আধুনিক ইতিহাসের আলোচিত রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে সাদ্দাম হুসেইন অন্যতম। কখনও ইরান বা কখনও কুয়েত আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইরাকের এই সাবেক প্রেসিডেন্ট একটা বড় সময় ধরে গণমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। কুয়েত আক্রমণের পেছনে প্রকৃত কারণ কী ছিল– তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। কেউ বলেন, ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় কুয়েতের কাছ থেকে বিশাল অংকের ঋণ গ্রহণের পর ইরাক সেই ঋণ শোধ করার মতো অবস্থায় ছিল না। বার বার অনুরোধের পরেও যখন কুয়েতের শাসকরা ঋণ মওকুফ করতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন সাদ্দাম হোসেন ক্ষুদ্ধ হন। আবার অনেকের মতে, কুয়েতের অতিরিক্ত তেল উৎপাদন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যের ভারসাম্য নষ্ট করছিল। ইরাক ও কুয়েত– দুটি দেশেরই অর্থনীতি বহুলাংশে নির্ভর করতো ভূগর্ভস্থ খনিজ তেল রপ্তানির উপর। তাই কুয়েতকে একটি ‘শিক্ষা’ দিতেই আক্রমণ চালান সাদ্দাম হুসেইন– অনেকে এই মত পোষণ করেন।
ইতিহাস লিখিত হয় বিজয়ীদের হাতে– এটা ইতিহাসের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বিজয়ীদের হাতে ইতিহাস লিখিত হওয়ার সময় অনেক কিছুই ইতিহাসে খেরোখাতা থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। বিজয়ীরা সাধারণত যেসব অনৈতিক কিংবা নেতিবাচক কাজকর্মের সাথে যুক্ত থাকে, সেগুলো সুপরিকল্পিতভাবে ছেঁটে ফেলা হয়। ইতিহাসের পরতে পরতে এই বৈশিষ্ট্যের সত্যতা নিরূপিত হয়েছে। ইরাকের কুয়েত আক্রমণের পর যখন একপর্যায়ে যখন তাদের পরাজয় একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, সৈন্যরা পালিয়ে স্বদেশে ফিরতে যাচ্ছিল, তখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী তাদের উপর প্রায় দশ ঘন্টা ধরে তীব্র বোমাবর্ষণ করে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর এই ‘যুদ্ধাপরাধ’ এর বিরুদ্ধে কখনোই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তেমন উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। কিংবা যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িতদের যেভাবে অনেকক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে বাধ্য করা হয়– এক্ষেত্রে এরকমও কিছু দেখা যায় নি কখনও।
ইরাকের বসরা থেকে কুয়েত পর্যন্ত যে রাস্তাটি ছিল, তার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘হাইওয়ে এইট্টি’ (Highway 80)। ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে ইরাকি সেনারা এই সড়ক ব্যবহার করেই পার্শ্ববর্তী দেশ কুয়েতে আক্রমণ করে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইরাকের এই আক্রমণের তীব্র সমালোচনা করা হয়। আক্রমণের অল্প কয়েকদিনের মাথায়ই কুয়েত পরাজয় বরণ করে। প্রাণ বাঁচাতে কুয়েতের রাজপরিবারের সদস্যরা সৌদি আরবে পালাতে বাধ্য হয়। ইরাকি সেনারা সেখানে নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে অল্প সময়ের মধ্যেই।
কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানায় কেউই ইরানের আক্রমণকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইরাকি দখলদারিত্ব উৎখাতের জন্য ন্যাটোকে আহ্বান জানানো হয়। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থার পক্ষ থেকে বার বার কুয়েতের সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দেয়ার শান্তিপূর্ণ প্রস্তাব দেয়ার পরও ইরাক কর্ণপাত করেনি। তাই একপর্যায়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকি দখলদার বাহিনীকে উৎখাত করতে ‘যেকোনো পদক্ষেপ’ গ্রহণ করার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। এরপরই মূলত ন্যাটোর যৌথ সেনাবাহিনী ইরাকি দখলদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়, শুরু হয় ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’।
যুদ্ধের শেষ দিকে যখন ইরাকের পরাজয় একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, তখন দেশটির দখলদার সেনাবাহিনী পশ্চাদপসরণ শুরু করে। ছয় মাস আগে তারা যে ‘হাইওয়ে এইট্টি’ দিয়ে কুয়েতের রাজধানী দখলের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করেছিল, সেই পথেই তারা স্বদেশে ফিরে আসতে শুরু করে। ফিরে আসার পথে তারা পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করছিল, অর্থাৎ সর্বোচ্চ যতটুকু ক্ষতিসাধন করা যায়, ততটুকু করে তারা ইরাকে ফিরে আসতে শুরু করছিল। আর এখানেই ওঁৎ পেতে ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী। যেহেতু ইরাকি সেনাবাহিনীর ফেরার পথ (হাইওয়ে এইট্টি) মোটাদাগে ছিল একটাই, তাই তারা এখানেই ইরাকি সেনাবাহিনীর উপর বড়সড় আক্রমণের অপেক্ষায় ছিল। ইরাকি সেনাবাহিনীর সমস্ত যানবাহন যখন রাস্তায় চলাচল করতে শুরু করে, তখন প্রথমে গাড়িবহরের শুরুর ও শেষের ভারি যানবাহনগুলোর উপর বোমাবর্ষণ করে ধ্বংস করা হয়। এতে প্রায় ষাট কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট শুরু হয়। এরপরের দশ ঘন্টা ধরে চলে অবিরাম বোমাবর্ষণ। উপর থেকে টানা ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপের ফলে একেবারে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় রাস্তাটি। ‘হাইওয়ে এইট্টি’ পরিণত হয় ‘হাইওয়ে অব ডেথ’-এ।
এই বোমা হামলার পর আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এক নতুন বিতর্ক শুরু হয়। অনেকের মতে, ইরাকি সেনাবাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে স্বদেশে ফিরছিল। এক্ষেত্রে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের এই হামলা রীতিমতো ‘যুদ্ধাপরাধ’। ইরাকি কর্তৃপক্ষ দাবি করে- আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুসারে ইরান শান্তিপূর্ণভাবেই পশ্চাদপসরণ করছিল। এই অবস্থায় বোমা হামলা চালানো রীতিমতো গণহত্যা। অপরদিকে, অন্য একদল মানুষ মনে করেছিলেন, কুয়েতে হামলা করে যেভাবে একটি দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হেনে এবং কুয়েতি নাগরিকদের মানবাধিকার ভূলুন্ঠিত করার মাধ্যমে ইরাকি দখলদার বাহিনী যে অপরাধ করেছে, তার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এমন বোমাবর্ষণ ঠিক আছে। এছাড়াও বোমাবর্ষণের পক্ষে যুক্তি ছিল যে ইরাকি সেনাবাহিনী আদতে আত্মসমর্পণ করেনি, বরং যুদ্ধের কৌশল হিসেবেই তারা পিছিয়ে আসছিল। যে সামরিক ব্যক্তিরা এই বোমাবর্ষণের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। একজন ব্যক্তি ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
“আমার ভেতরের একটি অংশ বলছে, এই বোমাবর্ষণ ঠিক আছে। এটা যেন পুকুরে সাঁতার কাটা হাসের দিকে তাক করে বন্দুক চালনার মতো। তারপরও এটা কি আমাকে অস্বস্তি এনে দেয়? মোটেও না। কিন্তু অপর এক অংশ বলছে- এই মানুষরা কেন মারা যাচ্ছে? একজন মানসিক ভারসাম্যহীন শাসকের স্বার্থ পূরণের জন্য? এটা কি ঠিক? যা-ই হোক, আমরা যুদ্ধ করছি। এটা যুদ্ধের একটি বিয়োগান্তক অংশ, কিন্তু আমরা আমাদের দায়িত্বই তো পালন করছি।”
এই বোমাবর্ষণের ভয়াবহতা ছিল বর্ণনার অযোগ্য। ঠিক কতজন মানুষ এই বোমা হামলায় মারা গিয়েছিলেন, তার সঠিক সংখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এই বোমা হামলায় মৃত ইরাকি সৈন্যের সংখ্যা ছিল ছয় হাজার থেকে দশ হাজারের মতো। আর ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার। কিছু সৈন্য পালাতে সমর্থ হলেও বেশিরভাগই বোমা হামলার ফলে মৃত্যুবরণ করেন।
সকালে সাংবাদিকরা যখন সেই রাস্তায় যান, তখন হতাহতের সংখ্যা দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েন। হাজার হাজার পুড়ে যাওয়া যানবাহন পড়ে ছিল মরুভূমির বুক চিরে যাওয়া সেই রাস্তায়। পড়ে থাকা লাশগুলোর অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে সাংবাদিকদের তোলা বেশিরভাগ ছবিই পরবর্তীতে গণমাধ্যমে ছাপানোর উপযুক্ত ছিল না। এতগুলো মানুষ ও যানবাহন হারানোর ফলে ইরাকের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। হাইওয়ে অব ডেথের ছবিই পরবর্তীতে উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রতীকী চিত্র হয়ে দাঁড়ায়।
সাদ্দাম হুসেইন ও ইরাকি সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডের ফলে পুরো বিশ্বের সামনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে যে নেতিবাচক প্রতিমূর্তি তৈরি হয়, তার কারণে তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া অপরাধের বিরুদ্ধে তেমন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি কিংবা আলোচনা হয়নি– এটাই ধরে নেয়া হয়। মরুভূমির মাঝখানে রাতের বেলায় আটকে পড়া সেনাবাহিনীর উপর বোমাবর্ষণের সাথে যারা জড়িত ছিল, তাদেরকেও দায়মুক্তি দেয়া হয়। ‘হাইওয়ে অব ডেথ’ মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধাপরাধের সাক্ষী হয়েছে পরবর্তীতে আরও একবার, ২০০৩ সালে। সেবার সাদ্দাম হুসেইনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে– এই অযুহাতে ইরাকে হামলা চালানো হয়েছিল সেই রাস্তা দিয়েই।