একইভাবে, চীনও বিভিন্ন সময় ব্রিটিশ আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। যেমন: ১৮৩৯–৪২ সালের প্রথম আফিম যুদ্ধ ও ১৮৫৬–৬০ সালের দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিটেন হংকং–সহ চীনের অংশবিশেষ দখল করে নেয় এবং চীনকে একটি আধা–উপনিবেশে (semi-colony) পরিণত করে। পরবর্তীতে ১৮৯৯–১৯০১ সালে চীনে সংঘটিত বিদেশি উপনিবেশবাদবিরোধী বক্সার বিদ্রোহ চলাকালে ব্রিটিশ সৈন্যরা আট–জাতির জোটের (Eight-Nation Alliance) সম্মিলিত বাহিনীর অংশ হিসেবে চীনের রাজধানী পিকিং (বর্তমান বেইজিং) দখলে অংশ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত চীনে ব্রিটিশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বজায় ছিল।
সুতরাং, বিশ্বের খুব কম রাষ্ট্রই ব্রিটিশ আক্রমণ এড়াতে পেরেছে। জাতিসংঘের বর্তমান সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩। এই ১৯৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৭০টি রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ব্রিটিশরা অতীতে কখনো না কখনো আক্রমণ পরিচালনা করেছে। অবশিষ্ট ২৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি হচ্ছে ব্রিটেন স্বয়ং, কিন্তু কোনো রাষ্ট্র যেহেতু নিজেই নিজের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে না, সেজন্য ব্রিটেনকে এক্ষেত্রে বিবেচনার বাইরে রাখা হয়। বাকি ২২টি রাষ্ট্র হচ্ছে সেইসব রাষ্ট্র, যারা কখনো ব্রিটিশ আক্রমণের সম্মুখীন হয়নি বা যাদের ভূখণ্ডে কখনো ব্রিটিশ সৈন্যরা আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেনি। অবশ্য এটি উল্লেখ্য যে, এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটিতে ইতিহাসের কোনো একপর্যায়ে ব্রিটিশ নাগরিকরা কোনো ধরনের সামরিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু হয় সেগুলোর ধরন উক্ত ভূখণ্ডের সরকারের প্রতি আক্রমণাত্মক ছিল না, নয়তো সেগুলো ব্রিটিশ রাষ্ট্রের অনুমোদনপ্রাপ্ত ছিল না। সেজন্য এই ধরনের সামরিক কার্যক্রমকে ‘আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।
আইভরি কোস্ট
‘আইভরি কোস্ট প্রজাতন্ত্র’ (ফরাসি: République de Côte d’Ivoire) পশ্চিম আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত একটি মাঝারি আকৃতির রাষ্ট্র। ৩,২২,৪৬৩ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট রাষ্ট্রটির উত্তর–পশ্চিমে গিনি ও মালি, পশ্চিমে লাইবেরিয়া, উত্তর–পূর্বে বুর্কিনা ফাসো, পূর্বে ঘানা এবং দক্ষিণে গিনি উপসাগর অবস্থিত। ঘানা ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল এবং গিনি উপসাগরের মাধ্যমে আইভরি কোস্ট আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত, সুতরাং ব্রিটিশদের পক্ষে আইভরি কোস্টে আক্রমণ চালানো ছিল খুবই সহজ। কিন্তু ব্রিটিশরা কখনো আইভরি কোস্টের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করেনি।
অবশ্য অন্তত একবার আইভরি কোস্টের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ পরিচালনার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। ১৮৪৩ সালে আইভরি কোস্টের আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো ফ্রান্সের ‘আশ্রিত রাষ্ট্রে’ (protectorate) পরিণত হয় এবং ১৮৮০–এর দশক নাগাদ আইভরি কোস্টের উপকূলীয় অঞ্চল সরাসরি ফ্রান্সের শাসনাধীনে চলে আসে। কিন্তু ১৮৭৮ সালে সামোরি তুরে নামক মান্দিনকা জাতিভুক্ত একজন মুসলিম ধর্মীয় নেতা ও সমরবিশারদ এতদঞ্চলে ‘ওয়াসুলু সাম্রাজ্য’ নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান গিনির দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল, সিয়েরা লিয়নের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের অংশবিশেষ, মালির অংশবিশেষ, আইভরি কোস্টের উত্তরাঞ্চলের অংশবিশেষ এবং বুর্কিনা ফাসোর দক্ষিণাঞ্চলের অংশবিশেষ এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তুরে এতদঞ্চলে ফরাসি উপনিবেশবাদের বিরোধী ছিলেন এবং এজন্য ফ্রান্সের সঙ্গে ওয়াসুলু সাম্রাজ্যের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে ১৮৮৫ সালের জানুয়ারিতে তুরে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তার নবগঠিত রাষ্ট্রকে ব্রিটিশ সুরক্ষার ছায়াতলে আনার প্রস্তাব করেন। ব্রিটিশরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে ওয়াসুলু সাম্রাজ্য (এবং সেই হিসেবে বর্তমান আইভরি কোস্টের অংশবিশেষ) ব্রিটেনের একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হতো, কিন্তু একইসঙ্গে ফ্রান্সের সাথে তাদের যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিত। সেসময় ইউরোপে জার্মানির শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং এই পরিস্থিতিতে ব্রিটেন ফ্রান্সের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হতে আগ্রহী ছিল না। এজন্য ব্রিটিশরা তুরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। অবশ্য ব্রিটিশরা ওয়াসুলু সাম্রাজ্যের কাছে বিপুল সংখ্যক রিপিটিং রাইফেল (repeating rifle) বিক্রি করে এবং এগুলোর সাহায্যে রাষ্ট্রটি ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
এদিকে ১৮৮৯ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে একটি সমঝোতা হয় এবং সেই মোতাবেক ব্রিটেন বর্তমান আইভরি কোস্টের ভূখণ্ডের ওপর ফ্রান্সের আধিপত্য স্বীকার করে নেয়। ব্রিটিশরা এই সমঝোতার শর্তাবলি মেনে চলে এবং এজন্য আইভরি কোস্টে তারা কখনো কোনো ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করেনি। ১৮৯৩ সালে বর্তমান আইভরি কোস্টের ভূখণ্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৫৮ সালে আইভরি কোস্ট একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
২০০২ সালে আইভরি কোস্টে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলে। আইভরি কোস্টের প্রথম গৃহযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত এই যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সৈন্যরা আইভরি কোস্টে ‘অপারেশন ফিলিস’ নামক একটি অভিযান পরিচালনা করে, কিন্তু সেটি আইভরি কোস্টের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনো আক্রমণ ছিল না। উক্ত অভিযানের অংশ হিসেবে ২০০৪ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ‘রয়্যাল গুর্খা রাইফেলসে’র সদস্যরা আইভরি কোস্টের তদানীন্তন রাজধানী আবিদজানে প্রবেশ করে এবং একই সময়ে তাদেরকে সহায়তা করার জন্য ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অ্যাম্ফিবিয়াস ট্রান্সপোর্ট ডক ‘এইচএমএস অ্যালবিয়ন’কে আইভরি কোস্টের জলসীমায় প্রেরণ করা হয়। ব্রিটিশ সৈন্যরা আবিদজান বিমানবন্দরের মধ্য দিয়ে দেশটিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিবিদসহ প্রায় ৩০০ ব্রিটিশ নাগরিককে যুদ্ধকবলিত আইভরি কোস্ট থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
অর্থাৎ, ব্রিটেন আইভরি কোস্টে মাত্র একবার সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে, এবং সেটি কোনো আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়নি। এজন্য আইভরি কোস্ট সেই স্বল্প সংখ্যক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছে, যাদের ভূখণ্ডে ব্রিটেন কখনো আক্রমণ পরিচালনা করেনি।
অ্যান্ডোরা
‘অ্যান্ডোরা রাজ্য’ (কাতালান: Principat d’Andorra) ইউরোপের আইবেরীয় উপদ্বীপে পিরেনিজ পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত অতিক্ষুদ্র রাষ্ট্র (microstate)। ৪৬৭.৬৩ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট রাষ্ট্রটি আয়তনের দিক থেকে ইউরোপের ৬ষ্ঠ ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির উত্তরে ফ্রান্স এবং দক্ষিণে স্পেন অবস্থিত। স্পেনের কাতালোনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত উর্গেল কাউন্টির বিশপ এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি যৌথভাবে এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির শাসকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ১২৭৮ সালে রাষ্ট্রটি আরাগনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। উল্লেখ্য, আরাগন ছিল পূর্ব স্পেনকেন্দ্রিক একটি রাষ্ট্র, দ্বাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত যেটির অস্তিত্ব ছিল।
স্বাধীনতা লাভের সময়ই অ্যান্ডোরার দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং তখন থেকে রাষ্ট্রটিতে এই শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। অবশ্য ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সের বিপ্লবী সরকার অ্যান্ডোরার সঙ্গে তাদের এই সম্পর্ক ছিন্ন করে, কিন্তু ১৮০৯ সালে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন এই ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করেন। ১৮১২–১৮১৩ সালে ফ্রান্স সরাসরি অ্যান্ডোরা দখল করে নেয়, কিন্তু ১৮১৪ সালে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ও ব্রিটেনের নেতৃত্বাধীন ফ্রান্সবিরোধী ষষ্ঠ জোটের (Sixth Coalition) কাছে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর অ্যান্ডোরা পুনরায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তখন থেকে অ্যান্ডোরার শাসনব্যবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।
অ্যান্ডোরার ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য সময় ধরে রাষ্ট্রটি ফ্রান্স ও স্পেনের প্রভাবাধীন ছিল। অতীতে এই দুটি রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিটেনের তীব্র দ্বন্দ্ব ছিল এবং ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে বহু সংখ্যক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে ব্রিটেন কখনো অ্যান্ডোরায় আক্রমণ পরিচালনা করেনি। রাষ্ট্রটি আয়তনের দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং কৌশলগতভাবে রাষ্ট্রটির গুরুত্ব খুবই কম। তদুপরি, রাষ্ট্রটি স্থলবেষ্টিত হওয়ার কারণে ব্রিটেনের পক্ষে সহজে রাষ্ট্রটির ওপর নৌপথে আক্রমণ পরিচালনা করা সহজ ছিল না। এজন্যই ব্রিটেন এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটিতে আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত ছিল বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যান্ডোরা নিরপেক্ষতা ঘোষণা করে, এবং উভয় যুদ্ধের সময়ই উভয় পক্ষ অ্যান্ডোরার নিরপেক্ষতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির ওপর আক্রমণ পরিচালনা করা থেকে বিরত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই, এই সময়েও ব্রিটেন অ্যান্ডোরায় কোনো ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করেনি।
অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪০ সালের জুনে অ্যান্ডোরার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ফ্রান্স জার্মানির নিকট পরাজিত হয় ও আত্মসমর্পণ করে। এসময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্য ফ্রান্সে অবস্থান করছিল এবং অগ্রসরমান জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ফ্রান্সের আত্মসমর্পণের পর উক্ত ব্রিটিশ সৈন্যরা ফ্রান্স ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিছু কিছু ব্রিটিশ বৈমানিক (যাদের বিমান জার্মানরা ভূপাতিত করেছিল) বন্দিত্বের হাত থেকে বাঁচার জন্য জার্মান–অধিকৃত ফ্রান্স থেকে অ্যান্ডোরায় পালিয়ে আসে এবং সেখান থেকে ব্রিটেনে প্রত্যাবর্তন করে। এটি হচ্ছে অ্যান্ডোরার ইতিহাসের একমাত্র সময়, যখন ব্রিটিশ সৈন্যরা অ্যান্ডোরার ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু এটিকে ‘আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
সুতরাং, ব্রিটিশ সৈন্যরা ইতিহাসে কেবল একবার অ্যান্ডোরার ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে এবং সেটির উদ্দেশ্য আক্রমণাত্মক ছিল না, বরং আত্মরক্ষামূলক ছিল। এজন্য অ্যান্ডোরা এমন একটি রাষ্ট্র, যেটিকে কখনো ব্রিটিশ আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়নি।